কোরক বসুর কণ্ঠে এই ফিচারটির পডকাস্ট শুনতে হলে ক্লিক করুন

১৯৫৫ সালে মুক্তি পেল ‘পথের পাঁচালী’ ১৯৫৬ সালে ‘চলাচল।এর কিছু পরেই কলকাতার এক প্রথম সারির দৈনিকে দুই ছবির দুই পরিচালককে নিয়ে একটি লেখার হেডিং হল, ‘একই আকাশে দুই মানিক’ মিল অবশ্য শুধু নামেই এক মানিক, অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের লক্ষ্য বাস্তবধর্মী ছবি নির্মাণ অন্য মানিক, অসিত সেন সিদ্ধহস্ত আবেগধর্মী ছবি তৈরিতে  সে দিন এক মোবাইল-আড্ডায় অসিত সেনের পুত্র পার্থ সেন বললেন, ‘বাবার বেশির ভাগ ছবিই তো ‘টিয়ারজার্কার’ যেখানে চোখের জল বাধা মানে না আবার ‘চলাচল’ ‘পঞ্চতপা’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, প্রত্যেকটি ছবিই নায়িকা-কেন্দ্রিক অসিত সেনের ছবি মানেই হিট বাবার বহু বাংলা ও হিন্দি ছবির গান আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে’ পার্থবাবুর আক্ষেপ, আজ ‘সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল’ বা ‘অজয়-তপন-তরুণ’ বলাটা দস্তুর হলেও বাংলা ছবির স্বর্ণযুগে, পাঁচ ও ছ’য়ের দশকে কিন্তু সত্যজিৎ রায়, অজয় কর, তপন সিংহ এবং অসিত সেনের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হত
Asit Sen
অসিত সেনের চিত্রমালা। ছবি সৌজন্য – wikipedia এবং youtube
অসিত সেনের জন্ম ওপার বাংলার (এখন বাংলাদেশ) বিক্রমপুরের আউটশাহীতে ১৯২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সেখানে ছিল তাঁর মামাবাড়ি বাবা রেলে চাকরি করতেন অসমের নওগাঁওয়ে সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে অসিত ভর্তি হন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে সেখানে সহপাঠী হিসাবে পান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও সলিল চৌধুরীকে পার্থবাবুর কথায়, ‘বাবা খুব ভালো গান গাইতেন কলেজে পড়ার সময়ই ঠিক হয়ে গিয়েছিল গৌরীপ্রসন্ন হবেন গীতিকার, সলিল সুরকার আর বাবা গায়ক কিন্তু জীবন বইল অন্য খাতে ১৯৪৬ সালে ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে বিশিষ্ট ক্যামেরাম্যান এবং আত্মীয় রামানন্দ সেনগুপ্তর সহকারী হিসাবে অসিত সেনের চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ এর পর নিউ থিয়েটার্সে বিমল রায়ের সহকারী হিসাবেও কয়েকটি ছবিতে কাজ করেন এরই মাঝে মুভি ক্যামেরায় বন্দি করেন দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গান্ধীজির সফর  চিত্র পরিচালক হিসাবে অসিত সেনের প্রথম বাংলা ছবি ‘চলাচল’ এই ছবি তৈরির নেপথ্য কাহিনি শোনালেন পার্থবাবু ‘সেই সময় লাইটহাউস-নিউ এম্পায়ার-এর উল্টো দিকে ছিল স্টুডিয়ো এভারেস্ট এর মালিক ছিলেন মিস্টার চন্দক সকাল থেকে সন্ধ্যা বাবাকে এখানে স্টিল ফটোগ্রাফার হিসাবে থাকতে হত এর পর লাইটহাউস-নিউ এম্পায়ারে নাইট শো শেষ হলে ফিল্ম গোটানোর কাজ সামলাতে হত তাঁকেই তারপর গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে তবে লাভ একটা ছিল দুটি হলেরই মালিক ভিক্টর মার্শালের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় বহু ছবি দেখার সুযোগ মিলত সেই থেকে একটু একটু করে ছবি বানানোর ইচ্ছেটাও দানা বাঁধে’ ‘চলাচল’ বানাতে অর্থ জোগালেন মিস্টার চন্দক, অসিত সেনের আত্মীয় ও বন্ধুরা অসিতের জ্যোঠতুতো ভাই প্রীতিময় সেন ছিলেন পেশায় বাস্তুকার তিনিই ছবির শিল্প উপদেষ্টা ছবিতে ব্যবহৃত আসবাব যেত বাড়ি থেকে বাড়িতেই রান্না হত পুরো ইউনিটের জন্য ভাত আর মুরগির মাংস।তারপর পাঠানো হত ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় যৌথ পরিবারও হয়ে উঠত আনন্দপুরী কারণ বাড়ির বাচ্চারা জানত শুটিং থাকলে তারাও ভাত-মাংসের ভাগ পাবে    
Asit Sen
তরুণ পরিচালক কাজে মগ্ন। তখন তিনি অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা।
পার্থবাবুর কথায়, ‘আগেই বলেছি বাবার ছবিতে আবেগই প্রধান নইলে ভাবুন তো ‘চলাচল’এর শেষ দিকে, মন্টুর কাছে অবিনাশের (নির্মলকুমার) মৃত্যুর খবর পেয়ে সরমার (অরুন্ধতীদেবী) ভেঙে পড়ার দৃশ্যটা ক’জন দর্শক লক্ষ করেন কাচের দরজায় অরুন্ধতীর হাত লেগে যেটা ছিঁড়ে যাচ্ছে সেটা সেলোফেন পেপার? সবাই তখন সরমাকেই দেখছেন ফ্রস্টেড গ্লাস লাগানোর মতো বাজেট প্রযোজকদের ছিল না যে!   
Asit sen
অ্যালফ্রেড হিচককের সঙ্গে অসিত সেন।
অসিতের প্রথম চারটি বাংলা ছবি ‘চলাচল’, ‘পঞ্চতপা’, জীবন তৃষ্ণা ও ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর কাহিনিকার ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দু’জনের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার বিনিময় চলত সব সময় তা বলে বিতর্ক-ঝগড়াও কিছু কম হত না। ‘জীবন তৃষ্ণা’ অসিত সেনের পরিচালনায় সুচিত্রা-উত্তমের এক মাত্র ছবি কিন্তু এই ছবির মাধ্যমে দুই ম্যাটিনি আইডলের সঙ্গে অসিতের যে বন্ধুত্ব হয়, তা থেকে যায় আজীবন ‘জীবন তৃষ্ণা’র শুটিংয়ের এমন একটি ঘটনার কথা জানালেন পার্থবাবু যেটি বাংলা ছবির ইতিহাসে স্বচ্ছন্দে জায়গা করে নিতে পারে 
Asit sen
উত্তর ফাল্গুনীর সেটে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে, যে সম্পর্ক আজীবন ছিল অটুট।
একদিন দেখা গেল সুচিত্রা সেন দুধ-সাদা ব্লাউজ পরে স্টুডিয়োয় এসেছেন তাই দেখে অসিতবাবু মহা খাপ্পা সাদা-কালো ছবিতে এমন রং নৈব নৈব চ হাতে সময় কম, তাই মহানায়িকাকে আদেশ করলেন, ‘অন্য জামা পরে ব্লাউজটা এখনই ইউনিটের কাউকে দাও’ সেটি পাওয়া মাত্র পরিচালক মশাইয়ের হুকুম, ‘ফুটন্ত চায়ের জলে ওটাকে ভিজিয়ে, এক ঘণ্টার মধ্যে শুকিয়ে নিয়ে আয়’ সত্যি, একেই বলে শুটিং! ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির শুটিং যখন শুরু হয় তখন প্রযোজক রাখালচন্দ্র সাহার দুশ্চিন্তা ছিল, ‘নায়িকা-প্রধান ছবি, উত্তমকুমার নেই এ ছবি চলবে তো? পথে বসব না তো?’ কারণ এ ছবি করতে গিয়ে তাঁকে তাঁর কটন মিল বন্ধক দিতে হয়েছিল সেই ছবি মুক্তির পর সুপারহিট তো হলই এবং এত টাকার ব্যবসা করল, যে রাখাল টালিগঞ্জে তাঁর নতুন বাড়ির নামকরণ করলেন ‘দীপ জ্বেলে যাই’ এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো ‘এই রাত তোমার আমার’ গানে ‘ব্যাক টু ক্যামেরা’য় যে অভিনেতাকে দেখা যায়, তিনি অসিত সেন নিজেই মহানায়িকার ইচ্ছায় সিনেমায় তাঁর একমাত্র অভিনয় দুষ্টুমি সুচিত্রাও কিছু কম করতেন না অসিতবাবুর নতুন হিলম্যান গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে নেওয়া থেকে সড়কপথে মুম্বই যেতে অসিতবাবুকে হঠাৎ শামিল করা এবং একটুর জন্য চম্বলের দস্যুর খপ্পর থেকে বেঁচে যাওয়া, এ সবই ছিল তার নিদর্শন 
Asit sen
একটি অনুষ্ঠানে অসিত সেনের সঙ্গে উত্তমকুমার ও বিকাশ রায়।
‘উত্তর ফাল্গুনী’ নিয়েও রয়েছে এমন গল্প উত্তমকুমার প্রযোজিত ছবি অথচ নায়কের চরিত্রে বিকাশ রায়? এই প্রশ্ন উঠতে অসিতবাবুর সাফ কথা, ‘আগে বই শেষ হোক, তার পর কথা কমু’ শুধু কী তাই? ছবি যখন মুক্তি পাচ্ছে তখন রুশ ছবি নির্মাণের কলা-কৌশল জানতে অসিত সেন সফর করছেন মস্কো-লেনিনগ্রাদ ১৯৬৩ সালের শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পায় ‘উত্তর ফাল্গুনী’অথচ ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ মুক্তি পাওয়ার পরের দু’বছর অসিতবাবুর হাতে কোনও কাজ ছিল না
Asit sen
বৈরাগ-এর সেটে। দিলীপ কুমার, সায়রা বানু, প্রেম চোপড়া ও মদন পুরীর সঙ্গে পরিচালক।
১৯৬৬ সালে ‘উত্তর ফাল্গুনী’র রিমেক ‘মমতা’র পরের দু’দশকে, মুম্বই হয়ে ওঠে তাঁর কর্মভূমি বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির প্রবাদপুরুষ, ফিল্মিস্তানের কর্ণধার শশধর মুখোপাধ্যায় যখন অসিত সেনকে এক বার বলেছিলেন দর্শককে ভুনি খিচুড়ির নেশা ধরাতে হলে দু’টি উপাদান চাই, সিচুয়েশন ও গান, তখন সে কথা তাঁর মনে ধরেনি পরে সেই ফর্মুলা যখন শিরোধার্য করলেন তখন ঝুলি থেকে বেরোল ‘আনোখি রাত’, ‘খামোশি’, ‘সফর’, ‘শরাফৎ’, ‘অন্নদাতা’, ‘বৈরাগ’-এর মতো হিট তাঁর সৌভাগ্য, তিনি পেয়েছিলেন এল বি লছমন, মুশির-রিয়াজের মতো সহৃদয় প্রযোজক, মজরুহ সুলতানপুরি, ইন্দিবর ও যোগেশের মতো গীতিকার এবং রোশন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীর মতো সুরকারকে ‘সফর’ পরিচালক অসিত সেনকে এনে দেয় ফিল্মফেয়ার সম্মান
Asit sen
বাবার সঙ্গে তরুণ পার্থ সেন। সঙ্গে প্রিয় পোষ্য।
আটের দশকের মাঝামাঝি বলিউডে ছবি নির্মাণ ও প্রযোজনার ধারা বদলে যাওয়ায় কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়েই অসিতবাবু ফিরে আসেন কলকাতায়। দু’টি বাংলা ছবি ছাড়াও পরিচালনা করেন একাধিক টেলিফিল্ম। অবশ্য ততদিনে এক নতুন জগতের স্বাদ পেয়েছেন তিনি। দেখলেন, জন্মেই মাতৃহারা, ঠাকুমা ও পিসিদের কাছে মানুষ, তাঁর একমাত্র সন্তান, লা মার্টস ও সেন্ট জেভিয়ার্সের গণ্ডি পেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। যাকে আট বছর বয়সে একা একা স্কুলে যাওয়ার পাঠ দিয়েছিলেন, বৃষ্টিতে স্কুলে আটকে পড়া সত্ত্বেও লিফট না দিয়ে ক্লাস এইটের সহপাঠীদের মতো স্বাবলম্বী হতে শিখিয়েছিলেন, যে কলেজ পড়ুয়াকে উপদেশ দিয়েছিলেন কখনও ফিল্টার উইলস থেকে চারমিনারে না নামতে, সেই পার্থ সেন তখন জাহাজ শিল্পে শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক। পুত্রবধূ রত্না সেন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগে বিশিষ্ট ঘোষক ও সঞ্চালক। আর নাতনি প্রিয়াঞ্জলি একটু একটু করে পা রাখছে ফিল্ম স্টাডিজের দুনিয়ায়।
Asit sen
অসিত সেনের পরবর্তী দুই প্রজন্ম। বাঁ দিক থেকে, পুত্র পার্থ সেন, নাতনি প্রিয়াঞ্জলি সেন এবং পুত্রবধূ রত্না সেন।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি ১৯৬৮ সালের কথা গিয়েছি উত্তর বিহারের ছোট্ট শহর মোতিহারিতে, জন্মভিটেয় পুজো শেষ বিজয়া করার ঢল নেমেছে বাড়িতে বাড়িতে মা-কাকা-পিসিদের সঙ্গে আমিও গিয়েছি এমনই এক বাড়িতে নোনতা-মিষ্টি পর্ব শেষ হতেই বাড়ির গিন্নি বললেন, ‘ও নতুন বৌমা, ওই গানটা একবার শুনিয়ে দাও’ চৌকির উপর বসে লণ্ঠনের আবছা আলোয় ঘোমটাটা আর একটু টেনে নিয়ে, মাথা নিচু করে বৌমা ধরলেন, ‘ওহো রে তাল মিলে নদী কে জল মে, নদী মিলে সাগর মে, সাগর মিলে কৌন সে জল মে, কোই জানে না এরও কয়েক বছর পর, সাদাকালো টিভিতে দেখলাম চৌকিদার-বেশী সঞ্জীবকুমারের লিপে নববধূকে নিয়ে সেই ঘরে ফেরার গান আর পাঁচ দশক পর অসিত সেনের স্মৃতিকথা পড়ে জানলাম এটি একটি ভাটিয়ালি গান, যার হদিশ ‘আনোখি রাত’-এর সঙ্গীত পরিচালক রোশনকে দিয়েছিলেন অসিত সেন স্বয়ং শুধু বাংলার তাল ফল হিন্দিতে অনায়াসে বদলে যায় তাল বা পুকুরে মুকেশের কণ্ঠে সেই কালজয়ী গান হয়ে রইল রোশনেরও শেষ সুরসৃষ্টি অন্য দিকে বাংলা ছবির অন্যতম কাণ্ডারী, অন্নদাতা অসিত সেনের দীপ নিভে যায় ২০০১ সালের ২৫ অগস্ট   ঋণ: স্মৃতির সোনালি রেখা – অসিত সেন আজও মনে পড়ে – রামানন্দ সেনগুপ্ত পারিবারিক ছবি: সৌজন্য পার্থ সেন  

দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *