সালটা ১৯৬৬। দক্ষিণ কলকাতার এক কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে আমি ঢুকলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে, পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করতে। মাথায় তখন সাংবাদিকতার ভূত। অবশ্য শিশুবেলা থেকেই সাংবাদিকতা নিয়ে আমার খুব আগ্রহ আর কৌতূহল ছিল। কী ভাবে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে, তা সে বন্যা বা ভূমিকম্প বিপর্যস্ত অঞ্চলই হোক বা যুদ্ধক্ষেত্র, জীবন বিপন্ন করে সাংবাদিকরা গোপন, রোমাঞ্চকর তথ্য খুঁচিয়ে তুলে এনে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেন, সেটা আমাকে অবাক করে দিত। তা বলে এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে আমার সাংবাদিকতার পাঠ নেওয়াতে আমার অভিভাবকদের সায় ছিল। তাঁরা প্রভূত আপত্তি করেছিলেন, বাধাও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর কারও আপত্তিই ধোপে টিঁকল না।

Journalism
সাংবাদিকতা ক্লাসে বাচ্চি কাঙা ( কারকারিয়া) ও সহপাঠীদের সঙ্গে আমি। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

তখন আমাদের ক্লাস হত দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ে। ভর্তির সময়ে লিখিত শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে দু’বছরের পাঠ্যক্রমে যে কোনও একটি সংবাদপত্রে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হবে। তখন তো কাগুজে নির্দেশে বেমালুম ‘হ্যাঁ’ করে দিয়েছি। বাস্তবে সেটা যে কত কঠিন, টের পেলাম, যখন আমাকে কলকাতার কাগজগুলোর দরজায় দরজায় ঘুরে নিরাশ হতে হল। কেউই শিক্ষানবিশ রাখতে রাজি হল না। এখনও মনে পড়ে, আমি আর আমার এক বান্ধবী রত্না গিয়েছি কলকাতার এক নম্বর বাংলা দৈনিকের দফতরে কাজ শেখার আর্জি নিয়ে। দেখা করলাম যাঁর সঙ্গে, তিনি শুধু যে একজন কৃতী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ছিলেন তাই নয়, ওই সংবাদপত্রে তাঁর স্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সাংবাদিকতায় তিনি নাকি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন বলে খ্যাতিও ছিল যথেষ্ট। সে কথা আমাদেরও অজানা ছিল না। কিন্তু আমাদের শিক্ষানবিশ রাখতে তাঁর অপারগতার নেপথ্যে যে কারণ তিনি দেখিয়েছিলেন, তা কোনওদিন ভুলতে পারিনি। জানিয়েছিলেন, দফতরে নাকি মহিলা শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই এবং মহিলা সহকর্মীর আগমনে তাঁর তরুণ সাংবাদিককুলের চিত্তচাঞ্চল্য হতে পারে, এ-ই তাঁর আশঙ্কা।

তবে শেষ পর্যন্ত বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। আমি ঢুকলাম বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের দৈনিক বসুমতী কাগজে আর রত্না ইউএনআই-তে। বসুমতী সংবাদপত্রের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন। শুনেছি, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্নেহধন্য ছিল বসুমতী প্রকাশনা সংস্থা। ১৯১৪ সালে তার পথ চলা শুরু হয় এই ভবনেই। আমি যে সময়ে বসুমতীতে যাওয়া শুরু করি, তখন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বসুমতী কাগজের স্বর্ণযুগ চলছে। রোজ বারোটা নাগাদ দুপুরের খাওয়া সেরে ১০ নম্বর বাসে চেপে অফিস যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অফিস থেকে হাঁটা পথ। আর আমার ছিল সান্ধ্য ক্লাস। কাজেই সময়মতো ক্লাসে পৌঁছতে অসুবিধে হত না। তখন চিফ রিপোর্টার ছিলেন রমেন গোস্বামী। আমি রোজ গিয়ে বসতাম ওঁর চেয়ারের উলটো দিকে। বসুমতীতে তখন ছিলেন অধীর চক্রবতী আর কুমুদ দাশগুপ্ত, যাঁদের সে সময়ই সাংবাদিক হিসেবে বিস্তর সুনাম ছিল। অধীরদা ছিলেন রাজনৈতিক সংবাদদাতা আর কুমুদদা ডেপুটি চিফ রিপোর্টার। ওঁদের উৎসাহ ও সহযোগিতাতেই আমার অল্পবিস্তর রিপোর্টারি শুরু। ওঁদের হাত ধরে প্রথম মহাকরণ আর বিধানসভায় পা-রাখা। আমার বেশির ভাগ কপি কুমুদদাই দেখে দিতেন।

Journalism
মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়কে ছেঁকে ধরেছে সাংবাদিকের দল। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

মহাকরণে তখন সাংবাদিকদের বসার জন্য একটা ঘেরা জায়গা ছিল, যার বাইরে ইংরিজি হরফে লেখা থাকত ‘প্রেস কর্নার’। কলকাতার অনেক নামীদামি সাংবাদিক ওখানে এসে বসতেন। ওখানে বসেই কত খবরের খসড়া তৈরি হতে দেখেছি যা পরদিন কাগজে ঝড় তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী। অর্থ ও পরিবহন, এই দুই দফতরের ভার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে জ্যোতি বসুকে। এসইউসি-র সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় পেলেন শ্রম দফতর। ওঁর কার্যকালে, খানিকটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই সম্ভবত, কলকারখানা অফিস কাছারিতে মালিক-শ্রমিক-কর্মচারি নিত্যি বিবাদ লেগে থাকত। কথায় কথায় ঘেরাও আর কর্মবিরতি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছল, যে সুবোধ বাবু এক সময়ে ‘ঘেরাও মন্ত্রী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠলেন। এছাড়া এতগুলো দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার- মতানৈক্য, বিরোধ, দলাদলি লেগেই থাকত। আর রিপোর্টারদের তো পোয়াবারো! অন্তত খবর আমদানিতে কোনও ঘাটতি পড়ত না।

প্রেস কর্নারে যে সব সাংবাদিকদের নিয়মিত আসতে দেখতাম, তাঁদের মধ্যে একজনের কথা আজও ভুলিনি। তিনি সুধীর চক্রবর্তী, পিটিআই-এর চিফ রিপোর্টার। সব অনুজ সাংবাদিকদের কাছেই তিনি ছিলেন অভিভাবকপ্রতিম এবং একান্ত প্রিয় সুধীরদা। অত্যন্ত সহৃদয়, অমায়িক স্বভাবের মানুষ। আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে ওঁর স্নেহ পেয়েছি। কী ভাবে কম কথায় রিপোর্ট করতে হয়, হাতে ধরে শেখাতেন। এক ডাকে সে যুগে যে সাংবাদিককে সবাই চিনতেন, আনন্দবাজার পত্রিকার সেই বরুণ সেনগুপ্তও নিয়মিত আসতেন প্রেস কর্নারে। ষাটের দশকে সাংবাদিকতায় এখনকার মতো মেয়েদের ভিড় ছিল না। ফলে মহাকরণের প্রেস কর্নার বা বিধানসভা ভবন অথবা যে কোনও সাংবাদিক বৈঠক- প্রায় সর্বত্রই আমি আর রত্না ছিলাম হংসমধ্যে বকোযথা। প্রথমদিকে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও পরে ব্যাপারটা দু’পক্ষের কাছেই সহজ হয়ে গিয়েছিল।

Journalism
যুক্তফ্রন্ট আমলে কোনও জরুরি ঘোষণার মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

এরই মধ্যে একবার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে এক সাংবাদিক বৈঠকে আমাকে পাঠানো হল। যুক্তফ্রন্ট সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ডেকেছিলেন সেটা। আমার সঙ্গে শ্যাম মল্লিক, বসুমতীর তরুণ রিপোর্টার। শ্যাম বাংলা কাগজে কাজ করলে কী হবে, সারাক্ষণ অদ্ভূত উচ্চারণে ইংরিজিতে কথা বলত। খুব মজা লাগত। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন বৈঠক সবে শুরু হয়েছে। মাটিতে ফরাস পাতা। শ্যাম সামনে গিয়ে বসল আর আমি পিছনের দিকে। ডঃ ঘোষ বসেছিলেন একটু উঁচু গদিতে, সাংবাদিকদের মুখোমুখি। আমার পাশে বসেছিলেন এক তরুণ সাংবাদিক। পরে জানলাম উনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের অসীম চৌধুরী। একেবারে সামনের সারিতে বসেছিলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। শ্যামলা দোহারা চেহারা। খাদ্যনীতি নিয়ে মন্ত্রীকে সব প্রশ্ন প্রায় তিনিই করছিলেন। মাঝে মাঝে তো প্রশ্নবাণে মন্ত্রীমশাইকে বেশ পর্যুদস্ত বলে মনে হচ্ছিল। প্রশ্ন তীক্ষ্ণ হলেও শালীনতার সীমা একটুও লঙ্ঘিত হচ্ছিল না। ফলে প্রফুল্লবাবুকে ভেবেচিন্তে উত্তর দিতে হচ্ছিল। অসীম ফিসফিস করে বললেন, “ওঁকে চেনেন না? উনি তো শংকর ঘোষ! টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সংবাদদাতা। কলকাতার প্রথম সারির সাংবাদিক!” সেই প্রথম দেখা। তখন কি আর জানি যে দিনেকালে ইনি আমার ঘরের মানুষ হবেন? তবে মুগ্ধতা যে একটা সেদিনই তৈরি হয়েছিল, সেটা অনস্বীকার্য।

ইতিমধ্যে বসুমতী অফিসে আমার জন্য একটা দারুণ খবর অপেক্ষা করছিল। তখন বিশ্বভারতীর সমাবর্তন আর পৌষমেলা হত একই সময়। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে বিশ্বভারতীর আচার্য। কাজেই সমাবর্তনে থাকবেন। বসুমতী থেকে কুমুদ দাশগুপ্ত যাবেন। সঙ্গে যাবে কে? নবীন সাংবাদিক আমি। বার্তা সম্পাদক বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও চিফ রিপোর্টার রমেনবাবু এসব স্থির করেছেন। অফিসে গিয়ে খবরটা পেয়ে আমি তো উত্তেজনায় ফুটছি। তবে বাড়িতে জানাতেই আপত্তি। যদিও শেষমেশ আমার জেদের কাছের মা-বাবার হার। নির্দিষ্ট দিনে কুমুদদার সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি, সাংবাদিক থৈ থৈ প্ল্যাটফর্মে। সবাই একই ট্রেনে একই কামরায় উঠলাম। যুগান্তর পত্রিকার সুবোধ বসু চলেছেন স্ত্রী পলিকে নিয়ে। সঙ্গে আর এক সাংবাদিক কচি। আরও অনেকের সঙ্গে রয়েছেন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সোমেন মুখোপাধ্যায়, স্টেটস্‌ম্যানের সুমন্ত সেন, কালান্তরের চিফ রিপোর্টার চিত্তপ্রিয় রায়, পিটিআই থেকে সুধীরদা এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়ার শংকর ঘোষ! যথারীতি আমি একমাত্র মহিলা সাংবাদিক এবং অবশ্যই কনিষ্ঠতম।

Journalism
শংকর তখন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার দুঁদে সাংবাদিক। অনুজ সাংবাদিকরা ওঁকে রীতিমতো সম্ভ্রমের চোখে দেখত। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

ট্রেনে জানলার ধার পেলাম। আমার হালকা ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে কে যেন একজন জায়গা মতো রেখে দিল। ওটার মধ্যেই আমার দু’দিনের সামান্য জামাকাপড়। মোটামুটি সকলেরই মুখ চেনা। ওঁদের মধ্যে কচি, সোমেনের সঙ্গে আমার বেশি পরিচয় ছিল। ট্রেনে চা আর টা কোনওটাই বাদ গেল না। রাজ্য রাজনীতিতে তখন একটা অস্থির অবস্থা। সারা রাস্তা তাই নিয়ে গরমাগরম আলোচনা শুনতে শুনতে বোলপুর পৌঁছলাম। শান্তিনিকেতনে এ আমার প্রথম আসা নয়। বোলপুর স্টেশন থেকে সাইকেল রিক্সায় চেপে সরকারি ট্যুরিস্ট লজ। মেলার মাঠের ঠিক উল্টোদিকের এই লজেই সব সাংবাদিকদের থাকার ব্যবস্থা। সুবোধ বসুর স্ত্রী পলি আর আমি রুমমেট। সুবোধবাবু গেলেন অন্য কোন এক সাংবাদিকের সঙ্গে থাকতে। আমি অপ্রস্তুত। আমার কারণেই ওঁদের আলাদা থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যবস্থায় সুবোধকে যেন একটু বেশিই খুশি মনে হল। কারণটা বুঝলাম পরের দিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে। খুব ভালো গান গাইতেন সুবোধ। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। শুনলাম সারা রাত চলেছে গান এবং পান! অর্থাৎ ঢুকুঢুকু আর আড্ডায় জমাটি রাত কেটেছে ওঁদের। কাজেই আমি পলির সঙ্গে থাকায় সুবোধের সুবিধে! তবে এসব আড্ডায় শংকর থাকতেন না। অনুজ সাংবাদিকদের কাছে ‘শংকরদা’ ছিলেন বেশ সম্ভ্রমের পাত্র। ওঁর সামনে সকলে ঠাট্টাতামাসা-ও করত একটু রেখে ঢেকে।

সেসব দিনের পর প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। তাই তখনকার কলকাতার সাংবাদিকদের সঙ্গে আজকের অবস্থার ব্যবধান আকাশপাতাল বললেও বোধহয় কম বলা হয়। আমার সংক্ষিপ্ত সাংবাদিক জীবনে, দেশের এক নম্বর কাগজের নামী সাংবাদিককেও দেখেছি শহরের বাইরে গেলে ট্রেনের সাধারণ কামরায় যাতায়াত করতে। হাতে গোনা সাংবাদিকের নিজের গাড়ি ছিল। যাঁদের ছিল, তাঁরাও অধিকাংশ সময়ে বাসেট্রামেই যাতায়াত করতে পছন্দ করতেন। যে যাঁর দফতর থেকে মহাকরণ বা বিধানসভা পৌঁছতে দূরত্ব অনুসারে বাসে-ট্রামে বা পায়ে হেঁটে আসতেন। কথায় কথায় কোম্পানির পয়সায় পাঁচ তারা হোটেলে ওঠারও চল ছিল না। এখনকার সাংবাদিকরা এসব সম্ভবত কল্পনাও করতে পারবেন না। তাঁদের এসবের প্রয়োজনও দেখি না।

সে যাই হোক, শান্তিনিকেতনে পরের দিন দুপুরে সবাই মিলে ডাইনিংরুমে খেতে বসা হল। পলি আর সুবোধ ছিলেন না। কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্টিলের পাত্রে করে ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি, মাছের ঝোল টেবিলে রেখে গেলেন ওয়েটার। নিজেদের নিয়ে খেতে হবে। টেবিলে আমি একমাত্র মহিলা, ফলে পরিবেশনের কাজটা নিজেই আগ বাড়িয়ে করতে গেলাম। হাতায় করে ভাত তুলে কুমুদদার প্লেটে পৌঁছবার আগেই ঝুরঝুর করে ভাত পড়ল মাঝপথে, টেবিলে। আমি যারপরনাই অপ্রস্তুত। অন্যরা না দেখার ভান করলেও শংকর কিন্তু লেগপুল করতে ছাড়লেন না।
— থাক থাক, বোঝা গেছে তুমি খুবই কাজের মেয়ে। চুপটি করে বস। আমিই দিয়ে দিচ্ছি।
হাসতে হাসতে এই কথা বলে সবার পাতে উনিই ভাত দিলেন।

Journalism
ইন্দিরা গান্ধীকে প্রথম দেখলাম শান্তিনিকেতন সমাবর্তনে। সামনে থেকে শুনলাম বক্তৃতা। ছবি সৌজন্য – indiatvnews.com

ওই দিন বিকেলেই হেলিকপটার করে ইন্দিরা গান্ধী বোলপুরে পৌঁছলেন। আজও মনে আছে দৃশ্যটা… উনি কপ্টার থেকে নামছেন, আর আমরা সাংবাদিকরা বেড়া দিয়ে ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছি। সেই প্রথম ইন্দিরাকে চাক্ষুষ দেখা। যেমন সুন্দরী, তেমন ব্যক্তিত্ব, তেমনই কেতাদুরস্ত চালচলন। সাংবাদিকদের তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বোধহয় করুণা হল ওঁর। গাড়িতে ওঠার আগে একটু দাঁড়ালেন। মুখে স্মিত হাসি। হাত নাড়লেন আমাদের। মৃদুকণ্ঠে শুভেচ্ছা জানিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন। সত্যিই প্রিয়দর্শিনী। প্রথম দেখাতেই আমি মুগ্ধ।

পরদিন আম্রকুঞ্জে সমাবর্তন। মূল প্রতিবেদন কুমুদদা-ই লিখলেন। আমি ঠেকা দিলাম। কলকাতা থেকেই নির্দেশ ছিল, আমি লিখব মঞ্চে হাজির অতিথিদের কথা, এবং অবশ্যই ইন্দিরার ব্যক্তিত্ব, তাঁর পোশাক, তাঁর অপার সৌন্দর্যের কথা। লিখব কালোর চায়ের দোকানের কথা, পৌষমেলার মাঠ আর রাঙা মাটির পথের কথা। অনুষ্ঠান শুরু হল। সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বসলাম। দেশবিদেশের কত সাংবাদিক সেখানে! সাঙ্ঘাতিক রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম! সেই প্রথম মঞ্চের সামনে, সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসে ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা শুনলাম। সে দিনের অভিজ্ঞতা আমার মনের সোনার সিন্দুকে আজীবনের জন্য কয়েদ করে রেখেছি।

Journalism
পৌষমেলা থেকে শংকরের কিনে দেওয়া পাতার টুপি মাথায়, ট্যুরিস্ট লজের বারান্দায়। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

অনুষ্ঠান শেষে সারাদিন রাঙা মাটির পথে ঘুরে বেড়ালাম আমরা। তারপরে মেলায়। কচি, সোমেন, সুধীরদা, শংকর, কুমুদদা- সবাই মিলে জিলিপি আর তেলেভাজা খাওয়া হল। উপহারও পেলাম। সুধীরদা ওঁর স্ত্রী আর মেয়ের জন্য উপহার কিনলেন। আমার জন্য কিনলেন একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা। কোনও ওজর আপত্তি শুনলেন না। আর চুপি চুপি একটা খেজুর পাতার টুপি উপহার পেলাম শংকরের কাছ থেকে। সেটা মাথায় দিয়ে ছবিও তুললাম। আমার হাতে বেশি টাকাপয়সা ছিল না। তবু আমি সাধ্যমতো ওদের সকলের জন্য টুকটাক কিনলাম। তার জন্য বকুনিও খেলাম। শংকরের সে সময়ে সিগারেটের নেশা ছিল। আজও মনে পড়ে, ওঁর জন্য কিনেছিলাম একটা পোড়া মাটির ছাইদান। বিয়ের পরেও দেখতাম, ওটাতেই ছাই ফেলতেন শংকর। ‘৬৭ সালে কেনা সেই রংচটা সামান্য জিনিসটা এই সেদিন আমার হাত ফসকে পড়ে ভেঙে গেল। ২০০৯ সালে শংকর চলে গিয়েছেন। নিজের অসাবধানতায় আমাদের এই অনাবিল আনন্দদিনের স্মৃতিচিহ্নটাও হারিয়ে ফেললাম সেদিন। খুব কষ্ট হল। কিন্তু যাক সে কথা!

Journalism
প্রতিমা ঠাকুরের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

পরদিনই ফেরার কথা। ঠিক হল, রাতে সবাই মিলে আর একবার মেলায় আসা হবে। অনেক রাত পর্যন্ত বাউল গান শুনব, সাঁওতালি নাচ দেখব। শংকর বললেন, ডিনার সেরে ভালো করে গরম জামা গায়ে দিয়ে যেন লজের বারান্দায় বেরিয়ে আসি। একসঙ্গে মেলায় যাব। আমি তো তখন উত্তেজনায় ফুটছি। কথামতো তাড়াতাড়ি ডিনার সারা হল। গরম জামায় আপাদমস্তক মুড়ে দল বেঁধে মেলার মাঠে গেলাম। অত রাতেও লোকের কমতি নেই। একদিকে কীর্তনের আখড়া আর অন্য দিকে বাউলের দল একতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে চলেছে। চারদিকে আলোর রোশনাই। সাঁওতালি মেয়েরা হাতে বানানো মাটি ও ধাতুর গয়না, খেলনার পসরা সাজিয়ে বসে। বন্‌ বন্‌ করে নাগরদোলা ঘুরছে। আশপাশের গ্রাম থেকে আসা সাঁওতাল মেয়ে পুরুষে খোলা আকাশের নিচে গানের সুরে মাদলের তালে নাচছেন। কত রকমের গ্রামীণ শিল্পের সম্ভার। দারুণ আনন্দ হল। পরের দিন সকালের ট্রেনেই একদল কলকাতা ফিরলেন। আমি কুমুদদার সঙ্গে ফিরলাম দুপুরের ট্রেনে।

Journalism
২৫ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে আমি আর শংকর। 

ক’দিন বাদে বসুমতীর রোববারের ক্রোড়পত্রে আমার লেখাটা বেরল। শংকর ফোন করে বললেন, ‘লেখাটা ভালো হয়েছে।’ অত ব্যস্ততার মধ্যেও খেয়াল করে আমার লেখাটি পড়েছেন? সে এক আচম্বিত আনন্দ!

তবে এর পর থেকেই বসুমতীতে কিছু কিছু সমস্যা শুরু হয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম, আমার কাজ নিয়ে চিফ রিপোর্টারের মধ্যে একটা যেন চাপা অসন্তোষ। এদিকে কোথায় যে আমার ভুল, সেটাও স্পষ্ট করে বলছিলেন না। মহাকরণ বা সভাসমিতিতে আমার যাওয়া কার্যত বন্ধ করে দিলেন। ডেস্কে বসিয়ে রাখতেন। সময়মতো ক্লাসেও পৌঁছতে পারছিলাম না। কুমুদদাকে বললাম। কিন্তু উনিই বা কী করবেন? চিফ রিপোর্টারের বিরুদ্ধে কত আর কথা বলবেন! ইতিমধ্যেই আশ্চর্য যোগাযোগে কালান্তর পত্রিকার চিফ রিপোর্টার চিত্তপ্রিয় রায় আমাকে ওঁদের কাগজে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। দৈনিক বসুমতীকে চিরবিদায় জানিয়ে শুরু করলাম কালান্তরে রিপোর্টারির দ্বিতীয় ইনিংস।

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

8 Responses

  1. খুব ভালো লাগল। আমি কুমুদ দাশগুপ্তের মেজ ছেলে। দীর্ঘদিন বর্তমানের চিফ রিপোর্টার ছিলাম। ২৫ বছর কাজ করার পর ছেড়ে দিই। তারপর প্রতিদিন কাগজে এক বছর কাজ করেছি। শেষে এই সময় থেকে গত বছর অবসর নিয়েছি। আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু বাবার মুখে আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। যোগাযোগ হলে ভালো লাগবে।

  2. দারুণ লেখা আলপনা আন্টি । Down the memory lane….আমার বাবা Hindustan Standard এ চাকরি করেছেন আজীবন । একসময় দিল্লি তে ছিলেন তারপর কোলকাতায় । আপনার সঙ্গে ইতিহাস ফিরে দেখলাম ।

    1. চমৎকার স্মৃতিচারণ আলপনাদি। তোমাদের ওই সময়টাকে ছবির মতো তুলে ধরেছ। এখানে থেমো না। পরের অধ্যায়টা শুরু করে দাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *