ছোটবেলা থেকেই যে আমি পান সিগারেটের দোকানে হত্যে দিয়ে দাঁড়াতাম, এ-কথা আমার পাড়ার সকলে জানত। পাড়া মানে তখন তো গড়িয়া। মোড় থেকে ব্রিজ পেরিয়ে বিশ-তিরিশ কদম হেঁটে বোসপাড়া। সে-ই আমার পাড়া, সে-ই আমার সাকিন, আমার ঘর, ছোট্টবেলা থেকে। ছোট জায়গায় যেমন হয়, দু’তিনশো মিটার হাঁটলেই এক একটা মোড়, তাদের নাম যায় বদলে বদলে। তেমনই, আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডাইনে হেঁটে আবার ডাইনে ঘুরলেই যে-মোড়, তার নাম ছিল তালতলা। কেন ছিল অবশ্য জানি না, এক কালে হয়তো অনেক তালগাছ থেকে থাকবে। কিন্তু আমার যখন বেশ ছোটবেলা, মানে সত্তরের শেষ হয়ে আশির দশকের গোড়া, তখন কোনও তালগাছ ওখানে দেখিনি। বরং একজন গম্ভীর বটগাছ দিব্যি জাঁকিয়ে জায়গা দখল করে বসে থাকতেন। অবশ্য তাঁকে সম্মান দেখিয়ে জায়গাটাকে বটতলা আখ্যা দেওয়া যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত, সে-কথা বড় হয়ে বুঝেছি।

তা, যা বলছিলাম। ওই সরুপানা রাস্তা দ্বিতীয়বার ডাইনে ঘুরে, একটু ‘উট চলেছে মুখটি তুলে’-র মতো উঁচু হয়ে ঠিক যেখানে তালতলার মোড়ে মিশেছে, সেই কোণায়, বাঁ হাতে, ভারি ঘুপচি এক দোকান ছিল। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, চারপাশের দোকানগুলোর কোনও না কোনও নাম থাকে। অমুক স্টোর্স, তমুক ভাণ্ডার, এইসব। কিন্তু এ-দোকানটার কোনও নাম ছিল না। সত্যি বলতে কী, নাম লেখাবার জায়গাটাই ছিল না এই দোকানের কপালে। এতই সে ঘুপচি। একদিকে জাঁদরেল মুদি দোকান, আর একদিকে সাইকেল আর বাইক সারানোর ঝমঝম গ্যারাজ। তার পাশে, কোনও রকমে শরণার্থী হয়ে নিজের সংকোচ জাহির করে যেন মুখ বাড়িয়েছিল এই দোকানঘর, যাকে নিয়ে আজকের গপ্পো।

সে ছিল পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। মেঝে থেকে কিছু হাত পর্যন্ত নড়বড়ে একখানা কাচের বাক্স। তাতে হরেক ব্র্যান্ডের সিগারেট রাখা। অবশ্য দামিগুলো নয়, আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়ায় সে সব আর কে-ই বা কিনবে। পাশাপাশি, বিখ্যাত বিড়ি কোম্পানির দু’চার প্যাকেট করে ভারি যত্নে সাজানো। বাক্সের মাথায় পানের সরঞ্জাম। ছোট থেকে দেখছি, মায়ের পানের নেশা। সত্যি বলতে কী, গালে পান দেওয়া অবস্থা ছাড়া মায়ের আসল মুখটা কেমন, সে আমি তখন খুব কমই দেখেছি। কিন্তু এই দোকান থেকে মায়ের পান আসত না। কেন না এখানে থাকত বাংলা পাতা কেবল। মিঠে পাতার খরিদ্দার পাড়ায় খুব কম। ওই আমার মায়ের মতো এক কি দু’জন। সেই বাংলা পাতা ডাঁই করে রাখা, তার উপরে ভেজা লাল কাপড়, আর একপাশে সুপুরি, খয়ের, চুন, চমনবাহার, কিমাম, জর্দা, এইসব।

দিনভর, দোকানের কাচের বাক্সের পিছনে, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন এক কাকু। তাঁর নাম জানিনি কখনও। দোকানদারদের ক’জনের নামই বা জানা হয়ে ওঠে আমাদের। জানিনি তাই। কাকু বলেই ডাকতাম তাঁকে। সত্যিই এক-মানুষ জায়গা থেকে থাকবে দোকানঘরের মধ্যে। তাতেও থাক থাক করে জিনিস রাখা। কোথাও লজেন্সের কৌটো, কোথাও স্থানীয় কারিগরের হাতে তৈরি খেলনা, প্লাস্টিকের। এইসব। সে সবেরও খদ্দের জুটে যেত ঠিক। আর এসবের মধ্যেই, কোনও রকমের নিজের ভারী চেহারাটা নিয়ে হাসিমুখে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতেন পানকাকু। মনে মনে তাঁকে ওই নামেই ডাকতাম আমি। বুকখোলা ফুলশার্ট পরতেন সব সময়, সরু গোঁফ ছিল, আর মাঝখান থেকে সিঁথি করা বেশ কায়দার বাবরি চুল। ও-ব্যাপারটা তখন খুব ফ্যাশনের ছিল বলেই হয়তো।

এখন কথা হচ্ছে, ওই দোকানে হত্যে দিয়ে আমি দাঁড়াতাম কেন? যাতায়াতের পথে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনছেন, পসন্দমাফিক পান বানিয়ে নিচ্ছেন কেউ, দু’একজন এমনি জটলা করে গল্প করছে, আর দোকানের ধারের লোহার রড থেকে নেমে আসা নারকেল-দড়ির মুখে ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। এরই একপাশে আমি দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি পানকাকুর মহার্ঘ দোকানের দিকে।

কেন?

কেন না আমাদের গোটা পাড়ায় একমাত্র পানকাকুর দোকানেই পোস্টকার্ড বিক্রি হতো। যেমন তেমন পোস্টকার্ড নয়, যেটা কিনে চিঠি লিখে ফেললেই হল। সে তো গড়িয়া পোস্টাপিসে গেলেই গাদা গাদা পাওয়া যায়। এ হল স্পেশাল পোস্টকার্ড। চাইলে কি আর তাতেও চিঠি হয় না? হয়। পেছনে চিঠি আর নামধাম লেখার জায়গা আছে, স্ট্যাম্প সাঁটারও চৌখুপি আঁকা আছে। কিন্তু তাতে ভারি বয়েই গেছে আমার। আসল খেলা তো পোস্টকার্ডের এ পিঠে।

Old insignificant shops
দেখতে দেখতে এমন একখানা গ্যালারিতে গিয়ে বসতাম, যেখান থেকে এই সক্কলকার খেলা একসঙ্গে দেখা যায়। অলঙ্করণ – চিরঞ্জিৎ সামন্ত

হ্যাঁ, খেলাই বটে। ক্রিকেটারদের ছবি ছাপা পোস্টকার্ড বিক্রি করতেন পানকাকু। পোস্টকার্ডের ওই যে আয়তক্ষেত্র, তা জুড়ে থাকত কোনও না কোনও নামজাদা ক্রিকেট খেলোয়াড়ের ছবি। এ কোণা থেকে ও কোণা জুড়ে রঙিনে ছাপা। ছাপা যদি আজকের সঙ্গে তুলনা করি, তবে বলতে হবে নেহাতই কাঁচা মানের। রং কোথাও বেশি কোথাও কম, ধারাল নয় তেমন সবকিছু, কখনও ফেটে যাওয়াও বটে। কিন্তু ওই ছোট্ট বয়সে ছবি মানে ছবি! পানকাকুর দোকানের দু’পাশে খুলে দেওয়া টিনের দরজার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝুলত সেইসব পোস্টকার্ড, প্লাস্টিকের খাপে ভরা। আর খরিদ্দারদের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি হাঁ করে দেখতাম, ওই যে বোলিং অ্যাকশনের চূড়ান্ত মুহূর্তে মাটি থেকে দু’হাত উঠে পড়েছেন কপিল দেব, ওই তো, ফুলটস ছিল নির্ঘাত, পা ভাঁজের পর স্যুইপ করে হাসছেন ভিভিয়ান রিচার্ডস, এই যে, অসম্ভব একটা ক্যাচ ধরবার জন্য লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ছেন সৈয়দ কিরমানি, ওই যে, ফিল্ড সাজাতে গিয়ে কাকে যেন নির্দেশ দিচ্ছেন অ্যালান বর্ডার, ঝড়ের বেগে তীক্ষ্ণ চোখ নিয়ে ছুটে আসছেন ইমরান খান, ট্রোফি হাতে নিয়ে হাসছেন ঝকঝকে আর রোগা রবি শাস্ত্রী, পলক ফেলার আগে ছয় মেরে ব্যাট তুলে আছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ, উইকেট নেবার পর শূন্যে লাফিয়ে উঠেছেন ওই যে রিচার্ড হ্যাডলি, বিটুইন দ্য উইকেটস আড়াআড়ি ব্যাট হাতে নিয়ে ছুটছেন মরিয়া গাভাসকর… আরও কত নাম, আরও কত খেলোয়াড়, আরও কত তারকা।

আমি চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখতাম সক্কলকে। দেখতে দেখতে, এমন একখানা গ্যালারিতে গিয়ে বসতাম, যেখান থেকে এই সক্কলকার খেলা একসঙ্গে দেখা যায়। আমাদের বাড়িতে তখনও টিভি আসেনি। খেলা দেখতে হলে দোতলায় পিন্টুদা বুয়াদার বাড়ি যেতে হয়। মা আর বাবার গোপন আলোচনা মাঝেমধ্যে কানে আসে, টিভি কেনার ব্যাপারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত কিছু নেন না তাঁরা। তবে কিনলেও যে সাদা কালোই হবে, তা বুঝতে পারি বেশ। তাই রঙিন খেলোয়াড়দের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর এক আশ্চর্য সুযোগ আমাকে করে দিয়েছিলেন সদাহাসিমুখ এই পানকাকু। আমি যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম, খেয়াল করতেন তিনি সেটা। খদ্দের সামলে মাঝেমধ্যে জিগ্যেস করতেন, ‘কী? নেবে নাকি একটা?’

আমি আমতা আমতা করে দাম জিগ্যেস করলে বলতেন, ‘বেশি না, চার আনা। এক টাকায় চারটে।’ আমি ছুট দিতাম বাড়িতে। এক টাকা চাইবার সাহস তখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু আট আনা? আট আনা চাইলে কি পাওয়া যাবে না বাজার-ফেরত বাবা কিংবা গান-শিখিয়ে-ওঠা মায়ের কাছে? পেয়েও যেতাম কখনও। চার আনা, বা আট আনা। সেই কালচে ছোট্ট কয়েন তখন আমার কাছে সোনার মোহরের চেয়ে কম কিছু নয়। আর লাগাতাম ফিরতি ছুট, পানকাকুর দোকানের দিকে। এবার আমিও খদ্দের। রীতিমতো জাত্যাভিমান নিয়ে বড়োদের ভিড় ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলতাম, ‘কাকু, একটা রবি শাস্ত্রী দাও না।’

এইভাবে টুকটুক করে জমে উঠেছিল আমার নিজস্ব, গোপন ড্রেসিং রুম। যেখানে ইমরানের সঙ্গেই থাকতেন ডেভিড বুন, ইয়ান বথামের সঙ্গে গল্প করতেন ম্যালকম মার্শাল, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের পাশে দাঁড়াতেন মাইক গ্যাটিং। আমি স্কুল থেকে ফিরে সযত্নে ফাটল ধরা লাল মেঝের ওপর ছবিগুলো পাশাপাশি রাখতাম। রাখতাম, আর অপলক তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে। একদিন এর পাশে ও, একদিন তার পাশে সে। এগারোজন হলে পৃথিবীর সেরা ক্রিকেট টিমের মালিক হব আমি, ভাবতাম এমন।

আজ আর মনে পড়ে না, শেষমেশ ক’খানা পোস্টকার্ডের গর্বিত মজুতদার হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। কিন্তু মনে পড়ে, একখানা ছোট্ট চার আনা আমাকে কত ঐশ্বর্যবান বানিয়ে তুলতে পারত সহজেই। আজ আর পারে না। চার আনার দাম কমেছে, আমার বয়স বেড়েছে, ঐশ্বর্য তার সংজ্ঞা পাল্টে নিয়েছে মাঝপথে। হাতের মুঠোর চৌকোনা যন্ত্রটি থেকে যে-কোনও সময়ে যে-কোনও ছবি নামিয়ে নিয়ে জমিয়ে রাখতে পারি আমি, ক্ষমতা এতখানিই। কিন্তু দিনের পর দিন দূর থেকে তাকিয়ে থাকার পর একদিন রবি শাস্ত্রীর রঙিন ছবি হাতে পাওয়ার যে-আনন্দ, ভিভ রিচার্ডসকে বুকে চেপে ধরে বাড়ি নিয়ে যাবার যে-গর্ব, আজকের পৃথিবী তা আর ফিরিয়ে দিতে পারে না আমাকে।

যাই তো মাঝেমধ্যে আজও সে-পাড়ায়। নানা বাহানায় পৌঁছই। তালতলার মোড়ের ছোট্ট ঘুপচি দোকানটা বন্ধই দেখি। কে জানে, পানকাকু কেমন আছেন। পোস্টকার্ডে খেলোয়াড়দের ছবি তো বিক্রি হয় না আর নিশ্চয়ই। ছোটদের কোন রংয়ের স্বপ্ন এখন দেখান তিনি, জানা হয় না। জানা তো এও হয় না, ছোটরা আর এমন স্বপ্ন দ্যাখে কিনা! শুধু চোখের সামনে ছোট্ট দোকানটার বন্ধ ঝাঁপের বাইরে আমি এক অপেক্ষমান বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পাই, যে বাড়িতে অনেক বলেকয়ে চার আনা জোগাড় করে এনেছে। কিন্তু দোকানটা আর খুলছে না কিছুতেই…

Srijato

শ্রীজাত জাত-কবি। লেখা শুরু করেছিলেন নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি। ২০০৪-এ এসেই কাব্যগ্রন্থ 'উড়ন্ত সব জোকার'-এর জন্য আনন্দ পুরস্কার। গীতিকার হিসেবেও জনপ্রিয়তার শিখরে। পাওয়া হয়ে গিয়েছে ফিল্মফেয়ারও। ২০১৯-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে বই 'যে জ্যোৎস্না হরিণাতীত', গদ্যসংকলন 'যা কিছু আজ ব্যক্তিগত' এবং উপন্যাস 'যে কথা বলোনি আগে'। এ যাবৎ প্রকাশিত বাকি কাব্যগ্রন্থের তালিকা এপিকসদৃশ দীর্ঘ। ট্রোলিংয়ের তোয়াক্কা না-করেই ফেসবুকে নিয়মিত কবিতা লিখে পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পছন্দ করেন টেক স্যাভি কবি।

12 Responses

  1. ছোট বেলার কথা মনে করিয়ে দিলেন চিরঞ্জিত বাবু। আমরাও ছোট বেলায় এরকম কার্ড জমাতাম তবে সেগুলো ছিলো তখনকার সময়ের filmstar দের। মিঠুন চক্রবর্তী র fan ছিলাম। কত যে কার্ড জমিয়েছিলাম! কিন্তু গোপন বাক্সে লুকিয়ে রাখতে হতো মা য়ের ভয়ে। তখন সিনেমা মানে পেকে যাওয়া আর সেই পাকা মেয়েকে কেউ পছন্দ করতো না।

  2. শ্রীজাত র লেখায় যে আন্তরিকতা থাকে তা বিষয়বস্তুর মূল্য অনেক বাড়িয়ে দেয়.. সে কবিতা ই হোক বা গান বা গল্প.. বড় ভালো লাগলো.. ধন্যবাদ জানাই

  3. “দোকানটা আর খুলছে না কিছুতেই…”,
    বাইরে এক অপেক্ষমান বাচ্চা ছেলেকেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না !
    আশ্চর্য এক শিশুমনের অপেক্ষায় কতো যে সময় বয়ে যায় !
    খুবই সুন্দর অতীতদর্শন।

  4. হ্যাঁ আমরাও কিনেছি স্কুলের কাছে দোকানে,
    অনেকটা একই রকম অনুভূতি তবে শুধু খেলোয়াড়দের ছবি নয় সেইসঙ্গে ফিল্মস্টারদের ছবিও থাকতো তাও আমরা একটু বেশি বয়সে কিনেছি। সেগুলো সযত্নে যারা গুছিয়ে রাখত তখন তারা আমাদের কাছে বড় বড় লাইব্রেরীয়ান।

  5. ছোটবেলার এত বাঙ্ময় বর্ণনা, আপনার সৃজনশীলতা য় সম্ভব।
    অভিনন্দন আপনাকে আর আপনার এই সৃষ্টির উপস্থাপকদের ।

  6. খুব ভালো লাগলো। আশির দশকের শেষভাগে আমার পুত্রের কথা মনে পড়লো । সে জমাতো বিখ্যাত ফুটবলারদের ছবি দেওয়া ছোট ছোট কার্ড। আমার পৌত্রকেও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো স্বপ্ন দেখাবে কিছু, এই একবিংশ শতাব্দীর যান্ত্রিক যুগেও। দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *