পড়ুন: জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায়-পর্ব ১

সবে তো বললাম হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের হয়ে রবিশঙ্করের ইন্টারিভউ নেওয়ার কথা। ১৯৭২-৭৩ সময়কালটা যে কীভাবে ভরে ছিল গানে গানে তা মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়। কলকাতা ও বাঙালির জীবনে অমন সুরেলা দিন আর কবে কখন গেছে বলতে হলে গালে হাত দিয়ে বসতে হবে। আর সে-সময়টা যে প্রাণ ভরিয়ে জুড়িয়ে নিতে পারলাম তারও প্রধান কারণ বন্ধু, বস, অনুপ্রেরণা অরূপ সরকার। গানবাজনা দিয়েই যাঁর সঙ্গে আলাপ, ক্রমে বন্ধুতা এবং শেষে ওঁরই হাত ধরে আনন্দবাজার সংস্থায় প্রবেশ। কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার উনি, কিন্তু ডেকে ঘরে বসালে কথাবার্তা সবই গান নিয়ে। ওঁর সেকালের ঢালাও চেম্বারে ঢুকলে প্রথম বাক্যটাই দাঁড়াত, ‘‘নতুন কী শোনা হল?’’ আর এই বলার সঙ্গতে কাচের টেবলটপে দ্রিদিম ত্রিদিম করে তবলার ধ্বনি তোলা। 

আর আমার শোনা মানে দুনিয়ার সেরা গান অবিরত কানে ঝরে পড়া। আজ উস্তাদ আমির খাঁ তো কাল বেগম আখতার। কখনও কখনও একই সন্ধ্যায় খাঁ সাহেব ও বেগম সাহেবান! যেমন ক্যালকাটা মিউজিক সার্কেলের এক সন্ধ্যা। এঁদের দু’জনকেই তার আগে লম্বা সময় ধরে শুনেছি, কিন্তু ওই সন্ধ্যায় এই দু’জনেরই যে কী হল তা কল্পনাতেও আনতে পারিনি। মনে হল যেন বেলাশেষের গান ধরেছেন, যার আর পর নেই…

Begum Akhtar
বেগম আখতার

বেগম ওঁর সেরা সব গানের মধ্যে কখন একসময় ধরে নিলেন দাগ দেহলবির ওই অসম্ভব করুণ শেরটাই—‘উজর আনেমে ভি হ্যায় অউর বুলাতে ভি নহি।’ যার শেষ পঙক্তিটা যখন শুনছি চোখ ভরে জল এল। কবি দাগ দেহলবির কী কথা? না, ‘জান পিয়ারি ভি নহি জান সে যাতে ভি নহি।’ প্রাণের মায়াও নেই, প্রাণটা যায়ও না। যখন শুনেছি এই গান তখনও জানি না এর সুর করেছেন খৈয়াম, যাঁর মতো করুণ, মধুর সুর খুব বেশি লোকের হাত বয়ে আসেনি। আর হায়, কেন যে মনে হল শুনতে শুনতে যে এর মধ্যে কোথায় যেন মৃত্যু লুকিয়ে আছে? এই জন্যই কি যে ওই ‘জান পিয়ারি…’ কলির আগে দাগ লিখছেন ‘জিস্ত সে তঙ্গ হো এ দাগ তো জিতে কিঁউ হো।’ জীবনে এতই যদি বীতশ্রদ্ধ তাহলে বেঁচে আছ কেন দাগ?

সেই সন্ধ্যাতে মনস্থ করেছিলাম যে বেগম যদি আর ক’দিন শহরে থাকেন, তো ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নেব। অরূপ ছিলেন খেয়াল, সেরাদ, সেতারভক্ত, কিন্তু আমার আখতারি-প্রীতিতে আনন্দ পেতেন। তবে ওঁকে এই অভিলাষের কথা বলেছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না। যাঁকে বলেছিলাম তিনি বিমান ঘোষ, তখনও আকাশবাণী কলকাতার অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডিরেক্টর। পরে এইচএমভি-র কর্তাব্যক্তি হন। 

আবদার শুনে বিমানদা বলেছিলেন, ‘‘ওঁর সোলো প্রোগ্রাম আছে ত্যাগরাজ হলে দেড়-দু’মাসের মধ্যে। ওঁর নতুন অ্যালবাম নিয়ে কথা আছে, তুমিও যেও আমার সঙ্গে। ও তো তোমার অফিসের কাছাকাছি ব্রডওয়ে হোটেলে ওঠে। চল, দারুণ সময় কাটবে।’’

বিমানদা বলেছিলেন, ‘দারুণ সময়’, তবে আখেরে যা কেটেছিল তা এককথায় ‘অবিস্মরণীয়’। তার আগে ত্যাগরাজ হলে যে অনুষ্ঠান করলেন তা বাস্তবিক এক মেহফিল। হল জুড়ে ফরাশ পেতে বসা সাত-আটশ’ শ্রোতা। এক পাশে ছড়ানো কার্পেটে দল নিয়ে বসে বেগম তাঁর উর্দু গজল-সম্ভার শুনিয়ে ধরে নিলেন একের পর এক বাংলা গান ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’, ‘জোছনা করেছে আড়ি, আসে না আমার বাড়ি’, ‘এ মৌসুমে পরদেশে যেতে তোমায় দেব না’… হলে বাঙালি শ্রোতা কতজন ছিলেন জানি না, তবে গোটা হল তোলপাড়। বাঙালি হৃদয়ের কোথায় কতখানি যে সেঁধিয়ে গেছেন বেগম সাহেবা তদ্দিনে তা ওঁর একেকটা সুরে, মীড়ে, মূর্চ্ছনায় ধরা দিচ্ছিল। উনি সুর লাগাচ্ছেন আর হল ভাসছে ‘আহা্’-র বন্যায়; যখন মেহফিল শেষ করছেন রব উঠল ‘যেতে তোমায় দেব না।’

Begum_Akhtar
মালেকা-এ-গজল বেগম আখতার

এর পরেই বিমানদার সঙ্গে ব্রডওয়ে হোটেলে যাওয়া। সেখানেও দেখি সোফায় নয়, বেগম কার্পেটে বসা। পাশে স্কচের বোতল, কয়েকটা গেলাস, জল আর দু’তিন প্যাকেট স্টেট এক্সপ্রেস ৫৫৫ সিগারেট। বিমানদা ড্রিংক বা স্মোক কোনওটাই করেন না, তাই আমাকেও না বলতে হল। বেগম বললেন, ‘‘সে কী! দাদা খান না জানি, আপনি ছোট ভাই, একটু তো কম্পানি দিন!’’ উনি দুটো গেলাসে হুইস্কি ঢাললেন, হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘‘চিয়ার্স! চিয়ার্স! বলার চেয়ে এই ভালো…’’ এরপর ওঁর গেলাসটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে সুর লাগিয়ে বললেন, ‘‘দিওয়ানা বনানা হ্যাঁয় তো দিওয়ানা বনা দে।’’

বিমানদা আমার দিকে ঝুঁকে গলা নামিয়ে বললেন, ‘‘এটাই আখতারি। সমস্ত কিছুর মধ্যেই ওর নিজের একটা স্টাইল। নাও কথা শুরু কর।’’

কথা কী শুরু করব, আমার কথা তো সব হারিয়ে যাচ্ছে! ভেবে এসেছিলাম দাগ দেহলবির ‘উজ্র আনেমে ভি হ্যায় অউর বুলাতে ভি নহি’ দিয়ে শুরু করব, ‘উজ্র’ বা অজুহাত দিয়ে আড়ালে থাকার দূরত্ব গড়ে নেওয়ার ব্যথার কথা জিজ্ঞেস করব, জানতে চাইব চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, ফিরে না আসার এত ভাবনা, বর্ণনা, অশ্রুর মধ্যে কবি দাগকে নাকি নিজেকেও খোঁজেন?

জিজ্ঞেস করতে হয়নি, আমার মনের কথা পড়ে নিয়েই বুঝি বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বাংলা আর উর্দু তো কবিতার ভাষা, তাই কলকাতার মানুষ চাইল আমি বাংলাতেও কিছু শোনাই। আর সেখানেও তো গাইছি ‘ফিরে কেন এলে না’। উর্দুতে কাদের কথা ভাল লাগে?’’

বললাম, ‘‘মীর বকি মীর…’’ কথা শেষ হয়নি, বেগম হুইস্কিতে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে খুব মিহি সুরে বললেন, ‘‘দিল কি বাত কহা নহি যাতি।’’

বললাম, ‘‘মির্জা গালিব, দাগ, ক্যায়ফি আজমি…’’ 

ক্যায়ফির নাম করতে মিহি সুরে বললেন, ‘‘অ্যায় মোহব্বাত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া।’’

আমি মনে মনে মানে করে নিলাম—হে প্রেম, তোমার বিদায়ে কান্না এল। মুখে বললাম, ‘‘আপনার রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠানে গাওয়া দাগ-এর ‘উজ্র আনে মে’-র সুর কি আপনারই?’’

বেগম বললেন, ‘‘না, না। খৈয়াম সাহাবের। কী অপূর্ব সুর! ওঁর আরও একটা দারুণ সুরে মীর তকি মীরের একটা গজল গেয়েছি। বিমানভাইয়ার কম্পানিতে রেকর্ড হয়েছ। শুনবেন…’’

বেশরমের মতো আবদার করে বসলাম, ‘‘একটু যদি মুখটা শোনান’’ —

বেগম গেলাস নামিয়ে খুব হাল্কা করে গেয়ে দিলেন, ‘‘উল্টি হো গয়ি সব তদবিরেঁ, কুছ ভি দবা ন কাম কিয়া।’’

বিমানদা চোখ বুজে মাথা নাড়তে লাগলেন, আমি নোটবুকে শের এবং বেগমের কথাগুলো নোট করতে করতে কয়েকবার ‘আহা!’ বলে ফেললাম। বেগম ওই দু’লাইনই গেয়ে থেমে বললেন,‘‘কলকাতায় পরের বার আপনাদের পুরোপুরি শোনাব।’’

পরের বার গানটা ওঁর ‘ইন মেমোরিয়াম’ লং প্লে কিনে শুনতে হল কারণ সে-বছরই পুজোর মাসে, ৩০ অক্টোবর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন মালেকা-এ-গজল বেগম আখতার। 

ঘটনা এই যে সে-বছরই কলকাতায় রোড অ্যাক্সিডেন্টে স্বর্গলাভ করেছিলেন বেগমের প্রাণের গায়ক উস্তাদ আমির খাঁ। তারিখটা ১৩ ফেব্রুয়ারি। সেই খবরে—পরে শুনেছি ও পড়েছি—বেগম ক্রমাগত কপাল চাপড়ে কেঁদে শেষে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

Amir Khan
পণ্ডিত আমির খাঁ সাহেব

কলকাতায় খাঁ সাহেবের গণনাতীত ভক্তদেরও প্রায় একই দশা। আমার কানে সমানে বাজছে রবীন্দ্র সদনে ওঁর গাওয়া বাগেশ্রী ও নান্দ। বেলভেডিয়ারে পি. কে গুপ্তার বাড়ির আসরে শুদ্ধ কল্যাণ ও ওঁর স্বনির্মিত রাগ কলাশ্রী এবং ল্যান্সডাউন রোডে আমাদের দাদাস্থানীয় বন্ধু অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমন্ত্রণ’ বাড়িতে নিবেদিত বেহাগ ও কেদার। ওঁর খেয়ালের অপূর্ব রূপরস বুকে ধরে ঘুরিফিরি ওঁর ভক্ত আমরা। খাঁ সে-সময় কলকাতায় অরুণদার বাড়িতে উঠতেন আর ওঁর সঙ্গ পেতে আমরা সেখানে জড়ো হতাম। ওঁর শিষ্যা পূরবী মুখোপাধ্যায় ওঁর অনেক কথাই তখন টেপ করতেন। একদিন তো খাঁ সাহেব, যিনি ঠুংরি গাইতেন না, এমনকী খেয়ালেরও বিলম্বিত বিস্তারে আস্থায়ী গেয়ে এবং অন্তরায় না গিয়ে অপূর্ব সব তারানা দিয়ে আসর মাতিয়ে দিতেন—তিনি বেগমের ‘এই মৌসুমে পরদেশে যেতে তোমায় দেব না’-র ভূয়সী প্রশংসা করে নিজেই গানটা গেয়ে দিলেন! ওহ্ মাই গড, সে যে কী সুরে ও পার্ফেকশনে বলে বলে বোঝানো সম্ভব না। পূরবীদি সে গান রেকর্ডও করেছিলেন। খাঁ সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুর পর অরুণদার বাড়িতে টেপে ধরা ওঁর সেই ‘এই মৌসুমে পরদেশে’ শুনে বিস্ময়ে বোবা হয়ে যেতাম। যখন সুরে ঢেলে ভাসিয়ে গাইছেন ‘যেতে তোমায় দেব না’ তখন চোখের জল ধরে রাখা কঠিন হত। 

এই খাঁ সাহেব ওঁর জীবনের শেষ আসর করলেন অরুণদা’র বাড়িতে। অরুণদা ওঁর বন্ধুবান্ধব, সংগীতরসিকদের একত্র করেছিলেন এক স্মরণীয় আসরে। খাঁ সাহেব গেয়েছিলেন বেহাগ, কেদার ও আভোগী কানাড়া। গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ডও করেছিলেন সেই আসর। ওঁর সঙ্গে হারমোনিয়ামে ছিলেন কমল বন্দ্যোপাধ্যায়। কমলদা’র কাছে শোনা গানের এক বিরতিতে খাঁ সাহেব ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কমল, তুমি কি আমার গলায় এক-আধবার একটা শাঁখের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো?’’ কমলদা যখন বললেন, ‘‘হ্যাঁ। এর আগের দিনেও গলায় ওই আওয়াজ পেয়েছি। ভাবছিলাম এটা একটা নতুন কাজ আপনার গলার।’’

আমির খাঁ তখন খুব বিষণ্ণ কণ্ঠে ওঁকে বলেছিলেন, ‘‘না, কমল, নতুন কাজ নয়। এ হল ওপরে চলে যাবার ডাক। এই শাঁখের আওয়াজ মানে আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে।’’ যাই হোক, তার পরেও শিল্পী অপরূপ উচ্চতায় নিয়ে গেলেন ওঁর বেহাগ, কেদার, আভোগী কানাড়া। 

পরদিন অরুণদা’র বাড়ির আড্ডায় গায়ক অধীর বাগচীও বলল ও-ও এক-আধবার শুনেছে শঙ্খধ্বনি। 

এরও দিন দুয়েক পরে ওই ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে সত্যি সত্যি উপরের ডাকে চলে গেলেন উস্তাদ আমির খাঁ।

(চলবে)

 

 

 

*ছবি সৌজন্য:  Wikipedia

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *