আমার কোনও দেশের বাড়ি নেই। আমার অস্তিত্ব জুড়ে যে ‘দ্যাশের বাড়ি’র ছবি, সেটা বলতে গেলে সম্পূর্ণভাবে আমার কল্পনাপ্রসূত। সেই ছোটবেলা থেকে শোনা আমার বাবা, মা, দাদু ঠাকুমার স্মৃতিচারণে, আমার কল্পনায় গড়া আমার ‘দ্যাশের বাড়ি’।

আমার সেই ‘দ্যাশের বাড়ি’ আক্ষরিক অর্থে একদিন ছিল, এখন নেই। সেই যে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের ভূগোল নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা খেলা খেলেছিলেন, তাতেই আমাদের ‘দ্যাশের বাড়ি’ কোথায় হারিয়ে গেল।

না, এমন বলতে পারি না যে, আমাদের মস্ত জমিদারি ছিল, চক মেলানো প্রাসাদ ছিল, ছিল প্রান্তর জুড়ে গাছ গাছালি, খেতখামার, মাছভরা পুষ্করিণী! আমরা ছিলাম অতি সাধারণ শিক্ষিত এক হিন্দু বৈদ্য পরিবার। এখনও কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, তোমার দেশ কোথায়, আমি বিনা দ্বিধায় বলি, আমার দেশ পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলায় আর আমার গ্রাম মাহিলাড়া। কারণ আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার দেশ ছিল ওখানে।

মাহিলাড়া। বরিশাল জেলার সদর সাব ডিভিশনের গৌর নদী থানার এক ছোট্ট গ্রাম। আমার ঠাকুর্দা নরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন ওই গ্রামের এক বিশেষ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি বিএ পরীক্ষাতে খুব ভাল ফল করেছিলেন। চেষ্টা করলে সে  সময়কার আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করা ওঁর পক্ষে খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু তরুণ নরেন ইংরেজ শাসকের অধস্তন কর্মচারি হতে চাননি। দেশে তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের হাওয়া। এর উপরে বরিশালের সু্যোগ্য সন্তান, সমাজসেবী,  দেশমাতৃকার পূজারী অশ্বিনীকুমার দত্তকে তিনি গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। এ দিকে মধ্যবিত্ত সংসারে অর্থেরও প্রয়োজন এবং বাড়ির বড়ছেলে হিসাবে তাঁর দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। অগত্যা তিনি গুরুর শরণাপন্ন হলেন। অশ্বিনী দত্ত নিজেও ছিলেন শিক্ষাব্রতী। তিনি উপদেশ দিলেন মানুষ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে।

সেই শুরু।

প্রথমে মাদারিপুর ও পরে বরিশাল জেলার একে ইনস্টিটিউশন এবং শেষে দীর্ঘদিন শ্রীচৈতন্য গোবিন্দমোহন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আমার বাবা, কাকারা সবাই চৈতন্য স্কুলেই পড়াশুনো করেছেন। আমার ঠাকুর্দা ১৯০৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন।

মাহিলাড়া গ্রাম থেকে আমাদের পরিবার যখন বরিশালে এসে পাকাপাকি ভাবে থাকা শুরু করে তখন যে বস্তুটি তাদের সঙ্গে এসেছিল তা হল একটি ঢেঁকি। জমিদারির ঠাটবাট না থাকলেও আমাদের মাহিলাড়া গ্রামে বেশ কিছু ধানী জমি ছিল আর সেই জমির চাষবাস এবং রক্ষণাবেক্ষণ যাঁরা করতেন, তাঁরা পরিচিত ছিলেন গুপ্তবাড়ির প্রজা হিসাবে। বিনিময়ে তাঁরা ঐ জমিতেই ঘর করে থাকতেন আর পেতেন ধানের এক অংশ যা দিয়ে তাঁদের সম্বচ্ছরের চালের সংস্থান হত। বাকি ধান তাঁরা বরিশালে এসে দিয়ে যেতেন আমাদের বাড়িতে। আমার ঠাকুমা নিজে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে সেই ধান কুটতেন। আমাদেরও সারা বছর চলত সেই চাল দিয়ে। শুনেছি আমার তিন পিসি এবং মা-ও নাকি একাজে মাঝে মাঝে হাত লাগাতেন।

আমার ঠাকুর্দার বরিশালে নিজের কোনও বাড়ি ছিল না। সবই ভাড়া বাড়ি। আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৪৫ সালে বরিশালের সদর হাসপাতালে। সেই সময়ে আমরা ভাড়া ছিলাম কলেজ রোডে। শঙ্কর মঠের উলটো দিকে কৃতান্ত গুহর বাড়িতে। এ সবই শোনা আমার অশীতিপর ছোট কাকার মুখে। আমাদের বাবা, কাকা, পিসিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই এখনও জীবিত। একতলা সেই বাড়িটা ছিল বারান্দা ঘেরা। এই বারান্দাতে কাকা নাকি আমাকে নিয়ে লোফালুফি খেলতেন।

এরপর আমরা যে বাড়িতে গিয়েছিলাম সেটা ছিল দোতলা। দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমরা এ বাড়িতেই ভাড়াটে ছিলাম। আমার যা বয়স ছিল তাতে কিছুই মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার যেন মনে হয় চোখ বুজলে এই বাড়ির ছবি আমি এখনও দেখতে পাই! পরে বুঝেছি, আমার তিন বছরের বড় দিদি অঞ্জনা আর সাড়ে পাঁচ বছরের বড় দাদা সমীর, ওরাই আমাকে এসব গল্প করতো। এই বাড়ির নিচের তলায় সামনের ঘরে ছিল আমার বাবা, ডাক্তার বিজিতেন্দ্র গুপ্তর চেম্বার। বাড়িটা ছিল সদর রোডের দিকে মুখ করা। বাড়ির প্রবেশপথ ও বগুড়া রোডের মধ্যে এক ফালি জমি ছিল। সেখানে বাগান করে নানাবিধ সবজি ফলানো হত।

বাবা তখন সদর হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে বাবার দুই সহকর্মী ছিলেন, যাঁদের একজন ছিলেন ড আলম। বড় হয়ে কলকাতায়ও বাবার মুখে ওঁর নাম শুনেছি অনেকবার। তিনি শুধু বাবার সহকর্মীই ছিলেন না, বাবা বলতেন ড আলম ও তাঁর পরিবার ছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধুও। দিদির মনে আছে, ড আলমের ছেলে ছিল ওর সমবয়সি  খেলার সাথি। অন্য জন ড নৃপেন দাস বরিশালের নামকরা শল্য চিকিৎসক, যিনি আমাদের মতোই দেশভাগের অব্যবহিত পরেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। আমার বাবা তাঁকে দাদা বলে ডাকতেন। আমৃত্যু তাঁদের সখ্য অটুট ছিল।

অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁর বাবার নামে বরিশালে ব্রজমোহন দত্ত কলেজ স্থাপন করেছিলেন। সাধারণের কাছে যার পরিচিতি ছিল বিএম কলেজ নামে। এই কলেজেই আমার কাকা-পিসিরা সবাই পড়াশুনো করেছেন। আমার মেজ পিসি অঞ্জলি ছিলেন ডাকাবুকো মেয়ে। কলেজে ওঁদের ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন জীবনানন্দ দাশ। তখনও কবি হিসেবে ওঁর তেমন নামডাক হয়নি। এবং যে কোনও কারণেই হোক অধ্যাপনার কাজে তিনি বিশেষ সুনাম অর্জন করতে পারেননি। দুষ্টু ছাত্রীরা তাঁর কিছু মুদ্রাদোষ নিয়ে হাসাহাসি করতেও ছাড়তেন না। এঁদের মধ্যে আমার পিসিটিও ছিলেন। কবির জিভের জড়তাজনিত সমস্যা ছিল। কেউ কেউ আড়ালে নাম দিয়েছিলেন ‘জীহ্বানন্দ’। যদিও পরবর্তীকালে এঁরাই তাঁর কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েছিলেন। আর নির্ঘাত তখন নিজেদের অল্পবয়সের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা দগ্ধ হয়েছিলেন!

ভারেতর স্বাধীনতা সংগ্রামেও বরিশাল জেলার অনেক অবদান ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনে এই জেলার সংগ্রামীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ছোটকাকার মুখে শুনেছি, এই বাড়ির সামনে বগুড়া রোডের উপরেই আমার কাকামণি জ্যোতিরিন্দ্র গুপ্ত ও তাঁর তরুণ বন্ধুরা একবার একটি সুন্দর তোরণ বানিয়েছিলেন আর তাতে বড় বড় হরফে লিখে দিয়েছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান’।

কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল আমাদের বরিশাল জেলা। দেশের খাদ্যশষ্য উৎপাদনের এক বড় উৎস ছিল এই অঞ্চল। খালবিল জলাভূমিতে ভরা এই বরিশালে যানবাহন বলতে ছিল নৌকো আর স্টিমার। আজও বরিশাল যেতে হলে স্টিমারই ভরসা। আমার মা-বাবার মুখে শুনেছি স্টিমারে করে আসা-যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ছিল স্টিমারের সারেংয়ের হাতে রান্না মুর্গির ঝোল-ভাত। বরেণ্য সাহিত্যিক মুজতবা আলির রচনায় অমর হয়ে আছে গোয়ালন্দ স্টিমারের মুর্গির ঝোলের স্বাদু কাহিনি। আমার বাবা বলতেন, ডাঙার মানুষ এই রান্না রাঁধতে পারেন না। এ হল একান্তই মাঝি-মাল্লার রান্না।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ হল। স্বাধীনতা-উত্তর অনৈতিক রাজনীতির শিকার হলেন দেশের সাধারণ মানুষ। আমাদের গুপ্ত পরিবারকেও দেশত্যাগ করতে হল। এর আগেই অবশ্য আমার বড়কাকা এবং মেজপিসি দু’জনেই বরিশালে লেখাপড়ার পাট শেষ করে জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তাঁরা বালিগঞ্জে মামার বাড়িতে থেকে চাকরি করতেন। ১৯৪৮ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন, ছোট কাকা, আর এক অবিবাহিত পিসি দেশ ছেড়ে চলে আসি। আমার সেজকাকা আর ঠাকুমা পরে আসেন। দাদু আসেন ১৯৫০ সালে। ততদিন পর্যন্ত তিনি চৈতন্য স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।

এখন বুঝতে পারি ওঁদের সকলের দেশ ছেড়ে আসতে কী কষ্ট হয়েছিল! আমি শিশু, কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু নতুন পরিবেশে দাদু ঠাকুমাকে ছেড়ে এসে প্রথম দিকে নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। জন্মভূমির সঙ্গে আমার সম্পর্কের এইখানে ইতি। আমি আমার দেশমাকে চেনার সুযোগ পাইনি, সে আমার দুর্ভাগ্য কিন্তু তাই বলে সেই জন্মভূমি মাকে আমি ভুলে গিয়েছি তা কখনওই বলতে পারি না। কোনও দিন সুযোগ পেলে একবার বরিশাল যাব আর সেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে এক খণ্ড আমার আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসব।

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *