এর মধ্যে কাজ তো করেই যাচ্ছি। ‘আরাধনা’-র (১৯৬৯) আউটডোর করতে গিয়েছি দার্জিলিং, মানিকদা বললেন, চলে এসো, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র (১৯৬৯) শ্যুটিং শুরু করছি। শক্তিজি বললেন, যাওয়ার আগে মেরে সপনোঁ কি রানি গানটা শ্যুট করে যাও। বললাম, মানিকদা ডেকেছেন। আমি কি অপেক্ষা করাতে পারি? আমাকে ছাড়াই রাজেশ খান্না ওই গানের দৃশ্যটা করে চলে গেল। শক্তি পরে আবার ট্রেনে আমার অংশটা ইনডোরে আলাদা করে শ্যুট করে গানের দৃশ্যটায় মিশিয়েছিলেন।

ছবি যখন রিলিজ করল, আমাকে বৃদ্ধার সাজে দেখেই অডিটোরিয়াম থেকে হাসির আওয়াজ। এই রোলে লোকে আমাকে নিল না বুঝে শক্তিজি বেরিয়েই গেলেন হল থেকে। কিছুক্ষণ পরে হল থেকে যখন ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, লোকে ছুটল শক্তিজিকে ফিরিয়ে আনতে। ভাগ্যিস ছবিটা ভালো চলেছিল, ওটার জন্যে সেবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও দিল আমাকে! নইলে কত যে কথা শোনাতেন শক্তিজি!
১৯৬৮ সালের ২৭ ডিসেম্বরে বিয়ে হল আমাদের। কলকাতায়। সেটা নিয়েও বিভ্রাট কিছু কম হয়নি। কানে আসত অনেকেই নাকি বলছে, কতদিন আর টিকবে এই বিয়ে? বড়জোর বছর দুয়েক! সেখানে থামলেও তো ভালো ছিল। হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে অনেকেই ঠিক ভালো চোখে দেখতে পারলেন না। বিয়ের আগে ভয় দেখানো কয়েকটা চিঠি এল বাবার কাছে। খুনের হুমকি-টুমকিও ছিল তাতে। বাবা মনে করলেন, রিসেপশনের পক্ষে ফোর্ট উইলিয়াম হবে নিরাপদ এবং উপযুক্ত জায়গা। সেনাবাহিনীর অনুমতি পাওয়া গেল, সেই মত জানানোও হয়ে গেল সবাইকে। বেশ ঘটা হয়েছিল আমাদের বিয়ের আয়োজনে। আসার কথা দেশ-বিদেশের বেশ কিছু বিখ্যাত অতিথির। পাকিস্তানের মেজর জেনারেল শের আলি খান টাইগারের নিজের কাকা। তিনিও আসছেন আমাদের বিয়েতে।

ব্যস, সেটা জেনে বিয়ের ঠিক দু-দিন আগে ফোর্ট উইলিয়ামের সেনাকর্তারা বলল, আমরা অনুমতি ফিরিয়ে নিচ্ছি, তোমরা অন্য কোথাও অনুষ্ঠান কর। তখন শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে রিসেপশনের ব্যবস্থা হল বাবার বন্ধু এক বিদেশি ডিপ্লোম্যাটের বাড়ির লনে। পদ্মজা নাইডু, গভর্নর তখন, এসেছিলেন আমাদের বিয়েতে। মানিকদা উপহার দিয়েছিলেন ‘অপুর সংসার’-এর ষোলো মিলিমিটার প্রিন্ট। পুরো সেট। বংশীদা দিয়েছিলেন গণেশ পাইন আর বিকাশ ভট্টাচার্যের একটা করে ছবি। স-ব নষ্ট হয়ে গেছে, জানেন? একসঙ্গে সব রেখে দিয়েছিলাম আমার বম্বের বাড়ির লফটে। একবার বর্ষায় জল ঢুকে খারাপ করে দিল! গণেশ পাইন নষ্ট করে ফেলেছি, ভাবতে পারেন!

টাইগার তখন প্রিন্সলি স্টেট পটৌডির নবম নবাব। তাই কলকাতায় বিয়ের পর আমরা প্রথম গেলাম হরিয়ানার পটৌডিতে। সেখানে হল আমাদের ‘ওয়ালিমা’, মানে রিসেপশন। তারপর দিল্লিতে আম্মার কাছে একটা টি-পার্টি, সেখান থেকে বম্বে। বম্বে, কারণ টাইগার তখনও নিয়মিত খেলছে, আর আমার হাতেও বেশ কয়েকটা ছবি। ‘আরাধনা’-র আউটডোর শেষ হয়ে গেলেও, ইনডোরের কাজ তখনও বাকি। তাই বম্বেই তখন আমাদের স্থায়ী ঠিকানা।
বম্বের সব কাজ সেরে কিছুদিন পর আমরা গেলাম ভোপাল। টাইগারের বাবা ইফতিকার আলি খান, আমরা বলি সরকার, তিনি যেমন ছিলেন পটৌডির নবাব, আম্মা সাজিদা সুলতান তেমন ছিলেন ভোপালের শেষ স্বাধীন নবাব হামিদুল্লা খানের মেয়ে। ১৯৬০ সালে নবাব হামিদুল্লার মৃত্যুর পর ভোপালের রীতি অনুযায়ী নবাব বেগম হন তিনিই। কিন্তু যেহেতু তখন তিনি পটৌডির নবাবের স্ত্রী, তাই তিনি আর ভোপালী নন, অতএব যথার্থ উত্তরাধিকারী নন – এই অভিযোগে আদালতে তাঁর অধিকার চ্যালেঞ্জ করেন নবাব হামিদুল্লার স্ত্রী, মানে আম্মার নিজের মা। ভারত সরকার অবশ্য আম্মাকেই ভোপালের টাইটুলার রুলার হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তবু পরিবারের অন্যরা আদালতে আম্মার বিরুদ্ধ পক্ষেই গেলেন। সেই মামলা তো আজও চলছে।

এখনকার অনেকেই হয়ত জানেন না, তাই বলছি, রাজ্য হিসেবে ভোপাল ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ভারতে ২১ বার তোপ দেগে সম্মান জানানো হত হায়দরাবাদের নিজাম আর গোয়ালিয়র, বরোদা, মহীশূর আর কাশ্মীরের মহারাজদের। তারপরেই ছিল ১৯ তোপের ভোপাল, ইন্দোর, উদয়পুর, কোলাপুর আর ত্রাভাঙ্কোর। যোধপুর, জয়পুর, কোচবিহার, দ্বারভাঙ্গা সবই কিন্তু ছিল ১৯ তোপের চেয়ে কম। এই সব রাজ্যের পাশে পটৌডি কিন্তু অনেক ছোট, বলতে পারেন বিশাল একটা বাগানবাড়ি। কোনও তুলনাই হয় না।
পটৌডির প্রিভি পার্স ছিল বছরে ৪৮ হাজার টাকা। আর ভোপাল পেত ৫ লাখ, নাকি তারও বেশি। ৫ লাখ টাকায় তখন বম্বেতে বাড়ি কেনা যেত! সেই টাকার সঙ্গে বেশ কিছু সম্মান বা সুবিধেও পাওয়া যেত। যেমন বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখা যেত, বিদেশ থেকে ইচ্ছেমত গাড়ি কেনা যেত নিজেদের ব্যবহারের জন্যে। সেই গাড়ির নম্বর প্লেটে থাকত এস্টেটের নাম। টাইগারের গাড়ির নম্বর ছিল পটৌডি ৩। প্রিভি পার্স তুলে দেওয়ার পর নবাব-মহারাজারা সবাই ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন। অনেক রাজপ্রাসাদই তো এখন বিলাসবহুল হোটেল হয়ে গেছে।

তখনকার দিনে আমাদের ভোপাল যাওয়া মানেই একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। আম্মা থাকেন ৪০০ একর জোড়া রাজপ্রাসাদে। কিন্তু আমাদের কাছে তখন তার চেয়েও বড় আকর্ষণ চিকলৌড়ের শিকার-বাড়ি। জঙ্গলের মধ্যে ৮০০ একর জোড়া হ্রদের গায়ে ছিল সেই বাড়ি। সেখানে স্কোয়াশ কোর্ট, পোলো গ্রাউন্ড, ভেতরে একটা বাইরে একটা সুইমিং পুল। আর চতুর্দিকে জঙ্গল। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার প্রিভি পার্স বা রাজন্য ভাতা বাতিল করার আগে পর্যন্ত এই সব জঙ্গল ছিল রাজ-সম্পত্তি।
আম্মার অনুমতি নিয়ে ভারত সরকার একবার যুগোস্লোভিয়ার কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোকে বাঘ শিকার করাতে এই চিকলৌড়ে এনেছিল। বাঘ যে সেবার পাওয়া যায়নি, সে অবশ্য আলাদা কথা। তবে জঙ্গলের গভীরে সেই বাড়িতে সূর্য ডোবার পর গরমের দিনেও ঠাণ্ডা লাগত। সব মশালের আলো নিভিয়ে দেওয়ার পর আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে গাছপালার গায়ে গায়ে। প্রত্যেক রাতে সে এক আশ্চর্য দেওয়ালি। ইস, জোনাকিরা সব গেল কোথায়? আমার নাতি-নাতনিরা তো দেখেইনি, ছেলেমেয়েরাও দেখেছে কিনা সন্দেহ।

১৯৭১-এ প্রিভি পার্স বাতিল হওয়ার পর ভোপাল প্যালেসের সব গার্ড তুলে নিতে হল। আম্মা তখন ওই প্রাসাদ ছেড়ে থাকতে শুরু করলেন নবাব পরিবারের গেস্ট হাউসে, মানে এতদিন নবাবের অতিথি হয়ে যারা ভোপালে আসতেন, তাঁদের যেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হত, সেই বাড়িতে। সেটাও একটা মস্ত লেকের ধারে ২৫ একর জোড়া বিশাল সম্পত্তি। বর্ষাকালে আমরা দেখতাম দূর থেকে বৃষ্টি আসছে সেই হ্রদের ওপর দিয়ে। এর কিছুদিনের মধ্যেই এল ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্ট। তখন কাছনারিয়া, চিকলৌড়, মানে ভোপাল নবাবের সব জঙ্গল সরকার নিয়ে নিল। গেস্ট হাউসের বেশ কিছুটা জমি দেওয়া হল সইফিয়া কলেজকে। বাকি জমিতে চমৎকার গোলাপ বাগান করেছিলেন আম্মা। গোলাপ চারা তৈরি করতেন নিজের হাতে।
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত আমরা সময় পেলেই বম্বে থেকে ছুটতাম ভোপাল। নিয়মিত। ভোপাল থেকে লং ড্রাইভে যেতাম চিকলৌড়। সেখানে টাইগার যেত প্যাট্রিজ শিকার করতে। প্রথম বাঘ মেরেছিল টাইগার ১৩ বছর বয়সে। তখনকার দিনে নবাব-মহারাজাদের পরিবারে অনেকেই মনে করতেন, ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা, এসবই যদি না করলে তবে আর তুমি পুরুষ কিসের! তবে এই সব পরিবারের শিকারিরা বেশ কিছু এথিক্সও মেনে চলতেন। বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী মারবে না, ফিমেল স্পেসিজ মারবে না, মেটিং সিজনে শিকার করবে না, বাচ্চা হরিণ মারবে না, এই সব। কিন্তু পোচিং, বা চোরা শিকারের বাড়াবাড়ি শুরু হতে সমস্ত অবস্থাটাই তো পাল্টে গেল। অভিজাত শিকারিরা বেশির ভাগই তখন কনজার্ভেশনালিস্ট হয়ে গেলেন। বন্যপ্রাণী মারার চেয়ে তাদের বাঁচানোতেই মন দিতে শুরু করলেন তাঁরা। টাইগারের অবশ্য বিয়ের আগেই বাঘ শিকারের শখ মিটে গিয়েছিল।

১৯৭৬ সালে টাইগারের ইচ্ছে হয়েছিল ভোপালে গিয়ে থাকতে। সইফ আর সাবাকে নিয়ে আমরা গেলাম ভোপাল। সইফকে ভর্তি করা হল ওখানকার বাল ভবন স্কুলে। কিন্তু দেড় কি দু-বছর পর টাইগার আর ভোপালে থাকতে চাইল না। আমরা ফিরে এলাম বম্বেতে। (চলবে)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।