ছোটবেলায় ধারণা ছিল ইলেকট্রিকাল কনডাকটার-এর আবিষ্কর্তা পাড়ার মিঠুদা। ওর দু’মহলা বাড়ির স্টোররুমের একটা দেওয়াল সারা বছর স্যাঁতস্যাঁতে। দেওয়ালের উপরের দিকে, এক কোণে একটা পেল্লায় মিটার বক্স। সেখান থেকে মোটা-সরু হরেক রকমের তার এদিক ওদিক হাঁটা লাগিয়েছে। একবার শাস্তিস্বরূপ বেচারা সন্তুকে কান ধরে দাঁড়াতে হয়েছিল ওই দেওয়ালের দিকে পিঠ করে। রাস্তায় বুলটিদির গলার আওয়াজে মিঠুদা একটু অন্যমনস্ক। সেই সুযোগে একটু রিল্যাক্স করবে বলে সন্তু দেওয়ালে হেলান দিল। তারপর ‘আআআআআআআ…’ ত্রাহিরব, পতন ও মূর্ছা। মিঠুদা বাবরি ঝাঁকিয়ে বলেছিল ‘পুরো দেওয়ালটাকে কনডাকটার বানিয়ে রেখেছি। আমার সঙ্গে চালাকি নয়।’
সেই থেকে বুঝলাম ভিজে বেড়াল আর ভেজা দেওয়ালে খুব একটা তফাত নেই। অনেক পরে জেনেছি ১৭২৯ সাল নাগাদ স্তিফেন গ্রে নামে এক সাহেব, যিনি একই সঙ্গে কাপড়ের রঙ এবং জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে ক্রিয়াকলাপ চালাতেন, কনডাকটার আর ইনসুলেটার আবিষ্কার করেন। এর জন্যে তাঁকে বিস্তর খাটাখাটনি করতে হয়েছিল। মিঠুদা গ্রে সাহেবের নাম শোনেনি সেটা হলপ করে বলতে পারি কিন্তু ইলেকট্রিক কনডাকটার এর মাহাত্ম্য ওর মত সহজ করে কেউ বোঝাতে পারে নি। অবিশ্যি নিন্দুকেরা বলে ও পাড়ার মধুবাবু আরও বড় বিজ্ঞানী। উনি তখন সদ্য কলেজে পড়াতে শুরু করেছেন, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নে মশগুল। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ওঁর গুরু বিশেষ এবং উনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে বেঞ্জামিনের চেয়ে অনেক ভাল ঘুড়ি ওড়ান। তাই নববধূ যখন সাহেবের এক্সপেরিমেন্ট গাঁজাখুরি বলে গাল পাড়লেন, মধুবাবু বেজায় আহত হলেন। তারপর চিলছাদ, সিল্ক এর পেটকাটি , পাটের দড়ি, তামার তার, সিল্কের ফিতে… মানে সাহেব যা ফর্দ করে গিয়েছেন সেই ১৭৫২ সালে, জোটালেন। শেষ পাতে গিন্নির শাড়ির আঁচলের গিঁট খুলে আলমারির চাবিগোছা নিয়ে ঝুলিয়ে দিলেন দড়ির প্রান্তে। হাতে লাটাই ধরিয়ে দিলেন। এ দিকে আকাশে মেঘ দেখে সুতো গোটাচ্ছে অন্য ছাদ।
মধুবাবু হাঁ করে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছেন। বৃষ্টি না নামলে পণ্ডশ্রম। যাওয়ার বেলায় একটা চাঁদিয়াল কী মনে করে একেবারে হাতের গোড়া থেকে লুটে নিল মধুবাবুর ঘুড়ি। আলমারির চাবিসমেত। মধুবাবু চোর চোর চীৎকার করে উঠলেন। গিন্নি হাসলেন না কাঁদলেন বোঝার আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। মধুবাবু জ্বরে পড়লেন। ঘোরের মধ্যে ওঁ ওঁ করছেন। সত্য ডাক্তার বললেন উনি ওহমস ল’ আওড়াচ্ছেন।
এই বেঞ্জামিন সাহেবের আর এক অবদান বিজলী দণ্ড। আগে পাড়ার সবচেয়ে উঁচু বাড়ির ছাদে একটি দু’টি লাগান থাকতো। এখন সব বাড়িই উঁচু হয়ে যাওয়ায় প্রত্যেক ছাদেই দেখতে পাওয়া যায়। প্রোমোটারের বানানো বাড়ি হলে তো কথাই নেই, একগুচ্ছ লাগিয়ে দেবে। ‘আমাদের সঙ্গে অন্যদের তুলনা করবেন না দাদা, ৫ টা কাঠি দিয়েছি।’ ‘আচ্ছা… কিন্তু বাজ পড়লে মাটিতে সিঁধোবে তো?’ ‘সেটা পড়লেই বুঝতে পারবেন। আর ঘর-ফর জ্বলে গেলে ইনশিওরেন্স আছে’।
ও দিকে কাজের মাসিকে বেঞ্জামিন পড়ানো হয়নি। উনি দুটি ডান্ডায় দড়ি টাঙিয়ে কাপড় শুকোতে দিয়েছেন। দাদা-বৌদি তারিফ করছেন। বাজ না পড়লে বাজকাঠির কী কাজ! একটা ভেঙে গিয়েছিল, পিক্লু ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে। হাতে নিয়ে শিবঠাকুর সেজেছে।

ছোটবেলায় কোনও কিছুরই মানে বোঝা যায় না। বড়রাও বোঝাতে চান না। তাই কখনও কনডাকটার হয়েও নিজেকে ভেবেছি ইনসুলেটার, আবার কখনও উলটোটা। বাধ্য হয়ে ফিজিক্স বই হাতড়াই। এ বার জলের মত পরিষ্কার। কনডাকটর হল সেই বস্তু যার ঘাড়ে ভোল্টেজ চাপালে ইলেকট্রন পড়ি কি মরি করে এই অ্যাটম থেকে ওই অ্যাটম লাফিয়ে বেড়ায়। ফুচাই ওর প্রেমিকাকে এই কথাই বোঝাতে গিয়েছিল। মানে বসন্তের হাই ভোলটেজে ওর হৃদয়ের ইলেকট্রন ছিটকে বেরতে চাইছে। সপাটে চড়। ফুচাই জানল ইলেকট্রিক শক কাকে বলে। ওই এক শকেই ও ইনসুলেটার হয়ে গেল।
ছাদের ঘটনার পর মধুবাবুও ইনসুলেটার হয়ে যাবেন ভেবেছিলেন কিন্তু খাঁটি ইনসুলেটার যে অবাস্তব, সে কথা সাহেবরাই বলে গেছেন। আর সাহেবদের কথা যে ধ্রুব সত্য সে তো আমরা জন্ম থেকেই জানি। মধুবাবুর তিন কন্যাসন্তান কে নিয়েও চিন্তা। কী কুক্ষণে (ডাক) নাম রেখেছিলেন রূপা, তামা ও সোনা। হাইলি কন্ডাক্টিং। বাড়ির পরিবেশ আয়োনাইজড। একটু এদিক ওদিক হলেই স্পার্ক মারছে। এ দিকে আজ আবার রূপার হবু শ্বশুর আসছেন চা খেতে। রূপা নিজেই একটি ইনসুলেটার পছন্দ করেছে। বাবাকে বলেছে দিনকাল বদলেছে। এখন ফ্রি ইলেকট্রন এর জামানা। তাই ছেলের বাপ আসবে মেয়ের বাপের কাছে।
হবু বেয়াই মেয়েদের নাম শুনেই হো হো। ‘করেছেন কি মশাই! আমার তিনটি ছেলে থাকলে নাম রাখতাম ইস্পাত, এলুমিনিয়াম আর লোহা – একমাত্র ছেলে তাই নাম রেখেছি ফুচাই।’ মধুবাবুর কান লাল হল কিন্তু রাগতে পারলেন না। বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হল।
ফুলশয্যার রাতে হঠাৎ ঝড়-জল। থেকে থেকে কড়কড় শব্দে বাজ পড়ছে। যারা দরজায় আড়ি পাতছিল, গুটি গুটি নিজেদের বিছানায়। মাঝরাতে আলো চলে গেল। কেবল ফল্ট বোধহয়। রূপা বলল ‘ঠিকমত আরথিং না করলে এই হয়।’ ফুচাই বলল, ‘উঁহু…রিস্ক না নিয়ে অনেক সময় নিজেরাই অফ করে দেয়।’ তারপর টর্চের আলোয় রূপার হাত ধরে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেল।
-‘কোথায় যাচ্ছি?’
-‘ছাদে।’
রূপা অবাক। ছাদে উঠে দেখল, ঠিক মাঝখানে একটা অদ্ভুতুড়ে বাক্স। ছোটবেলায় প্যাকিং বক্স দিয়ে বানানো বাড়ির মত। শুধু তফাৎ এই যে, চারদিক চকচকে একটা ধাতব পাত দিয়ে মোড়া।
ফুচাই বলল, ‘আজ রাতটা আমরা এই ঘরে কাটাবো।’
রূপা বলল, ‘বাজ পড়ে মরব তো!’
ফুচাই মুচকি হেসে বলল, ‘পাগল নাকি! সেই ১৮৩৬ থেকে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ফ্যারাডে সাহেব তো এই ঘরেই ছিলেন। অনেক কাকুতি মিনতি করে রাজি করিয়েছি। উনি তো কবেই প্রমাণ করেছেন – চার্জটা কনডাকটরের সারফেসে থাকে। ভিতরে ইলেকট্রিক ফিল্ড শূন্য।’
রূপা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘প্রথমটা সত্যি। দ্বিতীয়টা সত্যি কিনা ভিতরে গিয়ে দেখি। এসো।’
অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।
Beautifully written. A distinct feel of North Calcutta and our dear Tom Brown’s school days peeped through the lines. Keep writing ?
Lovely piece Anu! Glad to see you are back at it.