বসন্তবিহারের বাড়ির লম্বা-চওড়া গেট দিয়ে ঢুকে একফালি বাগান পেরিয়ে প্রশস্ত ড্রইং রুমে পৌঁছে দিয়ে গেলেন এক প্রহরী। সেখানে অপেক্ষা করছেন এক পরিচারিকা। খানদানি কেতায় বসতে বলে তিনি জানতে চাইলেন, চা, কফি, না শরবত, কোন পানীয়টি পছন্দ করব? পরিচারিকা বিদায় নিতেই ঝলমলে হাসিমুখে এসে পৌঁছলেন শর্মিলা ঠাকুর। সামান্য সৌজন্য বিনিময়, জানতে চাইলেন কলকাতার সাম্প্রতিক খবরাখবর। ঠিক রানির মতোই লাগছে তাঁকে তখন, সেই উজ্জ্বল সকালে। মনে হচ্ছে বাস্তব জীবনে এই সম্রাজ্ঞীর ভূমিকাই যেন নির্ধারিত ছিল তাঁর জন্যে। রেকর্ডার অন করে সে কথা বলতেই চোখে হাসির একটা ঝিলিক, একটা ভুরু যেন সামান্য উঠল।

sharmila Tagore
১৯৬০ সালে সত্যজিৎ রায়ের দেবী ছবিতে। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

কী! রানির মত জীবন? যাঃ, বাইরে থেকে দেখলে ওরকম হয়তো মনে হয়। না না, আমার কখনও সে রকম মনে হয়নি। কখনওই না।
তবে এটা স্বীকার করব
, প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনও কিছু করতে বাধ্য হওয়ার অবমাননাতে আমাকে খুব কমই পড়তে হয়েছে। কিন্তু হয়েছে। সিনেমায় অভিনয় করছি বলে যেমন প্রবল অনিচ্ছাতেও ডায়োসেশন ছাড়তে হয়েছে। চারুবালা দাস তখন প্রিন্সিপাল, তাঁর মনে হয়েছিল এতে অন্যদের ওপর অবাঞ্ছিত প্রভাব পড়তে পারে। অথচ তত দিনে ডায়োসেশন আমার খুব প্রিয় স্কুল। ‘শেক্সপিয়রওয়ালা’ তখন নাটক করতে আসে সেই স্কুলে। শশী কাপুর কখনও আসেননি, কিন্তু জেনিফার কেন্ডল আর ওর বোন ফেলিসিটি কেন্ডল আমাদের স্কুলে শেক্সপিয়রের ‘টুয়েলফথ নাইট’ অভিনয় করে গেছে ওদের মা-বাবার সঙ্গে। উৎপল দত্তও ছিলেন সেই নাটকের দলে। স্কুলের নাটকেই তো প্রথম অভিনয় করি আমি। পাঁচ থেকে তেরো বছর বয়স পর্যন্ত পড়েছি ডায়োসেশনে, আমার ভালোও লাগত খুব।

বাবা মিস দাসকে বলেছিলেন, কথা দেওয়া হয়ে গেছে সত্যজিৎ রায়কে।
বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তিনি কী ধরনের ছবি করেন। কিন্তু মিস দাস কিছুতেই মত বদলাননি।
বাবার ছিল বদলির চাকরি
, তখন আসানসোলে পোস্টিং।
আমাকে ডায়োসেশন ছাড়িয়ে আসানসোলের লোরেটো-তে ভর্তি করে দিলেন। কারণ
, আমার অভিনয়ের ব্যাপারে লোরেটোর কোনও আপত্তি ছিল না। বরং সেখানকার শিক্ষিকারা আমার আলাদা যত্ন নিয়েছেন আগাগোড়া।

***

মা-বাবা দু’জনেই তো ঠাকুরবাড়ির লোক। গগনেন্দ্রনাথের পৌত্র গীতীন্দ্রনাথ আমার বাবা, আর রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রপৌত্রী আমার মা ইরা। আমার কাছে বাপি আর মিমি।
ঠাকুর পরিবারব্যাপারটা তখন আমার মাথাতে ছিলই না।
তবে শিল্পবোধটা বোধ হয় পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছি। বাবা এঞ্জিনিয়ার ছিলেন
, ইন্ডিয়ান অক্সিজেনে কাজ করতেন। বারবার বদলি হতেন বলে পড়াশোনার জন্যে আমি থাকতাম কলকাতায় দাদুর বাড়িতে।
ঠাকুরদা কনকেন্দ্রনাথকে ডাকতাম খোকা
, আর ঠাকুমা সুরমাসুন্দরীকে দাদু।

sharmila Tagore
অপুর সংসারে টিনএজার শর্মিলা ঠাকুর! ছবি – লেখকের সংগ্রহ

দ্বারকানাথের মধ্যমপুত্র গিরীন্দ্রনাথের বাড়ি, যাকে জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়ি বলা হত, বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর ওঁরা একটা বাড়ি ভাড়া করে উঠে এসেছিলেন দক্ষিণ কলকাতায়, রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের কাছে।
ছোটবেলায় সেখানেই একসঙ্গে থাকতাম অনেকে মিলে। কাকা-কাকিমারা ছিলেন
, পিসিরা ছিলেন।
বাড়িতে আমার কাছাকাছি বয়সের বাচ্চা ছিল জনা দশেক।

ছোটকাকা সুশান্তর বিয়ে, বাসরঘরের কথা তো আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাসে করে যাতায়াত করতেন বলে ছোটপিসি শুক্লাকে ডাকতাম বাসপিসিয়া বলে। মা-বাবার অনুপস্থিতে আমার অভিভাবকের দায়িত্ব ছিল আমার আরেক পিসিয়া করবীর ওপর।
নিজে বিয়ে করেননি
, বলা যায় তাঁর কাছেই মানুষ হয়েছি ছোটবেলায়।

sharmila Tagore
অপুর সংসার (১৯৫৯)-এর বিখ্যাত বাসরঘরের দৃশ্য। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

বড় হয়েছি খুব পরিপাটি করে আনাজ কাটা কোনটা গোল করে কাটা হবে আর কোনটা লম্বা, কোনটায় খোসা থাকবে আর কোনটায় থাকবে না, বড়ি দেওয়া, আলপনা দেওয়া, মশলা দিয়ে নানা রকম জিনিস তৈরি করে বিয়ের তত্ত্ব সাজানো দেখতে দেখতে, শিখতে শিখতে। যে সব জামাকাপড় পরতাম, তার বেশির ভাগই বাড়িতে সেলাই করা। আমাদের মতো এটা পারি না, ওটা পারি না-র দিন ছিল না সেটা। তখন বাড়ির মহিলারা সবাই রান্না করতে পারতেন, সেলাই করতে পারতেন, উল বুনতে পারতেন। কেনা সোয়েটার তো কখনওই পরিনি। সরস্বতী পুজো থেকে বিশ্বকর্মা পুজো, পয়লা বৈশাখ, বিজয়া দশমী, বাড়িতেই হত সব। সত্যনারায়ণ পুজোর চেয়ে সেই পুজোর প্রসাদ তৈরি করাতে উৎসাহ পেতাম অনেক বেশি। এরকম কিছু-না-কিছু চলত সারা বছর।

বাবা একবার কলকাতায় বদলি হয়ে এসে ১৩ নম্বর টাউনসেন্ড রোডে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করলেন। সেখানে আমি, মা আর বাবা। টিঙ্কু তখনও হয়েছে কিনা ঠিক মনে পড়ছে না। সেখানে গিয়ে আমার এমন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল! রীতিমত ডিপ্রেশন। আমরা আবার ফিরে গিয়েছিলাম ঠাকুরদার বাড়িতে। স্কুলে তো ইউনিফর্ম পরে যেতেই হত, কিন্তু এগারো-বারো বছর বয়স থেকেই বাড়িতে শাড়ি পরা চালু হয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণীতে গান আর নাচ শিখতাম। বেহালাও শেখানো হচ্ছিল আমাকে, যদিও সেটা আমার মোটেই পছন্দের ছিল না। তবে ভালোবাসতাম বই পড়তে। বারো বছর বয়সের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের গল্প, গোগ্রাসে পড়েছি সব। পিসিয়া নিজে চাকরি করতেন। কিন্তু তার মধ্যেই আমার জন্যে যতটা সময় দেওয়া সম্ভব, উনি অকাতরে দিতেন। (চলবে)

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *