ক্লাস সেভেনে, ‘ব্যাগার’ ক্লাসে বাংলা পড়াতে এসে স্যার সহজ ভাষায় ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমানের সারমর্ম বোঝাতে চেয়েছিলেন।
উনি বলেছিলেন, একদিকে জীবন ও অন্যদিকে মৃত্যু, মধ্যিখানে একটি সাঁকো। আমরা সবাই ধীরে ধীরে এই সাঁকো পার হব।
এই দর্শন ছাত্রদের মরমে পশিল।
এরপর থেকে উনি ক্লাসে ঢোকামাত্র ‘সাঁকো’ ‘সাঁকো’ রব।
অগত্যা ক্লাস সামলানোর জন্য উনি হুমকি দিতে শুরু করলেন – “আমার বাড়িতে শঙ্কর মাছের চাবুক আছে, একবার টাচ করলেই ইলেকট্রিক শক” ইত্যাদি।
আমরা ঘাবড়ে গিয়ে শান্ত হলাম। স্যার-ও এই সহজ সমাধানে নিজের পিঠ চাপড়ালেন।
কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি সমস্যা হল, তাঁরা বুঝতে পারেন না বা চান না, যে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদেরও বয়স বাড়ে। তাই নিজের অজান্তেই তাঁরা ফি বছর একই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করেন। ক্লাস নাইনে যখন সেই হুমকি ধেয়ে এল, তার আগেই আমরা ভাজা মাছ উল্টে খেতে শিখে গিয়েছি। লোডশেডিং-এর দৌলতে ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ ধারণা হয়েছে। পিছনের সারি থেকে কেউ একজন খোনা গলায় বলল, “তা একদিন নিয়ে আসুন না আপনার চাবুক, দেখি কেমন দেখতে।”
স্যার অগ্নিশর্মা হলেন এবং আমরা কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়ালাম।
ইতিহাসের ক্লাসে এই সমস্যা ছিল না। স্যার সাধারণতঃ ক্লাস শেষ হওয়ার দশ-পনেরো মিনিট আগে আসতেন। ওঁর মুগুর ভাঁজা চেহারা। ততক্ষণে শ্রেণীকক্ষে পানিপথের সবকটি যুদ্ধ ঘটে গেছে। এদিক ওদিক বিভিন্ন সাইজের কাগজের গোলা ছড়িয়ে। ভাঙা স্কেলের টুকরো। একটি ছাত্রের জামা হাট করে খোলা। সে সারা ক্লাস ঘুরে ঘুরে ছেঁড়া বোতাম খুঁজে বেড়াচ্ছে। মনিটর এক মনে বোর্ডে দুষ্টু ছেলেদের নাম লিখে পাশে ‘তারা’ চিহ্ন আঁকছে। যারা তার টিফিন স্পনসর করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি তাদের পাশে একাধিক স্টার। স্যার এসেই বলতেন, “আজ আর সময় নেই; যাদের নামের পাশে অনেক স্টার তারা বেরিয়ে আয়।”
এরপর কিল-চড়ের বন্যা। এই কারণেই আমরাও চাইতাম উনি অল্প সময়ের জন্যই ক্লাসে আসুন।
কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি সমস্যা হল, তাঁরা বুঝতে পারেন না বা চান না, যে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদেরও বয়স বাড়ে। তাই নিজের অজান্তেই তাঁরা ফি বছর একই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করেন। ক্লাস নাইনে যখন সেই হুমকি ধেয়ে এল, তার আগেই আমরা ভাজা মাছ উল্টে খেতে শিখে গিয়েছি।
আবেগমথিত কণ্ঠে ব্যাকরণ পড়াতেন যে শিক্ষক, তিনি আমার খুল্লতাতর বয়সী।
পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। দু’মিনিটের মধ্যেই তাঁর ক্লাস ওই তৃষিত মরুপ্রান্তর ত্যাগ করে সুজলা সুফলা বঙ্গে প্রবেশ করত।
উনি তাঁর ছোট মেয়ের গল্প শুরু করতেন। তার বঙ্গলিপি খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছড়া পড়ে শোনাতেন। লাল কালিতে আঁকা হিজিবিজি রাক্ষস-খোক্কসের ছবি দেখাতেন আর নিজেই হেসে উঠতেন।
আমাদের বয়েজ স্কুল। শিক্ষকমণ্ডলীও পুরুষ শাসিত। সুতরাং এই ক্লাসটি ছিল চিরবসন্তের ঠিকানা।
একবার এক সহপাঠীর হাতের লেখা দেখে উনি দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন – “ঠিক আমার ছোটমেয়ের মত লেখা, মুক্তো ঝরছে।”
এই কথা শুনে বন্ধুর কান লাল হল। বুঝলাম আমাদের সঙ্গে সঙ্গে স্যারের মেয়েও বড় হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে কয়েক পাতা হ্যান্ডরাইটিং প্র্যাকটিস।
ইলেভেনে কলেজে ভর্তি হওয়ার অর্থ: সাপের পাঁচ পা দর্শন। অঙ্কের ক্লাস কেটে নুন-শোয়ে জেমস বন্ড দেখে আবার কলেজের দিকে হাঁটা দিয়েছি, বাধ্যতামূলক ক্যান্টিন ক্লাসে হাজিরা দেওয়ার জন্য। হঠাৎ সামনে বিকাশ রায়। ‘ছদ্মবেশী’ সিনেমার সিন থেকে উঠে এলেন যেন। আসলে উনি আমাদের স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক। মুখ অল্প ফাঁক করে দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন বিলিতি শব্দ ছুঁড়ে দিতেন আমাদের মতো নিধিরাম সর্দারদের দিকে। চিনতে পেরে বাংলায় বাঁকা হাসলেন – “কী হে? রাজকার্য করে ফিরছ?”
এই প্রশ্নের উত্তর হয় না, তাই মুখ নামিয়ে জিভ কাটলাম।
রাজপাট চালাতে গেলে সাপোর্ট লাগে।
রাজা তো বেঁচে থাকে রানির ভরসায়।
ছেলেদের স্কুলে পড়ে, জাঁদরেল শিক্ষকদের শাসনে বড় হয়ে হৃদয় কুঁকড়ে ছিল।
কলেজে আমাদের কলজে প্রসারিত হল।
ইতিহাস শিখিয়েছে প্রেমের কোনও ধর্ম নেই। তাই যে কন্যের দিকেই অপাঙ্গে তাকাই সে-ই রানির মত স্বপ্নে আবির্ভূত হয়।
বেশিদূর এগতে পারি না, কারণ ওই পালোয়ানসম ইতিহাসের স্যারের ফরমান – টেবিলের তলায় হাফ নিল ডাউন।
ইলেভেনে কলেজে ভর্তি হওয়ার অর্থ: সাপের পাঁচ পা দর্শন। অঙ্কের ক্লাস কেটে নুন-শোয়ে জেমস বন্ড দেখে আবার কলেজের দিকে হাঁটা দিয়েছি, বাধ্যতামূলক ক্যান্টিন ক্লাসে হাজিরা দেওয়ার জন্য। হঠাৎ সামনে বিকাশ রায়। ‘ছদ্মবেশী’ সিনেমার সিন থেকে উঠে এলেন যেন।
যারা জন্মপ্রেমিক, তারা অবিশ্যি সাহসি নাবিক। যেমন আমাদের এক সহপাঠী।
ফার্স্ট ইয়ারে কলেজের গেটে সমুদ্রনীল শাড়িতে তার চোখ হোঁচট খেল।
দূর থেকে সিনিয়র না জুনিয়র ঠাহর হয় না। কিন্তু বন্ধুর মন কি সে কথা মানবে! তারওপর সে ওই বয়সেই কলেজের পপ্যুলার ফিগার।
কিছুদিন পর অবিশ্যি বোঝা গেল গোড়ায় গলদ। নীল শাড়ি আসলে অধ্যাপিকা। সম্প্রতি জয়েন করেছেন।

বন্ধু একটু মুষড়ে পড়লেও মচকাল না। সে এই স্বপ্নভ্রম নিয়ে একটি গান বেঁধে ফেলল এবং হিপ-হপ স্টাইলে কলেজ ফেস্ট-এ গাইল।
বলা বাহুল্য সেই গান অতি জনপ্রিয় হল এবং একসময় কলেজের সিঁড়িতে, লন-এ, ক্যান্টিনে মায় ক্লাসরুমে ডেস্ক বাজিয়ে গাওয়া হতে থাকল।
কলেজ ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগে, এক শেষ বিকেলে, ম্যাডাম তাঁর রূপগুণমুগ্ধ-কে পাকড়াও করলেন মেইন গেটে।
মুচকি হেসে জানালেন ওই গানটি শুনতে চান।
সে কী, না না, ছি ছি, কোনও যুক্তিই ধোপে টিঁকল না। গানটি যেহেতু ওঁকে নিয়ে লেখা, তাই শোনাতেই হবে।
নিন্দুকেরা বলে প্রেমিকপ্রবর সেদিন অনুপ জালোটার ক্যাসেট কিনে বাড়ি ফিরেছিল। ভজনের সুরে গানটি প্র্যাকটিস করবে বলে।
অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।
E lekha porei mone holo Scottish na hye jay na. Aar gaan ta ki “Swwetheart I am feeling alone”?