গৃহিণী দেহ রেখেছেন একমাস হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন ধরেই উচ্চগ্রামে ঘোষণা করছিলেন “তোমাদের জন্যই আমি যে কোনওদিন মাথার শিরা ছিঁড়ে মরে যাব।” কিন্তু বাড়ির কেউই পাত্তা দেয়নি। কে জানত উনি নিজের কথা রেখে ফেলবেন ধাঁই করে!

শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গিয়েছে। সেই অবধি তো একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। তারপরও মনে হচ্ছিল যে হয়তো তিনি কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন- গবেষণার কাজে বা লেকচার দিতে গিয়েছেন। এখন সেই চটকাটাও কেটে গিয়েছে। ফ্ল্যাটে শম্ভুবাবু, দুই কন্যা মোহর আর গিনি, আর মেয়েদের মামাবাবু রোদ্দুর ঘোরাফেরা করেন। আর গিন্নি দেওয়াল থেকে ঝুলতে ঝুলতে মুচকি মুচকি হাসেন। শম্ভুবাবুর মাতৃদেবী সিদ্ধেশ্বরী বেশিটা সময় নিজের ঘরেই থাকেন। পুজো-ঘুম-সিরিয়ালেই নিজেকে বন্দি করে নিয়েছেন। সব্বাই ব্যস্ত। উদ্বৃত্ত সময়ে তাঁর সাথে কথা বলার আর গপ্পো করার কেউ নেই বলে চোখের জল ফেলেন।

একদিন নিজের জগতের বাইরে গিয়ে বসার ঘরে বৌমার ছবিতে বাসি মালা দেখে কেঁপে উঠে হাঁক দিয়েছিলেন “সাধনা!” বলে। সিদ্ধেশ্বরীদেবীর এই উচ্চস্বর অনেকদিন বাদে শুনে পুরনো কাজের মেয়ে সাধনা- যে নিজেকে বাড়ির ম্যানেজার বলে পরিচয় দিয়ে থাকে, হন্তদন্ত হয়ে হাজির হল। “জানিস না, কোনও ফটোতে বাসি মালা ঝুললে বৌমা রেগে যায়!” হঠাৎ খেয়াল পড়তে কালে গোলমাল হয়ে গিয়েছে- ‘যায়’টা ‘যেতো’ হবে। চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন সিদ্ধেশ্বরী। তারপর থেকে মালাটা নিত্য আসে আর বৌমার গলায় টাটকা মালা ঝোলে।

একটা সময় বাড়ির সবাই গিন্নির অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হল। প্রথম কয়েকদিন মন্দ কাটল না- এক অন্যরকম স্বাধীন জীবন। শম্ভুবাবু মনের সুখে সন্ধ্যে হতেই বোতল খুলে বসে পড়তে শুরু করলেন। মোহর রোজ ম্যাগি খেতে শুরু করল। গিনি ইন্‌স্টাগ্রামে অ্যাকাউণ্ট খুলে ফেলল। রোদ্দুর মাঝরাত অবধি অন্‌লাইন থাকতে শুরু করল। সিদ্ধেশ্বরী নতুন নতুন উপোস শুরু করলেন। খবরদারি করার, নজরদারি করার কেউ নেই- টোটাল স্বাধীনতা! বেশ কাটছিল দিনগুলো।

কিন্তু তাল কাটল এক সকালে। সাতদিন আগে সাধনা পাঁচ কিলো আটা কেনার পয়সা নিয়েছিল শম্ভুবাবুর স্পষ্ট মনে আছে। এখন সাধনার দাবি, তাকে দু’কিলো আটার পয়সা দেওয়া হয়েছে। কথা কাটাকাটিটা চিৎকার অবধি যখন দৌড়ল, তখন কর্তার মনে পড়লো গিন্নির মানে ইন্দিরার তিরোধানের পর থেকে রোজকার হিসেবের খাতা লেখা হয়নি। সেদিনই বিকেলে গিনি ঘোষণা করলো সে আসছে শনিবার বন্ধুর বাড়িতে থাকবে। কে বন্ধু, কেমন বন্ধু, তার মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় নেই- কোনওমতে শম্ভুবাবু সামাল দিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু এ বার তিনি বেশ বুঝতে পারলেন চাকরি-সংসার-লেখালিখি নিয়ে যে সমবাহু ত্রিভুজ তিনি বানিয়েছিলেন, সেটা এবার ধ্বংস হল বলে!

কয়েকদিন ঠেকনা দিয়ে চালিয়ে একদিন সকালবেলা অফিসে পৌঁছে শম্ভুবাবু ইনবক্সে দেখলেন মানবসম্পদ দফতর থেকে একটা ইমেল এসেছে। সত্বর তাঁকে তাঁর সমস্ত মার্কশিট জমা দিতে বলা হয়েছে। তাঁর মনে পড়ল, ছ’মাস আগে যখন এই কোম্পানিতে জয়েন করেন, বলা হয়েছিল ছ’মাসের মধ্যে এগুলো জমা দিতে। ইন্দিরাকে বলেওছিলেন সেই কথা। ইন্দিরা বলেছিল সময় করে বার করে রাখবে। সেগুলো তার হেফাজতেই থাকত। ইন্দিরার চলে যাওয়ার ধাক্কায় ভুলেই গিয়েছিলেন সে কথাটা। বাড়ি ফিরে সর্বত্র খুঁজতে শুরু করলেন শম্ভুবাবু। অবশেষে আলমারির লকারে রাখা একটা খাম থেকে বেরল তাঁর কলেজ জীবন থেকে সমস্ত পরীক্ষার মার্কশিট। ইন্দিরার কথা ভেবে চোখে জল এসে গেল শম্ভুবাবুর। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল পড়ল, আরে! মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের মার্কশিট তো নেই এই খামে! ধপ করে মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন শম্ভুবাবু। এত ভালো চাকরিটা চলে যাবে! কোম্পানি কি এই খুঁজে না-পাওয়া মেনে নেবে!

রাতে খেতে বসে এই সমস্যার কথা জানাতে দেখা গেল, বাড়ির বাকি সদস্যরাও বিভিন্ন সমস্যায় জেরবার। রোদ্দুর অভিনেতা। তাদের দল আমেরিকা যাওয়ার আমন্ত্রন পেয়েছে। নিউইয়র্কের “কল্লোল” তাদের দুর্গাপূজার সময় ওখানকার বঙ্গসম্মেলনে নেমন্তন্ন করেছে। কিন্তু রোদ্দুর তার কোট বা ওভারকোট কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না বাড়িতে। মোহর তার বন্ধু সান্ত্বনার পালাজো নিয়ে এসেছিলো। সান্ত্বনা সেটা ফেরত চাইছে। মোহর খুঁজে পাচ্ছে না। গিনির ইস্কুলে মাইনে বাকি পড়েছে বলে ইস্কুল থেকে নোটিস দিয়েছে। সিদ্ধেশ্বরীর বাতের মলম শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোন দোকানে ওটা পাওয়া যায় কেউ জানে না। অনেক আলাপ আলোচনা করা হল, কিন্তু লাভ কিছুই হল না। একটা জিনিসই আবিষ্কৃত হল- ইন্দিরা থাকতে কোনওদিনই এই সমস্যাগুলো হয়নি। গিনি হঠাৎ বলে উঠল- “প্ল্যানচেট করো না! মা এসে এই সব প্রবলেমেটিক সাম সল্‌ভ করে দেবে!”

আইডিয়াটা মন্দ নয়। আর কোনও উপায়ও নেই! দেরি করলে শম্ভুবাবুর চাকরি চলে যেতে পারে। সেই রাতেই প্ল্যানচেটে বসা হবে, সেটাই ঠিক হল। মিডিয়াম হওয়ার জন্যে রোদ্দুরকে রাজি করানো গেল এই কড়ারে, যে তার কোট আর ওভারকোট কোথায় আছে সবার আগে জেনে নিতে হবে। সব্বাই হাত ধরাধরি করে ডাইনিং টেবিল ঘিরে বসল। আগের ডাইনিং টেবিলটা বাতিল করে গোল ডাইনিং টেবিল নিয়ে আসাটা ইন্দিরারই মস্তিস্কপ্রসূত। খাওয়ার সময় সাম্যবাদকে গুরুত্ব দিয়ে। তারই কেনা সেই গোল ডাইনিং টেবিলে তারই প্ল্যানচেট- শম্ভুবাবু গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্ধকার ঘর। মোমবাতির আলো। হাত ধরাধরি করে সবাই বসে। সবাই ইন্দিরাকে স্মরণ করছে আর ডাকছে। হঠাৎ একসময় রোদ্দুরের গলা নেতিয়ে পড়ল। গলার আওয়াজও বদলে গেল। ইন্দিরা এসেছে।

-বলো কী হয়েছে। হাঁকডাক করছ কেন!

একে একে সব্বাই তাদের সমস্যাগুলো বলল আর নিমেষে ইন্দিরার আত্মা সব সল্‌ভ করে দিল। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের মার্কশিট কোন জায়গায় রয়েছে। ঠিক কোন মোবাইলে গিনির স্কুল ফি নিয়ে রিমাইন্ডার সেট করা আছে থেকে কোন লণ্ড্রিতে কোট-ওভারকোট আছে আর সেই লণ্ড্রির বিল কোন ব্যাগে আছে সেই অবধি বলে দিল। হৃষ্টচিত্তে শম্ভুবাবু জিজ্ঞেস করলেন “আছো কেমন ওখানে?” উত্তর এল, “এখন বকবক করার সময় নেই। কলেজে যেতে দেরি হয়ে যাবে। প্রিন্সিপালটা শুধু বাঁশ দেয়। এই মাসে তুমি চারদিন বাদ দিয়ে রোজ ড্রিঙ্ক করেছ। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? আমি চললাম।” খানিক বাদে রোদ্দুর স্বাভাবিক হয়ে গেল। সবাই শুতে চলে গেল। শম্ভুবাবু বিছানায় একা একা শুয়ে সারারাত ভাবলেন। ওখানেও কলেজে প্রিন্সিপাল ইন্দিরাকে বাঁশ দিচ্ছে আর ওখান থেকেও ইন্দিরা ওঁর গ্লাস-বোতলের সদ্ভাবের ওপর নজর রাখছে?

কয়েকদিনের মধ্যেই এই প্ল্যানচেটের কথা ছড়িয়ে পড়ল। সাধনা ঝাঁপিয়ে পড়ল সব্বার আগে। বাসন মাজার কল্যাণী নাকি মাঝেমাঝেই রাত নটা বাজিয়ে আসছে, ইন্দিরা থাকতে যা কোনওদিন হয়নি! ইন্দিরার মা কাবেরীদেবীর ফ্ল্যাটের মিউটেশন নিয়ে ইন্দিরার সঙ্গে স্থানীয় কাউন্সিলরের কী কথা হয়েছিল, কাবেরীদেবীর কোনও ধারনা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার প্ল্যানচেট। আবার রোদ্দুর মিডিয়াম। আবার ইন্দিরা। আবার সহজ সরল সমাধান। কাউন্সিলারের ছেলের জন্যে চাকরি দেখে দেওয়ার দায়িত্ব শম্ভুবাবুকে দিয়ে আর সাধনাকে কল্যাণীকে দুপুরে খেতে দেওয়ার দায়িত্ব মনে করিয়ে ইন্দিরার আত্মা স্বগতোক্তি করল “আমার কলেজের চাকরি আর থাকবে না। আজকেও লেট!”

এমন সমাধান কি লুকিয়ে রাখা যায়! সিদ্ধেশ্বরী আর কাবেরী তাঁদের সন্তানদের খবরটা দিলেন। আর আবার প্ল্যানচেট। কারও আয়া দরকার, কারও রান্নার লোক দেশে গিয়ে ফেরত আসছে না, কারও সন্তানের জন্যে টিচার পাওয়া যাচ্ছে না, কারও সন্তান হওয়া নিয়েই প্রবলেম। সেদিন প্ল্যানচেট বেশ অনেকক্ষণ চলল। ইন্দিরা আর কলেজের কথা বলল না। প্ল্যানচেটের ঘোর ভাঙল কলিং বেলের লম্বা আওয়াজে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শম্ভুবাবু ঘরের আলো জ্বালিয়ে চোখ পিটপিট করতে করতে দরজা খুলে বিপুল চমকে গেলেন। সামনে ইন্দিরা দাঁড়িয়ে।

-কী হল সরো! সংয়ের মতো দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?”

শম্ভুবাবু কোনওমতে বললেন- “তুমি তো চলে গিয়েছিলে!”

“মরেও কি নিস্তার আছে? তোমাদের ঠেলায় বিধাতা আর যমরাজ দুজন বোর হয়ে মিটিং করে ফেরত পাঠালেন। বললেন সব কাজ শেষ করে তবেই ফেরত যেতে। আমার সার্ভিস বুকের কী হবে কে জানে। কেরিয়ারের প্রয়োজন তো শুধু তোমাদেরই!”

এর পরেই কানে এল –“সূর্য ঢললেই তুমিও ঢলার ব্যবস্থা তো ভালোই করেছ দেখছি!”

বিস্ময়, খুশি আর নিশ্চিন্ততায় মাখামাখি হয়ে শম্ভুবাবু স্বগতোক্তি করলেন, ডমরুধরেরও এরকম ডঙ্কা-নিনাদ নিয়ে প্রত্যাবর্তন ঘটেনি

 

বিঃ দ্রঃ কারুর সঙ্গে কারুর মিল খুঁজে পেয়ে শম্ভুবাবুকে কলঙ্কিত ও লাঞ্ছিত করবেন না!

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

24 Responses

  1. অপূর্ব কারুর সাথে মিল পাওয়া গেলে বলা বারণ তাই মিলটা নিজের মধ্যে হজম করে এই corona আতঙ্কের মধ্যে চুপিচুপি হাসানোর জন্য পিনাকী আপনাকে অভিনন্দন

  2. দারুন মজা লাগলো পড়ে মন ভালো হয়ে গ্যালো …. একটুও মিল খুঁজিনি শুধু হেসেছি …আর প্রার্থনা করি.. এইরকম মন ভালো করা লেখা আরও লিখে যা ….

  3. যাক অবশেষে যমের মুখে ছাই দিয়ে, শম্ভু বাবু ইন্দিরা কে ঠিক ম্যানেজ করে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন. ???…তা
    সে জনকল্যাণ এর জন্যই হোক বা নিজকল্যানের জন্যই হোক ??? ব্রাভো শম্ভু বাবু ??

  4. মজা করে একদম বাস্তব টা কে দেখিয়েদিলে।দারুন।বাস্তবে তো এই গুরুত্বহীন কিন্তু অতিজরুরী মানুষরা চলে গেলে আর ফেরে না কিন্তু প্রতি পদে পদে তাদের অভাব বুঝিয়ে দেয় কত খানি প্রয়োজন ছিল তাকে।তোমার লেখায় ইচ্ছে পূরণ হলো সবার আমাদেরও।আহা সত্যি যদি এমন হতো!

  5. কাল্পনিক হলেও মন ভালো করা লেখা । । লেখাটা পড়ে সংসারে নিজের গুরুত্বটা নতুন করে উপলব্ধি করলাম । সত্যিই এখোনো অনেক কাজ বাকি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *