সেই কবে ১৯৭৭-এর হেমন্তে লন্ডনে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম মহম্মদ আলির, তার আবেশ প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল পরেও এতটুকু কাটল না। এখনও চোখ বুঁজলে প্রবাদপ্রতিম মানুষটাকে মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে দেখি। বিশেষ করে মনে পড়ে সেই মুহূর্ত যখন ইন্টারভিউ শেষ করে টেপ রেকর্ডার, কাগজপত্র ব্যাগে ভরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বক্সারকে বলেছিলাম, “স্যর, যাবার আগে একটা শেষ প্রশ্ন…”

আলি তখনও সোফায় বসে। বললেন, “শিওর! করো।”

জিজ্ঞেস করলাম, “এই যে বক্সিং আপনাদের, এ কি শুধুই ঘুসোঘুসি, রক্তপাত, হারজিত?”

আলি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন ঠোঁটে হাসি নিয়ে। ওঁর ভারী হাতটা আমার পিঠে রাখলেন, আর সামান্য চাপ দিয়ে বললেন বেশ অনুভূতির সঙ্গে, “নো। ইটস লাইফ।” না, এটা জীবন। 

Muhammad Ali

কয়েক বছর আগে এই সব অমূল্য স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছিল কিংবদন্তী মানুষটি যেদিন সেই জীবনকেই বিদায় জানালেন। আর ক’দিন আগে ভীষণভাবে ভেসে উঠলেন মনে যখন আমাদের দেশেরই কিছু সেরা কুস্তিগীর—বিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া এবং আরও কয়েকজন—স্থির করলেন যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাঁদের জেতা পদকগুলো গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন! কারণ কী? না, ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের বড়কর্তা যে ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ নামের লোকটি, তিনি দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন করে গেছেন মহিলা মল্ল-বীরাঙ্গনাদের। যার প্রতিবাদে পুলিশে গিয়েও কাজ হয়নি, প্রভাবশালী বড়কর্তার বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর-ও নেয়নি। তখন দিল্লির যন্তরমন্তরে তাঁরা বিক্ষোভে বসেন। যেদিন নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন হল সেদিন সংসদযাত্রারও চেষ্টা করেন। যন্তরমন্তর থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাঁদের তোলা ছাড়াও অমানবিকভাবে রোধ করা সংসদের পথ। কুস্তিগীররা ঘোষণা করলেন তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা এবার বদলাবে: দেশের হয়ে লড়ে জেতা গৌরবের পদকগুলো তাঁরা গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন। 

আরও পড়ুন: বৈষম্যের খেলায় আর কতদিন?

গোটা দেশ শিউরে উঠেছিল বিনেশ, সাক্ষী, বজরংদের এই সিদ্ধান্তে, ‘না, না, ওটা কোরো না!’ এমন আর্তনাদ প্রদেশে প্রদেশে। খবরটা কাগজে পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল এমনই এক প্রতিবাদের উপাখ্যান, যা পড়েছি মহম্মদ আলির অতুলনীয় আত্মকথা ‘দ্য গ্রেটেস্ট : মাই ওন স্টোরি’-তে। একটু বলি?

Indian athletics v/s Police

১৯৬০-এ রোম অলিম্পিক্সে লাইট হেভিওয়েট ডিভিশনে টগবগে মার্কিন তরুণ ক্যাসিয়াস ক্লে দুর্ধর্ষ টেকনিক, স্পিড এবং পাওয়ার নিয়ে সেমিফাইনালে একজন পোলিশ এবং ফাইনালে একজন রুশ বক্সারকে পিটিয়ে তক্তা করে সোনার পদক জিতেছিলেন। ধর্মান্তরিত হয়ে ক্লে মহম্মদ আলি হয়েছিলেন এর অনেক পরে। তরুণ ক্যাসিয়াস ক্লে’র কাছে এই সোনার পদক ছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনের গৌরবের চিহ্ন। কী অপূর্ব আবেগে আলি ওঁর আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন এই মেডেলের মূল্য ওঁর জীবনে! একটু শোনাই? আলি লিখছেন…

“কী করে এর উত্তর জোগাব? সব কারণটা তো আমার জানাও নেই। অলিম্পিক মেডেলটাই আমার জীবনের প্রাপ্তি ছিল ততদিনে। আমি ওটাকে পুজো করতাম। ওটা ছিল একটা কীর্তির সাক্ষর, একটা প্রতিষ্ঠা, একটা সম্পর্কের চিহ্ন, একটা দলের প্রতিনিধি, একটি দেশ ও জগতের নাগরিক ও মানুষ হওয়ার সম্মান। এই মেডেল দিয়ে আমার স্কুল সেন্ট্রাল হাইয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের জানানোর ছিল যে পড়াশুনোর পরীক্ষায় তেমন কিছু করে দেখাতে না পারলেও আমিও বড় কিছু জেতার ক্ষমতা রাখি।”

Muhammad Ali Olympic gold medal

কীসের জন্য এই ভাবনাটা এল ক্যাসিয়াসের? ওর বন্ধু রনি তখন বারবার ওকে বারণ করছে মেডেলটা ওহায়ো নদীর কালো জলে ছুড়ে ফেলতে। কিন্তু ও ছুড়ে ফেলবেই। কারণ আজ ওর এক স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে— ওর ধারণা ছিল গলায় অলিম্পিকের সোনার মেডেল ঝুলিয়ে কোনও ‘কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য’ রেস্তোরাঁতেও অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারবে। গায়ের রং মুছে দেবে অলিম্পিক মেডেলের স্বর্ণচ্ছটা। অথচ ওর নিজের শহর লুইসভিলের ‘দ্য ওনার’ রেস্তোরাঁয় কেউ যেন পাত্তাই দেয় না ওকে। বন্ধু রনি তো রীতিমতো অবাক হয়েই চেঁচাতে শুরু করল, “আরে, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না, এ হল চ্যাম্পিয়ন! লুইসভিলের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন! সবে ইটালি থেকে জিতে ফিরেছে!”

ক্যাসিয়াসের গা গুলিয়ে উঠল। বন্ধুকে ধমকালো, “রনি, চুপ কর! ভিক্ষে চাস না। কোনও ভিক্ষে নয়।”

মহম্মদ আলি ওঁর আত্মকথায় লিখেছেন, “রোমে নিজেকে মার্কিন ছোকরা হিসেবে যা কিছু স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল এক নিমেষে সব মিলিয়ে গেল। আমার অলিম্পিক মধুচন্দ্রিমা ফুরিয়ে গেল। আমি কেন্টাকির সেই কালোদের খোঁয়াড়ে ফিরে গেলাম।”

Young Muhammad Ali

ক্লে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসার পর দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। প্রথমটা হল রেস্তোরাঁয় খেতে বসা এক শ্বেতাঙ্গ বালকের এক টুকরো সাদা কাগজ আর একটা লাল ক্রেয়ন নিয়ে ছুটে এসে বলা, “মিস্টার ক্লে, আপনার একটা অটোগ্রাফ দেবেন?” ক্লে তাতে লিখে দিলেন ‘ক্যাসিয়াস ক্লে—১৯৬০’।

কিন্তু রেস্তোরাঁয় বাইরে বেরোতেই প্রবল বৃষ্টি আর দ্বিতীয় অদ্ভুত ঘটনা। ক্লে’র সোনার মেডেল দেখে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে যাওয়া চার শ্বেতাঙ্গ গুন্ডা বাইকে করে ওঁকে ও রনিকে তাড়া করল। উদ্দেশ্য মেডেলটা কেড়ে নেওয়া আর একটু মারধর করে সাদাদের ক্ষমতা জাহির করা। 

ক্যাসিয়াস ক্লে’র হাতে ওই চার গুণ্ডার যে পিটাই সেদিন হয়েছিল তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা আছে ছ’পৃষ্ঠা ধরে আলির স্মৃতিকথায়। কতবার পড়া হয়েছে, অথচ বার বার নতুন করে রোমাঞ্চিত হই। বাচ্চাদের কমিক্স পড়ে উত্তেজিত হওয়ার মতো। চোখ ভিজে আসে যখন পড়ি এই প্রাণের পদকটাই ক্লে ছুড়ে ফেলল নদীর জলে শ্বেতাঙ্গাদের ঘৃণার বিরোধিতায়। এত লড়াই করে পদকটা বাঁচিয়ে সেটাকেই বিসর্জন দিল। রনি কেবলই বলতে থাকল, “কিন্তু কেন? কেন ফেললি?”

ক্লে’র তখন একটাই উত্তর : “ওটার আর দরকার নেই আমাদের।”

বিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিকরা ওঁদের পদক গঙ্গায় ভাসাতে যাচ্ছেন জেনে গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত মহম্মদ আলির জীবনের এই ঘটনা ক্রমান্বয়ে উছলে উঠল মনে। 

 

 

* ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *