এখন করোনার লকডাউন পিরিয়ডে আমাদের সহকারীরা কাছে নেই। তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে দিলে বিপদ দু’পক্ষেরই। তাই এই দুর্যোগের দিনে আমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই চালিয়ে নিতে হবে। এছাড়া মনে রাখতে হবে, এই সময় ‘রিসোরসেস আর লিমিটেড।’ কিন্তু তাই বলে আমাদের ক্রিয়েটিভিটি কিন্তু আনলিমিটেড! তাই বুঝেশুঝে খরচা করতে হবে সঞ্চিত জিনিসপত্র। আর যেহেতু সহকারীরা কাছে নেই তাই সবজি কাটার সময়, মশলা বাটার সময় যেন বেশি না হয়ে যায়। কারণ তাহলে কুকিং টাইম আবার ইটিং টাইমের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যাবে। গৃহিণীদের গলদঘর্ম অবস্থা হবে এবং সেটা পোষাবে না। কারণ ঘরের অন্য কাজগুলোও তো তাঁদেরই করতে হচ্ছে এখন! তাই কয়েকটা সাদামাটা সহজ এবং কেজো রেসিপি দিচ্ছি সবার সুবিধার্থে। এইসব সাদামাটা উপকরণ এখন আমাদের সবার কাছেই মজুত আশা করি। ফলে লকডাউনের দিনগুলো কাটুক একটু আরামে!
এখন দুপুরে প্রথম পাতে নিম বেগুন অথবা উচ্ছে-আলু সেদ্ধ দিয়ে শুরু হোক খাওয়া। মাঝখানে থাক ডাল বা পোস্ত কিছু একটা। আর শেষ পাতে দুধ বা দই দিয়ে ভাত। পাকা কলা থাকলে ভালোই। বাজারে গিয়ে মাছ মাংসের ঝামেলা না বাড়ালেই হল। থাকলে ভালো তবে জীবন ততোই সহজ হবে যতো এসব ঝামেলা কমাবেন।
(১) জলখাবারে উতরোনো উত্তাপম
১ কাপ আটা, ১ কাপ ময়দা, ১ কাপ সুজি, ১ কাপ চালের গুঁড়ো আরও যা যা সব আছে রান্নাঘরে, গুঁড়ো করা ওটস, ছাতু, বেসন সব দিতে পারো। একটা ডেকচিতে এসব নিয়ে নাও। টক দই থাকলে ভালো। নয়তো জলে ভিজিয়ে রাখ ঘণ্টা তিন চারেক। তারপর রাম ঘাঁটা ঘেঁটে এক্কেরে ঘ’ করে দাও করোনার বাঁদরামির মত। এবার কুচোনো পেঁয়াজ, লংকা, ধনেপাতা, নুন দিয়ে ননস্টিকে তেল ছিটেফোঁটা দিয়ে দোসার মত ভেজে নাও দুপিঠ। এর মধ্যে গাজর, ক্যাপসিকাম কুচিও দেওয়া যায়। কয়েকটা এমনি ভেজে কয়েকটিতে চিজ কুরে দিয়ে ভাজতে পারো। শেষের ক’টায় দুটো ডিম ফেটিয়ে আন্ডা দোসার মত ভাজতে পারো। এই বাজারে নারকেলের চাটনি জুটবে না। স্যস/আচার তো থাকেই নানারকম। জলখাবারেই নয় শুধু মনে হয় রাতের খাওয়াও দৌড়বে একদিন।
(২) ডিনারে রুটি রোল
রুটি বানাতে পারলে নাথিং লাইক দ্যাট। বাসি রুটিতেও দারুণ চলে। ননস্টিক প্যানে রিফাইন্ড তেল এক চামচ, তার মধ্যে ফেটানো ডিমের গোলা এক হাতা। তারপর রুটি চেপে দিয়ে এগ রোলের মত ভেজে উল্টে দেওয়া। এবার পেঁয়াজ, লংকা, শশা, ক্যাপসিকাম কুচি, লেবুর রস, গোলমরিচ দিয়ে রোল করে নিলেই হল উপাদেয় রুটি রোল। একটা ডিমে দুটো রুটি একজন প্রাপ্তবয়স্কের দিব্য চলে যাবে করোনার বাজারে।
(৩) ভাতের ফ্যানের স্যুপ
গরম ভাতের ফ্যান পরিচ্ছন্ন জায়গায় রেখে দাও। গাজর, বিনস কুচি থাকলে ভালো না থাকলেও এই বাজারে ক্ষতি নেই। ক্যালরির কথা ভেবো না এখন। বাচ্চাদের জন্য খুব সুস্বাদু অথচ পুষ্টিকর। ডেকচির মধ্যে ফ্যান নিয়ে তার মধ্যে একটু মাখনে স্যতে করে নেওয়া পেঁয়াজ, রসুনকুচি দিয়ে ফুটতে দেওয়া। তারপরেই নুন, সামান্য চিনি, গোল মরিচ। একটা ডিম ভেঙে এগড্রপ করে তাক লাগিয়ে দিলেও মন্দ হবে না। এবার চিকেন সেদ্ধ থাকলে ছুটতে থাকবে এই স্যুপ। চিকেন দিলে একটু সয়া স্যস আর ট্যোম্যাটো কেচাপ দিলেই মাত!

(৪) খোসা স্টার ফ্রাই
করোনার বাজারে কিছুই যাবে না ফেলা। অতএব সব খোসা বাঁচিয়ে, জমিয়ে রাখ ধুয়ে নিয়ে কৌটো করে ফ্রিজের এক কোণায়। খোসা দিয়ে স্টার ফ্রাই এক অভিনব রুড ফুড অফ বেঙ্গল। (‘রুড ফুড’ জন্য কথাটির আমার পাঠঋণঃ ফুড কলামনিস্ট বীর সাংভি) খোসা যদি স্টার ফ্রাইতে কাজে লাগানো হয় তবে একটু মোটা করে স্ক্রেপ করা ভালো। এবার সব খোসায় একটু নুন, লঙ্কাগুড়ো, বেসন, আটা ছড়িয়ে ভালো করে মেখে তেলের মধ্যে ঢাকাচাপা দিয়ে ভাজা অনেকক্ষণ ধরে। এর মধ্যে একটু পোস্ত দানা ছড়ালে দারুণ লাগবে কিন্তু। ভুললে চলবে না ছাঁকা তেলে এখন ডিপ ফ্রাই খাবার সময় নয়। শুধু ভাত ডালের কম্বো হিসেবে অসামান্য পুষ্টিকর এই স্টার ফ্রাই।
(৫) ডাল সেদ্ধ
ভাজা মুগ ডাল হলে সেদ্ধ করে সামান্য একটু জল দিয়ে এই বাজারে পাতলা করে নিয়ে তার মধ্যে সেদ্ধ করা আলু, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা লংকা আর নুন। তারপরে সুগন্ধি গাওয়া ঘি ছড়িয়ে নিলেই হল। মুশুর ডাল হলে জল দিয়ে সামান্য পাতলা করে নিয়ে নুন, কাঁচা পিঁয়াজ, লংকা কুচি আর সরষের তেল দিলেই দারুণ।
(৬) পোস্তবাটা উইথ সেদ্ধ পটল
কাঁচালংকা দিয়ে পোস্ত বাটা, নুন আর প্রেশারে সেদ্ধ করা, হালকা খোসা ছাড়ানো পটল একসঙ্গে সরষের তেল ছড়িয়ে রেখে দিলেই রেডি গরম ভাতের সঙ্গে।
(৭) ডিম পোস্ত
ডিম সেদ্ধ করে গায়ে দাগ দিয়ে রাখতে হবে আর প্রতিটি ডিমের জন্য এক চামচ পোস্ত কাঁচা লংকা দিয়ে বেটে রাখতে হবে। আলু আর পেঁয়াজ লম্বা করে কেটে নিয়ে কড়াইতে সরষের তেল দিয়ে আলু পেঁয়াজ ভেজে নিতে হবে। এবার ডিম, পোস্তবাটা, নুন, কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলু সেদ্ধ হলেই ওপর থেকে সামান্য কাঁচা সরষের তেল ছড়ালেই ব্যাস!
(৮) স্ক্র্যাম্বলড ডিমের বাটিচ্চচড়ি
সরষের তেল দিয়ে পেঁয়াজ ভাঁজতে হবে। তার মধ্যেই ঝিরি ঝিরি কাটা আলু। এবার ডিম ফাটিয়ে তার মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। এবার ওপর থেকেই নুন, হলুদ, লংকাগুঁড়ো । পুরো ডিম ঘেঁটে দেবে না। বেশ বড় বড় অংশ থাকবে। এবার ফুটে উঠলে আলু সেদ্ধ হলেই কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামিয়ে নিলেই হল। এভাবে রাঁধা দুটো ডিম, একটা বড় আলু, একটা বড় পেঁয়াজে তিনজন ভালোভাবে খেতে পারেন করোনা যুগে। বেশি খরচা না করে।
(৯) বড়ি বেগুনের ঝাল
কয়েকটি হিং দেওয়া কলাইডালের বড়ি ছাঁকা তেলে ভেজে তুলে রেখে সেই তেলেই পাঁচফোড়ন দিয়ে কাটা আলু, সজনে ডাঁটা আর বরবটি, নুন দিয়ে নাড়াচাড়া করে জল দিতে হবে। হলুদ দিয়ে জল ফুটলেই বেগুনের টুকরো আর বড়ি দিয়ে চাপা দিতে হবে। ফুটে উঠলেই লংকাগুঁড়ো ছড়িয়ে মাখামাখা হলে দু’একটা বড়ি ভেঙে দিতে হবে। সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে। বড়ি বেশি দিলে রান্নার খুব তার হয়।
(১০) ঝালের ঝোল
আগেকার বঙ্গবিধবাদের খাদ্যতালিকায় থাকত এই নিরামিষ ঝোলটি। আলু, পটল, ফুলকপি, বেগুন, ঝিঙে সব লম্বা লম্বা করে কেটে নিয়ে সরষের তেলে নেড়ে নিতে হবে। এবার নুন, হলুদ দিয়ে ফুটে সেদ্ধ হলে সামান্য কাঁচা লংকা, সর্ষে বাটা, লঙ্কা গুঁড়ো, মিষ্টি । অন্য কড়াইতে ঘিয়ের মধ্যে পাঁচ ফোড়ন, শুকনো লংকা দিয়ে ঢেলে দাও সেই ঝোল তার মধ্যে। এক হাতা দুধ ছড়াও। ফুটলে নামিয়ে নেওয়া। গরমকালের এই ঝোলে নুন মিষ্টি দেওয়া, করা করে ভাজা মটরডালের বড়া দিলে দারুণ লাগে।
(১১) পেঁপের শুক্তো
ঝিরিঝিরি করে পেঁপে কেটে ভাপিয়ে নাও। আলু, ঝিঙে, উচ্ছে, সজনে ডাঁটা সব কেটে নাও শুক্তোয় যেমন কাটে আর কী। বড়ি ভেজে রাখ। এবার উচ্ছে বাদে সব আনাজ সেদ্ধ পেঁপের মধ্যে দিয়ে আবার সেদ্ধ কর নুন দিয়ে। তারপর মিষ্টি। সামান্য আদা গ্রেট করে তার মধ্যে আটা গুলে রাখো দুধ দিয়ে। পোস্তবাটা দু’চামচ মেশাও সেই মিশ্রণে। এবার ঘিয়ে পাঁচফোড়ন, তেজপাতা দিয়ে ঢেলে দাও সেদ্ধ আনাজের মধ্যে। তেলের মধ্যে মুচমুচে করে ভাজা উচ্ছে ছড়িয়ে দাও এই মাখামাখা শুক্তোর ওপর। আরেকটু ঘি দেওয়াই যায় কারণ শুরুতে উচ্ছে ভাজা ছাড়া আর তেল লাগেনি কোথাও।
(১২) ঘরোয়া থুকপা
আমার থুকপা ঘরোয়া এবং পেট ভরা। গাজর, বিনস, বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম ফাইন করে কুচিয়ে শুধু গাজর, বিনস নুন দিয়ে ভাপিয়ে নাও ভাতের ফ্যানের মধ্যে। সেদ্ধ চিকেন থাকলে ভালো। না থাকলেও ক্ষতি নেই। এবার এক চামচ মাখনে একটা ছোট পেঁয়াজ, ছ’কোয়া রসুনকুচি, কাচালংকা কুচি দিয়ে বেশ করে ভেজে নাও। ভাজার সময় দাও ম্যাগির মশলা বা ম্যাগি কিউব। এবার সেটা ঢেলে দাও সেদ্ধ সবজির মিশ্রণে। ফুটে উঠলে ম্যাগি দাও তার মধ্যে। এবার ডিম ফাটিয়ে এগ ড্রপের মতো নাড়তে থাক। গোলমরিচ, সামান্য চিনি দাও। এবার নামানোর আগে বাঁধাকপি আর ক্যাপসিকাম কুচি। ইচ্ছেমত সয়া সস, চিলি স্যস, টাবাসকো ছড়িয়ে গরম গরম খাও এই স্যুপি নুডলস। পেট, মন দুই ভরবে এই কমপ্লিট মিলে।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
জিভে জল মনে বল ?
কি ভরসা যে জোগালে।প্রতিটি রান্না সহজ অথচ পুষ্টিকর