বিটি রোডের পাশে ঐতিহ‍্যবাহী বেলঘরিয়ার সরস্বতী প্রেস। কলকাতা তো বটেই, সারা ভারতবর্ষে এই প্রেসের সুখ‍্যাতি রয়েছে। ১৯২৩ সালে ‘যুগান্তর’ দলের কর্ণধার প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর পরামর্শে ত‍ৎকালীন দুই বিখ‍্যাত কংগ্রেস নেতা অরুণচন্দ্র গুহ এবং মনোরঞ্জন গুপ্তকে সঙ্গী করে মহেন্দ্রনাথ দত্ত ২৬/২ বেনিয়াটোলা লেনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সরস্বতী প্রেস। পরবর্তীকালে সাহিত‍্য সংসদ এবং শিশু সাহিত‍্য সংসদও তৈরি করেন এই মহেন্দ্রনাথ দত্ত-ই। বেনিয়াটোলা লেনে সরস্বতী প্রেসের শুরুটা হলেও নানা কারণে পরের বছর থেকে তা স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। পরাধীন ভারতে মূলত জাতীয়তাবাদী সাহিত‍্যকে প্রচারের আলোতে নিয়ে আসাই ছিল এই প্রেস তৈরির নেপথ‍্য কারণ। ফলে এই প্রেসের প্রতিটি ইঁটের খাঁজে লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস। ১৯৭৫ সাল থেকে সরস্বতী প্রেসের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের সুযোগ‍্য পুত্র এবং সাহিত্য সংসদের কর্ণধার দেবজ‍্যোতি দত্ত। শতাব্দী প্রাচীন এই প্রেসের নেপথ‍্যের নানান গল্প নিয়ে বাংলালাইভের মুখোমুখি হলেন তিনি। প্রতি বুধবার ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি পর্বে প্রকাশিত হবে দেবজ‍্যোতি দত্তের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি। কথোপকথনে দেবজ্যোতি দত্ত এবং শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়…

আজ দশম পর্ব।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এখান থেকেই আমরা অভিধানের আলোচনায় ঢুকব…

দেবজ্যোতি দত্ত: এই অভিধান যখন বেরোয়, আমি আগে বলছিলাম দাশগুপ্ত কোম্পানি কেন সাহিত্য সংসদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের অভিধানের সাফল্যের মূল হোতা হচ্ছে দাশগুপ্ত কোম্পানি। দাশগুপ্ত সমস্ত জায়গায় তাঁদের বিভিন্ন ক্যাটালগ পাঠাতেন। সেগুলো একটা খামের ভেতর করে যেত। খামের ওপর ছাপা থাকত সংসদের অভিধান ব্যবহার করুন।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: বিজ্ঞাপনের কাজ করত ওটা!!

দেবজ্যোতি দত্ত: একদম, বিজ্ঞাপনের কাজ করত। এবং সমস্ত ইন্সটিটিউশন— যত কলেজ, যত স্কুল, যত ইউনিভার্সিটি— সমস্ত জায়গায় তাঁদের খাম যেত। এসব জায়গায় প্রচারে ভীষণ সাহায্য করেছিল। এই সাহায্য না-পেলে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সংসদ এ-জায়গায় পৌঁছতে পারত না।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: সংসদের প্রথম অভিধান কোনটা? কত সালে বেরিয়েছে?

দেবজ্যোতি দত্ত: বাংলা অভিধান। নভেম্বর, ১৯৫৭ সালে।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এটা কি শৈলেন্দ্রবাবু করেছেন?

দেবজ্যোতি দত্ত: শৈলেন্দ্র বিশ্বাস। এই শৈলেন্দ্র বিশ্বাস বাবার একজন আবিষ্কার।

Samsad Dictionary

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এই প্রসঙ্গে আমি আবার আসব। কিন্তু একটা জিনিস জানতে চাই আপনার কাছ থেকে সেটা হচ্ছে, বাংলায় যে অভিধানের কাজগুলো হয়েছে, সেগুলো বেশিরভাগই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। একজন মানুষ, তিনি একটি অভিধান রচনা করবেনযেমন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস…

দেবজ্যোতি দত্ত: হরিচরণ হয়েছে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন হয়েছ, সুবল মিত্র হয়েছে এবং এ টি দেব হয়েছে সবই কিন্তু একক প্রচেষ্টায়।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: একক প্রচেষ্টায়। এ টি দেব হয়তো নিজের একটা প্রকাশনার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন, সকলের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

দেবজ্যোতি দত্ত: সুবল মিত্র-ও করেছিলেন। নিউ বেঙ্গল প্রেস তো সুবল মিত্রের।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: আচ্ছা। কিন্তু হরিচরণের সে-সুবিধা ছিল না। অনেক কষ্ট সহ্য করে তাঁকে এই কাজটা করতে হয়েছিল।

দেবজ্যোতি দত্ত: জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের সুবিধাটা ছিল কী, ইন্ডিয়ান প্রেসের কর্ণধারের বাড়িতে উনি গৃহ-শিক্ষক ছিলেন! হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস— দুজনের অভিধানের তফাতটা হচ্ছে, হরিচরণ হলেন ব্যাকরণগত ও উৎপত্তিগত। আর জ্ঞানেন্দ্রমোহন হলেন ব্যবহারগত।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এটিমোলজি আর ইউসেজ।

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ। যার জন্য ‘অভিধান’ কথাটা হরিচরণে নেই। ‘শব্দকোষ’ ব্যবহার করেছেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে ‘অভিধান’ কথাটা আছে। 

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ আর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’।

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ।

Bengali Dictionaries
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ আর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এটাও আমার মনে হয়, আপনার বাবা মহেন্দ্রবাবুর এটা একটা বড় ভাবনা। অভিধান তো একটা বড় প্রকল্প, একটা সামাজিক প্রকল্প, একটা ইন্সটিটিউশন লাগে তার জন্যে, অনেক মানুষের অংশগ্রহণ লাগে এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, যে-কারণে আমাদের বাংলা ভাষার ক্ল্যাসিকাল অভিধান হিসেবে যেগুলো পরিচিত— হরিচরণ, জ্ঞানেন্দ্রমোহন, এমনকী খুব ছোট আকারে হলেও খুব কাজের অভিধান রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’…

দেবজ্যোতি দত্ত: ‘চলন্তিকা’ সেই সময়ে এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল কেন? হ্যান্ডি।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, ভীষণ হ্যান্ডি।

দেবজ্যোতি দত্ত: বড়-বড় অভিধান করে তো লাভ নেই! প্রাত্যহিক জীবনে যে-শব্দগুলো আমার দরকার হয়, সেগুলোর মানে নিয়েই ‘চলন্তিকা’।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এটাই ‘চলন্তিকা’-র ইউ এস পি।

দেবজ্যোতি দত্ত: একদম ঠিক বলেছ, এটাই ইউ এস পি। তার কারণটা হচ্ছে, যে-কোনও অভিধানের ক্ষেত্রে তুমি দেখবে একটা লজিক কাজ করে। রাজশেখর বসু ছিলেন বিজ্ঞানের লোক, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ছিলেন বিজ্ঞানের লোক। লজিকটা মাথায় রেখে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করে ব্যবহারগতভাবে যাতে কাজে লাগে, সেটা করেছেন। বাবা চেয়েছিলেন বড় অভিধান হোক। তার সঙ্গে সঙ্গে ছোট, হ্যান্ডি অভিধানও থাকুক। যার জন্য সংসদ ‘বাংলা অভিধান’ তৈরি হয়েছিল। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস বাবার আবিষ্কার, বললাম। তিনি আগে দেব সাহিত্য কুটীরে ছিলেন। সেখানে কোনও কারণবশত সুবোধ মজুমদারের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। তিনি ছেড়ে চলে এসেছেন, তখন বাবা তাঁকে নিয়ে এলেন। তাঁর বাড়ি থেকে আরম্ভ করে, সবরকম সাহায্য করে, মাসোহারা দিয়ে বাংলা অভিধান প্রথম চালু করেন।

Rajshekhar Basu
রাজশেখর বসু

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: শৈলেন্দ্রবাবু তো লেক্সিকোগ্রাফার হিসাবে একজন অসামান্য মানুষ ছিলেন।

দেবজ্যোতি দত্ত: ওই তো বলছি! লেক্সিকোগ্রাফি জিনিসটা তো বাংলাতে সেরকমভাবে প্রচলিত ছিল না। লেক্সিকোগ্রাফি— অভিধানের যে ব্যাপারটা, সেটা একটা সায়েন্স। সেটা কিন্তু এখানে সেরকমভাবে কাজে লাগেনি। এই বিজ্ঞানটা পরে আমি অনেকখানি পেয়েছিলাম ‘সমার্থ শব্দকোষ’ করার সময় অশোক মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। এই যে লজিক, সেটা সিলেকশনের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় জিনিস। অশোক মুখোপাধ্যায় পরে ‘ব্যাকরণ অভিধান’ করেছেন, ‘বানান অভিধান’ করেছেন, সবটাই কিন্তু ব্যবহারিক দিকটার প্রতি লক্ষ্য রেখে। তাই, অশোকবাবুর যত প্রশংসাই করা যাক, তা কম হয়। বাংলা ভাষাকে উনি যা দিয়েছেন, আর কেউ দিতে পারেননি।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ‘সমার্থ শব্দকোষ’ সত্যিই অতুলনীয়। আচ্ছা, এই যে সংসদের অভিধান ষাটের দশকে একটার পর একটা বেরোতে শুরু করল, ধীরে–ধীরে বাড়ছে, পরিবর্ধিত হচ্ছে, পরিমার্জিত হচ্ছে— পাঠকের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

দেবজ্যোতি দত্ত: ভালো। সেই তো বলছি যে, সংসদ, হাউস অফ ডিকশনারিস!

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: সেই সময় বাংলাতে যে অভিধানগুলো প্রচলিত ছিল, সেগুলোর সঙ্গে তো একটা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে যেতেই হচ্ছে?

দেবজ্যোতি দত্ত: সেই অবস্থায় সংসদ কিন্তু আস্তে আস্তে তার প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। এই যে প্রতিষ্ঠাটা পেল, সেটা দাশগুপ্ত কোম্পানির সৌজন্যে।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এর সঙ্গে কনটেন্ট-এর এই যে রেগুলার আপডেশন, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

দেবজ্যোতি দত্ত: রিভাইস করছে। এই রিভিশনের মধ্য দিয়েই কিন্তু ডিকশনারির গুরুত্বটা বেড়ে যায়। এইভাবে তো সবাই চিন্তা করত না। ‘চলন্তিকা’ আজ অব্দি রিভিশন হয়নি। রাজশেখর বসু মারা গেছেন, তার পর আর রিভিশন হয়নি।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: বিখ্যাত বড় অভিধানগুলোর কোনোটারই হয়নি?

দেবজ্যোতি দত্ত: অন্য কেউ চাননি। রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’র রিভিশন করব, কী করতে কী করব তার ঠিক নেই…

Shamaarthoshabdokosh

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: অভিধান যে একটা জাতির সামাজিক প্রকল্প, সেই ধারণাটা আমাদের নেই।

দেবজ্যোতি দত্ত: এখন সেটা ভেঙে গেছে এই কারণে, রিসেন্টলি বলছি, ডিকশনারি আর সেরকম চলে না। কারণ সমস্তটাই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। সূক্ষ্ম–সূক্ষ্ম যে পরিবর্তনগুলো ডিকশনারিতে পাওয়া যায়, তা ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না। ফলে কী হচ্ছে, ট্রান্সলেশন হচ্ছে, কিন্তু সেটা ভালো হচ্ছে না।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এখানেও আমার মনে হয়, আপনি যে কথাটা আগেও বললেন, প্রকৃত লেক্সিকোগ্রাফার না-পেলে কাজটা ওই মাত্রায় পৌঁছোতে পারে না।

দেবজ্যোতি দত্ত: এ-ব্যাপারে একটা কথা বলি আগে যেসব অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি ছিল, বিজ্ঞাপন সংস্থা, তারা প্রত্যেকটা ভাষায় আলাদা আলাদা কপি রাইটার রাখত। বাংলায় বাংলার মতো, ইংরেজিতে ইংরেজির মতো, হিন্দিতে হিন্দির মতো। তাতে লোকাল এসেন্সটা বজায় থাকত। এখন ভাষার এই ব্যাপারটা নেই। ইউনিভার্সাল একটা কপি হয়। যার জন্যে ‘ধামাকা’ কথাটা চলে এসেছে। একটা ভাষার মধ্যে অন্য একট ভাষার শব্দ ঢুকতেই পারে, কিন্তু সেই শব্দটা কতটা তার কালচারের সঙ্গে যাচ্ছে, সেটা বোধগম্য হতে হয়। সেদিন একটা বিজ্ঞাপন দেখছিলাম, ম্যাট্রিমোনিয়ালের। এম এস ধোনি, তাঁর সঙ্গে একজন মহিলা এবং একজন মেয়ে। বাংলায় কথাবার্তা চলছে। হঠাৎ মেয়েটি বলছে মাতাশ্রীকে জিজ্ঞেস করুন। মা-কে জিজ্ঞেস করুন না, মাতাশ্রীকে জিজ্ঞেস করুন! এইটা হচ্ছে এখনকার দিনের কালচার। মাতাশ্রী এসেছে কবে ? যখন টিভি-তে রামায়ণ হল, তখন থেকে মাতাশ্রী কথাটা উঠল। তার আগে ছিল না। ইউনিভার্সাল মার্কেটিং ল্যাঙ্গোয়েজ এটাই এখন প্রধান ব্যাপার হয়ে গেছে। সেটা খালি ওই স্ক্রিপ্টে চেঞ্জ করলেই হয়ে যাবে। তাতেই লোক বুঝতে পারবে। ভাষার প্রতি আমাদের মমতাটা কমে যাচ্ছে কি না জানি না। কিন্তু ছাপা ডিকশনারির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে তা বলতেই হবে।

 

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia

*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে আগামী বুধবার, ২৮ জুন, ২০২৩

banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *