গোছানো ব্যাপারটা ছোটদের অভিধানে থাকে না। থাকলেও তা দুষ্প্রাপ্য।
ওদের মুঠি তো আলগাই হয়।
শিশু ভোলানাথ হয়ে দিব্যি কলার তুলে ঘুরে বেড়ায় ওরা!
তাই ওদের জন্যে যখন লাল টুকটুকে, সাড়ে ন’ইঞ্চি বাই সাত ইঞ্চি সাইজের, বত্রিশ পাতার, অ্যালবামের মতো আড়াআড়ি বাঁধানো একটা বই তৈরি করা হল, তখন আপনা-আপনিই তার নাম হয়ে গেল ‘ছড়াছড়ি’। 

খিটিমিটি রাগ থেকে মিটিমিটি হাসি

শুরুতে কিন্ত এই ছড়ানো-ছিটোনো ব্যাপারটার জন্যেই শুরু হয়েছিল মৃদু খিটিমিটি।

‘ঘরে আর কোনও মানুষ থাকবে না, আর কেউ এসে বসতেও পারবে না তোমার এই বইপত্রের ঠ্যালায়… দেখো, ঘরের ভেতর কেঁচো- বিছের আখড়া হবে… এবার বাড়িতে কাউকে নেমন্তন্ন করে দ্যাখো, ঘর সাফ না-করলে আমি কিন্তু নন কোঅপারেশন-এ যাব!’
গৃহিনীর এই গজগজানি শুনতে শুনতে রজতবাবু সুপারঅ্যাক্টিভ হয়ে একদিন তাকেই আবার হাতেনাতে ধরে ফেললেন। এক ছুটির সকালে, ছাদের সিঁড়ির পাশে ডাঁই করা কিছু বইপত্র, একদিস্তে পুরনো ড্রয়িং খাতা এনে ধপ করে মেঝেয় রাখলেন।
— শুধু আমিই জিনিস জমাই, না! এগুলো তবে কী!
হাঁই-হাঁই করে ওঠেন গৃহিনী।
— এসব ফেলা যাবে না মোটেই! জন্মের পর থেকে ছেলেমেয়ের যত আঁকাআঁকি এখনও পর্যন্ত, সব এখানে জমেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনো পর্যন্ত সবই জমবে।
রুচিরা আর রঙ্গিত তখন ক্লাস সিক্স আর ফোর।

Kids
ছোটরা মহানন্দে ছড়া বলছে মঞ্চে। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

আর এরপরই শুরু হল মজা। মুখে আর কথা নেই কারওর।
সবাই মিলে মেঝেয় বসে পড়ে পুরনো আঁকাগুলো নিয়ে মজে গেল।
মেয়ে খুব ছোট থেকেই ছবি আঁকে পরিপাটি করে আর ছেলে প্রায় দু’বছর বয়স থেকেই মেঝেতে হাতেখড়ি করেছে। যাতে পারে আঁকে, যখন পারে আঁকে আর আঁকতে আঁকতে সেই আঁকার গল্পগুলো বলা তার অভ্যেস।
আমি হাতের কাজ সামলে যতখানি লিখে রাখতে পেরেছিলাম, সেগুলো থেকে গেছে আঁকাদের পাশে-পাশে ডায়েরির ফুটনোটের মতো। এইসব দেখতে দেখতেই কত্তা-গিন্নির মাথায় এল বইয়ের প্ল্যান। না হলে কতদিন আর এসব জমিয়ে রাখা যাবে!

ঠিক হল, একজনের আঁকা ছবি থাকবে, আর একজন তার সঙ্গে লিখবে ছড়া। যেমন, রঙ্গিতের ছোটবেলায় আঁকা কোনও ছবি দেখে ছড়া বানাবে রুচিরা। আবার কখনও দিদির এখনকার একটা ছড়া শুনে ছবি আঁকবে ভাই।
এরকম ভাবেই মায়ের ছড়ায় ছেলে, মেয়ের ছড়ায় বাবা, বাবার আঁকায় ছেলে, মায়ের আঁকায় মেয়ে–  এইভাবে পুরনো নতুনে মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়া লেখা হল কিম্বা ছড়া পড়ে তার ছবি আঁকা হল।
লোডশেডিংয়ের সন্ধেবেলায় চারজনে মুখে-মুখেও তো কত ছড়া বানানো হয়েছিল।
আবার ভাইবোনের ছোটবেলার অনেক ছবিতেই দু’জনের মেলানো মেশানো কাজ ছিল। কেউ হয়তো আঁকতে শুরু করেছে পেনসিল দিয়ে, অন্যজন তার রংটা ফিনিশ করল–  এইরকম। ঠিক হল, সেটাও সূচীপত্রে আলাদা করে উল্লেখ করে দেওয়া হবে। তাই সূচীপত্রটিও হল অনেকটা জিগ-স’ পাজ়ল এর মতো।

Kids
রঙ্গিত আর তার কথাবলা পুতুল চিম্পুর খেলা! ছবি – লেখকের সংগ্রহ

ছাপাই

আমরা  মা-বাবা হিসেবে লক্ষ করেছিলাম, সেই ২০১১-র আগের পঁচিশ-তিরিশ বছরে এখানকার ছোটদের জন্যে তৈরি হওয়া বইগুলো ঠিক যেন মন দিয়ে বা ভালোবেসে ছাপানো হচ্ছে না।
বাচ্চাদের জন্যে কেউই তেমন নিখুঁত করে বই বানানোর কথা ভাবছেন না।
প্রচ্ছদগুলো ঠিক মনের মতো নয়, পাতার মান খারাপ, ছাপার ভুল যত্রতত্র।
বাঁধানো বই হলে তা মাস খানেকের মধ্যেই সেলাই-টেলাই খুলে খুদেদের হাতের ছোঁয়ায় ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। 
একজন বাচ্চার হাতে সেই রকম একটি বই কদাচ তুলে দেওয়ার পরিস্থিতি এলে, আমাদের মনের ভেতরটা কাঁটা লাগার মতো খচখচ করত।

‘ছড়াছড়ি’ বাঁধানোর সময় খেয়াল রাখা হয়েছিল, যাতে ছোটরা ওটার যে কোনও পাতা পুরোপুরি খুলে, দু’পাশের দুটো পাতার ওপর দু’হাত রেখে বইটা পড়তে পারে। বানান ও লে-আউটের ব্যাপারে পালন করা হয়েছিল চূড়ান্ত সতর্কতা এবং এ ব্যাপারে ভ্রাতৃপ্রতিম তরুণ কবি সেলিম মল্লিক আমাদের অসম্ভব সাহায্য করেছিল।
আসলে, বইটা এইভাবে তৈরি করার একটা ভাবনা ছিল বলেই, কোনও নামকরা প্রকাশকের হাতে শুধু অর্থটুকু ধরে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। নিজেরাই দৌড়োদৌড়ি করে সব কিনেছিলাম। তৈরি করেছিলাম নিজেদের একটি আইনসম্মত প্রকাশনা।
আর এভাবেই ‘রুচিরঙ্গ’ প্রকাশনার জন্ম হয়েছিল রুচিরা আর রঙ্গিতের নামের দু’টো টুকরো জুড়ে দিয়ে।
একগাল হেসে সংস্থার প্রকাশক হলেন আমার ছেলে-মেয়ের মহা উৎসাহী ঠাকুমা–  মীরা মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু ওদের বাবা এতেও ঠিক সন্তুষ্ট হল না। ওর বক্তব্য ছিল, বইটা নিয়ে জমিয়ে কিছু একটা করতে হবে।

উদ্বোধন

১৮ ডিসেম্বর ২০১১ রোববার, সকাল ১১ টা থেকে ২টো, থিয়েটার রোডের বিখ্যাত মঞ্চ ‘কলামন্দির’-এর বেসমেন্টের অডিটোরিয়াম ‘কলাকুঞ্জ’ বুক করা হল ‘ছড়াছড়ি’ বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্যে। আত্মীয়বন্ধুদের নেমন্তন্ন করা হয়ে গেল। এবার চাই উদ্বোধক। অতিথি চাই।

Kids
ছড়াছড়ি প্রকাশ করছেন দেবাশীষ দেব (বাঁ দিকে) ও ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

সকলের প্রিয় চিত্রশিল্পী কার্টুনিস্ট দেবাশীষ দেবকে একবার বলেই দেখা যাক।
ওমা! তাঁর ছবির মতই দারুণ হৈ হৈ করা এই মানুষটি এককথায় রাজি। আর তাঁকে সংগত করতে রাজি হয়ে গেলেন প্রখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। কাজেকাজেই শুরু হয়ে গেল জোরকদমে প্রস্তুতি।

ঠিক হল একটা অভাবনীয় ব্যাপার করতে হবে। এটা এসেছিল রজতেন্দ্রর মগজে। সঙ্গে ছিল আমার আর এক বিখ্যাত ম্যাজেশিয়ান ভাই অ্যামেজিং ডেভিড। মঞ্চ সাজানো হল রঙিন বেলুন দিয়ে। ‘ছড়াছড়ি’র জন্মদিন কিনা! প্রথমে রঙ্গিত-রুচিরাকে আর তারপর ‘ছড়াছড়ি’ বইটাকে ডেভিডই ম্যাজিক করে মঞ্চে নিয়ে এসে উদ্বোধকদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
হল ভরে গিয়েছিল প্রাণখোলা হাততালিতে। 

যুগলবন্দি 

ছড়া আর ছবির এমন অভিনব যুগলবন্দির কথা কেউ কখনও শুনেছেন!
স্টেজের ওপর স্ট্যান্ডে আটকানো আর্টপেপারে দেবাশীষ দেব এঁকে চলেছেন একের পর এক অনবদ্য সব কার্টুন, যেই-না স্মৃতি থেকে একটা করে ছড়া কাটছেন ভবানীপ্রসাদ!
কানে শোনা আর হাতে আঁকা চলছে প্রায় সমান স্পিডে।
অনেক খুদে কুচোকাঁচা, তাদের মা-বাবা সুদ্ধু হাজির ছিল সেখানে।
সে এক হই হই হাসির কাণ্ড। জনা কুড়ির কুচোবাহিনীকে আগে থেকে ছড়া বলাবার জন্যে তালিম দিয়ে তৈরি করানোর দায়িত্বে ছিলাম আমি।
কাছে এনে বসিয়ে, দরকারে ফোনে-ফোনে শিখিয়ে পড়িয়ে, আমাদের বন্ধুদের আর নিজেদের পাড়ার একদল ছানাপোনাকে সবকটা ছড়া ভালোভাবে রেডি করানোর খুশিতে, নিজেকে মনে হচ্ছিল হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা।

রুচিরা তখন ম্যাজিক আর রঙ্গিত ‘কথা বলা পুতুল’ নিয়ে ভেন্ট্রিলোকুইজম করতে ভালবাসত। ওরা দুজনেই দেখিয়েছিল সেসব। বাচ্চারা তো সেসব দেখে নেচে-কুঁদে একশা। বড়রাও সেসব দেখেছিলেন ধৈর্য ধরে। সেদিনের অনুষ্ঠানের শেষ আকর্ষণ ছিল ম্যাজেশিয়ান অ্যামেজিং ডেভিডের আশ্চর্য ‘ম্যাজিক শো’। ডেভিডের প্রতিভার কোনও তুলনা নেই। সে সমস্ত দর্শকদের একসঙ্গে মিলিয়ে নিল নিজের ম্যাজিক শো-এ। 

Kids
মঞ্চে ছড়া পড়ছেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। আর তাল মিলিয়ে মজার ছবি এঁকে চলেছেন দেবাশীষ দেব। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

সবকিছু মহানন্দে মিটে গেলেও একটা ব্যাপার নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের কাছে দরবার করল রুচিরা আর রঙ্গিত।
ওরা এসে বলল, ‘শোনো না, আমাদের ক্লাসের বন্ধুরাও ছড়া লিখতে জানে, ছবি আঁকতে জানে। ওদের একটা করে বই করে দেওয়া যায়?’

সব বন্ধুর জন্যে আলাদা আলাদা বই–  শুনে আমি ঢোঁক গিলেছিলাম।
কথাটা শুনে ওদের বাবা জিগ্যেস করল, ‘তোমাদের এক-একজন বন্ধু কতগুলো করে ছড়া লিখেছে আর ছবি এঁকেছে?’
উত্তরে জানা গেল, কেউ দু’টো, কেউ তিনটে আবার কেউ একটা। এর বেশি নয়।
তাহলে এই ক’টা মাত্র ছড়া আর ছবি দিয়ে তো একটা গোটা বই করা যায় না। কিন্তু খুব সুন্দর একটা পত্রিকা বের করা যায়, যাতে ওদের সব বন্ধুরাই ছবি আঁকতে আর ছড়া লিখতে পারবে।
আর সেই পত্রিকায়, সবার এলোমেলো হয়ে থাকা কাজকে যত্ন করে সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে রুচিরা আর রঙ্গিত।
মোটামুটি এইরকমই ছিল আমাদের প্রোপোজাল।
ওরাও তাতে রাজি হল।
তখন আমরা চারজন বসে ঠিক করেছিলাম ওদের পত্রিকার নাম হবে ‘এলোমেলো’।

পিয়ালী বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রিকা এবং চড়ুইপত্রে গদ্য এবং পদ্য লিখে চলেছেন অনেকদিন ধরে। ছবি আঁকা তাঁর প্রতিদিনের যাপনের মধ্যে পড়ে। বই এবং পত্রপত্রিকায় প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণের কাজও খুব কম নয়। বেড়াতে বা ট্রেকিংয়ে গিয়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নোটখাতায় লেখা এবং ছবি আঁকার অভ্যেস কলেজজীবন থেকেই। ভূগোলের এই শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মাঠে-ঘাটে গাছ পুঁতে বেড়ান। প্রিয় শখ বইপড়া, সিনেমা দেখা।

6 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *