ছোট্ট রিয়া দু’দিন ধরে খুব উত্তেজিত। কারণ আর কিছু নয়, ঠাম্মি আসছে। ঠাম্মি মাঝে মাঝেই এসেছে, দাদাই-ঠাম্মি এসে দু’তিন মাস করে থেকেও গেছে। এবারের ব্যাপারটা অন্য। এখন তো আর দাদাই নেই। ঠাম্মি একা একা আসছে। আসছে শুধু নয়, ঠাম্মি এখন থেকে এই বাড়িতে রিয়াদের সঙ্গেই থাকবে। বাবি যে খুব খুশি, মুখ দেখেই বুঝতে পারছে রিয়া। মাম বারবার বলছে, ”একদম দুষ্টুমি করবে না। ঠাম্মিকে বিরক্ত করবে না, কষ্ট দেবে না।”

না, ঠাম্মিকে একটুও কষ্ট দেবে না রিয়া। কেউ না-ই বলুক, রিয়া জানে এমনিই ঠাম্মি খুব কষ্টে আছে। দাদাই অমন ঘুমের মধ্যে একা একা আকাশের পাখি হয়ে গেল, ঠাম্মি বলেছে রিয়াকে, “পাশে শুয়ে থেকেও কিচ্ছুটি বুঝতে পারলাম না? সারারাত তো ঘুমই হয় না আমার। ভোরবেলা চোখ লেগে গেছে, আর অমনি তোর দাদাই কেমন ফাঁকি দিল আমায়, বল?”

পিসিমণি কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “কাউকে একটু কষ্ট দিতে চায়নি বাবা। কোনোদিন নিজের জন্যে মুখ ফুটে একটা জিনিস চায়নি, একটা কাজ করে দিতে বলেনি। যাবার সময়ও কাউকে একবার ডাক দিলে না বাবা?”

পিম্মা পিসিমণিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, “তবু তো তুই কাল বাবাকে দেখে গেছিস। আমি যে কতদিন পরে এলাম। ভাবতেই পারিনি যে, সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষটা এমন…” কান্নাকাটি অবশ্য সবাই করেছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোকজন। জেঠু-জেঠিমা সেদিনই দিল্লি থেকে এসে গেল, কাকাই-কাম্মা হায়দ্রাবাদ থেকে। আরও অনেক লোক। সবাইকে চেনে না রিয়া। 

Image 1

আর কত ফুল! ফুলের বিছানায় দাদাই ঘুমিয়েছিল। সবাই কত কান্নাকাটি করল, ঠাম্মি কিন্তু চুপ করে বসেছিল। দাদাইকে নিয়ে চলে গেল যখন সবাই, তখন রিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। পিসিমণি জড়িয়ে ধরল, কাম্মা এসে জড়িয়ে ধরল, তখনও রিয়ার হাত ধরে। এত জোরে ধরেছিল যে, রিয়ার হাতে লাগছিল। তবু রিয়া হাত ছাড়িয়ে নেয়নি। তারপর সবাই মিলে যখন ঘরে একলা শুইয়ে দিল ঠাম্মিকে, তখন বলেছিল রিয়াকে, “কিচ্ছু টের পেলাম না আমি ? ফাঁকি দিয়ে চলে গেল তোর দাদাই ?”

দাদাইকে আকাশের কাছে রেখে যখন সবাই ফিরে এল, বাবি এসে দাঁড়াল কেমন একটা অদ্ভুত কাপড় পরনে, রিয়ার হাত ছেড়ে বাবির হাত ধরেছিল ঠাম্মি, “কী হবে এখন?” 

“কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো।” বাবি কাঁদছিল। 

এই ক’দিন আগে ফোনে আবার বলছিল বাবি, “আমি আছি। তুমি আমার কাছে থাকবে। যার যা ইচ্ছে, নিয়ে যাক।”

পিসিমণি একদিন ফোন করেছিল, সেদিনও বলেছে বাবি, “মায়ের জন্যে আমি আছি। মা আর ওখানে অত অশান্তির মধ্যে থাকবে না।”

Image 2

কেউ কিছু না-ই বলুক, মাম আর বাবির কথা শুনে শুনে অশান্তির কথাটা জেনে ফেলেছে রিয়া। কাকাই আর কাম্মা বাড়ির দুটো ঘরে তালা দিয়ে দিয়েছে। সেই নিয়ে জেঠু আর জেঠিমা খুব রাগ করেছে। রান্নাঘরে বড় ফ্রিজটা কিনে দিয়েছিল জেঠু, সেটায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে। জেঠিমা ফোন করে ঠাম্মিকে বলেছে, “আপনার গলার মটরমালার হার কিন্তু কাউকে দেবেন না। ওটা আমার মেয়ের পাওনা। হারটা আপনার বড় ছেলেই কিনে দিয়েছিল, মনে আছে তো?”

হাতের চুড়ি নিয়েছে পিম্মা, গলার সরু হারটা পিসিমণি। ঠাম্মির যত রঙিন শাড়ি ছিল, সব পিম্মা আর পিসিমণি ভাগ করে নিয়ে নিয়েছে। কাম্মা আর জেঠিমা সেই নিয়ে খুব রাগ করেছে। হায়দ্রাবাদ থেকে একলাই বাড়ি এসেছে কাম্মা, “মায়ের কড়িয়াল বেনারসিটা আমি নেব, ওটা আমার বাপের বাড়ির দেওয়া… সবুজ পাড় কাঞ্জিভরম আমিই মাকে দিয়েছিলাম, ওটাও আমার চাই…”

মামকে জেঠিমাও ফোন করেছিল কাম্মা।

আরও পড়ুন: গল্প: প্রিয়জন

বীণাপিসি বাবিকে ফোন করেছিল একদিন, “ভুটাই এসে বড়বাবুর ঘরে শুচ্ছে রোজ। তোমার মা আজকাল প্রায়ই বসার ঘরের ছোট খাটে ঘুমোয় রাতে। আমি বললে তো কেউ শুনবে না দাদা, একটা কাজের লোক বৈ তো কেউ নই তোমাদের। তোমরা একবার এসে দেখে যাও।”

ভুটাই যেমন দাদাইয়ের ঘরে ঘুমোচ্ছে, ছোট পিসুন নাকি তেমনই মাঝে মাঝেই ওবাড়িতে রিয়াদের ঘরে ঢুকে শুয়ে থাকে। “খুব সাবধান দাদা। বড়বাবু নেই। তোমার মা তো চিরকালই নরম ধাতের মানুষ, কাউকে কিছুই বলতে পারবে না”— বীণাপিসি ফোনে বলেছে। 

ভুটাইয়ের কথা ফোন করে বাবিকে বলে দিয়েছে, তাই পিসিমণি খুব বকেছে বীণাপিসিকে, “কাজের লোককে মাথায় তুললে এমনই হয়।”

ফোনে খুব কাঁদছিল বীণাপিসি, “বড়বাবু আমাকে মেয়ের মতো দেখতেন কিনা, তুমিই বল দাদা।”

রোজই এমন নানা কাণ্ড। 

ভুটাই দাদাইয়ের ঘরে ঘুমোচ্ছে শুনে জেঠিমা দালানের দিকের মেজ ঘরটায় তালা দিয়ে দিয়েছে। দিল্লি থেকে নিজে আসতে পারেনি, জেঠিমার ভাই এসে তালা দিয়ে গেছে। সেই নিয়ে তুলকালাম, এই শব্দটা আজকাল প্রায়ই শোনে রিয়া, মানেটা ঠিক জানা নেই, তবে ওবাড়ির কথা হলেই মাম এইটা বলে।

“বাবা যে আর নেই, এখন বুঝতে পারছি আমি”, মাম মিনিমাসিকে বলছিল সেদিন। 

Image 3

বাবি একবার বাড়ি গেল, আর সব দেখেশুনে খুব রাগ হল বাবিরও। “মা আর থাকবে না এখানে”, বাবি বলে এসেছে। বাবিকে জড়িয়ে ধরে নাকি খুব কেঁদেছে ঠাম্মি। পাড়ার সবাইও বলেছে, “মাকে নিয়েই যাও। এত অশান্তি এখানে।”

ঠাম্মি তখনই রাজি হয়নি। আসলে দাদাই চলে যাবার পর জেঠু ঠাম্মিকে দিল্লি নিয়ে গেছিল। কী হয়েছে কে জানে, কাউকে তো কিছু বলে না, এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে এসেছে ঠাম্মি। পিসিমণিও নিয়ে গেছিল, ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে, “মা বড্ড উপোস করে, শরীর খারাপ হলে সবাই তো আমাকেই দুষবে।”

পিম্মা বলেছিল নিয়ে যাবে। ঠাম্মি বলেছে, “এত এদিক-সেদিক যেতে পারি না রে। শরীরে দেয় না। তোরা বরং সময় পেলে আসিস, থাকিস।”

থাকবে কোথায় ! তিনটে ঘরে তো তালা । 

“সেইজন্যেই বড়দি ভুটাইকে এবাড়িতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে দাদা”, কাকাই ফোন করেছিল বাবিকে, “ওরা বলাবলি করছিল, মিতু নিজের কানে শুনেছে, আজকাল মেয়েদেরও বাবার সম্পত্তিতে ভাগ আছে।”

“সে তো আছেই”, বাবি বলেছে।

“কেন দাদা? ওদের বিয়েতে চল্লিশ ভরি করে গয়না দেওয়া হয়নি? বড়দি বাড়ি করার সময় লোনের মার্জিন-মানি আপনি দেননি? আপনি দেওয়া মানে আমাদের বাড়ির দেওয়া নয়?” কাম্মার ফোন এসেছিল, স্পিকারে ফোন রেখেছিল বাবি, যাতে মাম শুনতে পায়, রিয়াও সব শুনেছে।

“ছোড়দির অপারেশনের সব খরচ বাবা দিয়েছে, বিয়ের খরচ দেবার পরও। বিপ্লবদার চাকরি চলে গেল, মাসের পর মাস ওদের সংসার টেনেছি আমরা। এখন সম্পত্তির ভাগ চাইলেই হবে?”

“এখনই এসব কথা কেন উঠছে, বল তো? বাবা গেছে, ক’দিন হয়েছে রে? মা এখনও সামলে উঠতেই পারেনি। শোন ছোটন, এসব ভাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে” বাবি বলেছে।

Image 4

রিয়ারও তাই মত। যদিও বাবি-মাম রিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেনি। বড়রা সব কথা ছোটদের সঙ্গে বলে না, কিন্তু রিয়া সব বুঝতে পারে। ঠাম্মি এখানে চলে আসছে বলে রিয়া তাই বেশ স্বস্তি পেয়েছে। বাবা নেই, কোথায় ছেলেমেয়েরা সবাই এখন মায়ের পাশে পাশে থাকবে, জড়িয়ে থাকবে— তা নয়। শুধুই অশান্তি। আহা ঠাম্মি! দাদাই নেই, কার সঙ্গেই বা কথা বলে! 

তবু আসতে চায়নি ঠাম্মি। ভয় পেয়েছে বোধহয়। বীণাপিসিকে বলেছিল ঠাম্মি, “আমি এখানেই থাকব। তোর বড়বাবু তো আমার মাথার ওপর একখান ছাদ রেখে গেছেই।”

ভালো করে ডাক্তার দেখাবে, চোখের অপারেশন হবে, এইসব বলে ঠাম্মিকে রাজি করিয়েছে বাবি।

মাম তাই বারবার বলছে, “এখানে যেন মায়ের কোনও অসুবিধে না হয়। কোনও কষ্ট না হয়।”‘

মিনিমাসির বুটিক থেকে সাদা লেসের কাজ করা চাদর আর বালিশের ঢাকনা। পাতলা জয়পুরি লেপ। বৃষ্টি পড়লেই ঠান্ডা হয়ে যায় এখানে, ঠাম্মির তো অভ্যেস নেই। শুভকাকুর দোকান থেকে নতুন একটা ঠাকুরের সিংহাসন। বারান্দায় বসার জন্যে একটা নতুন দোলনা-চেয়ার। বসার ঘরে নিচু একটা ছোট বেতের খাট, টিভিটা তো বসার ঘরেই, ঠাম্মি শুয়ে বসে দেখবে। একটা আলমারি খালি করে রেখেছে মাম, ঠাম্মির জিনিস থাকবে। অনুকাকিমার বাড়িতে মালিশ করতে আসা রোগামত বউটাকে বলে রেখেছে ঠাম্মির মালিশের জন্যে। শিপ্রামাসির বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার সাঁই-ভজন হয়, ঠাম্মিকে যেন যেতে বলে শিপ্রামাসি— বলে রেখেছে মাম। 

Image 5

“এত ব্যবস্থা করার কিছু নেই, মা তো আগেও এসেছে। দেখেছ তো, মায়ের কিছুই লাগে না! সবখানেই মানিয়ে নেয়”, বাবি বলেছে।

“না, মা আর মানিয়ে নিয়ে থাকবেন না”, মাম বলেছে, ‘মায়ের প্রতি সবার এই টেকেন ফর গ্রান্টেড অ্যাটিচ্যুড নিয়েই মুশকিল। মা যেখানে থাকবেন, রানির মতো থাকবেন।”

মামের কথাটা খুব ভালো লেগেছে রিয়ার। সত্যি তো, কেমন রানির মত সুন্দর ঠাম্মি। টুকটুকে ফর্সা, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, কাঁচাপাকা চুলে লাল সিঁদুর, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ, লাল লাল গাল, পানের রসে ঠোঁটও লাল। বড় বড় চোখ, মিষ্টি হাসি। রানিদের মতোই আলতো গলায় মিষ্টি করে কথা বলে ঠাম্মি। রানিদের মতো ঝলমলে গয়না নেই, কিন্তু ঠাম্মিকে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আর দুর্গাপুজোর সময় লালপাড় গরদের শাড়ির ঠাম্মি, ঠিক দুর্গাঠাকুরের মত।

বাবির সঙ্গে গাড়ি থেকে নামছে ঠাম্মি, ছুটে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে রিয়া। এই ঠাম্মি! এমন সাদা, ফ্যাকাশে! লাল টিপ নেই, রুক্ষ চুল, শুকনো মুখ। গলায় একটা কালো মোটা সুতোয় মাদুলি, আর কিছু নেই। হাতে সরু চুড়িগুলো আছে, কিন্তু সবুজ পাথরের আংটিটা নেই। সাদা শাড়ি, সরু খয়েরি পাড়। দাদাই যেদিন আকাশের পাখি হয়ে গেল, সেদিন এইরকম শাড়ি পরেছিল ঠাম্মি। কত আনন্দ হচ্ছিল, কত মজা হবে ঠাম্মি এলে… রিয়ার হঠাত্‍ কান্না পাচ্ছে খুব। এতদিন পরে হঠাত্‍ দাদাইকে মনে পড়ছে। বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে।

মাম এসে প্রণাম করল। হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ি ধরে। ঠাম্মি হাত বাড়িয়ে দিল রিয়ার দিকে।

রিয়ার ঘরেই থাকার ব্যবস্থা। ভেবে রেখেছিল ঠাম্মি এলে কত গল্প— রামায়ণের গল্প, মহাভারতের অর্জুনের গল্প, একলব্যের গল্প, বুদ্ধু-ভুতুম, রাক্ষসীরানি, সুখু-দুখু, ইতুপুজোর রুমনি-ঝুমনি, জয়াবতী— সব গল্পগুলো আবার শুনবে রিয়া। কিন্তু ঠাম্মি এখন আর গল্প বলেই না। শুধুই ওবাড়ির দুঃখের গল্পগুলো। ভুটাইদাদা কেমন বিরক্ত করেছে, পিম্মা পিসিমণি কাম্মা কে কবে কী কী বলেছে, বড়জেঠু এসে কী কী কঠিন কথা বলে গেছে, দাদাইয়ের ভাইরা কবে কী বলেছে, দাদাইয়ের বোনেরা কেউ কেন খবর নিল না, ঠাম্মির শাশুড়িমা কী কী কষ্ট দিয়েছে— কত পুরনো পুরনো দুঃখের কথা। এত কথাও তো বলত না আগে।

Image 6

স্কুল থেকে ফিরে রিয়া রোজই দেখে ঠাম্মি খেয়েদেয়ে ঘরে শুয়ে আছে, দাদাইয়ের একটা ছবি নিয়ে। এমনিতে কাউকে ছবিটা দেখায় না। নিজের আলমারিতে লুকিয়ে রাখে। আগে রিয়া না ফিরলে খাবার খেত না, রিয়াকে কেমন গল্প বলে বলে গোল্লা পাকিয়ে খাইয়ে দিত। মাম অফিস যাবার আগে গুছিয়ে শুক্তো-পোস্তবড়া-লাউঘণ্ট টেবিলে সাজিয়ে রাখে, ঠাম্মি ফেলে ছড়িয়ে খেয়ে উঠে যায়। এত যে লেসের চাদর, ঠাকুরের আসন… ফিরেও দেখে না। বাবি অফিস থেকে এসে গল্প করতে চায়, বাবির ছেলেবেলার গল্প, ঠাম্মি ঘুরেফিরে ওবাড়ির ঝগড়ার গল্পগুলো করে। বাবি যে-ই বলে, “ওসব কথা থাক”, ঠাম্মি তখন সিরিয়াল দেখতে চলে যায় ।

মাম বলেছে, “থাক, মা নিজের মতো থাকুন। যা ভালো লাগে, করতে দাও। কেউ বিরক্ত কোরো না। জোর কোরো না।”

বাবিও বলে, “বাবা চলে গিয়ে সব বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। মা কেমন বদলে গেছে!”

চোখের অপারেশন, ডাক্তার দেখানো সবই হল। আল্পনা কাকিমার বাড়ির সত্যনারায়ণের পুজো, শিপ্রামাসির বাড়ির সাঁই-ভজন, রামকৃষ্ণ মিশনের নামকীর্তন। ঠাম্মি কোনও ব্যাপারেই আপত্তি করেনি। নিষ্প্রাণ, নির্জীব পুতুলের মতো সবই মেনে নিচ্ছে। মনে নিচ্ছে কিনা বোঝার উপায় নেই। 

Image 7

আজকাল বাড়িতে সবাই কম কথা বলে। মাম আর দৌড়ে দৌড়ে ঠাম্মির জন্যে খাবার তৈরি করে না, বাবিও অফিস থেকে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়তেই ভালবাসে। মাম যে এত ঘর সাজাতে ভালবাসে— মাঝেমাঝেই জিনিসপত্র টানাটানি করে ঘর সাজাত, দেয়ালের জন্যে সুন্দর সুন্দর পেন্টিং, ঘর সাজানোর টুকিটাকি, সুন্দর সুন্দর লা-ওপালা কোরোলা বাসন মাঝে মাঝেই নিয়ে আসত… সব ছেড়ে দিয়েছে। ডোকরার মস্ত ময়ূর, পোড়ামাটির ঘোড়া, রঙিন কাচের ফ্লাওয়ার ভাস, জয়পুরি মিনার কাজ করা ঘণ্টাগুলো, পেতলের বুদ্ধ, ক্রিস্টালের গণেশ, টেরাকোটার দুর্গা— সব অযত্নে পড়ে থাকে । 

জেঠিমা ফোনে বলে, “আমাকে তো সবাই খারাপ ভাবছিলে, মা কেন এক সপ্তাহের বেশি থাকল না… এখন বুঝতে পারছ তো?”

কাম্মা বলে, “নিজের ভালোটা পাগলেও বোঝে। এত যত্ন করে নিয়ে গেছে দাদা, এত করছ তোমরা, একটু আনন্দে থাকতে পারে না? আসলে উনি ওইরকমই, সুখ কপালে সয় না।”

মিনিমাসি বলে, “শাশুড়ি কোনোদিন মা হয় না রে, মন খারাপ করিস না। যতই করিস, মন পাবি না।”

শুধু বীণাপিসি বলে, “শিকড় তুলে নিয়ে গেছ দাদা, একটু সময় দাও। মেয়েরা খুব ডালপালা বিছিয়ে শিকড় ছড়িয়ে থাকে সংসারে, সবটা তুলে নেওয়া যায় না।”

ঠাম্মি নেই, ওবাড়ির কাজ নেই, তবু প্রায় রোজই ওবাড়িতে যায় বীণাপিসি। ঠাকুরঘরে জল দেয়, প্রদীপ দেয়, ঘর ঝেড়েমুছে দেয়। ভুটাইদাদা তো ওখানেই থাকছে আজকাল, সেই সুবাদে পিসিমণিও। ছোটকাকু অফিসের কাজে গিয়ে একবার ঘুরে এল, একটা নতুন আলমারি কিনে রেখে এসেছে। জেঠিমা মুনিয়াদিদিকে নিয়ে কী পরীক্ষা দিতে গেল একবার, বীণাপিসিই গিয়ে রান্নাবান্না করে দিয়েছে। আজকাল ফোন হয়ে খুব সুবিধে। সবাই সব খবর পায়।

মাম আর দৌড়ে দৌড়ে ঠাম্মির জন্যে খাবার তৈরি করে না

স্কুলের সুপু করার ব্যাপার ছিল। প্রতিবারের মতো মা-ই করছিল সব। রঙিন কাগজ কেটে কেটে ভারতের ম্যাপ। রিয়াও হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছিল মাকে। আঠা, কাঁচি, কাগজ। ঠাম্মি এসে বসল। “সুতো নেই, রঙিন সুতো?”

“আছে মা। কেন?”

“আমাকে দাও, আমি রিয়াবুড়ির সুপু করে দিই।”

কতদিন পর ‘রিয়াবুড়ি’! মামও অবাক হয়েছে। “আমি এনে দিচ্ছি।”

ঠাম্মি হাত বাড়িয়ে মায়ের আঁচল ধরল, “একটু বোসো মা, আমি আগে বুঝে নিই।”

‘মা’! সেই আগের মতো! দাদাই-ঠাম্মি কোনওদিন ‘বৌমা’ বলে ডাকেনি। সবাই ‘মা’। সবাই একসঙ্গে হলে কত মজা হত এই নিয়ে, “কোন মা-কে ডাকছ, কী করে বুঝব?”

দাদাই হাসত, “মন দিয়ে ডাক শোনো, ঠিক বুঝতে পারবে।”

পরের দিন সকালে বাবি অফিস বেরোচ্ছে রোজকার মতো, রিয়াকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাবি অফিস চলে যাবে, রোজকার মতো ‘আসছি মা’ বলেছে, ঠাম্মিও ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলেছে, তারপরই “একটু দাঁড়া না মেজো খোকা”…অফিস যাবার সময় ডাকা নিয়ে কত বারণ করেছে সবাইকে, মনেই নেই। 

ঘর থেকে বেরিয়ে এল, হাতে সেই ছবিটা। দাদাইয়ের ছবি। 

“বাহ, খুব সুন্দর তো ছবিটা!”, বাবি বলল।

“তোতনকে দিয়ে করিয়েছি। ছোটখোকার বিয়ের সময় তোলা, মিনুর ছেলে তুলে দিয়েছিল। গ্রুপ ছবি ছিল, শিবেন ঠাকুরপো-প্রবোধ-ছোটখোকার শ্বশুর। তোর বাবার ছবিটা তোতন সেখান থেকে কেটে বার করে দিয়েছে, কম্পিউটারে। পোস্টাপিসের মোড়ে ছবির দোকান করেছে তোতন, দেখেছিস না?”

“খুব ভালো করেছ মা। বাবার এই ছবিটা খুব সুন্দর। কেমন হাসছে চোখদুটো।”

“সে তো হাসবেই। কেমন মজা দেখিয়ে চলে গেল! যাকগে, যা বলতে এলাম… ছবিটা বাঁধিয়ে এনে দিবি বাবা? আর ক’দিন পরেই বাত্‍সরিকের কাজ।”

“সে তো মাসখানেক দেরি আছে মা। আচ্ছা দাও, ছবিটা আজই বাঁধাতে দিয়ে দিই।” এতদিন পর এত স্বাভাবিক কথা বলছে ঠাম্মি। বাবি-মাম যে খুব খুশি, মুখ দেখেই বুঝতে পারছে রিয়া। 

Image 8

ছবি বাঁধাই হয়ে এল, মাম ডাইনিং টেবিলের পাশের ছোট টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে ছবিটা। সন্ধেবেলা চায়ের আসরে, আজকাল রোজ সন্ধেবেলা বাবি-মাম অফিস থেকে ফিরলে চায়ের আসর বসে। সেখানেই আসল কথাটা বলল ঠাম্মি…

“পরের রবিবার বাড়ি যাই? অনেকদিন তো হল! দুদিনের জন্যে ছুটি নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবি মেজখোকা?”

“এখনই কেন মা? বাত্‍সরিকের কাজের জন্যে চিন্তা করছ? আমি তো বলেছি তোমায়, সাতদিন আগে নিয়ে যাব। ওখানে সেজোকাকা প্রশান্তদা বিপ্লব ব্যবস্থা করে রাখবে… আমার সঙ্গে কথা হয়ে আছে। এখান থেকে কেন?”

“না রে। সে তো জানিই। তোরা আছিস, বাবার কাজের জন্যে আমার চিন্তা কী?”

“তাহলে?”

“তোমার কি এখানে অসুবিধে হচ্ছে মা?” মাম বলল, “আমরা কি কেউ কিছু করেছি? কিছু বলেছি?”

“ছিছি মা! কী যে বলছ তুমি! তোমার মতো মেয়ে, সবদিকে নজর, যেখানে জল পড়ে সেখানে ছাতি ধরো তুমি, তোমার কোনও ভুল হয়নি।”

“তাহলে? কেন চলে যেতে চাইছ?”

“আমায় কথা বলতে দাও”, বাবি মামকে থামিয়ে দিল, “মা চলে যেতে চাইবে কেন? মা তো এখানেই থাকবে, আমার কাছে। কথা তো হয়েই আছে, মা নিজে মত দিয়েছে। বাবার কাজের পর আবার ফিরে আসবে মা। যেতে চাইছে, আটকিয়ো না। মা একজন স্বাধীন মানুষ, মায়ের যখন ইচ্ছে হয়েছে বাড়ি যাবে।”

Image 9

বাবির মাথায় হাত রাখল ঠাম্মি, তারপর মুখে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, “আমার মেজখোকা চিরকালই বুঝমান। মাথাটাও খুব ঠান্ডা। আর মনটা তো আকাশের মতো। অনেক ভেবেই এখানে থাকতে মত দিয়েছি। কিন্তু ..” চুপ করে গেল ঠাম্মি। 

একেবারে চুপ। 

অনেকক্ষণ পরে, যখন মনে হল আর কথাই বলবে না ঠাম্মি, মামের হাত ধরল, “এদিকে এস মা। আমার কাছে এস। কত ভাবনা এই বুড়ো মায়ের জন্যে, না? বড়খোকার বাড়িতে আমাকে নিয়ে কত অশান্তি, টিঙ্কুর বাড়িতেও তাই। আর এই মেয়েটা… মা কী খাবে, কী করে ভালো থাকবে! আমার জন্যে কত ব্যবস্থা! আর আমি? ফিরেও দেখিনি। শুধু শুধুই কষ্ট দিয়েছি তোমায়। আসলে… অনেকগুলো দিন মনে মনে বড্ড নড়বড়ে হয়ে ছিলাম। নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি যে মা, আমাকে যে সব মানায় না, তাও ভুলে গেছিলাম। তারপর… এই ছবিটা…”

দাদাইয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মায়ায় হাসল ঠাম্মি, “মেজখোকা বলল না, মা স্বাধীন! মা কি সত্যিই স্বাধীন? নিজের ইচ্ছেমতো সব করতে পারে? এই বাড়িতে একটাও জায়গা নেই যেখানে তোর বাবার ছবিটা রাখি। দেয়ালে দেয়ালে কী সুন্দর ছবি, পেইন্টিং! এখানে কোথায় রাখি? রিয়াবুড়ির ঘরের দেয়াল জুড়ে রঙিন ছবি, ফুলের, প্রজাপতির, পুতুলের। বড্ড বেমানান লাগবে না, বল?”

“এইজন্যে মা? একটা ছবির জন্যে? আমাকে একবার বললে না তুমি? আমি এখনই বাবার ছবির ব্যবস্থা করছি।”

“না রে মা। আমি তো জানি, তোমাকে বললেই সুন্দর জায়গা করে শ্বশুরের ছবি রাখবে তুমি। কথাটা তা নয়। আমি ভেবে দেখলাম, এই বাড়ি এই সংসার আমার ছেলের… কিন্তু আমারই যে, তা নয়। ছবি রাখার জন্যে তোমাকে বলতে হবে। কিন্তু তা কেন? আমার তো সত্যিই জায়গার অভাব নেই। তিনি তো আমার ব্যবস্থা করেই গেছেন। আমি কেন সব ছেড়ে, সব অন্যায় মেনে নিয়ে নিজের স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দিই? তোমাদের স্বাধীন সংসারে তুমিই বা কেন মনের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারবে না? কেন আমার ইচ্ছেমতো ছবি সাজাতে হবে? সংসারে সবার জায়গা, সবার অধিকার নির্দিষ্ট।”

“আমি এরকম ভাবিই না মা। সংসারে আমার-তোমার বলে কিছু নেই। বাবার ছবিটা কি শুধুই তোমার একার? আমাদের নয়? এই ঘর, এই বাড়ি, এই সংসার তুমি নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও। আমার মেয়েটা ঠাম্মি বলতে অজ্ঞান! তুমি ওকে দ্যাখো, আমাদেরও আশ্রয় হও। এইটুকুই তো চেয়েছি।”

“জানি মেজখোকা। তুই আমার গর্ব। আমার সেরা সন্তান। কিন্তু জীবনে এই প্রথম স্বাধীন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে বাধা দিস না। দুর্বল করেও দিস না। ছবিটা আমায় নতুন শক্তি দিয়েছে। আমি সংসারে নিজের জায়গাটা চিনতে পেরেছি। আর কেউ আমাকে নিরাশ্রয়, ছিন্নমূল করতে পারবে না। এবার ওবাড়িতেই তোরা সবাই আসবি আমার কাছে। তোদের মায়ের কাছে, বাবার কাছে। তোদের কথা ভেবেই আমি জোর পেয়েছি। মাকে মায়া করে, মাযের কষ্ট দেখে কত ভাবনা। কত কষ্ট। বাবা থাকতে তো এমন নিরাশ্রয় অবস্থা হয়নি তোদেরও। তাহলে? আমাকেও পারতে হবে। ঠিক ঠিক আশ্রয় হয়ে উঠতে হবে।”

ঠাম্মির চোখে চিকচিকে আলো!

অবাক হয়ে চেয়ে আছে বাবি। ছেলেমানুষের মতো। মাম হঠাত্‍ হাত বাড়িয়ে প্রণাম করল ঠাম্মির পায়ে। “আয় রিয়াবুড়ি”, হাত বাড়িয়ে রিয়াকে কোলের কাছে টেনে নিল ঠাম্মি। পাশেই টেবিলের ওপরে দাদাই তখনও হাসছে। 

 

 

অঙ্কণ: শুভ্রনীল ঘোষ

ছবি সৌজন্য: Pinterest

Ivy Chattopadhyay

আইভি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬৩ সালে ইস্পাতনগরী জামশেদপুরে। সে শহরের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। ব্যাংকে চাকরি করেছেন। নেশা বই পড়া। সর্বভূক পাঠক। দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখির জগতে রয়েছেন। বিভিন্ন নামী পত্রপত্রিকা ও ওয়েবজিনে তাঁর গদ্য প্রকাশিত হয়। বইয়ের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত বারো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *