আঠেরো বছর বয়স থেকে চুটিয়ে কাজ করে গিয়েছি বম্বেতে। বিয়ের আগে আমার খুব ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু, এমনকি শক্তিজিও বলেছিলেন, বিয়ের পর কিন্তু নায়িকাদের জনপ্রিয়তা আর আগের মতো থাকে না। আর বাচ্চা মানে তো কেরিয়ার শেষ। নায়িকা হিসেবে যখন এত ভালো করছ তুমি, ঠিক তখনই বিয়েটা করতে হবে? আমার মনের ভেতর থেকে তখন কেউ বলে দিয়েছিল, জীবনটা কেরিয়ারের চেয়ে অনেক বড়। নিজের মনের সেই কথাটা শুনে বিয়ে করেছি পঁচিশ ছোঁয়ার আগেই। স্বামীর সঙ্গে বম্বেতে থাকতে শুরু করেছি।

টাইগার তখন খেলছে, আমিও কাজ করে যাচ্ছি। টাইগার কিন্তু আমার অভিনয় করা ছবি বিশেষ দেখত-টেখত না। বরং বলত, আরে বাবা, দেশে অভিনেতা-অভিনেত্রী অনেক আছে। কিন্তু ক্রিকেট ক্যাপ্টেন? স্রেফ একজন। ক্রিকেট মরশুম শুরু হলে কাউকে আর বলেও দিতে হত না আমাদের বাড়িতে কে বড় স্টার।
বিয়ের পর মনে হল এবার ফ্যামিলি টাইম চাই। সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার কথাও মাথায় এসেছিল একবার।
যশ চোপড়া যখন ‘আদমি অওর ইনসান’ করতে ডাকলেন, বললাম, না। ভাবছি অভিনয় ছেড়েই দেব। কাজটা গেল সায়রাবানুর কাছে। পরে অনেকে বোঝাল। ভেবেচিন্তে চালু করলাম সাড়ে ছটার মধ্যে প্যাক আপ। সাড়ে ছটা আর কোনওদিনই হত না। সব শেষ করে মেক আপ মুছে বেরোতে বেরোতে সাতটা-সাড়ে সাতটা বেজেই যেত। তার মধ্যে ছবি ছেড়েও দিচ্ছি একের পর এক। রাজেশ খান্নার সঙ্গে ‘হাতি মেরে সাথি’, চন্দর ভোরার ‘খিলোনা’, যেটা চলেছিল খুব, আবার সেরা অভিনেত্রীর জন্যে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল মমতাজ, বিজয় আনন্দের ‘তেরে মেরে সপনে’, মনোজ কুমারের ‘রোটি কাপড়া অওর মকান’, এরকম বেশ কিছু ভালো কাজ ফিরিয়ে দিয়েছি তখন।

না না, তার জন্যে কোনও আক্ষেপ নেই আমার।
যে বয়সে যেটা করতে ভালো লেগেছে, করেছি। ভুল করে থাকলে ভুল করেছি!
মানিকদার সিরিয়াস সব ছবির মতোই মন দিয়ে করেছি ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এর মত গ্ল্যামার-সর্বস্ব ছবি।
কিন্তু সেখানেই তো আটকে পড়ে থাকিনি। শরীর দেখানোর চেয়ে জোর দিয়েছি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানারকম চরিত্রের প্রতিক্রিয়া, তাদের আবেগ, ঠিক মতো ফুটিয়ে তোলায়। বেছে বেছে সেইরকম ছবিই নিয়েছি।
সেই সব চরিত্রে লোকে যদি আমাকে না নিত, তাহলে কি এতদিন ধরে অভিনয় করতে পারতাম?
***
হিন্দি ছবিতে অভিনয় জীবনের শুরুতে নায়ক হিসেবে পেয়েছি শাম্মি কাপুরকে। শাম্মিজি তখন বম্বের চলচ্চিত্র দুনিয়ার বিশাল স্টার। কোনওদিন ঠিক সময়ে সেটে আসেন না, আবার কাজ শেষ না-করে চলেও যান না কোনওদিন। ক্যামেরার সামনে যা ইচ্ছে করেন। আগে থেকে ধরে নেওয়া সম্ভবই নয়, এই সিনে শাম্মিজি ঠিক কী করবেন। অনেক সময়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন কিছু করেন, যাকে পাগলামি ছাড়া অন্য কিছু বলাই যায় না! এদিকে সেগুলোই দারুণ পছন্দ অল্পবয়সী ছেলেদের। তারাও পাগলের মতো সেইগুলোই অনুকরণ করে। তাঁর সঙ্গে অভিনয় করা খুব সহজ ছিল না, আবার ওঁর সঙ্গে কাজ করার আনন্দ ভোলাও যায় না।

প্রথম হিন্দি ছবিতে যে শাম্মিজির মতো কিংবদন্তী নায়ক পেয়েছি, তার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ‘কাশ্মীর কি কলি’ বা ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এর সময় শাম্মিজি আমাকে যেভাবে উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, আমাকে স্বচ্ছন্দে কাজ করতে সাহায্য করেছেন, তার জন্যে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। অত্যন্ত আমুদে মানুষ, জীবনরসে ভরপুর। একবার একটা অনুষ্ঠানের জন্যে বম্বে থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে পুণে পৌঁছে গেলেন! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা করতে গেলেন কেন? বললেন, কয়েক দিন আগে একজন একটা মার্সিডিজ় গাড়ি উপহার দিল। চালিয়ে দেখলাম, গাড়িটা কেমন। পুরো মস্তিতে পূর্ণ জীবন কাটানোর পর অসুস্থ থেকেছেন বেশ কিছুদিন, কিন্তু সেই অসুস্থতা কখনও তাঁর মনের ওপর ছাপ ফেলতে পারেনি।
প্রথম হিন্দি ছবি শাম্মি কাপুরের সঙ্গে করলেও সেই ১৮ বছর বয়সে আমি কিন্তু মনেপ্রাণে শশী কাপুরের ফ্যান। ওইরকম সুদর্শন আর সপ্রতিভ নায়ক, কে-ই বা তার ভক্ত হবে না? আমি তো আজ পর্যন্ত শশীজির চেয়ে সুদর্শন কাউকে দেখলাম না। সেই শশী কাপুরকে পেয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় হিন্দি ছবি ‘ওয়ক্ত’-এ। ‘ওয়ক্ত’ ছিল বি আর চোপড়ার প্রযোজনা আর যশ চোপড়ার পরিচালনায় মাল্টিস্টারার ছবি। একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বলরাজ সাহনি, সুনীল দত্ত, রাজকুমার, সাধনা, লীলা চিটনিস – তার সঙ্গে শশী আর আমি। সেখানে নৌকোর ওপর গানের একটা লম্বা দৃশ্য ছিল। বেশ সিরিয়াস ধরনের গান, কিন্তু আমার ভূমিকা এক চটুল মেয়ের আর শশীজি বেশ গম্ভীর যুবক। শট নেওয়া যেই শেষ হত, আমাদের ভূমিকা উল্টে যেত। আমি চিন্তায় পড়তাম কেমন অভিনয় করেছি তাই নিয়ে। আর শশীজি আমার অবস্থা দেখে শুরু করতেন ঠাট্টা-ইয়ার্কি। আমার যদি কোনও ভুলও হতো, শশীজি সেটাও নতুন একটা কিছু করে সামলে নিতেন। আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম, ক্যামেরার সামনে এত সহজ থাকেন কী করে? উত্তর পেয়েছিলাম, আমি বেশির ভাগ সময় মনেই রাখি না যে সামনে ক্যামেরা আছে!

তরুণ নায়কদের মধ্যে তখন বম্বেতে কাজ করছেন মনোজকুমার, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জীবকুমার আর তরুণী নায়িকা তনুজা, মমতাজ, ববিতা। এর মধ্যে আমার সঙ্গে শশীজির জুটিটাকে অনেকেরই মনে হল খুব ফ্রেশ। ‘ওয়ক্ত’ সে বছরের (১৯৬৫) সবচেয়ে বড় হিট হল। তারপর থেকে অনেক ছবিতেই একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা – ‘আমনে সামনে’ (১৯৬৭) থেকে ‘সুহানা সফর’ (১৯৭০), ‘মাই লাভ’ (১৯৭০), ‘আ গলে লাগ যা’ (১৯৭৩), ‘পাপ অওর পূণ্য’ (১৯৭৪), ‘আনাড়ি’ (১৯৭৫), গেহরি চোট (১৯৮৩), নিউ দিল্লি টাইমস (১৯৮৬) পর্যন্ত।
এর মধ্যে অনেক সময় নিজের কাজ নিজের কাছেই এত অপছন্দ হয়েছে যে ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে চলে যেতে যেতে চেয়েছি। শশী বারবার বুঝিয়েছেন, ফিরিয়ে এনেছেন। একটা কথা খুব বলতেন, ‘ইয়ে কমার্শিয়াল ফিল্ম তো টেম্পোরারি হোতে হ্যায়।’ তখন কথাটা কতটা বুঝেছি জানি না, তবে এখন অনেক বেশি করে কথাটার মানে বুঝতে পারি।

ব্যক্তিগত জীবনে টাইগার আর আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল জেনিফার আর শশী। টাইগার আর আমি ওদের বেশ কিছু থিয়েটার একসঙ্গে দেখতে গেছি। তাছাড়া প্রায়ই আড্ডা হত আমাদের, খাওয়া-দাওয়া হত একসঙ্গে। কখনও শশী-জেনিফারের বাড়িতে, কখনও আমাদের, কখনও হয়ত কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁয়। দম্পতি হিসেবে এইরকমের বন্ধুত্ব ইন্ডাস্ট্রির আর কারও সঙ্গেই হয়নি আমাদের।
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।