পবিত্র রমজান মাস শুরু, শুরু হয়েছে রোজা রাখাও। ফজরের নামাজ শুরুর আগে থাকে সেহরি পর্ব, আবার মাগরিব-এর নামাজে ভাঙে সারাদিনের রোজা, শুরু হয় ইফতার… পাপ পূণ্য ব্যতিরেকে দেখলে শরীর শুদ্ধিকরণের অন্যতম এক পথ এই রোজা। আর সুস্থ শরীরেই তো সুস্থ মনের বাস, যে সুস্থ মনে অর্জন করা যায় তাকওয়া আর পরহেজগারি।
 
শরীরবিজ্ঞানের দিক দিয়ে দেখতে গেলে চাহিদার চেয়ে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করতে থাকলে আস্তে আস্তে শরীরে টক্সিক বা বিষাক্ত পদার্থ জমা হতে থাকে, যা মেটাবলিজমের হার কমিয়ে শরীরের ক্ষতি করে। তাই কিছুদিন প্রয়োজনের চেয়ে কম ক্যালোরি গ্রহণ করে শরীরকে বিষমুক্ত করে, ঝরঝরে রাখার উপায় হল উপবাস। দীর্ঘক্ষণ উপবাসে অটোফেজির মাধ্যমে শরীরে পুরনো ও কমজোর কোষ পরিষ্কার হয়ে যায়।
 
সেহরি বা ইফতারের খাবার খেতে হবে বুঝে-শুনে। এক সাথে অনেকটা ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো, ভাজাভুজি তো খালি পেটে একদমই নয়… ক্যালোরি একটু কম হলেই ভালো, কিন্তু সুষম খাবারের পুষ্টিগুণের দিকেও নজর রাখতে হবে। ইফতারের খাবারে খেজুর, কলা, ডাবের জল, ফলের রস যেমন খুব উপকারী, সেরকম আরও কয়েকটি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ উপকারী সুপার ফুড দিয়ে আজকের খাবার। আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে উড়ে যাব সুদূর ইরানের ইফতার টেবিলে, কিংবা প্যালেস্টাইনের রান্নাঘরে আর মিশরের ওভেন থেকে বের করে আনব গরম কুকিজ…
 
আজ থাকছে
১. টাবুন রুটি আর চিকেন এর ডিশ মুসাখান
২. পারসি রাইস আর আখরোট বেদানা দিয়ে চিকেন স্টু ফেসেঞ্জুন
৩. খেজুর দিয়ে কুকি মামৌল
Musakhan Feast
মুসাখান সবার জন্যে উৎসবে

মুসাখান

 
ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকের দেশ, যেমন প্যালেস্টাইন, ইসরাইল, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এসব দেশে খাওয়া হয় মুসাখান। বিশেষ করে প্যালেস্টাইনে খুবই জনপ্রিয় এই খাবার। একদম বোল্ড ফ্লেভারের, একটু টক, একটু ঝাল ঝাল আর স্পাইসের গন্ধ সমেত। এই খাবার মূলত স্ট্রিট ফুড হলেও, নানান পারিবারিক অনুষ্ঠান আর জমায়েতেও খাওয়া হয়ে থাকে। পেঁয়াজ মূলত আমরা রান্নায় স্বাদ আনতে পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করি, এখানে কিন্তু পেঁয়াজটা অন্যতম বড় উপকরণ, চিকেনের সাথে। এই রান্নায় ব্যবহার হয় অলিভ অয়েল। এক সময় জলপাই পাকলে, হারভেস্ট ফেস্টিভ্যালে মুসাখান খাওয়া হত, এখন সারাবছর ধরেই এটা জনপ্রিয়। আর এর প্রধান ফ্লেভার আসে সুমাক থেকে। সুমাক একটি গুল্ম জাতীয় গাছের ফল, শুকিয়ে গুঁড়ো করে মশলা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে খুবই ব্যবহার করা হয়, মুসাখানের টক স্বাদ আসে এই সুমাক থেকে। 
এবারে দেখি, কী কী লাগবে মুসাখান বানাতে…
 
পেঁয়াজ ভেজে তৈরি করতে লাগবে
 
৫ টা পেঁয়াজ ডাইস করা
৪ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল এবং আরও ১/২ কাপ অলিভ অয়েল
৪ টেবিল চামচ সুমাক
২ টেবিল চামচ অল স্পাইস পাউডার
১ চা চামচ নুন
 
চিকেন রেডি করতে লাগবে
 
৩ টে চিকেনের বড় বড় পিস
৪ টে রসুন কোয়া
১ টা পেঁয়াজ ডাইস করা
১ টেবিল চামচ সুমাক
১ টেবিল চামচ অল স্পাইস পাউডার
দারচিনি এক ইঞ্চি, 
তেজপাতা দুটি
এলাচ ৪ টে
 
আর লাগবে, 
৩ টে টাবুন ব্রেড
সিলানট্রো কিংবা ধনে পাতা কুচি
শেষে ওপরে দেওয়ার মত আরো একটু সুমাক
আর আধ কাপ রোস্ট করা আমন্ড/ পাইন নাট কিংবা বাদাম
Musakhan
মুসাখান
টাবুন রুটি করতে
২ কাপ ময়দা
১ কাপ আটা
১ চামচ নুন
২ বড় চামচ সাদা বা অলিভ তেল আর মাখার জন্যে গরম জল
 
বড় এক চামচ ইস্ট, বড় এক চামচ চিনি আর উষ্ণ জল গুলে ইস্টটা অ্যাক্টিভেট করে, ময়দা, আটা আর বাকি সব কিছুর সঙ্গে মেখে ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। প্রায় দ্বিগুণ ফুলে উঠবে ঘণ্টাখানেক বা তার বেশি রাখলে। তারপর আবার মেখে, এর থেকে বড় লেচি কেটে রেখে আবার ফুলতে দিতে হবে। এই রুটি তাওয়াতে বড় সাদা সাদা নদীর পাথর গরম করে তার ওপরে স্যাঁকা হয়। খানিকটা পিটা রুটি বা পিৎজার রুটির মতনই।
 
এবার প্যানে তেল গরম করে, পেঁয়াজ দিয়ে একটু নেড়ে নুন দিয়ে দিতে হবে, কারণ এই পেঁয়াজ বাদামি হবে না। ঢেকে রেখে মাঝে মাঝে নাড়লেই হবে.. নরম হয়ে এলে সুমাক মিশিয়ে আর একটু নেড়ে পেঁয়াজ গুলো তুলে রেখে তেল টা আলাদা রাখতে হবে।
 
এরপর চিকেনের জন্যে তেল গরম করে, তাতে তেজপাতা আর বাকি গোটা গরম মশলা দিয়ে চিকেনটা দু পিঠ চার পাঁচ মিনিট ভেজে অনেকটা জল দিয়ে ঢিমে আঁচে রেখে দিতে হবে ঘণ্টাখানেক। তারপর স্টকটা আলাদা করে, শুধু চিকেনটা বেকিং ট্রেতে দিয়ে ওপরে সুমাক, প্যাপরিকা গুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো আর পেঁয়াজ ভাজার তেল খানিকটা বুলিয়ে রোস্ট করে নিতে হবে দু পিঠ লাল করে।
 
একটা থালায় চিকেন স্টু আর অলিভ ঢেলে, টাবুন রুটি কয়েক সেকেন্ড তাতে ডুবিয়ে তুলে নিয়ে, তার ওপরে ভালো করে পিৎজা সস দেবার মতো পেঁয়াজ বিছিয়ে ২০০°C এ ৫ মিনিট বেক করে রাখতে হবে।
শেষ ধাপে, রুটি আর পেঁয়াজের ওপরে মাংস দিয়ে ওপরে আরও একটু সুমাক, ধনে পাতা কুচি আর রোস্ট করা বাদাম ছড়িয়ে দিন। এবার হাত দিয়ে একটু রুটি, পেঁয়াজ আর মাংস ছিঁড়ে স্বাদ নিয়ে দেখুন, সপরিবারে!

ফেসেঞ্জুন আর পারসি জাফরান ভাত

 
পারসি ক্রিসপি জাফরান ভাত রান্না করতে লাগবে
 
২ কাপ বাসমতি চাল
৪ বড় চামচ নুন
৩ টেবিল চামচ সাদা তেল বা অলিভ অয়েল
১/৪ চামচ জাফরান, খল নুড়িতে গুঁড়ো করে উষ্ণ জলে ভেজানো
৩ বড় চামচ টক দই
১ চা চামচ হলুদ
৩ বড় চামচ মাখন
 
বাসমতি চাল ভিজিয়ে জল ছেঁকে রাখতে হবে। ওদিকে ভাতের জন্যে জল গরম করে, নুন আর সাদা তেল দিয়ে ভেজানো চাল ঠিক দাঁতে কাটা যায় এমন সেদ্ধ করে ফ্যান ঝরিয়ে রাখতে হবে।
একটা বাটিতে, দই আর অর্ধেক জাফরান আর হলুদ মিশিয়ে তাতে দু কাপ সেদ্ধ করা ভাত মিশিয়ে পাশে রেখে, একটা নন-স্টিক বা কাস্ট আয়রনের পাত্রে মাখন গরম করে তাতে ওই দই ভাতটা ভালো করে বিছিয়ে দিতে হবে। ওপরে বাকি সাদা ভাত ঢেলে তাতে বাকি জাফরান দিয়ে, খুব ঢিমে আঁচে প্রায় ঘণ্টাখানেক বসিয়ে রাখতে হবে, আর নাড়াচাড়া করা যাবে না। সেদ্ধ হয়ে এলে, একটা থালা ওপরে চাপা দিয়ে উল্টে ঢেলে নিলেই রেডি ক্রিসপি জাফরান ভাত!
Persian Crispy rice
পারসি ক্রিসপি রাইস
ফেসেঞ্জুন’-এর জন্যে লাগবে

২ কাপ আখরোট
১ কেজি চিকেন
৩ কাপ পেঁয়াজ কুচি
৪ টে রসুন কুচি
১ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো
১/২ চামচ করে দারচিনি, জায়ফল আর গোলমরিচ গুঁড়ো
অরেঞ্জ বা লেমন জেস্ট বা লেবুর খোসা গ্রেট করা ২ টেবিল চামচ
১/৪ কাপ বেদানার রস ফোটানো, যাকে ওরা বেদনার গুড় বলে, (চারটে বেদানার রস অল্প আঁচে দু চামচ ব্রাউন সুগার দিয়ে ফুটিয়ে গাঢ় করে নেওয়া)
চিকেন বা সবজি স্টক দুকাপ
নুন স্বাদমতো
২ টেবিল চামচ মাখন আর ২ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল বা সাদা তেল
 
 
আখরোটগুলো তাওয়াতে হালকা গন্ধ বেরনো অব্দি নেড়ে নিয়ে, ঠান্ডা করে মিক্সারে গুঁড়ো করে রাখতে হবে, প্রথম কাজ ওটা। এরপর তেল আর মাখন গরম করে চিকেনটা বেশ বাদামি করে দুপিঠ ভেজে তুলে রাখতে হবে। তারপর ওতেই, পেঁয়াজ বাদামি ভেজে তাতে রসুন দিয়ে রসুনের গন্ধ ছাড়লে, গোটা দারচিনি আর গুঁড়ো মশলা, লেবুর খোসা দিয়ে নাড়তে নাড়তে আখরোট গুঁড়ো মেশাতে হবে। তারপর চিকেন স্টক দিয়ে নেড়ে নিয়ে ফুটতে শুরু করলে বেদানার গাঢ় রস দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে মিনিট পনেরো। সব ফ্লেভার মিশে গেলে স্বাদমতো নুন, আর প্রয়োজনে একটু ব্রাউন সুগার মিশিয়ে চিকেন দিয়ে খুব নরম আঁচে বসিয়ে রাখতে হবে, তা প্রায় ঘণ্টাখানেক তো বটেই! ঘণ্টাখানেক পরে ওই ক্রিসপি ভাতের সাথে এই চিকেন স্টু পরিবেশন করলেই কেল্লাফতে। গার্নিশিং-এর জন্য ওপরে অল্প বেদনার দানা ছড়িয়ে নিন।
 
এই ফেসেঞ্জুন সম্ভবত ইরানের গিলান অঞ্চলের খাবার। এটা ইহুদিদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়। প্রথম দিকে, এটা বানানো হত হাঁসের মাংস দিয়ে, পরে চিকেন দিয়েও রান্না হয়। ইরানের রান্নাঘরে হাঁসের মাংস, আখরোট আর বেদানা খুবই প্রচলিত উপকরণ। সব কিছু দিয়ে তেমনই একটুকরো ইরানি ইফতার রইল টেবিলে।
Maamoul
মামৌল

মামৌল বা খেজুর কুকিজ

 
খেজুর ছাড়া ইফতার বা সেহরি ভাবাই যায় না। তাই শেষপাতে রইল খেজুর দিয়ে অন্যরকম সুস্বাদু কুকিজ
 
উপকরণ
 
সুজি ৫০০ গ্রাম
ময়দা ১.১/২ কাপ
মাখন ১৫০ গ্রাম
সাদা তেল ১/২ কাপ
গুঁড়ো দুধ ১/২ কাপ
চিনি গুঁড়ো ১ কাপ
জায়ফল কিম্বা মহলাব গুঁড়ো ১ চা চামচ
বেকিং পাউডার ১/২ চা চামচ
নুন স্বাদমতো
 
দুধ ১/৪ কাপ
ভ্যানিলা এসেন্স
গোলাপ জল ১/৪ কাপ
চিনি ২ চামচ, জল ১/৪ কাপ আর ইস্ট ১ চা চামচ গুলে রাখতে হবে ১৫ মিনিট, ব্যবহার করার আগে।
 
সুজিতে ঘি বা মাখন আর সাদা তেল মিশিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে রাখতে হবে, যাতে সুজি বেশ ফুলে ওঠে। তারপর তাতে ময়দা, বেকিং পাউডার, গুঁড়ো দুধ, চিনি গুঁড়ো, জায়ফল গুঁড়ো মিশিয়ে আবার আধঘণ্টা মতো ফ্রিজে রাখতে হবে। ওদিকে খেজুর বীজ ছাড়িয়ে মিক্সারে পেস্ট করে তাতে সাদা তেল মিশিয়ে ছোট ছোট গোল গোল ভাগ করে রাখতে হবে। তারপর ওই সুজি-ময়দা মাখা থেকে লেচি কেটে গোল করে, তাতে খেজুরের পুর ভরে আবার পুরোটা ঢেকে দিয়ে নানান রকম ডিজাইন করে রাখতে হবে। শেষে সব রেডি হলে ২০০°C এ বেক হবে, ১৫ মিনিট প্রায়।
ওভেন বন্ধ করে কিন্তু একটু ওয়েটিং টাইম দিতে হবে। তারপর স্বাদ নেওয়া মুচমুচে কুকিজের।
মামৌল নাকি প্রাচীন মিশরে প্রথম বানানো হত, নাম ছিল কাহক। তারপর কীভাবে কীভাবে ঈদ আর ইস্টারের একটা অংশ হয়ে গেছে এই কুকিজ। রোজাশেষের মিষ্টি উপহার মামৌল।
 
আজকের সবকটা খাবারই খাদ্যগুণে ভরপুর। সারা দিনের উপবাসের শেষে শরীরে পুষ্টি আর সন্তুষ্টি যোগান দেয় এমন। সুস্থ শরীরে মনে রোজা শেষে খুশির ঈদ মঙ্গলময় হয়ে উঠুক সবার জন্যে…
 
 
 
 
ছবি সৌজন্য: লেখক
Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *