প্রাচীন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর বিখ্যাত বন্দর। কোনও বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এই বন্দরে ঢুকলে সম্রাটের রক্ষীবাহিনী প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা জাহাজটিকে তল্লাশি করত। তবে এই তল্লাসী কোনও ধনরত্ন বা নিষিদ্ধ বস্তুর জন্য নয়। তল্লাশি চলত কোনও নতুন বইয়ের সন্ধানে। সেই বই রাখা হবে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে। কেমন ছিল সেই গ্রন্থাগার?

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ৩৩১ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ইজিপ্ট (মিশর) জয় করে স্থাপন করেন আলেকজান্দ্রিয়া, উৎকর্ষ ও প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ এক বন্দর-নগরী। কী ছিল না সেই নগরে? প্রশস্থ রাজপথ, মার্বেল খচিত অট্টালিকা, সুবিশাল বন্দর যার কথা আগেই বলা হয়েছে। বন্দরে ছিল ফারো (Pharo) নামের একটি বিশাল লাইট হাউস, প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। তবে উৎকর্ষে, বিশালতায় আলেকজান্দ্রিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ছিল এর গ্রন্থাগার এবং সংলগ্ন সংগ্রহশালা ও মিউজিয়াম। আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই প্রায় ছটি শতাব্দী জুড়ে এই গ্রন্থাগারে পূর্ব ও পশ্চিমের জ্ঞানভাণ্ডার যুক্ত হয়েছিল। হাইপাশিয়ার নৃশংস হত্যার পর প্রায় ছটি শতাব্দীর সঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডার সহ এই গ্রন্থাগারের দ্রুত অবলুপ্তি ঘটেছিল।

Pharos, the lighthouse of Alexandria Egypt
আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের বিখ্যাত লাইটহাউজ ফারো

কে ছিলেন হাইপাশিয়া? জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রথম মহিলা শহিদ। হাইপাশিয়া এই গ্রন্থাগারের শেষ আলোকবর্তিকা, যাকে ধর্মোন্মাদরা নৃশংসভাবে হত্যা করে দেহাবশেষ পুড়িয়ে ফেলেছিল।

আরও পড়ুন- নিবন্ধ: ভারতের প্রথমা বাঙালি ডাক্তার

হাইপাশিয়ার জন্ম আনুমানিক ৩৫৫ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ৩৭০ খ্রি.) আলেকজান্দ্রিয়ায়। তাঁর বাবা থিয়ন ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের অধ্যাপক, পরবর্তীকালে অধ্যক্ষ। হাইপাশিয়ার প্রথম শিক্ষাজীবন কেটেছে গ্রন্থাগার-সংলগ্ন মিউজিয়ামে। মিউজিয়াম শব্দটি এসেছে ‘মিউজেস’ নামক গ্রিক দেবীর নাম থেকে (goddesses of literature, Science and Arts)। এর পর বাবার কাছে পড়াশোনা করে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন সব বিষয়েই হাইপাশিয়া দক্ষতা অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক। আলেকজান্দ্রিয়ার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট হাইপাশিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন আর গণিত পড়াতে আমন্ত্রণ জানান। হাইপাশিয়া এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন।

Hypatia
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রথম মহিলা শহিদ হাইপাশিয়া

অসাধারণ সুন্দরী হাইপাশিয়ার অনুকূলে তাঁর সহজাত প্রবাদপ্রতিম ধীশক্তি, পারিবারিক পরিবেশ তো ছিলই, পাশাপাশি তাঁর বাবা জ্ঞানী, পণ্ডিত থিয়ন চেয়েছিলেন যে হাইপাশিয়া যেন সবদিক থেকেই একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে ওঠেন। শুধু পড়াশোনা নয়, হাইপাশিয়াকে শারীরিকভাবে সক্ষম করে তোলার জন্য তাঁকে নিয়মিত সাঁতার, নৌকা চালনা, ঘোড়ায় চড়া, পর্বত আরোহণে দক্ষ করে তুলেছিলেন থিয়ন। তিনি ক্রমে পুরুষদের সমকক্ষ স্বাধীনচেতা, বিদূষী, নির্ভীক হয়ে উঠেছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি জীবৎকালে এতটাই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন যে মিউজিয়াম ও লাইব্রেরির মতোই তাঁর বাড়ি আর বক্তৃতা কক্ষ দেখার জন্য দেশবিদেশের ছাত্ররা ভিড় করত। তিনি গণিতের বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট পুস্তক রচনা করেছিলেন, কিন্তু কোনোটাই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। 

তিনি বেশ কয়েকটি কমেন্টরিও লিখেছিলেন। এখানে বলা দরকার কোনও পুরনো বইয়ের পরিবর্ধিত এবং সময়ানুগ পরিমার্জিত সংস্করণকে বলে কমেন্টারি। মনে রাখতে হবে, তখনও মুদ্রণ ব্যবস্থা ছিল না। প্যাপিরাস জাতীয় গাছের ছালে কালি বুলিয়ে হাতে লেখা হত পুস্তক। এই কমেন্টারির সাহায্যেই প্রাচীন পুস্তকগুলিকে কালের গ্রাস থেকে বাঁচানো সম্ভব হত। পুরনো বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে ব্যবহৃত কালি খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হত না, ফলে গ্রন্থটি বিবর্ণ হয়ে যেত। এই কমেন্টারির মাধ্যমে গ্রন্থগুলি আবার নতুন করে লেখা হত। সেই সঙ্গে সময়োপযোগী পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হত। গ্রন্থাগার ধ্বংসের পরে তাঁর ছাত্রদের লেখা অন্যান্য যেটুকু প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা থেকে বলা হয় হাইপাশিয়া ‘অ্যাপোলোনিয়াস অব পাগা’-র কনিক্‌স (জিওমেট্রি) এবং ডায়াফনটাস অব আলেকজান্দ্রিয়ার অ্যারিথমেটিক (নাম্বার থিওরি) এবং তাঁর বাবা থিয়নের একটি কমেন্টারির সংশোধিত সংস্করণ করেছিলেন।

Hypatia-Teaching-Alexandria
প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক হাইপাশিয়া ও তাঁর ছাত্ররা

এই প্রশ্ন আবারো দেখা দেয় যে হাইপাশিয়ার মত সর্বগুণান্বিতা অসাধারণ সুন্দরীকে কেন নৃশংসভাবে হত্যা করা হল, আর কেনই বা এর পর পরই শুধু গ্রন্থাগার নয়, সামগ্রিকভাবে আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানচর্চাই স্তব্ধ হয়ে গেল।

এর প্রধান দুটি কারণ— ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পারস্পরিক ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং জ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করা ও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে উচ্চমার্গে অবস্থান। রোম সাম্রাজ্যের সেই সময়ে গ্রিক পণ্ডিত-গবেষকরা নিজস্ব পঠনপাঠন গবেষণায় যে সময় ব্যয় করতেন তার একটা ক্ষুদ্রাংশ দিয়েও তাঁরা দেশের আর্থিক, সামাজিক, ও ধর্মীয় অনাচার তথা দুরবস্থা বোঝার চেষ্টা করেননি। এঁরা সুদূর আকাশের নক্ষত্রদের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছর, অথচ বর্বর ক্রীতদাসপ্রথা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি, ক্রীতদাসদের প্রতি নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদ করেননি। এঁরা অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডার কুক্ষিগত করে রেখেছেন। ফলে শিক্ষায় বঞ্চিত সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অন্ধসংস্কার, অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আকর্ষণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। হাইপাশিয়ার সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল রোমানদের দখলে। রোমানদের অতিরিক্ত বিলাসব্যসন, ব্যভিচার, অত্যাচারিত ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ— সব মিলিয়ে একদিকে রোমান সাম্রাজ্যের টালমাটাল অবস্থা, অন্যদিকে খ্রিস্টান চার্চের আগ্রাসী মনোভাব— এই দুয়ের টানাপোড়েনের শিকার হয়েছিলেন হাইপাশিয়া।

hypatia-by-julia-margaret-cameron-
জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরনের কল্পনায় হাইপাশিয়া

৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান থিওফিলাস যখন আলোকজান্দ্রিয়ার বিশপ হন তখন থেকেই নগরীর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। থিওফিলাস ইহুদি, পাগানদের অত্যাচার করে নগর থেকে তাড়িয়ে দিতে শুরু করেন। তাঁদের দেবদেবীর মূর্তি ভাঙেন, মন্দির ভেঙে চার্চ তৈরি করেন। ৪১২ খ্রিস্টাব্দে থিওফিলাসের মৃত্যুর পর তাঁর ভাইপো সিরিল বিশপ হলে অবস্থা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

অপরদিকে নগরীর রোমান গভর্নর ওরেস্টেস নিজে খ্রিস্টান হলেও অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিলেন। হাইপাশিয়ার সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ধর্মযাজক সিরিল এবং প্রশাসক ওরেস্টেসের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে হাইপাশিয়া বন্ধু ওরেস্টেসের পক্ষে যোগ দিলেন। এতে সিরিল ভয় পেয়ে যান। সিরিল তাঁর সমর্থকদের সাহায্যে হাইপাশিয়ার সুনাম নষ্ট করতে সচেষ্ট হন। প্রচার শুরু হল ‘হাইপাশিয়া ডাইনি’। ‘জ্যোতিষ ও ব্ল্যাক-ম্যাজিকের মাধ্যমে সে মানুষের ক্ষতি করছে।’ এইভাবে হাইপাশিয়ার বিরুদ্ধে সিরিল ও তাঁর সহচরেরা নানা ভয়ংকর গুজব ছড়াতে শুরু করে। ফলে জনতা ক্রমেই উত্তেজিত হতে থাকে। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দের এক মার্চের সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের মতো হাইপাশিয়া যখন গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে একাকী রথে চড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন সিরিলের অনুগামী পিটার নামে এক খ্রিস্টান ধর্মযাজকের নেতৃত্বে ধর্মোন্মাদ উন্মত্ত জনতা হাইপাশিয়াকে হঠাৎ আক্রমণ করে রথ থেকে নামিয়ে আনে, আর বীভৎস নিষ্ঠুরতায় শরীরের হাড় মাংস টেনে ছিঁড়ে তাঁকে হত্যা করে দেহাবশেষ পুড়িয়ে ফেলে। এতেও উন্মত্ততা কমেনি। এরপর পোড়ানো হয় তাঁর বইপত্র, গবেষণালব্ধ সঞ্চয়।

Killing of Hypatia
হাইপাশিয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ড

তবে হাইপাশিয়া মরেননি। তাঁকে অমর করে রাখা হয়েছে চাঁদের একটি গহ্বর এবং একটি নদীকে তাঁর নামে চিহ্নিত করে। মাঝারি মাপের এই গহ্বরটি পুরো গোল বা চৌকো নয়, একটু অসমান। লম্বায় প্রায় ৪১ কিলোমিটার আর প্রস্থে ২৮ কিলোমিটার। বরফ-জমা নদীটি, যার নাম রিমে হাইপাশিয়া, দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৮০ কিমি.। হাইপাশিয়ার বাবা থিয়নের নামেও চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছে।

হাইপাশিয়ার জীবিত অবস্থাতেই আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের শেষ আলোকবর্তিকা হাইপাশিয়ার নৃশংস হত্যার পরে অবধারিতভাবে স্বতঃ অবলুপ্তি ঘটল এক অসাধারণ গ্রন্থাগার ও গবেষণাগারের। এরপর নেমে এল সহস্র বছরের অজ্ঞানতার অন্ধকার।

আবার নতুন করে আলো জ্বালালেন কোপার্নিকাস প্রমুখরা।

 

 

 

 

ছবি সৌজন্য: Picryl, Wikipedia, Lookandlearn.

Dr Sumitra Chaudhury author

ড. সুমিত্রা চৌধুরী বিজ্ঞানমনস্ক ও শিক্ষাব্রতী মানুষ। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। কর্মজীবনে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছেন। এছাড়া বর্তমানে তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি এবং প্রফেশন অসীমা চ্যাটার্জি ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি। বোর্ড মেম্বার হিসাবে যুক্ত আছেন আরও একাধিক বিজ্ঞান সংস্থার সঙ্গে...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *