২০২০ সালের মাঝামাঝি, লকডাউন-কালে, কোভিডাতঙ্ক যখন তুঙ্গে, তখন সোশাল মিডিয়ায় নানারকম সচেতনতামূলক টেক্সট ও ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছিল। জমিয়ে রাখতে শুরু করেছিলাম শিশুদের নিয়ে তৈরি বেশ কয়েকটা ভিডিও। সেখানেই দেখেছিলাম বছর পাঁচেকের একটি ঝাঁকড়াচুলো কন্যে তার দাদুকে মন দিয়ে বোঝাচ্ছে– বাজারে যাচ্ছো যাও, কিন্তু মাস্ক আর গ্লাভস পরতে ভুলো না। স্ক্রিনের বাইরে থাকা দাদুর প্রশ্ন– কেন, এসব না পরলে কী হবে? ছানাটির চটজলদি জবাব– না পরলে করোনাভাইরাস ছোটো হয়ে নাক মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গুটগুটি পাকাবে, তারপর কাশি কাশি আর কাশি। পপুলার সায়েন্সের জয়যাত্রা শুরু হয় ঠিক এই জায়গাটা থেকেই। 

বাঙালিদের মধ্যে যতজন কবি, তার দশভাগের একভাগও যে বিজ্ঞানী নয় তা ফেসবুক খুললে দিব্যি বোঝা যায়। মায় কিছু বিজ্ঞান গবেষককে দেখেছি, নিজের পেশাগত কাজকর্ম বিষয়ে এক লাইনও না লিখে টাইমলাইনে কেবল নিজের লেখা ছড়া পোস্ট করে যেতে। তবে কিনা, বিজ্ঞান সচেতন হতে গেলে আদৌ বিজ্ঞানী হতে হয় না। এমনকি বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও চলে, ওপরের উদাহরণ থেকে তা স্পষ্ট হয়। ইদানীং গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পড়ুয়াকে জিজ্ঞেস করলেও বলে দিতে পারবে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটলে কেন পেটে কৃমি হয়। সমাজের কথা যদি ছেড়েও দিই, শুধুমাত্র নিজে ভালো থাকা এবং স্বার্থপরের মতো নিজের পরিবারটুকুকেই ভালো রাখার জন্য, প্রতিটি বাঙালির মধ্যে বিজ্ঞান সচেতনতা জরুরি, হালফিলে পড়া বই অণুবীক্ষণেসেকথা আরও একবার মনে করিয়ে দিল।

১৪৪ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ বইয়ে আঠেরোটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নিবন্ধ। প্রতিটির বিষয় বিজ্ঞান। তবে সায়েন্স জার্নাল কিংবা রিসার্চ পেপারে প্রকাশিত জ্ঞানগর্ভ সন্দর্ভ নয়। সাধারণের বোধগম্য ভাষায় লেখা ঝরঝরে আলোচনা। সূচিপত্রের বিষয়বৈচিত্র্যও পাতা উলটে দেখার প্রতি আগ্রহ জাগায়, কেননা প্রতিটি লেখার নামকরণ চমকপ্রদ। পপুলার সায়েন্সের তর্জমা করতে দাঁড়ায় জনগণের বিজ্ঞান, বা বলা যেতে পারে সর্বজনগ্রাহ্য বিজ্ঞান। এবং তা নিয়ে গদ্য লেখার বেশকিছু নিয়মাবলি আছে বৈকি। 

অভিজিৎ চক্রবর্তী সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী। দীর্ঘ তিন দশক কাটিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে। কাজ করে এসেছেন বাল্টিমোরের দ্য জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতেও। চাইলে তাঁর লেখার প্ল্যাটফর্ম সীমাবদ্ধ থাকতেই পারত দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে। তা থাকেনি, কেননা শ্রীচক্রবর্তী আমাদের পূর্বসুরী বিজ্ঞানী শ্রী জগদীশচন্দ্র বসু কিংবা শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতোই বিশ্বাস করেছেন, নিজের ঘরের পাশে আরশিনগরের মানুষগুলোকে বিজ্ঞানমুখী করা জরুরি।

Bacteria and Virus
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়ার আলোচনা যেন দাঁতভাঙা না হয়ে যায়

জনগণের বিজ্ঞানের ঘোষিত চর্চা শুরু হয় ইওরোপে, উনিশ শতকের প্রথমদিকে। ১৮৫৯-এ প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের লেখা অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’ থেকে ২০১১ সালে নোয়া হারারির লেখা হিব্রু ভাষায় প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত ও বহুচর্চিত স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড’ সবই জনগণের বিজ্ঞানধর্মী বই। বাংলায় জগদীশচন্দ্র বসুর অব্যক্ত’ কিংবা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাংলার কীটপতঙ্গ’ উল্লেখযোগ্য। ইদানিং চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিসরে কিছু জনগণের বিজ্ঞানমূলক বই লেখা হচ্ছে বটে, কিন্তু কোনওভাবেই সেসব সাহিত্যের আধারে বিজ্ঞানচর্চা হয়ে উঠছে না৷ কিছুটা হচ্ছে বাংলা মিডিয়াম ইশকুলের সহায়ক বই, বাকিটা চটজলদি ঘরোয়া চিকিৎসার হদিশ। 

জনগণের বিজ্ঞানধর্মী গদ্য লেখার সময়ে মাথায় রাখতে হয়, তা যেন কখনওই সিলেবাসের লেখা না হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়ার আলোচনা করতে গিয়ে তার দাঁতভাঙা নাম, ইনকিউবেশন পিরিয়ড, রোগের সংবহন ও লক্ষণ- এসবে পাঠক যেন কিছুতেই জর্জরিত না হয়ে যান। অণুবীক্ষণেবইয়ের প্রথম গদ্য হার্মাদ ই-কোলাই’ কিংবা ষষ্ঠ গদ্য পরজীবী হে, যাও রে ফিরে’ এ ধরনের বিষয় নিয়েই লেখা। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্প বলার আদলে, যা পড়লে, এমনকী বিজ্ঞানচর্চায় অনভ্যস্ত পাঠকেরও মনে হবে না যে, কঠিন কিছু পড়ছি।

শ্রীচক্রবর্তী যে কাব্য ও সঙ্গীতের অনুরাগী, বইটি পড়লে তা সহজে বোঝা যায়। ম্যালেরিয়াল প্যারাসাইট সংক্রান্ত লেখার শিরোনামে নজরুলের গান পরদেশি মেঘ যাও রে ফিরে-র অনুষঙ্গ অসামান্য লিখনশৈলীর পরিচয় দেয়। কিংবা শেষদিকে কোভিড ১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ও পৃথিবী জুড়ে তৈরি হওয়া তজ্জনিত ধন্দ বিষয়ে লেখা একটি নিবন্ধ, যার শিরোনাম গুগল গুগল আমায় বল, নম্বরে কে মেশায় জল’নিখুঁত মাত্রা ও অন্ত্যমিল সহযোগে লিখিত এই বাক্যটি খুব সহজে পাঠককে গোটা লেখাটি পড়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়। জনগণের বিজ্ঞানমূলক লেখার এগুলোও উল্লেখযোগ্য শর্ত– গদ্যের মধ্যে যেন উপমা ও অলংকারের প্রয়োগ থাকে। অর্থাৎ সহজ কথায়, বিজ্ঞানের বই যেন সাহিত্য গুণান্বিত হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখে। 

কোভিডের প্রসঙ্গই যখন এলো, তখন বলে নেওয়া ভালো, এ বইয়ের তিনটি গদ্য করোনাভাইরাস সংক্রান্ত৷ সারা বিশ্বের মিডিয়া যে সময়ে সাধারণ মানুষকে ত্রস্ত বা সন্ত্রস্ত করতে বদ্ধপরিকর, বিজ্ঞানী শ্রীচক্রবর্তী তখন লিখছেন, বিজ্ঞান গবেষণার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। 

“কোভিড-১৯ আগমনের বছরপূর্তিতে এবার যদি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের সাধারণ মানুষ জিজ্ঞেস করে বসে– তাহলে নতুন এবং মোদ্দা কথাটি দাঁড়াল কী? হোয়াট ইজ নিউ? সেই ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীর সময় থেকে যা শিখেছিলাম, আজ ১০২ বছর পরেও সেই লক ডাউন, দূরত্ববিধি, মাস্ক, সাবান আর স্যানিটাইজার। মাথা ব্যাথার ওষুধ যদি হাড়মুড়মুড়ির ব্যাধিতেও কাজ করে, তবে মাথার ঠিক নীচে কানের ব্যথাতেই বা কাজ করবে না কেন? এজিথ্রোমাইসিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা আইভারমেকটিন – এই তিনজনের একজনও কী অ্যান্টিভাইরাল? তবে কোভিডের চিকিৎসায় এঁদের কেন ব্যবহার করা হল?” 

বইয়ে আঠেরোটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নিবন্ধ। প্রতিটির বিষয় বিজ্ঞান। তবে সায়েন্স জার্নাল কিংবা রিসার্চ পেপারে প্রকাশিত জ্ঞানগর্ভ সন্দর্ভ নয়। সাধারণের বোধগম্য ভাষায় লেখা ঝরঝরে আলোচনা। সূচিপত্রের বিষয়বৈচিত্র্যও পাতা উলটে দেখার প্রতি আগ্রহ জাগায়, কেননা প্রতিটি লেখার নামকরণ চমকপ্রদ। পপুলার সায়েন্সের তর্জমা করতে দাঁড়ায় জনগণের বিজ্ঞান, বা বলা যেতে পারে সর্বজনগ্রাহ্য বিজ্ঞান। এবং তা নিয়ে গদ্য লেখার বেশকিছু নিয়মাবলি আছে বৈকি। 

অন্যত্র তিনি যুক্তিসহযোগে একথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেনজনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে এলেবেলে মনে করার পশ্চিমি উন্নাসিকতার ভিত্তি খুব কিছু নেই।” শ্রী চক্রবর্তী লিখছেন, ইতিপূর্বে একাধিক ভাইরাসের প্রকোপের ক্ষেত্রে বিশ্বের ইতিহাসে যেমনটা ঘটেছে, তেমনই এক্ষেত্রেও

আর কটা মাস কাটাতে পারলেই কোভিড১৯, কোভিড২১ হয়ে নিজেই তার ভয়ংকর সংক্রমণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।” সম্প্রতি ওমিক্রন স্ট্রেনের ক্ষেত্রে তো দেখাই যাচ্ছে, রুগির সাইন-সিম্পটম আর ততখানি ভয়ানক নয়। ধুম জ্বর বা শ্বাসকষ্টের বদলে ব্যাপারটা এসে দাঁড়িয়েছে গলা ব্যথা ও গা হাত পা ব্যথায়।”

এ বইয়ের বেশিরভাগ লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক। কিছু লেখা বিজ্ঞানী বিষয়কও। লেখাগুলি শ্রীচক্রবর্তীর তিন শিক্ষক, প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী সুনীল পোদ্দার, অসীমা চট্টোপাধ্যায় এবং ভারতরত্ন চিন্তামণি নাগেশ রামচন্দ্র রাও-দের কাজ সম্পর্কে, এবং লেখকের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠককে অবহিত করে। কিন্তু আবারও বলে নেওয়া ভালো, এই লেখাগুলো তথাকথিত জীবনী বর্ণনা নয়, অনেক বেশি আন্তরিক। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত চৈনিক মহিলা বিজ্ঞানী ইউ ইউ তু প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে শ্রীচক্রবর্তী উল্লেখ করতে ভুললেন না– “আজও মহিলা বিজ্ঞানীদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় নগণ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে চীন দেশের ইউ ইউ তু-র গবেষণার এই সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও বেশি কৃতিত্বের।” একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর এই জেন্ডার সেন্সিটিভিটি মহিলা পাঠক হিসেবে নিজেকে বিজ্ঞান ও সমাজ সচেতনতার পরিসরে অনেকখানি উন্নীত করে। 

Table of Content
বিষয়বৈচিত্রে বইটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ

কনটেন্টের নিরিখে অণুবীক্ষণে’ সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু প্রকাশনার বেশকিছু ক্ষমার অযোগ্য ত্রুটি বইটিকে তা হয়ে ওঠার পথে বাধা দিয়েছে। প্রত্যেকটি নিবন্ধে বানান ও যতিচিহ্নের ভুল (যা প্রুফ রিডারের সংশোধন করার কথা, লেখকের নয়) ভয়ানক চোখে লাগে। কোনও এক বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহার করার ফলে যুক্তাক্ষরগুলো কিম্ভূতাকৃতি ধারণ করেছে। পড়তে গেলে হোঁচট খেতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ প্রকাশকই বই ছাপার আগে সম্পাদককে দেখিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না সম্ভবত। করলে, এই বইয়ের লেখাগুলোকে শুধুমাত্র পত্রপত্রিকায় প্রকাশকালের ভিত্তিতে নয়, বিষয়ের ভিত্তিতেও সাজানো যেতে পারত। 

ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ তৈরি না করে ভালো শিল্পীকে দিয়ে প্রচ্ছদ নির্মাণ করা যেতে পারত। এ বই অবশ্য সংগ্রহযোগ্য৷ শুধু বিজ্ঞানপ্রেমী বা বিজ্ঞানকর্মীদের কাছে নয়, আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে, যাঁরা স্বাদু গদ্য পড়তে চান, যাঁরা পড়তে ভালোবাসেন। তাই আগামী মুদ্রণে ত্রুটিগুলো শুধরে দেওয়ার দাবি রইল।

গ্রন্থ: অণুবীক্ষণে
ডঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী
সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২১
বিনিময়: ২০০ টাকা (হার্ডকভার)

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক ও nbc news

বিহু পেশায় বহুজাতিক সংস্থার কর্মী। আদি নিবাস নদিয়া জেলার শান্তিপুর। কর্মসূত্রে আট বছর যাবৎ দেশের একাধিক শহরে ভ্রাম্যমাণ। সঙ্গী বলতে রঙিন মাফলার আর বেরঙিন ইনহেলার। গরিমা বলতে ঘরজোড়া বইপত্র ও একটি যুক্তাক্ষরবিহীন নাম৷ স্বপ্ন দেখেন একদা চাকরি ছেড়ে গ্লোবট্রটার হওয়ার।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *