বাগদেবীর খালের দুপাশে ঘন জঙ্গল। খালের পাড়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শ্বাপদের মত জিভ দিয়ে টেনে টেনে জল খাচ্ছিল শেয়াল। ওপরগস্তিদের দলের একনম্বর মাছি। বেঁটে রোগা চিমড়েপনা চেহারা। শিকার কতদূরে রয়েছে মাটি শুঁকে নাকি সেটা বলে দিতে পারে। এরকমই বলে দলের সবাই। দিনের পর দিন শিকারকে অনুসরণ করে যেতে পারে একটুও ধৈর্য না হারিয়ে। মারাত্মক উপস্থিত বুদ্ধি। একটুকু বিপদের আঁচ পেলেই মুহূর্তের মধ্যে শরীরটাকে সাপের মত মিশিয়ে দিতে পারে গাছপালা ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আধহাত দূর থেকে হেঁটে গেলেও বুঝতে পারবে না কেউ। একমাত্র ডেরায় ছাড়া হাতের আঁজলায় অথবা পাত্রে ওকে কোনওদিন জল খেতে দেখেনি কেউ। উঁচু থেকে উঁচু গাছের মগডালে চড়ে যেতে পাড়ে চোখের নিমেষে। হরিণের গতিতে ছুটতে পারে মাইলের পর মাইল। ডুব সাঁতারে হার মানাতে পারে উদবেড়ালকেও। সব দেখেশুনে দলের সাথীরা এহেন নাম দিয়েছে। আসল নামটা নিজেরই আজ মনে পড়ে না ওর।
চকচক করে অনেকখানি জল খেয়ে উঠে দাঁড়াল শেয়াল। কেন জানিনা মন বলছে, কদিন ধরেই যা খুঁজছে সেই গোপন খাজানার চাবিকাঠিটা লুকিয়ে রয়েছে খালের দুপাশের এই জঙ্গলেই। চামড়া ঠেলে বেরনো পাঁজরের খাঁচায় হাতদুটো ভাল করে মুছে নিল শেয়াল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দুদিকে নজর চালাল ভাল করে। এক এক আঙুল জায়গাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জরিপ করছিল বনবেড়ালের মত চোখজোড়া। হঠাৎই নজরে পড়ল হাত বিশেক দূরে ভাঙ্গা কাঠের মত একটা কিছু মাথা উঁচিয়ে আছে জলের মধ্যে থেকে। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ টানাটানি করতেই হড়হড় করে কাদার তলা থেকে উঠে এল সেটা। একটা ছোট একচালার কাঠামো। মাটি গলে বেরিয়ে গেছে কবেই। শিথিল হয়ে যাওয়া পচা খড়ের বাঁধুনির আড়ালে সিংহ আর অসুরের ওপরে চারটে মূর্তির আদলটা এখনও বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। খড়ের গায় আঙুল টিপে নাকের ডগায় এনে শুঁকল শেয়াল। অন্তত তিন মাসের পুরনো। তার মানে দশমীতেই ভাসান দেওয়া হয়েছে মূর্তিটা। স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে আটকে গেছে পাড়ে। কিন্তু জায়গাটার অন্ততঃ ছ-সাত ক্রোশের মধ্যে তো কোন গ্রাম বা লোকালয় নেই। ছোট খালে খুব বেশি হলে ক্রোশখানেকের বেশি ভেসে আসতে পারবে না এটা। তার আগেই আটকে যাবে চড়ায়। তারমানে ক্রোশখানেকের মধ্যেই কেউ রয়েছে জঙ্গলে। তারা কারা? দপ করে জ্বলে উঠল শেয়ালের চোখজোড়া। ভুরু কুঁচকে ভাবল দু-একমুহূর্ত। তারপর গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেল স্রোতের উল্টোদিক আন্দাজ করে। আন্দাজের ফলও মিলল কিছুক্ষণ বাদেই। মাইল খানেক এগোতে না এগোতেই কাদায় কয়েকজোড়া পায়ের ছাপ। টাটকা। পাড়ের ঢালু বেয়ে নেমে এসে ফের ঘুরে মিলিয়ে গেছে জঙ্গলের গভীরে। নজর চালিয়ে চালিয়ে চারপাশটা একবার ভাল করে দেখে নিল শেয়াল। খামচে তুলে বেশ খানিকটা কাদামাটি ভাল করে মেখে নিল গায়ে মুখে। তারপর গোসাপের মত বুকে হেঁটে ঢুকে গেল জঙ্গলে।
একটু আগে কুয়াশাঘেরা ভাবটা কেটে গিয়ে চাঁদ উঠেছে। কদিন আগে পূর্ণিমা গেছে। জোছনায় জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে বল্লালগড়ের ঢিবি আর চারপাশ ঘিরে থাকা খোলা প্রান্তর। জঙ্গলের সীমানায় ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে একদৃষ্টে ভাঙাচোরা বিশাল কেল্লাটার দিকে ঘোরলাগা মানুষের মত হাঁ করে তাকিয়েছিল শেয়াল। দলের হয়ে শুঁকে বেড়ানোর কাজে আশেপাশের গোটা চারেক জেলার ইঞ্চি ইঞ্চি জমি শুঁকে শুঁকে ঘুরেছে ও। বড়পীরের দিব্যি, এরকম একটা জিনে পাওয়া ভুলামাসানের মত জায়গা এর আগে চোখে পড়েনি কখনও। বিশের ভয়ে সেই যে পাঁকবাদা ঘেরা চাঁদরায়, কেদার রায়ের গড়ে আশ্রয় নিয়েছিল ওরা, তার চেয়েও দুর্গম এ জায়গাটা। এতবড় কেল্লা অথচ চারপাশ ঘেরা জঙ্গলের ওপার থেকে কিছুই বোঝা যাবেনা। ঝকঝকে চাঁদের আলোয় কেল্লার সামনে আধভাঙ্গা একটা চাতালে পশ্চিমে মুখ করে নামাজ পড়ছে কয়েকজন। তারমধ্যে মেঘা আর জলিলকে স্পষ্ট চিনতে পারল ও। কিছুক্ষণ বাদে নামাজ সেরে উঠে দাঁড়াল ওরা। আর একমুহূর্তও এখানে থাকা নিরাপদ নয়। যকের ধন ভাঁড়ারের চাবি হাতে এসে গেছে! এবার ঠিক খবরটা খালি জায়গামত পৌঁছে দেওয়ার ওয়াস্তা, তাহলেই… ঠিক যেভাবে এসছিল সেভাবেই বুক ঘষটে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল শেয়াল।
বিশের ভয়ে সেই যে পাঁকবাদা ঘেরা চাঁদরায়, কেদার রায়ের গড়ে আশ্রয় নিয়েছিল ওরা, তার চেয়েও দুর্গম এ জায়গাটা। এতবড় কেল্লা অথচ চারপাশ ঘেরা জঙ্গলের ওপার থেকে কিছুই বোঝা যাবেনা। ঝকঝকে চাঁদের আলোয় কেল্লার সামনে আধভাঙ্গা একটা চাতালে পশ্চিমে মুখ করে নামাজ পড়ছে কয়েকজন। তারমধ্যে মেঘা আর জলিলকে স্পষ্ট চিনতে পারল ও।
মাঘ ফুরিয়েছে দু-তিনদিন হল। পাতলা চাদরের মত শীত এখনও জড়িয়ে রয়েছে রাঢ় বাংলার গায়ে। গড়ের উঁচু চাতালটার ওপর পা ঝুলিয়ে বসেছিল বিশ্বনাথ। ভাঙাচোরা দেয়ালের শরীর ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা বিশাল বটগাছটার ডালে ‘ট্রুইক টু, ট্রুইক টু’- ডেকেই চলেছে একটা কুম্ভাটুয়া পাখি। দেখা যাচ্ছেনা পাখিটাকে। ডালপালার ফাঁক দিয়ে হাল্কা রোদ এসে পড়ছে মুখে। ভোরবেলা সূর্যের এই কুসুম কুসুম ওমটুকু ভাল লাগছে বেশ। গড়ের একদম নিচে ফণীমনসার গাছগুলোয় ফুটে থাকা হলুদ ফুলগুলোর ওপর ওড়াউড়ি করছে রঙবেরঙের প্রজাপ্রতি। সামনে খোলা মাঠটায় ইতিউতি ছুটে বেড়াচ্ছে কাঠবিড়ালিরা। এটা ওটা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। একটু এদিক ওদিক দেখলেই একছুটে গিয়ে তুড়ুক করে উঠে পড়ছে গাছে। চাতালে বসে বসে আনমনে এসবই দেখছিল বিশ্বনাথ। এইসময় কাঁধের ওপর একটা হাত। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বিশ্বনাথ। মেঘা, কখন চুপচাপ এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে।
— “কিরে, চুপচাপ একা বসে আছিস এখানে?”
— “এমনি, রোজ তো আর ভোরবেলা ওঠা হয়না। তবে ভালই লাগছে বসে থাকতে। ওদের দেখছি বসে বসে।” আঙুল দিয়ে সামনে মাঠের দিকে দেখাল বিশ্বনাথ।
— “ওই প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, পাখিরা…ইচ্ছে করলে যেখানে খুশি যেতে পারে। অথচ আমরা পারিনা…সবসময় হিসেব কষে, পা মেপে মেপে চলতে হয়। হুঁশিয়ার থাকতে হয় এই বুঝি দুশমনদের খপ্পরে পড়ে গেলাম।”
— “ভুল বললি বিশে” জবাবে হাসল মেঘা।
— “হুঁশিয়ার সবাইকেই থাকতে হয় রে বিশে এই খোদাতাল্লার দুনিয়ায়। পাখি ভাবে এই বোধহয় বাজে ছোঁ মারল, কাঠবিড়ালি ভাবে এই বোধহয় গর্তে সাপ ঢুকল… সারা দুনিয়া জুড়ে এই হুঁশিয়ার থাকার খেলাটা চলছে নিরন্তর। একটা কেঁচোরও নিস্তার নেই এ খেলা থেকে।”
অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকিয়েছিল বিশ্বনাথ।। জীবনের কতবড় সারসত্যি কথাটা কত সহজে বলে দিল। আগে এভাবে কখনও ভেবেই দেখেনি।
— “তুই নেমাই ঠাকুরের মত বসে বসে ভাব। আমি চলি।”
বিশ্বনাথের হাতে একটা আলতো চাপড় মেরে উঠে দাঁড়াল মেঘা। ঘুরে এগোনোর মুখেই হাওয়া কেটে ‘সুঁই’ করে একটা কিছু ছুটে আসার শব্দ! চাতালের ওপর সটান মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মেঘা।
— “মেঘা আ আ!”
হতভম্ব বিস্ময়ের ঝটকাটা কাটিয়ে চিৎকার করে উঠল বিশ্বনাথ। পরমুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ে টানতে টানতে দেহটাকে টেনে নিয়ে এল চাতালের গায়ে ভাঙ্গা পাঁচিলটার আড়ালে। মাথার পিছনদিকে একটা ফুটো। ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে আসছে ফুটোটা দিয়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চাতালের মাটি। এক ঝটকায় শরীরটাকে চিৎ করে শুইয়ে দিল বিশ্বনাথ। দৃষ্টিহীন ঘোলাটে দুটো চোখের চাউনি। থিরথির করে কাঁপছে চোখদুটো। দু এক মুহূর্তের ব্যাপার। বিশ্বনাথের কোলে এলিয়ে পড়ল মাথাটা। চিৎকার শুনে ততক্ষণে ওপর থেকে নেমে এসেছে জলিল, প্রেমচাঁদরা। সামনে শোয়ানো মেঘার দেহটা বুকের মধ্যে দুহাতে জাপটে ধরে বসে রয়েছে বিশ্বনাথ। রক্তে মাখামাখি দুটো শরীর। ফ্যালফ্যালে দুচোখে তাকিয়ে আছে মেঘার দিকে। কী ঘটেছে সেটা বুঝতেই কিছুক্ষণ কেটে গেল সবার।
— “তোরা এখানেই থাক! আমি দেখে আসছি একবার।”
হুঁশ ফিরে পেয়ে সবার আগে বলে উঠল নলে। তারপর নেউলের মত ক্ষিপ্রগতিতে ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ছাদের দিকে। নেমে এল কিছুক্ষণ বাদেই।
— “চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলেছে ওরা…প্রচুর বন্দুক আর হাতিয়ার রয়েছে ওদের সঙ্গে।”
নলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফের একবার বৃষ্টির মত ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এল ঢিবি লক্ষ্য করে। ভাঙা দেওয়াল থেকে খসে পড়া চাঙড় আর চুন-সুরকির ধোঁয়ায় ঘোলাটে চারপাশ। মাথা নিচু করে পাঁচিলের আড়াল থেকে মুখ বাড়াল বিশ্বনাথ। মাঠের ওপারে জঙ্গলের গাছপালার আড়াল থেকে উঁচিয়ে থাকা অনেকগুলো বন্দুকের নল। লোকজনের নড়াচড়া আর কথাবার্তার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। বুক ঘষটে পাঁচিলের আড়ালে ফিরে এল বিশ্বনাথ। তারপর ঘুরে তাকাল সঙ্গীদের দিকে।
— “কেল্লার চারপাশে ছড়িয়ে পড় সবাই। সড়কি আর বল্লম ছাড়াও যত টোটা আর বন্দুক আছে সব নিয়ে নে সঙ্গে। পেমা, সন্ন্যাসী আর জলিল থাকবে এক একটা দলের আগে। ওদের কথা মেনে চলবি সবাই। নলে আমার সঙ্গে থাকবে এখানে। ঠিক আছে?”
–“জো হুকুম সর্দার” একসঙ্গে বলে উঠল সবাই।
তারপর ঝড়ের গতিতে মিলিয়ে গেল কেল্লার মধ্যে। নলের দিকে তাকাল বিশ্বনাথ। চোট খাওয়া বাঘের মত দৃষ্টি দুচোখে।
— “বড় শিকার খেলার সময় এসে গেছে রে নলে । যে দুশমন ডরপোকের মত দূর থেকে লড়ে, তার সঙ্গে লাঠি চলবে না। তুই গিয়ে আমাদের তীর ধনুক জোড়া আর বন্দুকগুলো নিয়ে আয়। সঙ্গে টোটা ভর্তি একটা বাক্স। আমাদের মেঘাকে মেরেছে ওরা। মরতে যদি হয়ই তবে একটার বদলে একশটা লাশ ফেলেই মরতে হবে ঠিক?”
— “একদম! জয় মা কালী!!” বলেই বিশ্বনাথের পাশ থেকে সরে গেল নলে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
দারুণ রোমাঞ্চ। টানটান গতিতে এগোচ্ছে। আহা আবার অপেক্ষা…
আপসোস এটাই যে আরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে