মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) ছবিতে একটি দৃশ্য আছে: নিরুদ্দেশ দিদিকে খুঁজতে বেরিয়েছে ভাই। অন্য কোথাও তার হদিশ না পেয়ে শেষমেশ পুলিশের কথায় এসে হাজির হয়েছে মর্গে। যদি অপঘাতে মৃত্যু হয়ে থাকে দিদির, তবে তার লাশ নির্ঘাত এসে জমা হয়েছে সেখানে। নিশুত রাতে মর্গের জানলা চুঁইয়ে ঢোকা আলো হাড়ের মত সাদা। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ভাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি শবাধারের সামনে। তাকে এগিয়ে আসতে বলে ডোম। তারপর হাতের হ্যাঁচকা টানে হাড়কাঁপানো ধাতব শব্দের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে নিথর শবদেহ। ‘এটা চলবে?’ ডোম শুধোয়। কোনও কথা না বলে ভাই একটার পর একটা বেওয়ারিশ লাশের মুখ দেখে আর ঘাড় নাড়ায়। এরকম চলতে চলতে, হঠাৎ কী যেন দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। চকিতে কাউন্টার শটে যে বীভৎস দৃশ্য আমরা দেখি তাতে রক্ত জল হয়ে যায়— থেঁৎলে বিকৃত হয়ে যাওয়া একটি মুখের ফ্রিজ শট, যার চামড়া সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভিতরের রক্ত, মাংস, ঘিলু। আমরা বুঝে উঠতে পারি না— এটা কি সেই হারিয়ে যাওয়া দিদি, চিন্ময়ীর লাশ? যতক্ষণ পর্যন্ত না ভাই মুখ ফুটে বলছে যে সে দিদিকে খুঁজে পায়নি, ততক্ষণ আমাদের মন ভয়ে-উৎকণ্ঠায় ভেঙেচুরে যেতে থাকল, কেবলই মনে হতে লাগল— নিষ্প্রাণ ক্ষতবিক্ষত ঐ মুখ আসলে চিন্ময়ীর। অস্তিত্বের দোলাচল নিয়ে এই উৎকণ্ঠা ও সংশয় মৃণাল সেনের তৃতীয় পর্যায়ের প্রধান বিশেষত্ব হয়ে উঠেছিল।

‘একদিন প্রতিদিন’, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জীবনের একটি ভিন্ন পর্বের সূচনা। ছবিতে মমতাশঙ্কর অভিনীত মেয়েটি, ভাড়াবাড়িতে একঘরে বাস করা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যা চিন্ময়ী, সে একদিন কাজে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। যত রাত বাড়ে, তত বাড়ির অন্যদের— বাবা, মা, ভাই, বোন— সবার মনে আশঙ্কা জমতে থাকে, বাড়তে থাকে ভাড়াবাড়ির অন্য ভাড়াটেদের কৌতূহল। তাদের সবার জল্পনা, গুজব ও সন্দেহের অদৃশ্য আধার হয়ে ওঠে অফস্ক্রিনে থেকে যাওয়া চিন্ময়ী। এতটাই শক্তিশালী সেসব কল্পনা, যে ছবির শেষে অক্ষত শরীরে চিন্ময়ী যখন বাড়িতে ফিরে আসে, তখন তার জবানবন্দি নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না কেউ। যেন তারা চিন্ময়ীর প্রাণবন্ত মুখের আড়ালে মৃত্যু ও পচনের চিহ্ন আবিষ্কার করেছে।
মৃণাল সেনের নিজের বয়ান থেকেই জানা যায় যে একদিন প্রতিদিন–এর প্রথম শো দেখে বেরোনোর পর তাঁর ‘এক সময়ের লড়াকু’ বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া ছিল— তিনি ‘যারপরনাই বুড়ো হয়ে গেছেন, ফলত (তাঁর) ছবির ধার গিয়েছে কমে,’ ছবির নৈরাশ্যবাদেই তা প্রমাণ হয়ে যায়— কোথাও ছিটেফোঁটা আশার আলো নেই। ছবিটি শেষ হয় পরিবারের কর্ত্রীর, অর্থাৎ চিন্ময়ীর মায়ের একটি শট দিয়ে: তিনি পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাড়াবাড়ির হেঁশেলে ঢোকেন, তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় তিনি উনুন ধরাচ্ছেন, ধোঁয়া উড়ছে। সেনের সমালোচকদের মতে, ‘মায়ের অভিব্যক্তিতে, বিষাদে ও একাকিত্বে প্রমাণ হয়ে গেল যে ছবিটি নৈরাশ্যবাদী।’ এই সময়ে শুধু মৃণাল সেন নন, তপন সিংহ [আতঙ্ক (১৯৮৬), অন্তর্ধান (১৯৯২)], উৎপলেন্দু চক্রবর্তী [চোখ (১৯৮৩)]— প্রমুখের ছবিতেও শহর হয়ে উঠছিল শবাগারের মতো— এঁরা তার নিষ্পৃহ ধাতব দেওয়ালে পচা-গলা আশাবাদের শেষ ছাপটুকু খুঁজে দেখতে চাইছিলেন। মৃণাল সেন কখনও সেই আশাবাদকে চোখ ধাঁধানো আলোয় পরিণত করেননি। ১৯৮৩ সালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন— তাঁর কাছে এখন ছবি তৈরির অন্যতম শর্ত হচ্ছে সর্বপ্রকার নিটোল পরিসমাপ্তি বা কনক্লুশন দেওয়া থেকে বিরত থাকা, জীবনের যে প্রতিরূপ পর্দায় দেখানো হচ্ছে, তার সব সমস্যার প্রতিকার ছবির মধ্যে যেন না হয়ে যায়। সমস্যার প্রতিকারের চাইতেও তিনি বারবার জোর দিচ্ছেন দর্শককে প্রশ্ন করার উপর। চাইছেন আখ্যানকে অধরা ছেড়ে দিতে, যাতে হল থেকে বেরোনোর পরও প্রশ্নগুলো ঘাই মেরে যায় দর্শকের মনে। ‘একদিন প্রতিদিন’ দেখে বেরোনোর পর অগণিত দর্শকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল— মেয়েটি অত রাত অবধি কোথায় ছিল? কেন তার ফিরতে দেরি হল? এ বিষয়ে ছবিতে কেন স্পষ্ট করে কিছু বলা হল না? মেট্রো সিনেমার শো শেষ হওয়ার পর অনেকেই এসে সরাসরি কৈফিয়ত দাবি করেছিলেন, যার উত্তরে মৃণাল সেন হৃষ্টচিত্তে জানান, ‘আমি নিজেও জানি না।’

সত্তরের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত— মৃণাল সেন তাঁর বেশ কয়েকটি ছবি নিয়ে দর্শকের সঙ্গে এই প্রশ্নোত্তরের খেলা চালিয়েছিলেন, ‘একদিন প্রতিদিন’ ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে ‘আকালের সন্ধানে’(১৯৮০), ‘চালচিত্র’(১৯৮১), ‘খারিজ’(১৯৮২), ‘খণ্ডহর’(১৯৮৩), ‘একদিন অচানক’(১৯৮৯)ও ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১)–র মত ছবি। ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর লা নুই আমেরিক্যান (১৯৭৩) -এর ‘film within a film’ ঘরানায় অনুপ্রাণিত হয়ে মৃণাল সেন ১৯৮০ সালে যে ছবিটি করলেন, সেই আকালের সন্ধানে-তে সিরিয়াস সিনেমা নামক উদ্যোগটিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। তেতাল্লিশের মন্বন্তর নিয়ে ছবি করবে বলে কলকাতার ফিল্ম কোম্পানি গিয়ে উপস্থিত হয় গ্রামে, সেখানে একটি প্রাচীন জমিদারবাড়ি ও তার চারপাশের এলাকা জুড়ে তারা ছবি শুট করতে থাকে। ফিল্ম কোম্পানির হানাদারিতে গ্রামের মোড়লস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা প্রথমে অসন্তুষ্ট হন, তারপর ক্রমশ বেঁকে বসেন, শেষমেশ তারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে শুটিং পণ্ড করে দেয়। ছবিতে দর্শকের পক্ষে সবচেয়ে দুষ্কর হয়ে ওঠে একটি সহানুভূতির ভরকেন্দ্র খুঁজে পাওয়া— এমন একটি চরিত্র যার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় , গ্রাম ও শহরের এই চিরকালীন ব্যবধানের ইতিহাসে যে সমঝোতাকারীর ভূমিকা নেবে।
যখনই কোনও ছবি দর্শকের মনে যথেষ্ট প্রশ্ন জাগাতে পারেনি, মৃণাল সেন নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়েছেন। ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে যে গ্রামের মানুষদের নিয়ে ছবি করলেন, তাদেরকেই যখন পরবর্তীকালে ছবিটা দেখান, তখন মনে এই আশা ছিল যে ছবি দেখে গ্রাম্য কুসংস্কার, দলাদলি, গোঁড়ামি— এসব সম্বন্ধে হয়তো তারা সচেতন হয়ে উঠবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। তিনি দেখলেন প্রশ্ন করা তো দূরস্ত, গ্রামের মানুষ সিনেমার পর্দায় নিজেদের দেখে বরং উচ্ছ্বসিত! এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার জন্যই হয়তো জার্মান চলচ্চিত্রকার রাইনহার্ড হফের কাছে তিনি কবুল করেন— সমাজের যে বর্গের মানুষকে নিয়ে উনি ছবিটি করেছেন, তাদেরকে ‘শুধরে দেওয়ার’ কোনও এলেমই ওঁর নেই। বরং যাঁরা ওঁর ছবির সমঝদার দর্শক, তাঁদের সাথে ক্রমাগত কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে হয়তো বা একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব, যাতে করে গোটা সিস্টেমটাকে ভিতর থেকে বদলে ফেলা যায়। অতঃপর এই সমঝদার দর্শককে প্রশ্নবিদ্ধ করে আত্মসমীক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়াই তাঁর ছবির প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে উঠল। তার জন্য উপাদান হিসেবে বেছে নিলেন নিত্যকার সামান্য কিছু ঘটনা— ওঁর নিজের ভাষায় ‘নন-ইভেন্ট’।

ষাট-সত্তরের বহু ঘাতপ্রতিঘাতে বিদীর্ণ সময় যখন গত হয়েছে; জ্বলন্ত রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে তৎক্ষণাৎ সোচ্চার হওয়ার দিন যখন শেষ; সাতাত্তরের নির্বাচনে বামফ্রন্টের অভাবনীয় জয়ের ওপর জমতে শুরু করেছে নৈরাশ্যের হিমস্তূপ— তখন মৃণাল সেন অন্তর্মুখী, বা বলা ভালো সমাজমুখী হচ্ছেন। খবরের কাগজের ভিতরের পাতার আপাততুচ্ছ স্টোরিতে, রাষ্ট্রের ইতিহাসের গতির বাইরে এঁটোকাঁটার মতো পড়ে থাকা দৈনন্দিনতার গল্পে তিনি আবিষ্কার করছেন নতুন চলচ্চিত্রের অঙ্কুর। এক প্রৌঢ় প্রোফেসরের হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, বড় খবরের কাগজের আপিসে কাজ জোটানোর জন্য হন্যে হয়ে স্টোরি খুঁজে বেড়ানো— এই ধরণের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা গল্প হয়ে উঠে আসতে থাকে এই পর্যায়ের ছবিতে।
Read more: Gabriel Garcia Marquez and Mrinal Sen- Friends Across Continents
কিন্তু দৈনন্দিনের অ্যানাটমি সবসময় আমাদের চোখে চেনা নাও ঠেকতে পারে। ১৯৪৭ সালে ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক অঁরি লেফেভর তাঁর ‘ক্রিটিক অফ এভরিডে লাইফ’ বইতে হেগেলকে উদ্ধৃত করে এর কাছাকাছি একটি মন্তব্য করেছিলেন – “যাকে চিনি, তাকেই যে ভালো করে জানি— এমন তো নয়।” হয়তো সবচাইতে চেনা ব্যাপারগুলোর মধ্যেই সবচেয়ে অজানা জিনিস এসে জড়ো হয়েছে। লেফেভর দেখেছিলেন কীভাবে নাৎসি আমলে সাধারণ মানুষের জীবন বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল ইতিহাসের চর্চা থেকে, তার জায়গায় সভ্যতা ও মহামানবদের ঢক্কানিনাদ হয়ে উঠেছিল প্রতিক্রিয়াশীল ইতিহাসচর্চার উপজীব্য। তাই তিনি মত দিয়েছিলেন, বিমূর্ত যুক্তি ও অধিবিদ্যার নিগড় থেকে বাস্তবকে নিষ্কৃতি না দিলে আর প্রাত্যহিক জীবনের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের নাগাল না পেলে ইতিহাস আবার পিছলে গিয়ে পড়বে প্রতিক্রিয়াশীলতার ফাঁদে। আমরা ইতিহাস বলতে যা বুঝি, তাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চার আখড়া থেকে বের করে আনি সিনেমার আঙিনায়, তাহলে দেখব লেফেভর যখন প্রাত্যহিক জীবনের দিকে ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকদের নজর টানার চেষ্টা করছেন, সেই একই বছর যুদ্ধোত্তর ইতালিতে শুরু হয়ে গেছে নিওরিয়ালিস্ট সিনেমার অভিযান, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের মহাকাব্যকে পাশ কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে লৌকিক জীবন, মানুষের সুখদুঃখের বিচিত্র স্ববিরোধের ইতিকথা— তা রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যতই অপাংক্তেয় হোক না কেন।

এটা কাকতালীয় নয় যে আশির দশকে এসে, যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসীন, তখনই মৃণাল সেন চোখ ফেরাচ্ছেন এই প্রাত্যহিকের ইতিহাসের দিকে, যা রাষ্ট্রের গতির সাথে তাল মিলিয়ে ছোটেনি। হয়তো বা তার চাকার তলায় থেঁৎলে গিয়েছে। যেমন, ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিতে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির এক প্রেমিক ছিল, নাম- সোমনাথ। ছিয়াত্তর সালে কলেজস্ট্রিটে একটি ছাত্রসমাবেশের ওপর পুলিশ গুলি চালায়, তাতে সে মারা যায়। সেই স্মৃতি দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গিয়েছে পরিবারের সকলের মনে। সন্দেহ হয়, হয়তো সেই অবসাদেই এতদিন পর মেয়েটি কোনও চরম পরিণতি বেছে নিয়েছে। ১৯৯১ সালের ছবি ‘মহাপৃথিবী’-তে বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে পড়ে, তার সঙ্গে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসে উনিশ বছর আগের রুধিরঝরা রাতের স্মৃতি— যে রাতে পরিবারের নকশাল ছেলেটি পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল। উনিশ বছর পরে, ছবির একেবারে শুরুতে, পরিবারের কর্ত্রী, ঐ অকালমৃত যুবকের মা আত্মহত্যা করেন। যদিও এর কারণ সকলের অজানা, তবু পাপবোধ কুরে খেতে থাকে সবাইকে, যে হয়তো সবাই অতীতের সেই অন্যায়কে ভুলে থাকতে চেয়েছিল বলে অভিমান করেই মহিলা এই পথ বেছে নিলেন। দুটি সমান্তরাল ইতিহাস, একটি সাধারণের ইতিহাস— যা আপামর সকলকে প্রভাবিত করে, অন্যটি একটি বিশেষ ইতিহাস, যার ঢেউ চার দেওয়ালের খুপরির বাইরে বেরোবে না কোনোদিন— এই দু’য়ের মর্মান্তিক সমাপতন যেন অতীতের একটি মুহূর্তে থিতু থাকেনি, বার বার ফিরে এসেছে প্রেতের মতো, নিষ্ক্রিয়তা আর বিস্মরণের গ্লানি হয়ে সবাইকে গিলে খেতে। এই ইতিহাসের হাত থেকে আর নিস্তার নেই।

মৃণাল সেনের আগেও এ’দেশে পার্টি, রাষ্ট্র ও সাধারণের ইতিহাস থেকে স্বতন্ত্র হয়ে ব্যক্তিসত্তার স্ফূরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন কিছু বামপন্থী চিন্তক (সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য), যা লেনিনোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিনিস্ট স্বৈরতন্ত্রের সাথে খাপ খায় না। মৃণাল সেন তাঁর তৃতীয় পর্যায়ের নাগরিক মধ্যবিত্তের ছবিতে দুই ইতিহাসের সমান্তরাল প্রবাহ দেখিয়ে ও একটির আঘাতে অপরটির ওলটপালট হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত পরিস্ফুট করে ব্যক্তিসত্তার হাহুতাশকেই বারবার তুলে ধরেন, যা ইতিহাসের কাছে হাত পেতে না পায় অবলম্বন, না পারে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্বকে সদর্পে ঘোষণা করতে। একুশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মৃণাল সেনের ক্যামেরা দেখছে দম হারিয়ে ধুঁকতে বসা নাগরিক আধুনিকতাকে, আর সব শেষে ‘মহাপৃথিবী’-র জরাভারাক্রান্ত পিতার মুখ দিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে ক্লান্ত স্বগতোক্তি: “আঁকড়ে ধরার মতো আর তো কিছু থাকল না।” এটি একটি জিজ্ঞাসাও হয়তো, যার জবাব তিনি খুঁজবেন জীবনের শেষ দুটি ছবি, অন্তরীণ (১১৯৩) ও আমার ভুবন (২০০২)-এ।
তথ্যসূত্র:
Lefebvre, Henri. Critique of Everyday Life, Vol. 1: Introduction. Translated by John Moore.
London, New York: Verso Books, 1991.
Sen, Mrinal. Montage: Life, Politics, Cinema. Kolkata: Seagull Books, 2018
Always Being Born, Kolkata: Stellar Publishers Pvt. Ltd., 2004.
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia, Mrinalsen.org
অভিষেক রায় বর্মণের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা হাওড়া জেলায়। বর্তমানে ফিল্ম স্টাডিসের গবেষক, বিশেষ উৎসাহ রয়েছে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন নিরীক্ষামূলক ধারা নিয়ে। এর পাশাপাশি কাউন্টার শট নামক একটি ফিল্ম বিষয়ক পত্রিকার সহসম্পাদক। অন্যান্য আগ্রহের বিষয়: জঁর সাহিত্য; কমিক্স; ইতিহাস; জীবজগৎ, বাংলা গদ্যসাহিত্য; সুররিয়ালিসম ইত্যাদি।