কলকাতার অনেকে হিন্দি ছবিকে যেমন দূরছাই করেন, আমিও হয়তো শুরুর দিকে সেটা করেছি।
নিজেকে বলেছি এ-ই তো হিন্দি সিনেমা! এখানে কিছুদিন টাকা রোজগার করব, তারপর চলে যাব।
কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে শুধরে নিয়েছি। কাজ করেছি যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে।
প্রথম দিকে নাচ-টাচের দৃশ্যে খুব আড়ষ্ট লাগত। কিন্তু খানিকটা শিখেটিখে নেওয়ার পর ওই সব দৃশ্যে অভিনয় করাটাও উপভোগ করেছি।
প্রথমে তো সত্যিই ভেবেছিলাম, এসব পারব না। কলকাতায় ফিরে যাব।
কিন্তু ‘কাশ্মীর কি কলি’ খুব ভালো চলল। অনেকগুলো অফার এল।
তার মধ্যে যশ চোপড়ার ছবি ‘ওয়ক্ত’ (১৯৬৫) সাইন করলাম। সেখানে শশী কপুরই আমার হিরো।
ভাবলাম এটা করে নিই, তারপর আর আসছি না। কিন্তু শশী আর আমি দু’জনেই তখন প্রায় নতুন মুখ, অন্য নায়ক-নায়িকাদের তুলনায় খুব তরতাজা। অল্পবয়সীদের কাছে এই জুটিটা চট করে জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

তখনও কিন্তু কলকাতাই আমার ঠিকানা।
শ্যুটিংয়ের জন্যে বম্বে আসি। একাই থাকি তাজমহল হোটেল বা সান-এন-স্যান্ড বা ওই রকম কোথাও।
শ্যুটিং শেষ হলে আবার ফিরে যাই কলকাতায়। সেই সময়ের হিন্দি ছবির নায়িকারা কিন্তু কেউই এরকম করতেন না।
সেটের বাইরে আমার মতো সালোয়ার কামিজ না পরে তাঁরা শাড়ি পরতেন। থাকতেন মা বা অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে।
ইনডোর শ্যুটিং হলে তো কথাই নেই, আউটডোরেও শ্যাপেরন নিয়ে যেতেন নায়িকারা। সিগারেট খেতেন লুকিয়ে। অ্যালকোহল নিতেন কোকাকোলা মিশিয়ে, যাতে দেখে কেউ বুঝতে না পারে।
এদিকে আমি তো সিগারেট ধরেছি বম্বেতে কাজ শুরুর আগেই। এত দিন পর সেটা আর লুকিয়ে খেতে যাব কেন?
অ্যালকোহলও লুকোছাপা করে খেতে হবে কেন বুঝতে পারি না। কই, নায়কদের তো কিছু লুকোতে হয় না!
কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে সকলে সেটা ভালো চোখে দেখেন না।
এ কেমন মেয়ে? একা একা থাকে, সবার সামনে মদ খায়, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে?
এদিকে আমার পরিচয় ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা, অনায়াসে ইংরেজি বলে। তাই মুখের ওপর আবার কেউ কিছু বলতেও পারেন না। কিন্তু চালচলনটা বেশ সন্দেহজনকই লাগে অনেকের চোখে। সে সব কথার কিছু কিছু আমার কানেও পৌঁছয়। তবু, আড়াল খোঁজার মতো কোনও কারণ খুঁজে পাই না কিছুতেই।
কই, নায়কদের বেলায় তো কেউ এসব কথা কেউ বলে না!

এইরকম চলতে চলতেই হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ‘অনুপমা’-তে (১৯৬৬) কাজ শুরু করেছি। করেছি মোহন সেগলের ‘দেবর’ (১৯৬৬) আর বৃজের একটা ছবি ‘ইয়ে রাত ফির না আয়েগি’ (১৯৬৬), যার নায়ক ছিলেন বিশ্বজিৎ। এগুলো সবই ছিল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। শক্তিজি, মানে শক্তি সামন্ত আবার কাস্ট করলেন ‘শাওন কি ঘটা’-য় (১৯৬৬)। সেটা অবশ্য রঙিন ছবি। তিনিই একদিন বললেন, এরকম করে হবে না। তুমি বম্বেতেই চলে এস। বাড়িতে আলোচনা করে দেখলাম কথাটা যুক্তিযুক্ত। তখন তারদেও-তে অল্টামাউন্ট রোডে, যে পাড়ায় এখন মুকেশ আম্বানির বাড়ি, একটা বড়সড় ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। কয়েক বছর পরে তারদেওতেই কারমাইকেল রোডে টেরেস-সমেত একটা সুন্দর ফ্ল্যাট কিনে পাকাপাকিভাবে বম্বে-বাসী হলাম।
এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার ঘটে গেছে।
‘চারুলতা’-র (১৯৬৪) স্ক্রিপ্ট পাঠিয়েছিলেন মানিকদা।
কয়েক দিন পর তিনি নিজেই একদিন বললেন, না-আ-আ, চারুর চরিত্রের পক্ষে তোমার বয়সটা বড্ড কম হয়ে যাচ্ছে।
ঘটনাচক্রে হয়ে যাওয়া অভিনেত্রী ততদিনে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের ছবিতে অভিনয়ের জন্যে ব্যাকুল।
লাফিয়ে উঠে বললাম, “সে কি মানিকদা, আপনিই তো আমাকে দিয়ে ‘দেবী’-র দয়াময়ী করালেন!”
উনি বললেন, “সেটা তো অল্প বয়সেরই একটা চরিত্র। কিন্তু চারু হল সংসার সামলানো বৌ, খানিকটা হলেও গিন্নি ধরনের। ওই চরিত্রে তোমার লুকটা ঠিক মানাবে না।”

আমার কাকতি-মিনতি আর বিশেষ শুনলেন না।
চারুলতা চরিত্রে প্রথমে বাছাই হয়েও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেলাম।
দু-বছর পর মানিকদা আবার ডাকলেন ‘নায়ক’-এর (১৯৬৬) জন্যে। এবার কাজ করতে গিয়ে অনেকটা ভালো করে চিনলাম উত্তমকুমারকে।
তার আগে ‘শেষ অঙ্ক’-তে অভিনয় করেছি বটে একসঙ্গে, কিন্তু সেটা বলার মতো কিছু নয়।
চিনলাম এবার। “আমিই ইন্ডাস্ট্রি” বলাটা তখনও চালু হয়নি কলকাতায়, কিন্তু বুঝলাম অনেক দিন ধরে ইন্ডাস্ট্রির এক নম্বর স্টারের জায়গাটা কী করে ধরে রাখতে হয়।
প্রেমিকের ভূমিকায়, বন্ধুর ভূমিকায়, ভাইয়ের ভূমিকায়, ছেলের ভূমিকায় – যে চরিত্রেই অভিনয় করেছেন, নিজস্ব একটা ছাপ রেখে গিয়েছেন। আর দর্শককে নিজের সঙ্গে ধরে রাখতে পেরেছেন বছরের পর বছর।
‘নায়ক’-এ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দারুণ অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দমের পরিবর্তনটা দর্শকদের ধরিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতায়। বেশির ভাগ শটই একটা টেকে ওকে। উনি যেটা পারেন, সেটা অন্য সকলে পারেন না, এমনই ওঁর স্টার ভ্যাল্যু।

‘নায়ক’-এ অভিনয়ের পর অবশ্য উত্তমবাবুর অভিনয়ের ধরনে একটা বদল এসেছিল। কেটে কেটে সংলাপ বলাটা তখন থেকেই শুরু। টাইমিংটাও বদলে গিয়েছিল। ‘নায়ক’-এর শেষের দিকে সেই দৃশ্যটা, যেখানে ট্রেনের দরজাটা খোলা, ছুটন্ত ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে, অরিন্দম বেশ খানিকটা মদ্যপান করেছেন ততক্ষণে, টাইটা একটু নেমে এসেছে, ট্রেনের গার্ডকে ডেকে বলছেন, চোখে চশমা, এইখানে একটা পেন গোঁজা, চেয়ার কারে যে মহিলা বসে আছেন, মানে আমাকে ডেকে নিয়ে আসতে, সেটা মানিকদা ভেঙে ভেঙে সংলাপ বলে পুরো দৃশ্যটা অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। মানিকদার অভিনয় তো ছিল অসাধারণ! উত্তমবাবু যখন করলেন, তখন তার সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট হল, কিন্তু পুরোটা হল না। অভিনয়ের এই ধরনটা নিশ্চয়ই উত্তমবাবুকে ভাবিয়েছিল। ওটা তুলে ফেলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। কারণ, তারপর অনেক সময়েই আমি ওঁকে ওই ভেঙে ভেঙে সংলাপ বলতে দেখেছি।

আমাদের দু’জনকে নিয়ে শক্তি সামন্ত করেছিলেন তাঁর ডাবল ভার্সান ছবি ‘অমানুষ’ (১৯৭৫)। শ্যুটিং হয়েছিল সুন্দরবনে।
ওখানে তখন থাকার জায়গা বলতে কিছু ছিলই না। স্টিল্টের ওপর, মানে মোটা মোটা খুঁটি পুঁতে মাটি থেকে বেশ খানিকটা ওপরে ঘর তৈরি করে শক্তিজি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
মে মাসের ভয়ঙ্কর গরম, জেনারেটর চালিয়ে ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তাতে এসি-টেসি তো দূরের কথা, পাখাটাও এমন ঢিমে তালে চলে যে তার ব্লেড গোনা যায়।
ওই গরমেও মশারির মধ্যে শুতাম বাধ্য হয়ে। আর শুয়ে শুয়ে দেখতাম মাথার ওপর ইঁদুর দৌড়চ্ছে ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বাথরুমের সাবান খেয়ে নিত সেই সব ইঁদুর।
এমন গরম যে এবেলার খাবার ওবেলা পচে যেত। আর, খাবার বলতে তো শুধু ভাত, ডাল আর মাছ।
তরিতরকারি কিচ্ছু পাওয়া যেত না সেখানে। সবজি টবজি এনে রাখা যেত না নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
সকালে এক দফা শ্যুটিং হত। রোদ বাড়লেই সব বন্ধ। আবার রাতে এক দফা শ্যুটিং। জায়গাটা দুর্গম, কিন্তু খুব সুন্দর। শক্তিজি ব্যবস্থাও করেছিলেন যথাসাধ্য।

উত্তমবাবুর পরিচালনায় যখন ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ (১৯৮১) করছি, তখন একটা দৃশ্যে আমি আর মিঠুন পালিয়ে যাব। আমি সিনটা বুঝে নিয়ে করলাম আমার মতো।
সেটা ওঁর ঠিক পছন্দ হল না। আমাকে আলাদা ডেকে বোঝালেন চরিত্রটার মধ্যে তখন কী কী হচ্ছে।
বললেন, তুমি একটা নিশ্চিত নিরাপত্তা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছ। যাকে ভালোবাসো তার প্রতি টান থেকেই যাচ্ছ, কিন্তু একটা ভয়ও আছে। সেই অনিশ্চয়তাটা তোমার মধ্যে একটা টানাপোড়েন তৈরি করছে, তোমাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
এটা যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন, তাতে বুঝলাম উনি যে নেহাতই একজন স্টার, ডিরেকশন দিতে এসে খানিকটা ভুরু নাচিয়ে, খানিকটা হাত নেড়ে কাজ সেরে ফেললেন, তা মোটেই নয়। যথেষ্ট গভীরতা আছে ওঁর সিনেমা-বোধে।
উত্তমবাবুর পরিচালনায়, উত্তমবাবুর সঙ্গে কাজ করাটা বেশ ভালো লাগছে তখন।
এর মধ্যে সুপ্রিয়াদির সঙ্গে পরিচয়ও খানিকটা গভীর হয়েছে।
মাঝেমাঝেই উনি রান্না করে খাওয়ান, বাড়িতেও ডাকেন। খুবই ভালো লেগেছিল ওঁকে।
কিন্তু ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ করতে করতেই মারা গেলেন উত্তমকুমার। ওঁর জায়গায় ডাবল ব্যবহার করে ছবিটা কোনওমতে শেষ করা হয়েছিল।

বম্বেতেও তখন উত্তমকুমারের সঙ্গে ‘দুরিয়াঁ’ (১৯৮১) নামে একটা ছবিতে কাজ করছি আমি।
থিয়েটার অভিনেতা এবং অভিনেত্রী এক দম্পতির সমস্যার সিরিয়াস গল্প।
দেখতাম অনেক চুপচাপ হয়ে গেছেন। সেটে বিশেষ আড্ডা-টাড্ডা মারেন না। ভেবেছিলাম, কলকাতায় যেভাবে রাজার মত কাজ করেন, সেটা বম্বেতে পাচ্ছেন না বলেই হয়ত একটু গুটিয়ে আছেন।
শরীর যে এত খারাপ হয়ে গেছে, সেটা বুঝতেই পারিনি।
উত্তমবাবু মারা যাওয়ার পর কুলভূষণ খারবান্দা ওঁর সংলাপগুলো ডাব করেছিল।
সেটা একেবারেই উত্তমবাবুর মতো হয়নি। যেভাবে বলতেন উনি, একটু ভেঙে, একটু ডিট্যাচড, সংলাপের সেই বিশেষ মাত্রাটাই আসেনি কুলভূষণের গলায়।
সারাক্ষণ মনে হয়, একজনের অভিনয় দেখছি, আর একজনের গলা শুনছি। কাজটা মোটেই তেমন জমেনি। (চলবে)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।