‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ ছিল শচিন ভৌমিকের লেখা গল্প, আমার ডাবল রোল। বেইরুট থেকে ফিরে বম্বেতে শ্যুটিং হওয়ার কথা ওই ক্যাবারে দৃশ্যটার, যেখানে আশা ভোঁসলের প্লেব্যাকে আমি জ়ুবি জ়ুবি জালেবু গানটা গাইব। তার মধ্যে আম্মার দিল্লির বাড়িতে টাইগারের সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। আমি শ্যুটিংয়ে গিয়ে সে কথা জানাতেই, ওরেব্বাস, সে কি হৈচৈ! এবার আর আমাদের মেয়েকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই, ওর আঙুলে এনগেজমেন্টের আংটি উঠে গেছে!
ঠিক এতটাই পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সিনেমা শিল্প। যে সিনেমা নায়িকাকে বিকিনি পরিয়ে দেশে শোরগোল ফেলে দেবে, সেই সিনেমার নির্মাতারা ভাবনা-চিন্তায় এতটাই রক্ষণশীল। আমাদের যদি বিয়ে না-হত, টাইগারের সঙ্গে সম্পর্কটা যদি মাঝপথে ভেঙে যেত, তাহলে ইন্ডাস্ট্রিতে তখন আমার কী বদনামটাই হত, ভাবুন একবার। অথচ কোনও পুরুষ অভিনেতাকে এসব টেরও পেতে হয় না! এমনকি, ছবির নায়কের কাছ থেকে নায়িকা যে সব সময় প্রত্যাশিত সহযোগিতা বা সহমর্মিতা পায়, তা-ও কিন্তু নয়। সকলে অবশ্যই এক রকম হয় না, সব সম্পর্কও এক রকম হয় না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এক প্রান্তে যদি শশী কাপুরকে রাখি, তবে অন্য প্রান্তে থাকবে কাকা, মানে রাজেশ খান্না। সৌজন্যে বা সহযোগিতায় শশী যতটা তৎপর ছিল, কাকা ঠিক ততটাই উদাসীন। প্রত্যেক দিন দেরি করে শ্যুটিংয়ে আসা, নির্ধারিত সময়ের পরেও শ্যুটিং চালিয়ে যাওয়ার জন্যে চাপ দেওয়া – কাকার এসব ব্যাপার নিয়ে তখন চর্চাও হয়েছে অনেক। অথচ আমার সঙ্গে ‘আরাধনা’-ই (১৯৬৯) কাকার প্রথম সুপারহিট।

সময়ের সঙ্গে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেক কিছুই পাল্টেছে। আজ আছি, কাল নেই – আমাদের সময়ে এটাই ছিল চলচ্চিত্র ব্যবসার ধরন। সেখান থেকে অনেক সংগঠিত হয়েছে আজকের চলচ্চিত্র শিল্পের বিনিয়োগ। তার সঙ্গে যন্ত্র আর প্রযুক্তি যেমন পাল্টেছে, তেমনই পাল্টেছে সেটের ভেতরের পরিবেশ। এখনকার সেটে কাজ করা অনেক আরামের। আগের চেয়ে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা অভিনয় করতে আসছে। তারা বেশিরভাগই যেমন পরিশ্রমী, তেমন স্পষ্টবক্তা। শ্যুটিংয়ে আজকাল কেউই দেরি করে আসে না। পরিচালকরা একেবারে নতুন ধরনের এবং বেশ সংবেদনশীল গল্প বেছে নিচ্ছেন একের পর এক। এরকম বেশ কিছু ছবি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। ফলে সিনেমার গল্পের পরিচিত ধারা আমূল পাল্টে যাচ্ছে।

সমাজ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যে পরিসরটা দেয়, সেটাও অনেক বড় হয়েছে, উদার হয়েছে। মনে আছে একবার একটা গ্রামের মধ্যে একসঙ্গে শ্যুটিং করছি আমি আর শশীকলা। সেখানে টয়লেটের খুব অসুবিধে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই গ্রামের এক সম্পন্ন মানুষের বাড়ি। তাঁরা আমাকে খুব খাতির করলেন, কিন্তু ভ্যাম্পের চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে বিখ্যাত শশীকলাকে প্রায় ঢুকতেই দিতে চান না! আর এখন? এই তো সইফ ‘ওমকারা’-তে ভিলেনের রোল করল, তার পরেই ‘লাভ আজকাল’-এ হিরো। দু’টো রোলেই দেখলাম লোকে ওকে ভালোই নিল। প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকেও দেখলাম একটা ছবিতে ভ্যাম্পের রোল করতে। তাতে ওর নায়িকার ইমেজের একটুও ক্ষতি হয়নি। আমাদের সময় এটা ভাবাই যেত না। কিন্তু আসল কথাটা হল, এত রকম পরিবর্তনের পরেও চলচ্চিত্র শিল্পে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা-চিন্তার কাঠামোটা কি খুব একটা বদলেছে? বৈষম্য কি আর নেই? আহা, তাই যদি হত!
***
প্রথম আলাপ থেকেই টাইগার আর আমি একে অন্যকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছিলাম। আমাকে কী জন্যে পছন্দ হয়েছিল জানি না, কিন্তু ওর অনেক গুণের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল টাইগারের সেন্স অফ হিউমার, ওর অনবদ্য রসবোধ। কদিন আগে ব্যাঙ্গালোরে ফারুখ এঞ্জিনিয়র যেমন একটা গল্প শোনাল। কলকাতায় খেলা, টিম বাস যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দিয়ে যাচ্ছে, টাইগার বলল, ওই যে দেখছ, এটাও আমাদের একটা প্যালেস। শুনে ফারুখ বলেছিল, তাহলে তো এখানে একদিন চা খেতে আসা যায়। টাইগার গম্ভীর হয়ে বলেছিল, সে তো আসাই যায়, তবে কর্মচারিদের জ্বালাতন করতে ভালো লাগে না।

সাঙ্ঘাতিক ছিল টাইগারের প্র্যাকটিকাল জোক। ওর বাবা ইফতিখার আলি খানের নামে টাইগার একটা ট্রোফি চালু করেছিল, যেটা খেলতে ভোপালে এসেছিলেন বিজয় মঞ্জরেকর, বিষেন সিং বেদী, আবিদ আলির মতো বিখ্যাত সব ক্রিকেটাররা। টাইগার সবাইকে নিয়ে গেল ভোপাল থেকে একটু দূরে চিকলৌড়ে, যেখানে লেকের ধারে জঙ্গলের মধ্যে আমাদের একটা চমৎকার বাগানবাড়ি আছে। সেখানে সবাই যখন খুব মজা করছে, তখন কাজের লোকেদের ডাকাত সাজিয়ে অপহরণের একটা নাটক ফাঁদল টাইগার। জায়গাটা চম্বলের কাছাকাছি, তাই ডাকাতদের উপদ্রবটা সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল। ডাকাতরা এসে জানতে চাইল, এখানকার সর্দার কে? কাঁপতে কাঁপতে টাইগারকে দেখিয়ে দিল কেউ। টাইগার আবার সেদিন খুব মামুলি পোশাক পরে আছে। ডাকাতরা বলল, ইয়ে তো ফাটা কাপড়া পহনে হুয়ে হ্যায়। মানতেই চাইল না ওকে সর্দার বলে। বয়স আর পোশাক-আশাকের জৌলুস দেখে ওরা বিজয় মঞ্জরেকরকেই সর্দার সাব্যস্ত করে তুলে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ চেয়ে চিঠি পাঠাল। টাইগার সেটা দিয়ে দিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলেন মঞ্জরেকর। সবাই টাইগারকে খুব ধন্য ধন্য করল। কিন্তু এর মধ্যে তোলপাড় হয়ে গেছে। অতিথিদের কেউ টেলিফোনে বিজয় মঞ্জরেকরের বাড়িতে অপহরণের খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। পুজো পাঠ শুরু হয়ে গেছে তাঁর বাড়িতে! ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে বিষেন ছাড়া টাইগার আর কাউকেই বোধ হয় বলতে পারেনি যে পুরোটাই ছিল একটা সাজানো নাটক। জানতে পারলে মঞ্জরেকর কী করবেন, ভেবে সবাই চুপ। উনি মারা যাওয়ার পরই লোকে কথা বলতে শুরু করেছিল ব্যাপারটা নিয়ে।
আমি নিজেও পড়েছি টাইগারের এই রকম রসিকতার ফাঁদে। তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। টাইগার কাকে দিয়ে যেন খবর পাঠাল, লন্ডনে পাঁচটা রেফ্রিজারেটর কিনেছে আমার জন্যে। আমি তো অবাক। পাঁচটা রেফ্রিজারেটর! নিয়ে করব কী? রাখব কোথায়? মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। টাইগারকে ফোন করতেই বলল, ‘হাহাহা, ওটা তো রসিকতা। জোক করেছিলাম!’ একবার সম্পূর্ণ অচেনা একটা জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে, বিছানায় আবিষ্কার করলাম একটা কুমিরছানা। ভাবুন একবার, অবস্থাটা কী হয়। পরে বোঝা গেল ওটা জ্যান্ত নয়, স্টাফড। চলতেই থাকত এইরকম।
ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টিমের সঙ্গেও তখন অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তখনকার সঙ্গে আজকের অবস্থার কোনও তুলনাই হয় না। যে টেস্ট ম্যাচে টিকিটের হাহাকার চলছে, সেই ম্যাচের জন্যে তখন ক্রিকেটাররা পেত দিনে পঞ্চাশ টাকা। ধোপদুরস্ত সাদা পোশাকে মাঠে নামতে হবে। কিন্তু লন্ড্রি খরচ দিনে দশ টাকা। সবাইকে থাকতে হত ঘর শেয়ার করে। ক্যাপ্টেনকেও। বউ, বান্ধবী কাউকে হোটেলে আনার প্রশ্নই নেই।
১৯৬৭-র জানুয়ারিতে ইডেন গার্ডেনসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে সেই টেস্ট, যেখানে সেকেন্ড ডে-তে বেশি টিকিট না জাল টিকিট, কী সব গন্ডগোলে আগুন-টাগুন জ্বলে ভয়ঙ্কর ব্যাপার, খেলা বানচাল হয়ে যেতে বসেছিল! কী কান্ড করে এসেছিলাম সেই ম্যাচ দেখতে। তখন বম্বেতে ডাবল শিফটে কাজ করছি দু’টো ছবির। সকালে ‘দিল অওর মহব্বত’ (১৯৬৮), দুপুরে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে ’মেরে হমদম মেরে দোস্ত’ (১৯৬৮)। মহম্মদ রফির গাওয়া ‘ছলকায়ে যাম’ গানটার সঙ্গে কাজ করছি আমি আর ধর্মেন্দ্র, কিন্তু সন্ধের মধ্যে শ্যুটিং শেষ করা গেল না। পরের দিন বিকেলে আমার কলকাতার টিকিট কাটা। এদিকে ওরা বলছে, সেট বেশি দিন রেখে দেওয়া যাবে না। ধর্মেন্দ্রকে বললাম, উনি যদি একটু থেকে গিয়ে কাজটা শেষ করে দেন। ধর্মেন্দ্র বুঝলেন এবং অবিশ্বাস্য সৌজন্য আর ভদ্রতা দেখিয়ে রাজিও হলেন কাজটা সেদিনই শেষ করতে। শ্যুটিং চলল ভোর চারটে পর্যন্ত। আমি মেক-আপ তুলে সোজা চলে গেলাম অন্য ছবির সেটে। তার শ্যুটিং চলল দুপুর দুটো পর্যন্ত। তারপর ছুটে এয়ারপোর্ট, সাড়ে তিনটেয় কলকাতার ফ্লাইট। মনে আছে, সোবার্সের সঙ্গে তখন জোর রোমান্স চলছে অঞ্জু মহেন্দ্রুর।

ইংল্যান্ড ট্যুরেও গিয়েছিলাম সে বছরেই। লন্ডনের বাইরে গেলে থাকতাম টিম যখন যেখানে আছে তার কাছাকাছি কোনও হোটেলে। মাঠে যেতাম গাড়ি ভাড়া করে, টিম বাসের পেছন পেছন। দলের সবাই অবশ্য আমাকে বেশ ভালোভাবেই নিয়েছিল, সেখানে কোনও সমস্যা ছিল না। আমরা যখন ডার্বিশায়ারে, খবর এল ফারুখ এঞ্জিনিয়র বাবা হয়েছে। বোধ হয় সেই পার্টির জন্যেই, নাচ শিখিয়েছিলাম হনুমন্ত সিংকে। তবে টাইগার কোনও ক্যাচ মিস করলেই শুনতে হত, ‘নিশ্চয়ই ওকে ঘুমোতে দাওনি কাল রাতে!’ অথচ, ফার্স্ট টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিল যখন, কেউ বলেনি, তুমি এসেছ বলে এত ভালো খেলছে টাইগার। সেই জন্যে অনুষ্কা শর্মার অবস্থাটা আমি এখন খুব ভালো বুঝতে পারি। (চলবে)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।