বহুকাল হল দু’বিঘে আকাশ কিনেছি। মেঘ দিয়ে সীমানা ঘেরা।

বিশেষ কাউকে ঢুকতে দিই না। লাঠি হাতে পাহারা দিই।

আমার আকাশে শীতলপাটি আছে। আমি সেখানে গড়াগড়ি খাই। মাথার উপরে ফড়িং ওড়ে। নীল, লাল, হলুদ ফড়িং। একটা ফিঙে এসে মাঝেমধ্যে লেজ নাড়ে।

সকালে কেউ মুড়ি ভাজে। মুড়ির কী মিঠে গন্ধ!

একতারাও বাজায় কেউ। একতারার শব্দ যখন ফিঙের ডানায় লাগে, একটা গন্ধ বেরোয়। ফড়িং, ফিঙে, একতারা, মুড়ি – ঝিম-ধরা গন্ধে আমার দু’বিঘে আকাশ তিরতির করে কাঁপে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

আড়াই হাজার বছর পর জেগে উঠি। তখনও আমার বুকে ফড়িং। চারদিকে মুড়ির গন্ধ। হঠাৎ টের পাই মেঘ করেছে।

আমার বর্ষা আসে আমার মেঘ বেয়ে। দক্ষিণ দিগন্তের কোণে আমার কেনা আকাশ। সেখানে একটা ছেঁড়া ঘুড়ি লাট খায়। এই ঘুড়ি আমাকে কানাকানি জানিয়ে দেয়, বর্ষা আসছে।

আমি কালো মেঘের গন্ধ পাই। আমি ধেনো মদের মতো মেঘ গিলি। আমার বুকের ভিতর বৃষ্টি নাচে। আমার শীতলপাটি ভিজে ওঠে। ফিঙের ডানায় বৃষ্টির ছাঁট। আমি নেশাতুর। আমার পাখি, আমার মেঘ, আমার ঘুড়ি। বর্ষা নামে ঝমঝমিয়ে।

আমার আকাশে একটা পাঠশালা আছে। গুরুমশাই আমার চেনা। তিনি আমার বাবাকে পড়িয়েছেন। ঠাকুরদাকে পড়িয়েছেন।

গুরুমশাইয়ের লম্বা দাড়ি। বয়স কত, কেউ জানে না। গত পাঁচ হাজার বছরে যত কবিতা লেখা হয়েছে, সব তাঁর মুখস্থ। তিনি আমাকে আজ পড়াচ্ছেন, ‘বাদল করেছে। মেঘের রং ঘন নীল।’ আমিও সুর করে পড়ছি, বাদল করেছে…। আশ্চর্য সেই সুর। দিগন্ত ছুঁয়ে দলে দলে ছুটে আসছে ছেলেমেয়ের  দল। যেন কিছু অচিন মেঘ ঢুকে পড়ছে আমার আকাশে।

ওই তো সুকুমার, ওই তো গোপাল, ওই যে নীলু, আরে ওটা ফুলি না? ফুলির বিনুনি দুলছে। ভেজা যূথির মতো ওর হাসি। ওর চোখের পাতায় বৃষ্টি। ওর জংলা জামায় বৃষ্টি। ওর হাতে স্লেট। সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই ফুটে ওঠে মহাকাব্য। গুরুমশাই মহাকাব্য পড়াতে থাকেন। তিনি এক বিরহিণীর কথা পড়াতে থাকেন। সেই বিরহিণী এক নিভৃত বাতায়নে বসে। তার এলোকেশ হাওয়ায় ওড়ে।

গুরুমশাই ভেজা মেঘে ঘুমিয়ে পড়েন। স্যাঁতসেঁতে কাঁথার গন্ধ নাকে আসে।

আমার আকাশে ছিল এক মাটির ঘর। দু’পাশে ঝোপঝাড়। কচুবন। সেই কচুবনে একটা ব্যাঙ থাকত। সেই প্রাগৈতিহাসিক ব্যাঙ গলাটা অনন্ত খাদে নামিয়ে একটানা ডেকে যেত। সে ডাকলে নদী জেগে উঠত।

কানাই খুড়ো কাঁধে বীজধান নিয়ে ছুটত বীজতলায়। থকথকে বীজতলা। মই টেনে সমান করা হতো। তারপর খুড়ো ছড়িয়ে দিত ধানের বীজ। অঙ্কুরিত ধানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে যেন মাতৃগর্ভ জেগে উঠতে। নদী জাগত, গর্ভে ফসলের কুঁড়ি জেগে উঠতে, কচুবনে কলরোল।

আমি গুটিয়ে যেতাম আমার ভিতর। স্যাঁতসেঁতে কাঁথাটা আমাকে আগলে রাখত। বসুধা জাগছে- আমি টের পেতাম কাঁথার ভিতর। 

আমাদের অনেক মাটির হাঁড়ি ছিল। তাতে থাকত ধান, চাল, চিঁড়ে, মুড়ি। কাপড়ের পুঁটুলিতে হাঁড়ির মুখ ঢাকা। পুঁটুলি সরালেই বিচিত্র একটা গন্ধ। আমি একবার দোয়েলের ছানাকে মাটির হাঁড়িতে রেখেছিলাম। রোজ মুসুরির ডাল গুঁড়ো করে তাকে খেতে দিতাম। বর্ষায় পাখিটা হারিয়ে গিয়েছিল। গাছের নীচে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল।

ন্যাকড়ার পুঁটুলি সরাতেই হাঁড়ির ভিতর থেকে ভেসে এল ভেজা চালের গন্ধ, দোয়েলছানার গায়ের গন্ধ। সে তো বহু যুগ আগের এক বর্ষার কথা। সেই দোয়েল কি বেঁচে আছে? তার মা কি তাকে আজও খুঁজে যাচ্ছে?

আমার দু’বিঘের আকাশে সব খুঁজে এনে জড়ো করি। ভাঙা পাখির বাসা, ছেঁড়া কাঁথা, ভিজে মাটির হাঁড়ি। লাঠি নিয়ে বসে থাকি। কাউকে ঢুকতে দিই না। বর্ষার জলে ফুলে ওঠা আমার ফুটবলটা কোথায়?

ফুটবল মাঠে এখন অট্টালিকা। কোনও এক নিতল নীল পাতালে নিশ্চয় ফুটবলটা শুয়ে আছে। বিকেল চারটে বাজল। দূর আকাশে কালো মেঘের ওড়াওড়ি। মাঠে ফুটবল নামল।

মাঠের ধারে আশশেওড়ার ঝোপ। পাশে একটা কবরখানা। তাতে দাঁড়িয়ে আছে কবেকার এক কদমগাছ। হঠাৎ খেলতে খেলতে চরাচর কাঁপিয়ে বৃষ্টি। আমাদের পকেটে কদম ফুল। কাদা থকথকে মাঠে কেউ বলল, গো… ও…ল। তা পর সে লুটিয়ে পড়ল কাদায়। কাদায় কদমের রেণু। কাদার গন্ধ, কদমের গন্ধ, ভেজা চামড়ার গন্ধ।

আমার আকাশে যেখানে আমার মাঠ, আমি অজস্র গন্ধ আজও সেখানে পুষে রেখেছি। 

স্বাধীনতা দিবসে হত ম্যারেড ও আনম্যারেডদের ম্যাচ। আমার বাবা ম্যারেড, আমি আনম্যারেড। বর্ষার ফুটবলে মাঠে বল কাড়তে গিয়ে সেই প্রথম বাবার পায়ে লাথি মারা। মাঠেই কপালে হাত ছুঁয়ে বাবাকে প্রণাম। তার পর দৌড় দৌড় আর দৌড়।  বর্ষার মাঠে যেন সময়ের অনন্ত দিকচিহ্ন।

আমার আকাশে আমি কাউকে ঢুকতে দিই না। ঝুলনের সৈন্যসামন্তরা সেখানে বন্দুক উঁচিয়ে বসে আছে কতকাল।

ঝুলনের পুতুল বানাত নিতাইদা। মাটির ঘর। উপরে টালি। নিতাইদার উঠোনে কত পুতুল শুয়ে থাকত। কোনওটায় রং হয়েছে। কোনওটায় হয়নি। এক বিচিত্র আধখেঁচড়া রঙের জগৎ। কোনও পুতুল আইসক্রিমওয়ালা, কোনও পুতুল উদাস চিন্তামণি, কোনও পুতুলের গায়ে সেনার উর্দি। বর্ষার মেঘের নীচে সেই সব পুতুলকে আমার পূর্বপুরুষ মনে হতো। আমি তাদের ঝুলনের ঘরে এনে রাখতাম। লাল সুরকির রাস্তা, তুলোর পাহাড়, পাহাড়ের নীচে লাল আলো, পাহাড়ের দু’ধারে সঙ্গিন উঁচিয়ে সৈন্য-সামন্ত।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভেজা মেঘের মতো গলায় ‘কুসুম দোলায় দোলে শ্যামরাই…’ বর্ষা এলে দূর পাহাড়ের গা বেয়ে গান ভেসে আসে আজও।

এরা সবাই আছে আমার দু’বিঘার আকাশে। আমি রোজ তাদের সঙ্গে কথা বলি। মেঘে মৃদঙ্গ বাজে। অঙ্কুরিত ধান থেকে চারা মাথা তোলে। ছেঁড়া ঘুড়ি দু’বেলা আমার কানে কানে বলে যায়, ‘বৃষ্টি এল, বৃষ্টি এল।’

আমি স্যাঁতসেঁতে কাঁথা খুঁজি।

পেশায় সাংবাদিক হলেও হৃদয়ে চিরনবীন কবি। এখনও বসন্ত এলে পলাশ ফুলের দিকে তাকাতে, কচি ঘাসের গন্ধ শুঁকতে আর সুপর্ণার বিরহে পাশ ফিরতে ভালোবাসেন। ছবি লেখেন গদ্যে। আনন্দবাজার পত্রিকার “অন্য পুজো” কলাম লিখে সুপরিচিত। পরে সেটি গাংচিল থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ফেসবুক কলাম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই নুনমরিচের জীবন।

3 Responses

  1. সুন্দর। সুপ্রভাত। চমৎকার লিখেছিস। অবশ্য বলাই বাহুল্য। এইখানের দেওয়ালে পাবো তোকে এবং তোর লেখাকে। বরং বলা ভালো, বাংলার ঋতুপর্বদের।
    সপরিবার ভালো থাকিস। মঙ্গল হোক বাংলালাইভ ডট কমের।
    বিনত

    অ।
    অশোককুমার কুণ্ডু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *