২৬ আগস্ট কলকাতা বেতারের জন্মদিন। সেই উপলক্ষেই বাংলালাইভের এই সংখ্যা আর তার জন্যই আমার লিখতে বসা। ১৯২৭-এর ২৬ আগস্ট থেকে শুরু হয় কলকাতা বেতারের অবিচ্ছিন্ন সম্প্রচার। তবে তার বুনিয়াদ গড়ে ওঠার পটভূমিকাটিও অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও চিত্তাকর্ষক। সে কথাই আজ বলব বলে স্থির করেছি।
বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে কলকাতায় সর্বপ্রথম সফলভাবে বেতার সম্প্রচার করেন। পরবর্তীকালে ১৯১২ সালে ভারতের সমুদ্র উপকূলে পাহারারত ব্রিটিশ নেভিগেশন কোম্পানির নৌবহরকে বেতার-যন্ত্রে সুসজ্জিত করে তুলতে কলকাতার হেস্টিংস স্ট্রিটে একটি অফিস খোলে মার্কনি কোম্পানি। সেটি আবার ১৯১৮-তে স্থানান্তরিত হয় কলকাতা হাইকোর্টের কাছাকাছি টেম্পল চেম্বার্সে, যার অধিকর্তা হন জে আর স্টেপলটন।

কলকাতায় সাময়িক ভাবে বেতার অনুষ্ঠানের প্রাথমিক সূচনা ঘটে ১৯২৩-এর নভেম্বরে সদ্য-গঠিত ‘রেডিয়ো ক্লাব অব বেঙ্গল’-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে। তারপর ১৯২৫ -এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক ডঃ শিশির কুমার মিত্র পদার্থবিদ্যা বিভাগের ঘরে ট্রান্সমিটার বসিয়ে ওয়্যারলেসে কথিকা, গান, আবৃত্তি সম্প্রচার শুরু করেন। সেই সম্প্রচারে উদ্বোধনী গান গেয়েছিলেন হীরেন্দ্রকুমার বসু, আর গানটি ছিল ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে…’।
১৯২৬ থেকে ১৯২৭-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত বেতারের যন্ত্র ও হেডফোন বিক্রির উদ্দেশ্যে চালু হয় খুদে রেডিয়ো স্টেশন। প্রাত্যহিক দু’ঘন্টার সান্ধ্য অধিবেশনে ইউরোপীয় প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জে আর স্টেপলটন, ভারতীয় প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে অমরকৃষ্ণ বসু। মুম্বইয়ের সেই সময়ের কয়েকজন ব্যবসায়ী ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন। ভারতে এই কোম্পানি গঠন করেন সুবিখ্যাত পারসি ব্যবসায়ী এফ এম চিনয়। জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে নিয়ে আসা হয় বিবিসিতে কর্মরত ই সি ডানস্টনকে। ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯২৬-এর ১৩ সেপ্টেম্বর।

ওই বছরই ভারতে বেতার সম্প্রচারের বাণিজ্যিক সাফল্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য বিবিসির প্রতিনিধি হিসেবে আসেন সি সি ওয়ালিক। কলকাতার টেম্পল চেম্বার বিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চতলে একটি বেতার ট্রান্সমিশন স্টুডিয়ো গড়ে তোলেন তিনিও। কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত, নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিশিষ্ট শিল্পীরা। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সেই হীরেন্দ্রকুমার বসু।
১৯২৭-এর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার কাশীপুর অঞ্চলে, টালা পার্কের গায়ে বেশ খানিকটা জায়গা মাসিক আড়াইশো টাকায় পাঁচ বছরের লিজ নেওয়া হয় বেতার সম্প্রচারের প্রয়োজনীয় ট্রান্সমিটার বসাতে। কলকাতায় স্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করতে ওই বছরই জুলাই মাসে ডালহৌসি স্কোয়্যারের পশ্চিমে, নির্জন পরিবেশে ১, গারস্টিন প্লেসের পুরনো বাড়িটির দোতলা ও তিনতলা পাঁচ বছরের লিজে ভাড়া নেওয়া হয় মাসিক আটশো টাকায়। (পরবর্তীকালে ভাড়া নেওয়া হয় সে বাড়ির তিনটি তলাই।)

১৯২৭ -এর ২৩ জুলাই ওই কোম্পানির বোম্বাই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন ভাইসরয় লর্ড আরউইন। স্টেশন ডিরেক্টর হন এল বি পেইজ। ২৩ জুলাই তারিখটি বর্তমানে ‘ভারতে সংগঠিত বেতার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দিন’ হিসেবে পালিত হয়। তার আগে ১৫ জুলাই মুম্বইয়ের ওরলি থেকে প্রকাশনা শুরু হয় ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির ইংরেজি মুখপত্র ‘ইন্ডিয়ান রেডিয়ো টাইমস’–এর।
কলকাতায় ১ গারস্টিন প্লেসের বাড়িতে ১৯২৭ -এর ২৬ অগস্ট ভারতের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্রটির উদ্বোধন হয়। দ্বারোদঘাটন করেন গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন সুলতান চিনয়। স্টেশন ডিরেক্টর নিযুক্ত হন সি সি ওয়ালিক এবং ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালক, বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। ঘোষণা ও সংবাদপাঠের জন্য নিযুক্ত হন ১৯১১-র আইএফএ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগানের হাফব্যাক্ রাজেন্দ্রনাথ সেন। তারপর ওই একই বছর, কলকাতা বেতারে একে একে যোগ দেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু, নলিনীকান্ত সরকার, বেহালার জমিদার-তনয় বীরেন রায় প্রমুখ। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২৮-এর শেষের দিকে ‘চিত্রা সংসদ’-এর সদস্য হয়ে যোগ দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার), বিজন বসু প্রমুখ গুণী ব্যক্তিরা। পঙ্কজকুমার মল্লিক অবশ্য কর্মী হিসেবে নয়, যোগ দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী হিসেবে।

‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’স্মৃতিগ্রন্থে নলিনীকান্ত সরকার লিখেছেন – “উদ্বোধন দিবসে কলকাতা স্টুডিয়োতে অংশগ্রহণ করলেন রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুপ্রসিদ্ধ কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, বিখ্যাত গায়িকা আঙুরবালা, প্রসিদ্ধ অন্ধগায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, প্রখ্যাত ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার, মধুরকণ্ঠী প্রফুল্ল বালা, সুরসিক সংগীতশিল্পী সিতাংশুজ্যোতি মজুমদার (বকু বাবু), প্রসিদ্ধ তবলাবাদক রাইচাঁদ বড়াল আর ১৯১১ সালের আই এফ এ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগান ক্লাবের অনতিক্রমনীয় হাফব্যাক রাজেন্দ্রনাথ সেন।” সে বছরেই নভেম্বর মাসে গঠিত হয় ‘বেতার নাটুকে দল’। ওই দলের সর্বপ্রথম নাটক অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘জমাখরচ’, ১৯২৮-এর ১৭ জানুয়ারি বেতারস্থ হয়। বেতার নাট্যরূপ দেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। প্রধানচরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি।
এদিকে, স্টেশন ডিরেক্টর সি সি ওয়ালিক কিছুদিনের মধ্যেই বিবিসি ফিরে গেলে, ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতা কেন্দ্রের পার্ট টাইম ডিরেক্টর হয়ে আসেন মার্কনি কোম্পানির কলকাতা অফিসের বড়ো সাহেব জে আর স্টেপলটন। স্টেশন এঞ্জিনিয়ার হন সুধীন্দ্রনাথ রায়। ১৯২৯-এর গোড়ার দিক থেকেই কলকাতার বেতার সম্প্রচারে আসে নানান বৈচিত্র্য। স্টুডেন্টস আওয়ার ফর কলেজ বয়েজ, চিলড্রেন কর্নার, তিন ঘণ্টার নাটক, ফুটবল, ক্রিকেট, জলসা ইত্যাদির রিলে, সংগীত শিক্ষার আসর, লেডিজ কর্নার বা মহিলা মজলিশ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের সূচনা এই সময়েই। ‘মহিলা মজলিশ’-এর পরিচালক ‘বিষ্ণুশর্মা’,‘সবিনয় নিবেদন’-এর উপস্থাপক ‘মেঘদূত’এবং ‘লাউডস্পিকার’ছদ্মনামের আড়ালের ব্যক্তিটি ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

প্রাথমিকভাবে ‘সংগীত শিক্ষার আসর’পরিচালনা করেন পর্যায়ক্রমে কৃষ্ণচন্দ্র দে, রাইচাঁদ বড়াল, তুলসি লাহিড়ি ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। অবশেষে পঙ্কজকুমার মল্লিকই এই দায়িত্ব পালন করেন প্রায় দীর্ঘ ৪২-৪৩ বছর। ১৯২৯ -এর জুন থেকে ‘ছোটদের বৈঠক’-এর সূচনা। প্রবর্তনায় ‘গল্পদাদা’ ছদ্মনামের আড়ালে ছিলেন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট যোগেশচন্দ্র বসু।
১৯৩০-এর ১ এপ্রিল বিবিসির প্রধান জন রীথের উপদেশ মতো ভারতীয় বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থা পরীক্ষামূলক ভাবে চলে আসে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। নতুন নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। তবে ১৯৩১ সালের ৯ অক্টোবর ভারত সরকার, ‘ইঞ্চকেপ’ কমিটির নির্দেশ মতো, ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৩ নভেম্বর দিল্লি থেকে কলকাতা বেতারে নির্দেশ আসে যাবতীয় কর্মসূচি বন্ধ করে দেবার। তবে ওই মাসেই কলেজ স্ট্রিটের একটি রেডিয়ো দোকানের মালিক মণীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতার স্টুডিয়ো, ট্রান্সমিটার ইত্যাদি নগদমূল্যে কিনে নিতে উদ্যোগী হল। নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারকে নিয়ে তিনি দেখা করেন সাংবাদিক তুষারকান্তি ঘোষের সঙ্গে।

আইনত ওই প্রস্তাবে অসম্মত হওয়া কঠিন ভেবে বেতার পরিচালন দফতরের ভারপ্রাপ্ত স্যার জোসেফ ভোর, লাটসাহেবকে বোঝালেন, প্রচারধর্মী এই প্রতিষ্ঠানটি হাতছাড়া করা কোনওমতেই যুক্তিযুক্ত হবে না। ব্রিটিশ সরকার সাময়িকভাবে রেডিয়ো চালাবার সিদ্ধান্ত নেন। পাকাপাকিভাবে সরকারি পরিচালনায় বেতার সম্প্রচার চালু রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯৩২-এর ৫ মে। নতুন উৎসাহে নতুন ধারার অনুষ্ঠান প্রণয়নে ব্রতী হন বেতার কর্মীরা।

কলকাতা বেতারের অনুষ্ঠানসূচি জ্ঞাপক পাক্ষিক পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’ প্রথম প্রকাশ হয় ১৯২৯ -এর ২৭ সেপ্টেম্বর। নামকরণ করেন বীরেন রায়। সম্পাদনার দায়িত্ব পান সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তার বছর দুয়েক পরে তিনি নবগঠিত ‘নিউ থিয়েটার্স’ -এ চলে গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন নলিনীকান্ত সরকার।

তেরো বছরেরও বেশি ওই পদে ছিলেন নলিনীকান্ত। তাঁর সম্পাদনা কালেই বিশেষ বিশেষ সংখ্যার পাশাপাশি ১৯৩৭ থেকে প্রথম প্রকাশিত হতে থাকে ‘বেতার জগৎ’ -এর শারদসংখ্যা। অনুষ্ঠানের আগাম খবর ছাড়াও ‘বেতার জগৎ’ -এ মুদ্রিত হত প্রচালিত কথিকা, গল্প, সাক্ষাৎকার, সমীক্ষা, স্বরলিপি, শ্রোতাদের চিঠিপত্র ইত্যাদি। অবশ্য তখন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ছাপা হত ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালকের নাম, পরে স্টেশন ডিরেক্টরের নাম। পৃথকভাবে প্রকৃত সম্পাদকের নাম মুদ্রিত হতে থাকে তারও পরে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে। যাঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য – গণেশচন্দ্র চক্রবর্তী, পি বি রায়, অনিল বরন গঙ্গোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ রায়, সুভাষ বসু, অসীম সোম প্রমুখ। কিন্তু হায়, বেতারপ্রেমী অগণিত শ্রোতা ও পাঠকের অনুরাগ তুচ্ছ করে ‘বেতার জগৎ’ -এর প্রকাশনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৬ -এর জানুয়ারি, দ্বিতীয় পক্ষের পরে পরেই।
১৯৩২-এর শারদীয় উৎসবের সূচনায় মহাষষ্ঠীর প্রভাতে যে ‘প্রত্যূষ প্রোগ্রামের’উন্মেষ, পঙ্কজকুমার মল্লিকের পরিচালনায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র ও গ্রন্থনাপাঠে সমৃদ্ধ বাণীকুমার বিরচিত সেই অনুষ্ঠানটি পরবর্তি কালে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’শিরোনামে খ্যাত হয় এবং ক্রমে তার সম্প্রচার মহালয়া তিথিতে সুনির্দিষ্ট হওয়ায় লোকমুখে অনুষ্ঠানটি ওই নামেই সমার্থক হয়ে ওঠে। এটি বাণীকুমারেরই লেখা ‘বসন্তেশ্বরী’চম্পূর পরিবর্তিত রূপ। সেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’বিশ্বের সম্প্রচার ইতিহাসে আজ তুলনারহিত। ১৯৭৬-এ এই অনুষ্ঠানটির পরিবর্তে ধ্যানেশ নারায়ন চক্রবর্তী রচিত ‘দেবীং দূর্গতিহারিনীম্’আলেখ্যটি সম্প্রচারিত হলেও পরের বছর থেকে আবার ফিরিয়ে আনতে হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কেই।

১৯৩৪-এর শুরুতেই ব্রিটিশ সরকার দিল্লিতে ভারতের তৃতীয় বেতারকেন্দ্রটি স্থাপন করেন। ১৯৩৫-এর ৩০ অগস্ট ভারতীয় বেতারের প্রথম ‘কন্ট্রোলার অব ব্রডকাস্টিং’ পদে কার্যভার গ্রহণ করেন বিবিসির লায়োনেল ফিলডেন। ১৯৩৬-এর ১ জানুয়ারি দিল্লি কেন্দ্র গণ্য হয় বেতার সম্প্রচারের সদর দফতর হিসেবে। ফিলডেনের উদ্যোগে সে বছরেরই ৮ জুন ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং’কোম্পানির নাম হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’। ফিলডেন, তখনকার ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোকে বোঝান যে, সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘অল ইন্ডিয়া’কথাটি জুড়ে দেওয়া যথাযথ। এছাড়া AIR এবং ‘Air’–এ দু’টি শব্দের ব্যঞ্জনাও এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই নামকরণের সঙ্গেই বেতার সম্প্রচারে আরও প্রাধান্য পায় তথ্য পরিবেশনা, শিক্ষা, বিনোদন ও উন্নয়ন এবং তার সমস্যা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর দিকটি। ১৯৩৭-এর ৩ মে অশোককুমার সেন কলকাতা কেন্দ্রে যোগ দেন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে। কলকাতা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলিতে বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠায় এই মানুষটির ভূমিকা চিরস্মরণীয়। তার প্রধানতম উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাষট্টিতম জন্মদিনে ১৯৩৭-এর ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতা বেতারে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘শরৎশর্বরী’র কথা। এতে যোগ দেন নরেন্দ্র দেব, রাধারানি দেবী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দাদা ঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত প্রমুখ শুভার্থী। তাঁদের স্মৃতিচারণ এবং কথাসাহিত্যিকের আন্তরিক একটি ভাষণ শ্রোতাদের বিমোহিত করে।

ওই বছরই ২৫ নভেম্বর কলকাতা কেন্দ্রের সান্ধ্য অধিবেশনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বেতার অনুষ্ঠান শোনার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আর, ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ অর্থাৎ ১৯৩৮-এর ৮ মে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিম্পঙের ‘গৌরীপুর লজ’ থেকে সরাসরি শ্রোতাদের উদ্দেশে আবৃত্তি করে শোনান তাঁর সদ্য লেখা কবিতা – ‘জন্মদিন’। অনুষ্ঠানটি এক যোগে প্রচারিত হয় কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, লখনউ, লাহোর ও পেশোয়ার কেন্দ্র থেকে। সে বছরের ১৬ অগস্ট কলকাতা বেতারের শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারের শক্তি বাড়িয়ে ১০ কিলোওয়াট করা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের একটি আশীর্বাণী ‘বেতার জগৎ’-এ প্রকাশের ইচ্ছেয় নলিনীকান্ত সরকার, সংগীত বিভাগের সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে সোজা শান্তিনিকেতন যান। উদ্দেশ্য, কবিকে অনুরোধ জানাবেন।
কবিগুরু তখন ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে কিছু লিখে না দিলেও ক’দিন পরেই শিরোনাম-বিহীন একটি কবিতা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটি – ‘ধরার আঙিনা হতে ঐ শোনো উঠিল আকাশবাণী’– আজ ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। কারণ এ কবিতার প্রথম ছত্রেই কলকাতা বেতারের নতুন নামের বীজ সুপ্ত হয়েছিল। ‘আকাশবাণী’ অভিধাটি অশোককুমার সেনের মনে আলোড়ন তোলে। কাশীরাম দাসের মহাভারতে এবং সুকুমার রায়ের নিবন্ধে অবশ্য ‘আকাশবাণী’ শব্দটির উল্লেখ ছিল। সুকুমার তো বেতার সম্প্রচার অর্থেই কথাটি ব্যবহার করেছিলেন, যদিও কলকাতায় তখনও বেতার সম্প্রচার শুরুই হয়নি। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।

১৯৩৯-এর মে মাসে রবীন্দ্রনাথ পুরীতে থাকাকালীন তাঁর কন্ঠে কিছু গান ও আবৃত্তি সেখানকার সার্কিট হাউস থেকে রেকর্ড করে আনেন অশোককুমার সেন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মনোমোহন ঘোষ (চিত্রগুপ্ত) এবং এঞ্জিনিয়ার প্রমোদকুমার দেব। সেই সম্পদ পরবর্তীকালে ডিস্ক রেকর্ডে প্রকাশের অনুমতি দেন বেতার কর্তৃপক্ষ। সে বছরই ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধ ঘোষণার পর ভারতীয় বেতারের সবকটি স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষার সংবাদ পরিবেশনার দায়ভার চলে যায় দিল্লি কেন্দ্রে। বাংলা সংবাদের জন্য কলকাতা থেকে দিল্লি যান রাজেন সেন ও বিজন বসু।
অক্টোবরে কলকাতা বেতারের সঙ্গে প্রোগ্রাম-ভিত্তিক চুক্তিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২৮-এর এপ্রিল থেকে নজরুল ছিলেন কলকাতা বেতারের তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী। তবে নজরুল মিউজিক কম্পোজার হিসেবে যোগদানের আগেই ১৯৩৬-এ কলকাতা বেতারের সংগীত প্রযোজনার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী এবং ‘যন্ত্রীসংঘ-এর প্রধান হিসেবে সুরেন্দ্রলাল দাস। একের পর এক বিভিন্ন গীতি আলেখ্য শ্রোতাদের উপহার দিতে থাকেন এঁরা। অনুসন্ধিৎসুরা সে বিষয়ের তথ্যাবলি জানেন।

১৯৪০ সালের ১ মার্চ অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সঙ্গীতানুষ্ঠানে নিষিদ্ধ হয় হারমোনিয়াম বাজানো। এর আগে ওই বছর জানুয়ারি মাসে অশোককুমার সেনকে চিঠি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা গান বেতারে প্রচারে আপত্তি জানান মূলত হারমোনিয়ামের কারণে। কন্ট্রোলার লায়োনেল ফিলডেনেরও অপছন্দের ছিল এই বাদ্যযন্ত্রটি। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি পৌঁছনোর দেড়মাসের মধ্যেই তিনি সবকটি বেতার কেন্দ্রে হারমোনিয়াম বর্জনের নির্দেশ দেন। পরবর্তী প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল ভারতীয় বেতারে।
এর পরের বছরটি ছিল বাঙালির কাছে শোকের। ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট (১৩৪৮, ২২ শ্রাবণ) রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ। কলকাতা বেতারে এর চার দিন আগে থেকেই কবির শারীরিক অবস্থার কথা বারবার ঘোষণা হতে থাকে। ৬ অগস্ট প্রতি ঘণ্টায় সেই ঘোষণা করা হয়। ৭ অগস্ট সকাল আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত পনেরো মিনিট অন্তর চলে ঘোষণা। অবশেষে দুঃসংবাদ ইন্দ্রপতনের। অতঃপর রাজপথে শবানুগমনের শোভাযাত্রার, ও শ্রাবণসন্ধ্যায় নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ধারাবিবরণীতে আপ্লুত হয়ে পড়েন আবালবৃদ্ধবনিতা সকল শ্রোতা। ওই দিন বেতারের সান্ধ্য অধিবেশনে কাজী নজরুল ইসলাম আবৃত্তি করেন সদ্যরচিত ‘রবিহারা’ কবিতাটি, এবং ইলা ঘোষ ও চিত্ত রায়কে সঙ্গে নিয়ে গেয়ে শোনান ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’গানটি।
এবার চলে আসি ১৯৪৭-এ। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ১৪ অগস্ট রাত এগারোটায় কলকাতা বেতারে প্রাসংগিক কথিকা ও কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নেন অমল হোম, সজনীকান্ত দাস, প্রবোধ কুমার সান্যাল, নিরঞ্জন মজুমদার প্রমুখ। আর মধ্যরাতে ভারতের সব ক’টি বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারিত হয় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি থেকে জওহরলাল নেহেরুর ভাষণ – Tryst with Destiny.স্বাধীন ভারতে তখন ৬টি বেতার কেন্দ্র – দিল্লি, কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ, লখনউ ও তিরুচিরাপল্লি। এছাড়া কম শক্তিসম্পন্ন বেতার কেন্দ্র ছিল – মহীশুর, ত্রিবান্দ্রম, হায়দরাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ ও বরোদা। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল কলকাতায় চালু হয় ‘রিজিওনাল নিউজ ইউনিট’বা ‘আঞ্চলিক সংবাদ বিভাগ’। ওই বছর থেকেই বিভিন্ন বেতারকেন্দ্রে চুক্তির ভিত্তিতে প্রযোজক নেবার ব্যবস্থা হয়।
দু’তিন বছরের মধ্যেই একে একে কলকাতা কেন্দ্রে যোগ দেন সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংগীত জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। নাট্য প্রযোজক হিসেবে আসেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তার আগে নাট্য উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মন্মথ রায়। সাহিত্য শলাহকার হিসেবে আসেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর মেয়াদ শেষ হলে আসেন পুলিনবিহারী সেন। লঘু সংগীতের প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সহকারী প্রযোজক গোপাল দাশগুপ্ত। ‘রম্যগীতি’-র সূচনাও ওই সময়েই। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন ভি জি যোগ। সাহিত্যবাসর ও কথিকা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন লীলা মজুমদার (১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত)।

এই প্রসঙ্গেই বলি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কথা। ১৯২৮ সালের শেষদিকে রেলের চাকরি ছেড়ে তিনি বেতারে যোগ দেন। নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের সহকারী হিসেবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মূলত দেখভাল করতেন সাহিত্য ও নাট্যবিভাগের কাজ। কিন্তু আদপে সামলাতেন সবকিছুই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। কলকাতা বেতারের গোড়াপত্তনটি সুদৃঢ় হতে পেরেছিল যেসব গুণীজনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁদের অন্যতম তো বটেই, বলা চলে প্রধানতমও। লাইভ ব্রডকাস্টের যুগ তখন। অনিবার্য কারণে অনুষ্ঠান প্রচারের মুহূর্তে হয়তো কেউ অনুপস্থিত – বিপত্তারণ বীরেন ভদ্র। কিন্তু বেতারের সরাসরি পাকা চাকরি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, তাঁর নামে উপরওয়ালার কান ভাঙানোর প্রতিবাদে। স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, শিল্পী মানুষের গোলামী আসে না।
পরবর্তীকালে তিনি ফের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন। ক্রমে নাট্য বিভাগের প্রযোজক হন। কত নাটকই না প্রযোজনা করেছেন তিনি – নিজস্ব নাটক, গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপ, অন্যের লেখা বেতার নাট্য। একদিকে ‘রূপ ও রঙ্গ’-এর আসরে ‘শ্রীবিরূপাক্ষ’ হিসেবে তাঁর অননুকরণীয় বাচন ভঙ্গিতে কৌতুকের মোড়কে তিনি সরব হয়েছেন সমাজের অসঙ্গতি, অবক্ষয়, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। আবার অন্যদিকে, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র গ্রন্থনাকার ও স্তোত্রপাঠক রূপে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র রচয়িতা বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য) এবং সংগীতকার পঙ্কজকুমার মল্লিক – এই ত্রিরত্ন পৃথিবীর বেতার সম্প্রচার-ইতিহাসে অতি সঙ্গত কারণেই আজ অমরত্বের দাবিদার।
আরও এক আশ্চর্য অথচ তুলনায় অনালোচিত শিল্পী ছিলেন বাণীকুমার। ‘মহিষাসুরমর্দিনী-তে যে অভিনব ভাষায় মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর কাহিনির সঙ্গে বাংলাভাষ্যের রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন তিনি, তার আবেদন অনায়াসে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার তথা ভারতের লাখো লাখো নিরক্ষর মানুষের কাছেও! সন্দেহ নেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’বাণীকুমারের মাষ্টারপিস। কিন্তু শুধুই কি তাই? তার আগে-পরেও অসংখ্য ‘বেতার বিচিত্রা’য় শ্রুতিমাধ্যমের আদর্শ স্ক্রিপ্ট রচনার উদাহরণ রেখেছেন তিনি। পার্বণ, পুরাণ, পুরাতত্ত্ব, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংগীত প্রভৃতি বিবিধ বিষয়বস্তুকে সর্বত্রগামী বেতার প্রচারের উপযোগী করে গড়ে তোলার মতো মগজের মেধা আর হৃদয়ের সুধার সম্মিলন ঘটেছিল তাঁর সৃজনশীলতায়। নাট্য প্রযোজনার আসনে যখন বসেছেন বাণীকুমার, নিজের লেখা ছাড়া গ্রহণ করেননি অন্য কারও স্ক্রিপ্ট। কলকাতা বেতারে সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিক গ্রন্থসমূহের একচেটিয়া নাট্যরূপদাতা ও প্রযোজক বলতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাণীকুমারের নাম।

বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, পরশুরাম – এঁদের কাহিনি নিয়ে বেতারনাট্য প্রযোজনার একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করেছিলেন তিনিই। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়েও বহু বেতার-নাটক নির্মাণ করেছেন। এমনকি, রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’, ‘ফাঁকি’, ‘পুরষ্কার’, ‘দেবতার গ্রাস’ প্রভৃতি কবিতাকেও বেতার নাট্যরূপ দিয়ে প্রচার করেছেন বাণীকুমার। সেগুলি শুনেছেন রবীন্দ্রনাথও! আরও একটি দুঃসাহসের কাজ করেছিলেন তিনি, যা ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েই থেকে গিয়েছে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে একদা নিষিদ্ধ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’উপন্যাসটির বেতারনাট্যরূপ প্রচার করেছিলেন ‘সন্তান’নাম দিয়ে। ভারতে স্বাধীনতা লাভের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রভাতী অধিবেশন শুরুর প্রারম্ভিক যে গীতি আলেখ্যাটি প্রচারিত হয় বাণীকুমারের প্রযোজনায় ও রচনায়, তার প্রথম গানের প্রথম পংক্তিটি ছিল – ‘তব কীর্তির কেতন উড়িছে অম্বরে অয়ি ভারতজননী’!
১৯৭৬-এর মহালয়ার ভোরে বিকল্প যে অনুষ্ঠানটি সংযোজিত হয়েছিল – সেই ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’-কে পরের বছরই পথ ছেড়ে দিতে হয়েছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে, আজও যা অব্যাহত। অথচ ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’-এর প্রস্তুতিতে আয়োজনের কার্পণ্য ছিল না কোনও। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গান গেয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পীরা এবং গ্রন্থনায় অন্যতম অংশগ্রহণকারী ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। তবু অনুষ্ঠানটি দাগ কাটতে পারেনি বিপুল শ্রোতৃগোষ্ঠীর হৃদয়ে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে অবিলম্বে ফিরিয়ে আনার দাবিতে উত্তাল হয় বাংলা। স্বমহিমায় ফের নিজের জায়গায় ফিরেও আসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’

এবার একটু পিছু ফিরি। ১৯৪৩-এর ১৫ আগস্ট ‘প্রথম বাঙালি মহিলা ঘোষিকা’হিসেবে কলকাতা বেতারে যোগ দেন ইন্দিরা দেবী। আর সেই বছরের ডিসেম্বরে আসেন নীলিমা সান্যাল, ইন্দু সাহা, সুনীল দাশগুপ্ত। ইন্দিরা দেবী ১৯৪৫-এর অগস্টে যে ‘শিশুমহল’ অনুষ্ঠান শুরু করেন, টানা ৩৭ বছর ধরে তার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওদিকে, ‘ছোটোদের বৈঠক’-এর প্রবর্তক ‘গল্পদাদা’ যোগেশচন্দ্র বসু ১৯৩৩-এর ১৭ নভেম্বর প্রয়াণের আগে দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভোগেন কয়েক বছর। সেই সময় থেকে এটি পরিচালনার ভার নেন তাঁরই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র কমল বসু। এরপর একে একে আরও অনেকেই এসেছেন এই আসর পরিচালনায় – তাঁদের মধ্যে বেলা হালদারও ছিলেন ‘মেজদিদি’ ছদ্মনামে। অবশেষে ১৯৪৩ -এ ‘দাদুমণি’ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় যখন এই অনুষ্ঠানের হাল ধরেন, তখন থেকেই ‘ছোটদের বৈঠক’-এর নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘গল্পদাদুর আসর’।

তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সপ্তাহে একদিন ‘মহিলা মজলিশ’ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন বেলা হালদার। কিন্তু ওই দশকের শেষের দিক থেকেই ‘মহিলা মজলিশ’-এর বরাদ্দ নির্ঘণ্ট সংক্ষিপ্ত হতে হতে একেক দিন এক একটি কথিকায় নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপর চল্লিশের দশকে শুরু হয় ‘মহিলা মহল’। পরিচালনায় পর্যায়ক্রমে আসেন মল্লিকা ঘোষ, নূরজাহান বেগ, মাধুরী বসু, রেখা দেবী, বেলা দে-র মতো বেতার ব্যক্তিত্ব। সংলাপ ও সংগীতে এঁদের সহযোগিতা করতেন নীলিমা সান্যাল। পরবর্তীকালে দিল্লির সংবাদপাঠিকা হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন তিনি। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে অজস্র বেতারনাট্যে নীলিমা সান্যাল ও জয়ন্ত চৌধুরীর তুখোড় অভিনয় মুগ্ধ করত শ্রোতাদের। ওদিকে ‘গল্পদাদুর আসর’-এর পরিচালক হিসেবেও খ্যাত হন জয়ন্ত চৌধুরী। ১৯৫৬ সালের ২৮ জুলাই শুরু হয় নাটকের জাতীয় অনুষ্ঠান। এই কার্যক্রমে বাংলার প্রথম নাটক গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘প্রফুল্ল’, এবং প্রথম গীতিনাট্য ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’।

১৯৫৭ থেকে কলকাতা বেতারে প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে বা ফেব্রুয়ারির গোড়ায় উদযাপিত হত ‘বেতারসপ্তাহ।’ এই ধারা চলেছিল ১৯৬২ পর্যন্ত। এই বছরই ২২ মার্চ ভারতের সংশোধিত পঞ্জিকা অনুসারে গণ্য হয় নতুন বর্ষ, এবং ১ এপ্রিল ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর’ নাম পাকাপাকি ভাবে বদলে রাখা হয় ‘আকাশবাণী’। এর আগে ১৯৩৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর মহীশূরের রাজার নিজস্ব একটি বেতার কেন্দ্র চালু হয়েছিল ‘আকাশবাণী’ নামে। প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৫৫ -য় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ব্যাঙ্গালোর’ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা হলে দেশীয় রাজার সেই বেসরকারি বেতার কেন্দ্রটি তারই অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু তার আগেও, ভারত স্বাধীন হবার পরে পরেই ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’য় অবরে-সবরে ‘আকাশবাণী’নাম-ও ঘোষণা করা হত। এমনকি মুদ্রিত হত ‘বেতার জগৎ’ এবং অনুষ্ঠানসূচিজ্ঞাপক অন্যান্য বেতার মুখপত্রেও।

১৯৫৫ -য় মহীশূরের আকাশবাণী অবলুপ্ত হওয়ায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’র অপর নাম ‘আকাশবাণী’ হতে আর কোনও আইনি বাধা রইল না। ১৯৫৭-এর ১ এপ্রিল থেকে সরকারি ভাবে ভারতীয় বেতার ‘অল ইণ্ডিয়া রেডিয়ো’ এবং ‘আকাশবাণী’- দু’টি নামেই পরিচিতি পেল। সংবিধান অনুযায়ী আমাদের এই দেশও যেমন পরিচিত ‘ভারত’ এবং ‘ইণ্ডিয়া’ নামে। পরের বছর ইংরেজি ‘দ্য ইণ্ডিয়ান লিসনার’ এবং হিন্দি ‘সারঙ্’ – সর্বভারতীয় বেতারসূচিজ্ঞাপক দু’টি মুখপত্রেরই নতুন নাম হল – ‘আকাশবাণী’।
১৯৫৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার বেতার কেন্দ্র ১, গারস্টিন প্লেস থেকে চলে এল ইডেন গার্ডেন্সের পাশে ‘আকাশবাণী ভবনে’। শুরু হল কলকাতা বেতারের নতুন অধ্যায়।
বিশেষ ঋণ – শ্রী অভীক চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতা বেতারে যোগ দেন ১৯৬৫তে। তারও আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীনই আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার। বেতারের কর্মজীবনে বিভিন্ন সময়ে 'সবিনয়ে নিবেদন'-এর উত্তরদাতা, 'গল্পদাদুর আসর'-এর পরিচালক এবং এফএম তরঙ্গের উপস্থাপক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে তাঁর ভূমিকা। নানা তথ্যে-সমৃদ্ধ তাঁর অনুষ্ঠান-পরিবেশনা এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেতারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা আকৃষ্ট করেছে সুধীজনকে। শ্রোতাদের চাহিদা পূরণে অবসরগ্রহণের পরেও টানা আট বছর এফএম-এ অনুষ্ঠান করেছেন।
khub tothyo somriddho lekha
অনেক অজানা তথ্য জানলাম, ঋদ্ধ হলাম।
লেখাটি পড়ে ভীষনভাবে আপ্লুত হলাম। অনেক অনেক তথ্যই জানতাম না এতদিন।
আকাশবাণীর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন প্রাক্তন কর্মী হিসেবে অত্যন্ত গৌরব অনুভব করি এই বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে জীবনের অতি বৃহৎ অধ্যায় কাটাতে পেরেছি ভেবে।
পরিশেষে একটি জিজ্ঞাসা, এই লেখাটি পরিচিত জনের সঙ্গে কীভাবে ভাগ করে নিতে পারি?
অনেক ধন্যবাদ।
যে কোনও সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডলে লেখাটির লিংক শেয়ার করতে পারেন আপনি। ধন্যবাদ।