অনেকদিন পর মনের মতো একখানা বই চোখে পড়েছে শোভনের। যে বইটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় খুব কষ্টে একবার কি দু’বার হাতে এসেছিল। খুব রেয়ার সেই বইটা ফুটপাথে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে চট করে আশেপাশে একবার তাকিয়েছিল সে। অন্য কারওর নজর পড়েনি তো বইটার ওপর। চিলের ছোবলের মতো হঠাৎ হাতের মুঠোয় ধরেছিল শিকার। আর ভাবনা নেই। শোভনের মনটা এক চাপা আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠছিল। কিন্তু, নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে। এই মুহূর্ত টা খুব বিপদজনক। চোখ-মুখের ছবি একবার যদি ফুটের ওই লোকটা দেখে ফেলে, তাহলেই জাল কেটে বেরিয়ে যেতে পারে শিকার।
হঠাৎ লোকটা বলে ওঠে,
— কি দাদা, বইটার কী হল?
শোভন চমকে ওঠে। পরক্ষণে নিজেকে নিস্পৃহ দেখাতে চায়।
— না, মানে ঠিক আছে।
— কত দেবেন? আগ্রহ মিশ্রিত কঠে জিজ্ঞেস করে লোকটা।

শোভন আর একবার তাকিয়ে দেখল বইটার দিকে। দূর থেকে তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকাল। লোকটাকে এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছে সে। মাথায় উসকো-খুশকো চুল। পরনে তেলচিটে জামা। পায়ে পুরোনো ছেঁড়া চটি। চোখ দুটো যেন কোটরে ঢুকে গিয়েছে। গালে হালকা হালকা না কামানো দাড়ি। দেখলে কেমন মায়া হয়। কথাবার্তায় লোকটা ধীর-স্থির। অন্যান্য ফুটের লোকগুলোর মতো নয়। তবে তার কাছে যে খুব উপযোগী বই থাকে তাও না। ওই কখনও-সখনও দু-একটা । এই জন্যই কি তার তেজও কম? নাকি খদ্দের ধরার এও এক প্রাচীন কৌশল? শোভন ঠিক বুঝতে পারে না। তবে আজকের এই বইটা বেশ কাজের। একসময় এই বইটার জন্যই বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা ছিল। মনে আছে, অরুণ একবার এই বইটার থেকে কয়েকটা পাতাই খুলে নিয়েছিল, যাতে অন্য কেউ দামী লেখাটা না পায়। আসলে ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরিতে গুটিকয়েক কপি ছিল। ওদিকে বইটা আবার আউট অফ প্রিন্ট। তাই, এক চাপা উত্তেজনা ছিল বন্ধুদের মধ্যে।

— কি দাদা, কত দেবেন?

লোকটার কথায় শোভনের সম্বিৎ ফেরে। হঠাৎ সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিল সে। আবার ফিরে আসে বাস্তবের ফুটপাথে। কত বল যায়? লোকটার দিকে এবং একই সঙ্গে বইটার দিকে তাকাবার ফাঁকে যেটুকু সময়, একটা চটজলদি হিসেব করে ফেলে তার মধ্যে।

সটান বলে দেয়। দামটা শুনে লোকটা একটু হাসে। কী বলতে চাইছে লোকটা ওই হাসিতে? তবে কি খুব কম বলা হয়ে গেল? তবে কি শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে? বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি হয়ে গেল শোভনের। হঠাৎ লোকটা বলে উঠল,
— দাদা, কত আর লাভ থাকে বলুন। কেনা দামের চেয়ে কমে তো আর দিতে পারি না। লোকটার কথায় কেমন যেন একটা মেকি ভাব খুঁজে পেল শোভন। মনে মনে ভাবল, আরও দু’দশ টাকা কি বাড়িয়ে বললে ভাল হত? লোকটা কি তবে তার মুখের আসল ভাষাটা পড়ে ফেলেছে?

দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকল শোভন। বেডের ওপর বই-এর ব্যাগটা রেখে আলোটা জ্বেলে দিল। এখন সন্ধে সাতটা কুড়ি। মনের মধ্যে একটা চাপা হর্ষ। হাত-পা ধুয়ে কখন বইটাকে আপাদমস্ক নিরীক্ষণ করা যায়। আর তারপর শঙ্করদা দেখলে তো …!
শঙ্করদা শোভনের রুমমেট। মনে মনে খুব ঈর্ষা করবে হয়তো। অথবা বইটা দেখেও না দেখার ভান করবে। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানায় পড়ে থাকা বইটার শরীর থেকে চোখে সরালো সে। বইটা যেন তবু ইশারা দিয়ে ডাকছে তাকে। নিজেকে একবার বিজয়ী মনে হল শোভনের। বইটা কিনে সে যেন একসঙ্গে অনেকজনকে হারিয়ে দিয়েছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার চোখাচোখি হল বইটার সঙ্গে। শঙ্করদার ফিরতে এখনও দেরি আছে। তার আসার আগেই বইটার সমস্ত ঘ্রাণ শুষে নেবে সে। এটা শোভনের অনেক দিনের অভ্যাস। নতুন বা পুরোনো যে কোনও বই কিনলেই অন্য কাউকে হাত দিতে দেবেনা, যতক্ষণ না সে নিজে ভাল করে দেখে, পড়ে। এই ভাবনাটাই তার মনকে কেমন আনন্দে ভরে দিল। অনেক পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দিল বইটা। যে কথাগুলো শোভন আর মনে করতে চায় না এখন। অথচ সে তো কোনও রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস নয়। তাহলে? সেইসব পুরোনো, ফেলে আসা দিনগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে শোভন। একটা করে পাতা উল্টে উল্টে সে পৌছে যাচ্ছে পরিচিত করিডর, মিলনদা ক্যান্টিন আর অস্পষ্ট কুয়াশা জড়ানো সেইসব সন্ধ্যাবেলায়। দরজাটা হঠাৎ নড়ে উঠল। শঙ্করদা এসে গিয়েছে তাহলে। এতক্ষণ শোভন যেখানে ছিল সেখান থেকে ফিরে আসা খুব মুশকিল। তবুও উঠতেই হল। উঠতেই হয়। মনের ভিতরের চাপা আনন্দটা এখনই বেরিয়ে আসতে চাইছে। কখন বলবে শঙ্করদাকে বইটার কথা। পরক্ষণে ভাবে না, এখন ঠিক বলার উপযুক্ত সময় নয়। আগে হাত-পা ধুয়ে আসুক, তারপর। তা না হলে শঙ্করদার যা বই-এর নেশা …। আবেগটা একটু সামলে নিল শোভন। শঙ্করদা কিন্তু এসে থেকে ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই এদিকে । তবে কি ইচ্ছা করেই নিজেকে নিস্পৃহ রাখছে সে। যেমন করে সে নিজেকে রেখেছিল ফুটের লোকটার সামনে? শোভন মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছিল। অপেক্ষা যখন চূড়ান্ত শিখর ছুয়েছে, ঠিক তখনই ফোনটা রেখে শঙ্করদা বলল,
–কিরে, কী বই ওটা?
শোভন এবার নিজের কোর্টে বল পেয়েছে। একটু খেলিয়ে খেলিয়ে কথাগুলো বলতে চাইল সে।
— না না, তেমন কিছু না। তবে বইটা এখন আউট অফ প্রিন্ট। শঙ্করদার মুখের যতটা পরিবর্তন আশা করেছিল ততটা দেখতে পেল না শোভন। তবে কি সুজাতাদির ব্যাপারটা নিয়ে ও খুব চিন্তিত?
— জানো তো, এই বইটার জন্য আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে …
শোভনকে মাঝপথে থামিয়ে শঙ্করদা বলে,
— থাম তো। তোর যতসব আদিখ্যেতা। কেন? বইটা কি এক কপিই ছিল নাকি? শঙ্করদার গলায় কি ঈর্ষা ঝরে পড়ল? শোভন মনে মনে ভাবে, ওর মনটা তাহলে ঘোরানো গেছে বইটার দিকে। কিন্তু কই, বইটা তো এখনও একবার চাইল না। ভাবতে ভাবতেই
— কই দেখি, কী এমন বই? কথাগুলোয় যেন তাচ্ছিল্যের সুর। কিছুক্ষণের জন্য চুপ-চাপ দুজনে । ততক্ষণে আবার ফোনটা বাজতে শুরু করেছে শঙ্করদার। শোভন নিজের মনে বইটার পাতা উল্টে যাচ্ছে। হঠাৎ শঙ্করদা প্রসঙ্গটা চেঞ্জ করে বলে,
— কি রে, যাবি না?
— কোথায়? আনমনে পাল্টা প্রশ্ন করে শোভন।
— কোথায় আবার। সকালে বলেছিলাম যে, একটা সোয়েটার কিনতে যাব।
— নানা, আজ আমি খুব ক্লান্ত। তুমি যাও। তাছাড়া আমি পছন্দের বুঝিটাই বা কী? প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইল শোভন। আসলে সে কিছুতেই এই আবেশটা ভেঙে বেরোতে চাইছে না আজ।
শঙ্করদা বেরিয়ে যেতেই আবার পুরোনো দিনগুলোতে ফিরতে চাইল শোভন। কেন জানি না আজ তাকে খুব টানছে সেই দিনগুলো। পড়তে পড়তে হঠাৎ বইটার শেষ পাতায় নজর যেতেই কেমন চমকে উঠল সে। একি, এটা তো হওয়ার কথা নয়। ভাল করে, খুঁটিয়ে দেখল লোগোটা। কিছুটা অস্পষ্ট । তবে ভাল করে দেখলে বোঝা যায় না এটা কিসের লোগো। তাড়াতাড়ি প্রথম থেকে আবার উল্টে-পান্টে দেখল। মাঝখানের পাতায় এসে আবার আটকে গেল চোখ। এখানে যেন আরও স্পষ্ট। আর তার পাশেই একসেশন নাম্বার আ১২৩৫। হ্যাঁ, এটাই তো সেই বইটা! যেটা ইস্যু করা হত না। তাহলে? এতদিন পর কীভাবে ফুটপাথ হয়ে আবার তার হাতে! এতক্ষণ সে ভেবেছিল বইটি হয়তো কারোর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। কোনও কারণে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু ভিতরের পাতায় স্পষ্ট লোগোটা শোভনের ধারণা পাল্টে গেল। ততক্ষণে কান গরম হয়ে উঠেছে শোভনের। একদিকে পুরোনো স্মৃতি, অন্যদিকে একটা রহস্যময় কৌতৃহল তাকে ঘিরে ধরেছে।
কখন যেন সময় গড়িয়ে গিয়েছে। খিদেও পেয়েছে খুব। সন্ধে থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তবু মনটা যেন কেমন ভারি হয়ে আছে। পেয়েও না পাওয়ার একটা পুরোনো ব্যথা চারিয়ে গেল ভিতরে। মনটা কিছুতেই হালকা হচ্ছে না। খিদেটাও যেন এই মুহূর্তে আর বসে থাকতে দিচ্ছে না।

রাস্তায় হাটতে হাঁটতে শোভনের মাথায় একটা আইডিয়া এল। যার কাছ থেকে বইটা কিনেছি তার হাতে নিশ্চয়ই জানা যাবে আসল সত্যটা। আর তাহলেই তো সমস রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। সত্যিটা প্রকাশ্য রাস্তায় চলে আসবে। মনটা কিছুটা হালকা হয়। কিন্তু কাল কি বসবে লোকটা ওখানে, — চিন্তাটা মাথার ভিতর কিলবিল করতে শুরু করেছে। শোভনকে আসতে দেখে রুটির দোকানের লোকটা বলে,
— দাদা, আর একটু দেরি হলেই তরকারি পেতেন না। মুখে একটু হাসি লেগে লোকটার।
— কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে শোভন।
— না, মানে — আপনার মতোই পড়ে আছে। আপনার ভাগ্যটা ভাল।
হেসে ওঠে শোভন। মনে মনে ভাবে, আজ সত্যিই দিনটা ভাল গেছে। আলো ঝলমল বিশাল শপিং মলটার পাশ দিয়ে মেসে ফিরতে ফিরতে পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল শোভনের। আজ যেন পুরোনো, ক্ষয়ে যাওয়া অতীতেই পেয়েছে তাকে। অস্পষ্ট হয়ে আসা একটা মুখ, একটা ক্ষীণ হয়ে আসা হাসির আওয়াজ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুরোনো ফেলে আসা সেই অতীতে। …
হঠাৎ রাস্তার ডানদিকের কাপড়ের দোকানটার দিকে নজর পড়তেই চমকে ওঠে শোভন। দোকানটার সিঁড়ির নীচে বসে রয়েছে লোকটা। হ্যাঁ, সেই ফুটপাথের লোকটা। সে কি ঠিক দেখছে? কিছুটা অবাক হয়ে এগিয়ে যায় কাছে। হ্যাঁ, এ তো সেই লোকটাই। নিজেকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না শোভন। যাকে সে মনে মনে খুঁজছে, যার কাছে রহস্যের সমাধানের চাবি — এ যে মেঘ না চাইতেই জল! এতটা কাকতালীয় ঘটনাও জীবনে ঘটে? নিজেকে সংযত করে শোভন বলে,
— আরে দাদা, আপনি এখানে? কী ব্যাপার?
লোকটা বোধহয় চিনতে পেরেছে শোভনকে। তবুও কিছুটা অন্যমনস্ক, অপ্রস্তুত;
— আপনি
— আমি? মানে, আজকে ওই যে আপনার কাছে বইটা কিনলাম। সত্যিই, বইটা আমার কাছে খুব মূল্যবান। শোভন এইভাবে নিজের থেকেই পূর্ব পরিচয়ের প্রসঙ্গটা তুলল। লোকটা এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসল। কোনও কথা না বলে কেবল সেই কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ, উসকো-খুসকো চুল আর অবাক বিস্ময় মাখা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের বিরাট শপিং মলটার দিকে।
— আপনি এখানে কী করছেন? মানে, আপনার আপনার কি এখানেই বাড়ি?
লোকটা এবার কিছুটা সঙ্কোচের সঙ্গে বলে,
— হ্যাঁ, ওই বিজন সেতুর ওপারে। কসবা রথতলা।
— এখানেই কি আসল বাড়ি, নাকি …? আসলে সে প্রথমেই মুল পয়েন্টে যেতে চাইছে না। একটু আলাপ জমিয়ে, তারপর আসল প্রশ্নটা করা যাবে। লোকটা একটু লাজুক হেসে জবাব দেয়,
— গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীকান্তপুর।
— ওহ:, আপনার নামটাই এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়নি দেখেছেন। যেন একটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে বোঝাতে চাইল শোভন। লোকটা -“নামে কী যায় আসে, নাম তো প্রতীক্ষা নয়।” একটু হেসে, তারপর বলল, অরুণ চক্রবর্তী।
লোকটার কথাবার্তায় এর আগেও কিছুটা মার্জিত রুচির পরিচয় পেয়েছে শোভন, তবু এই বিখ্যাত কবির বিখ্যাত লাইনটা শোনার পর কেমন যেন অবাক হল সে। সত্যিই, নাম তো অবিনশ্বর নয়, নশ্বর এই জীবনে মানুষের হৃদয়, মানুষের ভালবাসা, পরাজয়, আঘাত-প্রত্যাঘাত — এসবই চিরন্তন। হয়তো এসবও নশ্বর। আসলে, মানুষের ওই ছোট্ট মাথাটাতে কোনও কোনও জিনিস আর কত কত ঘটনা যে কীভাবে জায়গা করে নেয়, তা জানার উপায় সত্যিই সাধ্যাতীত। তবে, ব্যক্তিনাম কখনওই বেশিদিন স্থায়ী হয় না আমাদের স্মৃতিতে। মুছে যাওয়া কিছু পরিচয়, কিছু ছবি পড়ে থাকে স্মৃতিতে। যাই হোক, এবার কি সরাসরি আসল প্রশ্নটা করে ফেলবে শোভন? মাঠ প্রায় তৈরি। কিন্তু হঠাৎ লোকটা নিজের কথা বলতে শুরু করল। …
কথার মাঝখান থেকে যেন উঠে আসতে লাগল অন্য এক মানুষ। লোকটাকে যা ভেবেছিল, লোকটা যেন তা নয়। কথাবার্তায় ঝরে পড়ছে এক শিক্ষিত-মার্জিত ভাব। আর সময়ে সময়ে প্রকাশ পাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু কিসের এই দীর্ঘ শ্বাস? লোকটা যেন সজোরে এড়িয়ে যাচ্ছে সে প্রসঙ্গ। শোভন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে লোকটার কথাবার্তায়। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যেন এলোমেলো বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। সে কি ভেসে যাচ্ছে লোকটার কথায়? নাকি কোনও নতুন প্লুট তাকে ইশারা দিচ্ছে? হঠাৎ একটা ট্রামের “ঘড়ঘড়’ শব্দে সম্বিৎ ফিরল শোভনের। এই মুহূর্তে সে আর জানতে চায় না লোকটার কোনও কথা। যেটুকু সে জেনেছে তাই-ই যথেষ্ট। আচমকা
— আচ্ছা, আপনি ওই বইটা কোথায় পেলেন বলুন তো?
— কোন বইটা? লোকটা কিছুটা হতভম্ব।
— আরে, যেটা আজ আমি কিনলাম, বিকেলে।
— ও, ওটা? কেন বলুন তো?
– না, মানে এমনি বলছি। বইটা তো এখন আউট অফ প্রিন্ট। নিজেকে সামলে নেয় শোভন।
— আসলে ওই বইটা আমারও খুব প্রিয় ছিল। ওটা আমারই ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই।
শোভন কিছুটা রেগে যায় এবার। কিন্তু রাগটা প্রকাশ করে না। বলে,
— আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।
— কেন, আপনার কথাটাকে মিথ্যা বলে মনে হল কেন? কিছুটা রহস্যময় উচ্চারণ লোকটার গলায়। আর এই রহস্যেই ঢুকতে চাইছে শোভন।
— আপনি সত্যি করে বলুন তো, কে আপনাকে বইটা বিক্রির জন্য দিয়েছে?
কিছুটা নরম গলায় কথাগুলো বলে শোভন। এ যেন রহস্যের সমাধান তার হাতের মুঠোয় কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। — না, মানে আপনাকে এই বইটা যে দিয়েছে, তার কাছে আরও অনেক ভাল বই-এর সন্ধান পাওয়া যেত কি না। টোপটা দিয়ে ফাতনাটা দোলাচ্ছে শোভন। কিন্তু, সত্যিই কি মাছটা টোপ গিলবে? লোকটা আরও জোর দিয়ে বোঝাতে চাইল, বইটা তার নিজের। অথচ মুখে-চোখে একটা কেমন ভয়ার্ত ছাপ। মাথাটা এবার গরম হয়ে গেল শোভনের।
— আরে থামুন তো মশাই। বইটা কার জানেন? ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখেছেন একবার বিক্রির আগে?
লোকটার মুখটা যেন বিবর্ণ হয়ে গেল। বিরাট শপিং মলটার উজ্জল আলোয় লোকটার সেই বিবর্ণ সুখের ছবিটা ভাসতে লাগল।
— কোথায় পেয়েছেন সত্যি করে বলুন। শোভনের গলা গম্ভীর
— না, মানে একটা মেয়ে, সেদিন এসে …। বলেছিল কোনও স্যার নাকি …। চমকে ওঠে শোভন।
— স্যার? একটু ভেবে বলে, আচ্ছা মেয়েটার নাম কী বলুন তো? মানে, তাকে দেখতে কেমন? এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলো করে ফেলল সে। যেন রহস্য উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্সে পৌছে গিয়েছে। লোকটা যেরকম বর্ণনা দিল, সেরকম কাউকে তো শোভনের মনে পড়ছে না। তাহলে কি কোনও জুনিয়র স্টুডেন্ট? তাদের পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর ডিপার্টমেন্টে এসেছে? না কি ও সত্যিই অন্তরা? সে তো আগেও কয়েকবার র্যাক থেকে বই সরিয়েছিল। একবার তো তার চোখের সামেনেই। হিসাবটা ঠিক মেলাতে পারে না শোভন। অন্তরা কি এত বড় একটা কথা তাকে চেপে গিয়েছে। অথচ সে তো সমস্ত কথাই তাকে বলত। আসলে সে, এই বই সরানোটাকে কোনও দিনই অন্যায় কাজ বলে মনে করেনি। তাহলে কি অন্তরাই …?

তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই লাইটটা নিভে গেল। লোডশেডিং বোধহয়। অন্ধকারে অন্তরার মুখটা ভেসে এল একবার। অবাক হল শোভন। নিজের মনে একবার হাসল সে। আজ এতদিন পর ওকে আবার মনে পড়ল। শঙ্করদা এখনও ফেরেনি। টেবিলের ওপর থেকে মোমবাতি আর দেশলাইটা নিল। বেডের পাশে জানলাটাতে জ্বল মোমবাতিটা রাখল। হঠাৎ সারা ঘরটা কেমন যেন আলো-আঁধারি রহস্যময় পরিবেশ পেয়ে গেল। হাত-পা ধুয়ে এসে লেপের ভিতরে ঢুকে পড়ল শোভন। আজ যেন শীতটা একটু বেশি পড়েছে। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে মোমবাতির শিখাটা। সেই আলো আর অন্ধকারের রহস্যময় পরিবেশে লেপটাকে বুকের কাছে নিয়ে বইটা আবার বের করল। মলাটের ওপরটায় হাত দিয়ে কেমন যেন খসখসে একটা অনুভূতি হল শোভনের। তারপর পাতাগুলো উল্টোতে উল্টোতে তার মনে একটাই প্রশ্ন ভেসে আসছিল, লোকটা কি ঠিক বলল? এই কথা ভাবতে ভাবতে চোখের আরও কাছে নিয়ে এল বইটাকে। অক্ষরগুলোকে ভাল করে দেখল আবার। হঠাৎ বইটার পাতার ভাঁজ থেকে একটা পরিচিত গন্ধ টের পেল। গন্ধটা যেন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূরে। মোমবাতির আলোর শিখাটা যেন আবার কেঁপে উঠল এ সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *