ছেলেরা সাধারণত মাছের মুড়ো খেতে ভালবাসে না। আমার দাদা বাসত। আস্ত একটা মাথা। মাঝখান থেকে ঘা দিয়ে দু’ভাগ করলে রেগে যেত। ও চাইত আমিও খাই। কিন্তু আমার তো মাছেই অরুচি। তার আবার মাথা। আমার সেই দাদার মাথাটা ধারাল অস্ত্র দিয়ে মাঝখান থেকে দু’ভাগ ক’রে দিল কেউ। 

গতকাল আমার জন্মদিন গেল। বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার পর বাবা আমায় ছুঁয়ে একটা কথাই বলেছিল, ‘আর যাই হও তোমার দাদার মতো হয়ো না।’ মা মারা গেছেন অনেকদিন। বেঁচে থাকতে পায়েস বানাতেন এই দিনটায়। বৌদিকে দেখে যেতে পারেননি। বৌদি কাজু কিশমিশ দিয়ে পায়েস বানিয়ে আমায় নিজে হাতে খাইয়ে দিল প্রথম চামচটা। বৌদিকে যত দেখি তত যেন নতুন করে চিনলাম বলে মনে হয়। 

তিনদিন পর দাদার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। ফেরেনি। বাড়ির মেন গেটে তালা দেবার দায়িত্ব আমার। বিছানায় উপুড় হয়ে হিমু সমগ্র পড়ছিলাম। বৌদির উপহার। জন্মদিনে। ‘আর আসবে না, তালাটা দিয়ে দাও।’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দোতলায় চলে গেল বৌদি। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘ফোন করব একটা?’ দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল উপরের ঘরে।খুব একটা রাত হয়নি এখনও। গলির ভেতর ক্যারমবোর্ডের স্ট্রাইকারটার সঙ্গে পাশের বাড়ির টিভির শব্দ ঘর বদলের খেলা খেলছে। এ ঘর ও ঘর সে ঘর। বারান্দা কাচদেয়াল। কখনও ঢুকছে, কখনও বেরচ্ছে, কখনও বেরচ্ছে, কখনও ঢুকছে। অদ্ভুত অকারণ একটা উৎসব চলছে যেন। মন বসাতে পারছি না। চিনতে পারছি না বইয়ের মানুষগুলোকে। কোথায় যেন পালিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। 

মা মারা গেছেন অনেকদিন। বেঁচে থাকতে পায়েস বানাতেন এই দিনটায়। বৌদিকে দেখে যেতে পারেননি। বৌদি কাজু কিশমিশ দিয়ে পায়েস বানিয়ে আমায় নিজে হাতে খাইয়ে দিল প্রথম চামচটা। বৌদিকে যত দেখি তত যেন নতুন করে চিনলাম বলে মনে হয়। 

আজ সন্ধেবেলা আমাদের রিহার্সাল প্যাডে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। ঘাড় অবধি লম্বা চুল। চোখে মোটা কাচের চশমা, কথা বলার মধ্যে অদ্ভুত একটা প্যাশন। শব্দ আর কথাদের দৃশ্য নিয়েই ওঁর জগৎ। এ পাড়ায় নতুন। এখনও একা একা হেঁটে অলিগলিগুলো চেনার চেষ্টা করছেন। আমরা যে এ বাড়িটার দোতলায় বাজাই, সেটা উনি শুনেছেন কয়েকবার। স্মার্টলি চলে এলেন নিজেই। বেশ ব্যাপার আছে লোকটার। আমি গিটার দোলাতে দোলাতে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় লোকটাকে দেখেছিলাম আগে। নেশা করে। না করেও। অবশ্য বন্ধুরা বলে আমি নাকি একটু বার খাওয়া টাইপ। যদি সত্যিই সেটা হয় তাহলে গিটারটাও আমি শিখেছিলাম বার খেয়েই। ক্লাস সেভেনে। এটাই এখন আমার ফার্স্ট লাভ। জীবনের অনেক গল্প। সব্বার। কেউ লিখতে পারে, কেউ পারে না। ভাবছি আমার দাদাকে নিয়ে একটা গল্প লিখব। নিজের কথা তো বলিই সবসময়। নিজের সঙ্গে। আজ দাদাকে নিয়েই হোক। 

আমার দাদা ভাল গোলকিপার ছিল। পাড়ায় বেপাড়ায় টাইব্রেকারে বহু ম্যাচ জেতানোর রেকর্ড ছিল দাদার। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পেতলের কাপ বা টুর্নামেন্টের বেস্ট প্লেয়ারের ট্রফির জন্য আলাদা একটা শোকেসও ছিল বাড়িতে। মা থাকার সময় অবধিও ওগুলো সুন্দর করে সাজানো থাকত। তারপর একদিন শুনলাম দাদা নাকি বৌদিকে বারণ করেছে ওগুলো ধরতে। যাইহোক এখন আর সেসব নেই। 

দাদাকে বই পড়ে টেপরেকর্ডার সারাতে দেখেছি, কুয়োর মধ্যে পড়ে যাওয়া শালিকের বাচ্চাকে বালতি করে তুলে আনতে দেখেছি, ঘুরন্ত চাকতিতে আটকানো বেলুন বলে বলে ফাটাতে দেখেছি, বটল্‌ ওপেনার নেই বলে বিয়ারের বোতল দাঁত দিয়ে খুলতেও দেখেছি। দাদাই ছিল আমার হিরো। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্তও। আসলে শুধু দাদা নয়, ওই সময়টার পর থেকেই বোধহয় সবকিছুর প্রতি নিছক একটা সরলতা মরে যেতে শুরু করল। সেটা ভাল না খারাপ জানি না। তবে তারপর থেকেই দাদা চরিত্রটা আমার কাছে খুব কনফিউজ়ড্‌ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। কনফিউজ়ড্ শব্দটা পলিটিকালি কারেক্ট থাকার জন্য ব্যাবহার করলাম না কিন্তু। সত্যিই তখন বুঝতে পারিনি কীভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত। কারণ ওর ইমেজের আয়নাটা ভেঙে ফেলার ক্ষমতা আমার ছিল না। আজও নেই হয়তো। মাঝে মাঝে মনে হয় দাদা শুধু একটা ভাল দাদাই ছিল। ভাল ছেলে বা ভাল স্বামী হতে পারেনি। 

প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা ভাল? আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে গড়িয়াহাট বা উল্টোডাঙার মোড়ে দাঁড়িয়ে জনে জনে এই প্রশ্নটা করি। একটা মানুষ কখন ভাল হয়? বোকা হলে? অন্যদের সহজে বিশ্বাস করলে? ধাক্কাধাক্কি করে ভিড় ট্রেনে নিজের দাঁড়াবার জায়গাটুকু না করে নিতে পারলে?! নাকি যে নিজেরটা ছাড়া আর সবকিছুতেই অসম্ভব নিস্পৃহ থাকতে পারে? যাকে পাতি বাংলায় বলে সাতে পাঁচে না থাকা। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী জলের মতো যে পাত্রে ঢালা হয় তারই আকার নিতে পারে! জানি না। এখন আর জানতে চাইও না। 

আমি গিটার দোলাতে দোলাতে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় লোকটাকে দেখেছিলাম আগে। নেশা করে। না করেও। অবশ্য বন্ধুরা বলে আমি নাকি একটু বার খাওয়া টাইপ। যদি সত্যিই সেটা হয় তাহলে গিটারটাও আমি শিখেছিলাম বার খেয়েই। ক্লাস সেভেনে। এটাই এখন আমার ফার্স্ট লাভ। জীবনের অনেক গল্প। সব্বার। কেউ লিখতে পারে, কেউ পারে না। ভাবছি আমার দাদাকে নিয়ে একটা গল্প লিখব।

দাদার ঘটনাটার পর পুলিশ কিন্তু আমায় অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। দিনের পর দিন। যখন তখন। ‘আপনার দাদার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল?’ বলেছিলাম ভাল। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন। ‘ভাল মানে?’ বললাম ‘ভাল মানে ওর উপর আমার একটা দুর্বলতা ছিল। কোনও দিনও রাগ করে থাকতে পারিনি।’ হঠাৎ অন্য একজন ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলল ‘তার মানে রাগ হত। খারাপ লাগা ছিল।’ আমি অবাক। ‘দাদা-ভাইয়ের সম্পর্কে রাগ-অভিমান থাকাটা খুব স্বাভাবিক নয় কি?’ উত্তরের বদলে প্রশ্নবাণ উড়ে এল পরপর। ‘ইদানীং কার সঙ্গে বেশি কথা হত? দাদা না বৌদি?’ ‘আমরা শুনেছি আপনার দাদা প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না? কেন? কোথায় যেতেন?’ ‘আপনার দাদা -_বৌদির মধ্যে কি কোনও সমস্যা ছিল?’ একটা একটা করে উত্তর দিয়েছিলাম। মায়ের উল বোনার মতো। সাবলীল। কী একটা যেন ভর করেছিল তখন হয়তো জেদ আর আবেগহীনতা। যদিও সকাল থেকে অনেকবার মনে পড়েছিল মাকে। ভাগ্যিস নেই। অসম্ভব ভেঙে পড়ত 

একটা লাইন খুঁজছি লেখাটা শুরু করার জন্য। হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আমার এই গিটারটা, এখন যেটা নিয়ে শো করি আর কি, যেটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে জ্যাকেট খোলা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে বেশি ভালবাসে, এটা কিনেছিলাম আমার জমানো টাকায়। না, অ্যাকচুয়ালি মিথ্যে বলা হল, হাজার দু’য়েক কম পড়েছিল। তাই মন খারাপ করে দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম মনের মধ্যে একটা ছাই চাপা ধিকিধিকি অভিমান। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। সব সময় একটা বিরক্তি বিরক্তি ভাব। দাদা এসে হঠাৎ আমার পারফিউমটা মাখতে মাখতে বলল ‘তুই কি আমায় কিছু বলবি?’ আমি একটু অবাক। ‘কেন?’ ‘কারণটা আমি জানলে কি তোকে জিজ্ঞেস করতাম?’ কেন বলেছি কি বলিনি উত্তরটা ছিটকে এল। ‘না বলতে চাইলে থাক, আমার নিজেরও সবসময় জবাবদিহি করতে ভাল্লাগে না।’ তাপ্পি মারা রিকশার সিটের বেরিয়ে থাকা পেরেকের মতো লাগল কথাটা। তাই আমিও বললাম না। বুক নিংড়ে বেরনো কিছুটা নিঃশব্দ কষ্ট নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলাম। ‘গড়পঞ্চকোট জায়গাটা সম্পর্কে কোনও আইডিয়া আছে তোর?’ হঠাৎ এই প্রশ্নের মানে বোঝার আগেই বন্দুক লাইটারে বার তিনেক চাপ পড়ল। লাইটারটা দাদার হাতে। মুখের সামনে। ‘ভাল হয়েছে বেশ। আমায় এনে দিস তো।’ কথাটা শেষ করে ওয়ালেট থেকে টাকাটা বার করতে যেতেই বললাম ‘ওটা আমার না, ঋজুর। নিয়েছিলাম, পকেটেই থেকে গেছে।’ দাদা এবার বেশ অধৈর্য। ‘অকারণ জটিল করছিস ব্যাপারটাকে। তোর হোক, ঋজুর হোক, আরে বাবা কেনা তো হয়েছে কোনও একটা জায়গা থেকে!’ বুঝলাম খুব পছন্দ। কথা দিলাম এনে দেব। কিন্তু তখনই নিয়ে নিতে বলতে পারলাম না। অন্যের শখের জিনিস, যদি হারিয়ে ফেলে! আসলে নিজের জিনিস নিজে হারালে অত মনে থাকে না। অন্য কেউ হারালে বা নষ্ট করলে অপরাধবোধের ফোস্কা পড়ে তারপর যার জিনিস সে যদি সান্ত্বনার প্রলেপ লাগাতে গিয়ে মুখে এক মনে আর এক হয় – ‘আরে ছাড় তো, আমি নিজে কম লাইটার হারিয়েছি নাকি! এই জন্যই ঠিক করেছিলাম আর শালা দামি লাইটার ইউজ় করব না। তাকাবই না শালা!’ ব্যস্। ফোস্কা ফেটে দগদগে ঘা। 

যাইহোক, এটা যেমন জানতাম, ঠিক তেমনই জানতাম দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই আমার মনখারাপ হবেপছন্দসই গিটারটা কিনতে না পারার চোরা হতাশা কাটিয়ে একটা গান লেখার চেষ্টা করছিলাম। ‘মেঘ মেঘ পাহাড়, বৃষ্টি ভেজা বাড়ি/ আমাদের গান দেবে হাইওয়ে ভোর পাড়ি…’ ধুর হচ্ছে না। খুব ক্লিশে। গৌরবদা বলে, নিজের লেখা নিজে ছিঁড়ে কুটিকুটি করতে না পারলে নাকি বড় লেখক হওয়া যায় না। সে গানই হোক বা গল্প। গৌরবদা আমার দাদার ছোটবেলার বন্ধু। স্কুলের। ক্লাস ওয়ান থেকে। প্রেয়ারের লাইন, ক্লাসরুম, টিফিন, সাইকেল রাখা থেকে হিসি করতে লাইনে দাঁড়ানো, সবেতেই পাশাপাশি। আমার দাদার আর কোনও বন্ধু নেই। গৌরবদা বলেই এখনও টিঁকে আছে। গৌরবদা মেগা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে খুব একটা খারাপ রোজগার করে না। তবু মন উড়ুউড়ু। কিছুতেই একটা ছবির প্রোডিউসার পাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই ডিপ্রেশনে ভোগে। তখন আমাকে ওর বাড়িতে ডেকে নেয়। গান শুনতে চায়। স্কুল কলেজের নানারকম গল্প বলে। গৌরবদা যখন পেলিং-এ আউটডোর শ্যুটিং করতে গিয়ে ভূত দেখা বা প্রেমে পড়ার গল্প বলে, তখন একটুও অবিশ্বাস্য মনে হয় না।  শুধু মনে হয়, গৌরবদারও কোনও বন্ধু নেই। আমার দাদার-ও নেই। এই একটা ব্যাপারেই দু’জনের মিল। 

দাদা চরিত্রটা আমার কাছে খুব কনফিউজ়ড্‌ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। কনফিউজ়ড্ শব্দটা পলিটিকালি কারেক্ট থাকার জন্য ব্যাবহার করলাম না কিন্তু। সত্যিই তখন বুঝতে পারিনি কীভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত। কারণ ওর ইমেজের আয়নাটা ভেঙে ফেলার ক্ষমতা আমার ছিল না। আজও নেই হয়তো। মাঝে মাঝে মনে হয় দাদা শুধু একটা ভাল দাদাই ছিল। ভাল ছেলে বা ভাল স্বামী হতে পারেনি। 

দাদাকে বোঝা সহজ নয়। প্রেডিক্ট করা আরও কঠিন। বৌদিকে কিছু বলতে হয় না। কী করে যেন সব বুঝে যায়। ভেজানো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ‘আসব?’ বৌদির গলা। সাড়া দিলাম। ‘একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করব?’ তাকালাম। ‘ঘট ভেঙে কত পেলে?’ দাবায় চেকমেট হবার আগে বোঝা যায়। একটা সিক্সথ সেন্স বলে, এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে। ঠিক সেরকম মনে হল আমারও। কত পাওয়া গেছিল, সেটা আর ইম্পর্টেন্ট নয় আমার কাছে। দোকানে লোকটা একটা বাজে গিটার দেখিয়ে বারবার আমায় মুরগি করার চেষ্টা করছিল, ‘এটা নিয়ে যান, এটাও খুব ভাল। আপনার কাছে যা আছে তাতে হয়ে যাবে।’ আর আমি মুখ চুন করে একবার আমার পছন্দের গিটারটার দিকে তাকাচ্ছিলাম, একবার কাচের দরজার বাইরে রাস্তার দিকে। এটাই খোঁচা দিচ্ছিল মাঝেমাঝে। এতগুলো পাঁচটাকা দশটাকার কয়েন, তাই অনেক আশা করেছিলাম। 

বৌদি উত্তরের আশায় তাকিয়ে বসতে বললাম। মুখ ঘুরিয়ে নিল। ‘নাহ্‌ আমি যাই, বাবার ওষুধ আছে।’ আচমকা গা-টা কেমন রিরি করে উঠল। মাথা গরম করে চেঁচিয়ে বললাম – ‘তাহলে প্রশ্নটা করার মানে কী? দেড়টার জায়গায় একটা চল্লিশে ওষুধ খেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!’ বৌদি চলে যাচ্ছিল, কথাটা শুনে গতিপথ বদলে আমার মুখোমুখি। যারা নিজেরা খুব নিচু গলায় কথা বলতে ভালবাসে, তাদের কলরবটা অন্যরকম। তাদের মনখারাপ, রাগ, অভিমানের ধরনটাও যেন মাঝনদীর টানের মতো। সরব, কিন্তু সরগরম নয়। এই তাকানোটা আমি চিনি। ‘আর কিছু বলবে?’ এরপর আর বিস্ফোরণ সম্ভব নয়। এরকম একটা শান্ত সমাহিত গলাআয়নার মতো চোখ। নিজেকে দেখতে পেয়ে গুটিয়ে নিলাম। ‘না, যাও!’ বৌদি একটা হাত রাখল আমার কাঁধে। ‘আর একটু চেঁচিয়ে নিলে যদি মনটা ভাল হয় হোক না! আমারও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পারি না। জানি কষ্ট হয়।’ 

এই একটা ব্যাপারে আমি লুকোচুরি খেলতে শিখিনি, সবাই বলে। আমার অনুভূতিগুলো নাকি সহজেই পড়ে ফেলা যায়। এক নিঃশ্বাসে। বনফুলের অণুগল্পের মতো। কিন্তু আমার বৌদি, ওর মনের কুয়োয় ঝুপ করে বালতি ফেলে বোঝা যায় না কতটা গভীর। একটা ফিকে শব্দের প্রতিধ্বনি হয় শুধু। আর এই জন্যই হয়তো এ বাড়িতে টিঁকে গেল। তিনটে তিন রকম পুরুষমানুষ। তিনজনেই মর্জির মালিক। জীবনের যাবতীয় ফ্রাস্ট্রেশনগুলোকে কোনও জানলা খুলে দিতে পারে না, ফলে সেগুলো ঝুল বা শুকনো ধুলো হয়ে বেঁচে থাকে ঘরের আনাচে কানাচে। ময়লা শরীরেরই হোক বা বাড়ির, নিজের হলে মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়া কথা দুটোর আর আলাদা মানে থাকে না। হতে পারে এখন এটাই বৌদির বাড়ি কিন্তু বাস্তবিক, সে তো অন্য বাড়ির মানুষ। অন্য বাড়ি মানে একটি অভিজাত মুসলিম বাড়ির মেয়ে। 

দাদা একটা সময় লেদারের বিজনেস করেছিল। কাঁচা চামড়া। বছর দেড়েক টেড়েক হবে। কী খাটনি! সারাদিন দৌড়চ্ছে। বাড়িতে এলেও ফোন আর ফোন। ঘুম নেই। বাথরুমে উঠেছি, দেখি খাবার টেবিলে বকের গলার মতো বাঁকা ল্যাম্পটা দেয়ালে ছায়া ফেলেছে মানুষের। দাদা ক্যালকুলেটার নিয়ে ব্যস্ত ফ্যান চালায়নি! এলোমেলো হয়ে যেতে পারে টুকরো দরকারি কাগজ। বাবা ওপার বাংলার মানুষ। খাস বরিশালের। জ্যেঠু দাদুদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে শুনেছি। কেন জানি না মুসলমানদের প্রতি অদ্ভুত একটা নেতিবাচক মনোভাব। খালি দাদাকে সাবধান করত, ওদের সঙ্গে কোনওরকম ঝামেলায় জড়াবি না, চোখকান খোলা রেখে চলবি। জানবি ওরা সব পারে! দাদাকে বলত ঠিকই, কিন্তু মনে হত দেয়ালকে বলছে! 

একটা লাইন খুঁজছি লেখাটা শুরু করার জন্য। হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আমার এই গিটারটা, এখন যেটা নিয়ে শো করি আর কি, যেটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে জ্যাকেট খোলা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে বেশি ভালবাসে, এটা কিনেছিলাম আমার জমানো টাকায়। না, অ্যাকচুয়ালি মিথ্যে বলা হল, হাজার দু’য়েক কম পড়েছিল। তাই মন খারাপ করে দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম মনের মধ্যে একটা ছাই চাপা ধিকিধিকি অভিমান। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। সব সময় একটা বিরক্তি বিরক্তি ভাব।

আমায় একবার নিয়ে গিয়েছিল ওদের লেদার কমপ্লেক্সে। মাথায় রোদ। পেটভরা চিকেন তন্দুরি, বিফ কাবাব, কোল্ডড্রিঙ্ক। আর হাওয়ায় একটা গা গুলিয়ে ওঠা পচা গন্ধ। অনেকটা দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা বাসি মাংসের মতো‘ঠিকঠাক না রেস্টুরেন্টটা?’ প্রশ্নটা করে দাদা বোধহয় বুঝিয়ে দিল, খাবারের গন্ধে ভেসে থাক, বাইরে বেরলেই মনটা পালাই পালাই করতে পারে। সত্যি ওইটুকু ঘুপচি রেস্টুরেন্ট। কেউ ভাবতেই পারবে না এখানে রান্নার এত ভাল টেস্ট কী ভিড়! তবে ভিড়ের মানুষগুলো লাল মশলাদার বিফ ভুনা আর স্যাঁকা পাউরুটি খাচ্ছে। সব্বাই। দাদা বলল, এরা বাঁধা খদ্দের। এই একই খাবার রোজ খায়। বেশির ভাগই পেটের অসুখে ভোগে। 

দাদার একজন গডফাদার ছিল। আকবর ভাই। যতদূর জানি উনিই দাদাকে প্রায় হাতে ধরে বিজ়নেসটা শিখিয়েছিলেন। কাঁচা চামড়ার কোয়ালিটি চিনতে শিখিয়েছিলেন। কীভাবে টাকা রোলিং করবে, কোথায় ইনভেস্ট করতে হবে। মুর্শিদাবাদের আজিজ় হুসেন, ক্যানিংয়ের নিত্য মণ্ডল, বনগাঁর শেখ পিন্টুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘ছেলেটার খেয়াল রাখবি। বড় রেসের ঘোড়া। ভাল ছেলে। ওর ভাল হলে তোদেরও ভাল হবে।’ কথাগুলো আমার নিজের কানে শোনা। এরপর আরও অনেক কথা হয়েছিল। বেশির ভাগই চলে গিয়েছিল মাথার উপর দিয়ে। বুঝেছিলাম সব প্রফেশনেরই একটা নিজস্ব ভাষা থাকে। আর তা ছাড়া যে বাড়ির তিনভুবনে কেউ কোনও দিন ব্যবসা করেনি, বিজ়নেস ব্যাপারটা তাদের কাছে নিচুতলার মানুষ। মানে যার কথাবার্তার ছিরিছাঁদ নেই, আকাচা দাগ লাগা পোশাক, পায়ে পুরনো না-সারা ক্ষততে আরও বেশি পুরনো ব্যান্ডেজের শাসন। না… মানে হয়তো এতটাও নয়, তবু কিছুটা। আমারও দাদাকে বিজ়নেস করতে দেখার আগে এরকম একটা অশিক্ষিত ধারণা ছিলমনে হত যাদের জীবনে পড়াশোনার অভাব, ক্রিয়েটিভিটি খায় না মাখে বোঝে না, তারাই ব্যবসাপাতি করে। ভাঙল যখন, শব্দ হয়নি খুব বেশি। শুধু দেখলাম কুচি কুচি অনেকগুলো টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। সব কুড়োতে পারিনি এখনও। মাঝেমাঝে পায়ের নীচে পড়লে টের পাই। রক্ত বের হয়। কিন্তু দাদার কাছে গিয়ে বলতে পারি না, আমিও তোর সঙ্গে বিজ়নেস করব। কাকে বলব, দাদা তো থেকেও নেই। বা হয়তো না থেকেও আছে। দাদার পরিশ্রম, জেদ আর দিনরাতের সময়গুলো এলোমেলো করে দেওয়া বাঁধনছাড়া স্বপ্ন দেখার সেই সময়টা আছে। 

বিশ্বাস করুন, সত্যিই আমি জানি না দাদার কোনটা আকাশছোঁয়া আর কোনটা বাঁধনছাড়া। বৌদি বা বাবাও জানে না। মানুষটার তো সময়ই ছিল না এত কথার তবে আমার দাদা প্রমাণ করে দিয়েছিল কাঁচা টাকা উড়ে উড়ে আসে না। তার জন্য বুদ্ধি পরিকল্পনা আন্তরিকতা আর নাছোড়বান্দা মনোভাব থাকতেই হয়। একটা লোকের সঙ্গে অনেক টাকা থাকে বলে তাকে নিয়ে বাড়ির লোক দুশ্চিন্তা করছে, এটাও যে অভিজ্ঞতা হবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। 

সত্যি কথা বলতে কি, এমন অনেক চোখ ধাঁধানো শো-পিস আমাদের বাড়ির আনাচে কানাচে নিজের জায়গা খুঁজে নিল, যেখানে তাদের মানায়ই না। ফুটপাথে ঠান্ডা কাচের ভেতর রাজসিক নিঃশ্বাস ফেলা ঘড়িটার মালিক করে দিল দাদা একদিন। অ্যাওয়ার্ড শো-তে দেখা বিদ্যা বালানের শাড়ি বৌদির আলমারি অবধি পৌঁছে গেল। তবু দাদার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত না বাবা। দাদার কেমন লাগত জানি না, আমার খারাপ লাগত। দু’জনের জন্যেই। দাদাও তো এমনভাবে উত্তর দিত যেন চেয়ার টেবিলের সঙ্গে কথা বলছে। এখন বুঝি, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অনুমানক্ষমতা, বিচারবোধ বদলায়। দুর্যোগের খবর পৌঁছে যায় অনেক আগেই। পশুপাখিদের মতোই তারা অনুভব করে, কিছু একটা এলোমেলো হতে চলেছে। 

দাদা একটা সময় লেদারের বিজনেস করেছিল। কাঁচা চামড়া। বছর দেড়েক টেড়েক হবে। কী খাটনি! সারাদিন দৌড়চ্ছে। বাড়িতে এলেও ফোন আর ফোন। ঘুম নেই। বাথরুমে উঠেছি, দেখি খাবার টেবিলে বকের গলার মতো বাঁকা ল্যাম্পটা দেয়ালে ছায়া ফেলেছে মানুষের। দাদা ক্যালকুলেটার নিয়ে ব্যস্ত ফ্যান চালায়নি! এলোমেলো হয়ে যেতে পারে টুকরো দরকারি কাগজ। বাবা ওপার বাংলার মানুষ।

দাদার জীবনের মিরাকলগুলো বাবার কাছে ছিল অশনিসঙ্কেত। ইচ্ছে করে বৌদির কাছে জানতে চাইব কখনও কিছু আভাস পেয়েছিল কিনা। তারপর ভাবি খুব বোকাবোকা হবে প্রশ্নটা। বিশেষ করে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন মানুষটা আর ফিরে আসবে না জানি। 

অপরাধী এখনও ফেরার। পুলিশ এখনও অন্ধকারে। তবে ইদানীং শোনা যাচ্ছে একটা নাম। অন্য ঘটনার ছুতো ধরে। লোকটা চোলাই মদের ঠেক, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে। রাজনৈতিক ছাতার তলায় অনাথ আশ্রম চালানোর নামে নানা অসামাজিক কাজ করে। বাড়িতে এগুলো কিছু বলিনি। কিন্তু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে খবরটা ঢুকে পড়ল ঘরময়। 

একদিন বিকেলে বৌদি ঘরে এল। ‘আমায় একটা অনাথ আশ্রমে নিয়ে যাবে? জোকার দিকে। আমি একজনের সঙ্গে দেখা করব।’ দাদা আমার জায়গায় থাকলে বৌদিকে ঠিক নিয়ে যেত। আমার মনে হয় অত বুকের পাটা নেই। কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘বাবা কিছু বলেছে তোমায়?’ ‘কী নিয়ে?’ উত্তরটা শুনে ভাবছি বাবা কি তাহলে বলেনি! আমায় যে বলল! নাকি বৌদি আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছে কথাটা। ‘বল? বল না, বাবা যেটা বলতে চায় সেটা যদি তুমিও, মানে তুমিও বলবে ভেবে থাক তাহলে আর বলতে অসুবিধে কোথায়?’ 

আজ বাবার মনে হচ্ছে বৌদির জীবনটা একটা অন্ধকারের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে। প্রচুর লালকালির দাগওয়ালা কাটাকুটিতে ভরা ছন্নছাড়া সুতো খোলা নামগোত্রহীন খাতার মতো। আজ বাবার মনে হচ্ছে দাদার এই পরিণতিটার জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। আমি। বাবা নিজে। বৌদিও। তবুও আজ বাবার মনে হচ্ছে, এই দুর্যোগটা ভুলে নতুন করে ঘর বাঁধুক বৌদি। মানুষটা আমাদেরই থাকবে। শুধু একটা নতুন দিক্‌চক্রবাল রেখা তৈরি হোক বৌদির জীবনে। আকাশ না হোক। অন্তত আকাশটা যেখানে মিশেছে বলে মনে হয়।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় জন্ম অভিরূপের। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ। কিছুদিন ফ্রিলান্স সাংবাদিকতাও করেছেন। এরপরেই ঢুকে পড়া টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আঙিনায়। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির সঙ্গে পরিচয়। একইসাথে চলতে থাকে গল্প-কবিতার পালা। দেশ, এই সময়, আজকের সম্পূর্ণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *