আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০]

নুনের গ্রাম নিঙ্গেল

মণিপুর মানেই শ্যামলে শ্যামল ভূমি, নীলিমায় নীল। সবুজ তৃণভূমি, উচুঁনীচু পাহাড়-অরণ্য, জলপ্রপাত-ঝরনা আর চা বাগিচার সমারোহ। ইম্ফল নদীর ধারে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী রাজধানী শহর ইম্ফল ছাড়াও পর্যটকদের জন্য মণিপুর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য। 

রাজধানী ইম্ফলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। ভারতের প্রাচীন নগরীগুলির অন্যতম ইম্ফল শহরের মধ্যে যে এত গাছপালা, গভীর জঙ্গল আর বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থাকতে পারে তা মণিপুরের রাজধানীতে না এলে বোঝার উপায় নেই। ইম্ফলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা নিঃসন্দেহে লোকটাক লেক। মিষ্টি জলের হ্রদ। মণিপুরের বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় এই পর্যটনক্ষেত্রে সারা বছরই নব দম্পতিদের ভিড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে হাজির হয় সাধারণ পর্যটকও। সরোবরের আয়তন সর্বোচ্চ ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। বর্ষায় হ্রদের আকার বৃদ্ধি পায়। শীত-গ্রীষ্মে জল কম। মণিপুরের মৈরাং এলাকায় অবস্থিত এই লোকটাক লেকের মধ্যে রয়েছে ‘সেন্দ্রা’ নামের এক ভাসমান দ্বীপ। প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই ভাসমান দ্বীপটিই বোধহয় লোকটাক লেকের প্রধান আকর্ষণ। সেন্দ্রা দ্বীপে রয়েছে বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জাতীয় অভয়ারণ্য ‘কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক’। অভয়ারণ্যে রয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতির মণিপুরী সাংগাই হরিণ।

অন্যান্য অনেক দ্রষ্টব্যর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় মৈরাং-এর আইএনএ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। ইম্ফল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের মৈরাং যেতে সময় লাগে কমবেশি এক ঘণ্টা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মৈরাং-এর একটি বিশেষ ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ বা আইএনএ ভারতভূমিতে প্রথম নিজস্ব পতাকা মৈরাং-এ উত্তোলন করেছিল। সময়: ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৪। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৈরাং-এ গড়ে তোলা হয়েছে আইএনএ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। আইএনএ সেনানীদের  চিঠিপত্র, ছবি, সাংগঠনিক নথি, উর্দির বিভিন্ন ব্যাজ এবং অন্যান্য যুদ্ধ-স্মারকগুলিকে এক ছাদের নীচে নিয়ে এসে তৈরি করা হয়েছে আইএনএ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আইএনএ-র অবদান প্রত্যক্ষ করার জন্য এই মিউজিয়ামটি অবশ্য দ্রষ্টব্য।

Sangai Deer
বিলুপ্ত প্রজাতির মণিপুরী সাংগাই হরিণ

ইম্ফল শহরের মধ্যেই রয়েছে মণিপুর রাজাদের বাসস্থান ও প্রশাসনিক ভবন– কাংলা ফোর্ট। মণিপুরের প্রাক্তন রাজাদের উদ্যোগে নির্মিত গোবিন্দজি বৈষ্ণব মন্দিরও অন্যতম দ্রষ্টব্য। দুটি গম্বুজ ও একটি নাটমন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত মন্দিরের স্থাপত্য। পাশেই রয়েছে কৃষ্ণ ও বলরামের মন্দির। মসজিদও রয়েছে। তবে ইম্ফল শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় গন্তব্য হল– ‘ইমা কেইথেল’, অর্থাৎ মায়েদের বাজার। শুধুমাত্র মহিলারাই বাজারটি পরিচালনা করেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মহিলারা এই বাজারে পণ্য বিক্রি করতে আসেন। প্রায় তিন হাজার মহিলা ব্যবসায়ী এই বাজারের দৈনন্দিন বেচাকেনার কাজে যুক্ত। সারিবদ্ধভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে এখানে কেনা বেচা হয়। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, তৈরি খাবার, হস্তশিল্পের পণ্য, গৃহস্থালির জিনিস থেকে শুরু করে সবই মেলে এখানে। মণিপুরের তাঁত-বস্ত্র এবং অন্যান্য ঐতিহ্যগত হস্তনির্মিত পণ্য বিখ্যাত। মইরাংফি নকশার বিছানার চাদর, সিল্কের শাড়ি, সুতির শাড়ি, সাবেকি ওড়না, কম্বল, শাল, বাঁশের তৈরি পণ্য, কাগজ দ্বারা নির্মিত পণ্য, হাতির দাঁতের জিনিস, পুতুল, গয়না ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে রাখা আছে নানা দোকানে। মহিলা পরিচালিত এই বাজার স্বনামধন্য। বহু বিদেশি পর্যটক শুধু এই বাজারের টানেই এখানে বেড়াতে আসেন। নারীশক্তির এক বিশাল উদাহরণ এই ‘ইমা কেইথেল’ বা মায়েদের বাজার। সরকারিভাবে ১৯৩৯-এ ব্রিটিশ আমলে বাজারের প্রতিষ্ঠা হয়। সেই বাজার এখনও রমরমিয়ে চলছে। যদিও স্থানীয়দের অনেকের মতে সপ্তদশ শতক থেকেই বাজারটি চলছে। 

এত ঘোরাফেরা কেনাকাটার সুবাদে নিঙ্গেল গ্রাম যেন বাদ না পড়ে যায়। কেন? কারণ, নিঙ্গেল গ্রামে এখনও নুন তৈরি করা হয়।

Kangla Fort Imphal
ইম্ফল শহরের কাংলা ফোর্ট

মণিপুরের সঙ্গে সাগরের কোনও সম্পর্ক নেই। ভারতের পূর্ব প্রান্তের সীমান্তে অবস্থিত ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। পাহাড়-অরণ্য-ঝরনা, নদী-নালা থাকলেও এই রাজ্যের ত্রিসীমানায় কোনও সমুদ্রের খোঁজ পাওয়া যাবে না। এমনকি মণিপুরের নদীর জলও মিষ্টি। সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ির জলের মতো লোনা নয়। সেই মণিপুরেই এমন এক গ্রাম আছে যেখানে এখনও নুন তৈরি করা হয়। গ্রামের নাম নিঙ্গেল। জেলা থৌবল। 

রাজধানী শহর ইম্ফল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের নিঙ্গেল গ্রামে পৌঁছতে গাড়িতে সময় লাগে মিনিট পঞ্চাশ। ইম্ফল থেকে বেরিয়ে মোটামুটি সমভূমির উপর দিয়েই রাস্তা গড়িয়ে গেছে। তারপর ‘ঙরিয়ান’ (Ngariyan Hill) পাহাড়। খুব একটা উঁচু নয়। পাহাড়ের ওপারে রয়েছে ইয়াইরিপোক বাজার (Yairipok bazaar)। এই বাজার থেকে নিঙ্গেল গ্রাম মেরেকেটে ৭-৮ কিলোমিটার। উপত্যকার গ্রামে পৌঁছে হর্টন গির্জার পাশের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই বাঁ হাতে পড়বে পানথৈবি (Panthoibi) দেবীর থান। আর ডান পাশে একটা ঢিবি। এবার একটি কাঠের সেতু। সেতুর নীচে বয়ে চলেছে শীর্ণ জলধারা। সেতু পেরিয়ে গেলেই এসে যাবে গন্তব্য, যা স্থানীয় ভাষ্যে  থুমখং (Thumkhong)। মণিপুরী ভাষায় ‘থুং’ মানে লবণ আর ‘খং’ মানে কুয়ো।  

স্থানীয় মানুষজন রোজকার রান্নার কাজে এখানকার নুন নিয়মিত ব্যবহার না করলেও বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের রান্নায় নিঙ্গেলের নুন অবশ্যই ব্যবহৃত হয়। উপবাস-ব্রতে যেমন সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করা হয় ঠিক তেমনই আর কী।

Salt making Manipur
নিঙ্গেল গ্রামের নুন তৈরির পদ্ধতি

রাজধানী শহর ইম্ফল থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত লাইমাটন পর্বতমালার পাদদেশের গ্রাম নিঙ্গেলে পঞ্চাশ-ষাটটি পরিবারের বসবাস। সেখানেই সম্পূর্ণ দেশিয় পদ্ধতিতে এই নুন তৈরি হয়। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এখনও মণিপুরের সুপ্রাচীন এই নুন তৈরির পদ্ধতিকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে।

দেশিয় পদ্ধতিতে তৈরি এই নুন সম্পর্কে রয়েছে বেশ কিছু শুভ বিশ্বাস। বিশেষত মণিপুরে এখনও মেয়েদের গর্ভাবস্থায় ও সন্তান প্রসবের পর শরীর সুস্থ রাখতে এবং পুষ্টির জন্য নিঙ্গেলের নুন খাওয়ানো হয়। এই নুন ধন্বন্তরির মতো কাজ করে বলে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস। 

বিয়ে-থা, পুজো-পার্বণের মতো পবিত্র কাজে এই নুন এখনও সমাজের সব স্তরের মানুষ সমানভাবে ব্যবহার করেন। আগেকার দিনে মণিপুরের রাজা সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ এই লবণ পারিতোষিক দিতেন।   

পুজো বা বিয়ের মরশুমে নুন তৈরির ধুম লেগে যায় নিঙ্গেল গ্রামে। নুন উৎপাদনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তখন তাঁদের ব্যস্ততা ওঠে চরমে। ইম্ফলের ইমা কেইথেল, থঙ্গল মার্কেট, থোবাল বাজারে নুনের চাহিদা বেড়ে যায় দ্বিগুণ।

Ima Keithel
মায়েদের বাজার- ইমা কেইথেল

পাহাড়ও নয়, সমুদ্রও নয়, তা হলে এই নুনের উৎস কী! নিঙ্গেল গ্রামে তিনটে কুয়ো বা ইঁদারা আছে। সেই কুয়োর জল সম্পূর্ণ লবণাক্ত। কুয়োগুলি নাকি চারশো বছরেরও বেশি পুরনো। সবচেয়ে প্রাচীন কুয়োটির দেওয়াল কাঠের তৈরি। অন্য দুটি পরবর্তীকালে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। প্রাচীন কুয়োটি মোটা গাছের গুঁড়ির ভিতরটা ফাঁকা করে তৈরি করা হয়েছে। কালের দাপট প্রতিহত করে কুয়োটি আজও একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ছ’ ফুট ব্যাসার্ধের কুয়োটি প্রায় পঞ্চাশ ফুট গভীর। সারা বছরই কুয়োগুলি জলে ভর্তি থাকে।  

নিঙ্গেল থেকে দেড়-দু’কিলোমিটার দূরে উখোংসং এবং সিখং-এ আরও দু’টি নোনা জলের কুয়ো ছিল। আগে সেখানেও নুন তৈরি হত। কিন্তু এখন সে দুটি শুকিয়ে গেছে। ফলে সেই কুয়ো দু’টিতে এখন উৎপাদন বন্ধ।  

নোনা জলের কুয়ো থেকে জল এনে টিনের বড় পাত্রে কাঠকুটো জ্বালিয়ে জ্বাল দিয়ে দিয়ে ঘন করে তরল অবস্থায় মাটির সরা করে কলাপাতায় ঢেলে দেওয়া হয়। তরল পদার্থ বাষ্পীভূত হওয়ার পর অবশিষ্টাংশ জমে গিয়ে হাতে-গড়া মোটা রুটির মতো সরার আকার নেয়। এক-একটির দাম পড়ে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা। 

নিঙ্গেলকে মণিপুরি ভাষায় বলে— থুং খং। নিঙ্গেল এখন ‘নুনের গ্রাম’ বলে পরিচিতি লাভ করায় মণিপুরের পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। মণিপুর পর্যটনে গেলে সকলেই সময় সুযোগ করে একবার নিঙ্গেল যাওয়ার চেষ্টা করেন।  

প্রাকৃতিকভাবেও নিঙ্গেল জায়গাটি যেন ছবির মতো। পাহাড়ের পাদদেশে সবুজে মোড়া ছোট্ট জনপদ। মেরেকেটে হাজারখানেক লোকের বাস। বাঁধানো রাস্তা। বেশ কিছু ঘরবাড়ি। কয়েকটি দোকানপাট আর সুন্দর একটি মন্দির। মন্দিরে অধিষ্ঠিত প্রাচীন মণিপুরি দেবদেবী— নঙ্গপক, নিংথাও এবং প্যান্থাইবি। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস— এই দেবদেবীরা কুয়োগুলি রক্ষা করছেন।

অনেক আগে নিঙ্গেলের বাসিন্দাদের অধিকাংশই নুন তৈরির কাজ করতেন। কালের নিয়মে তা বদলেছে। নতুন প্রজন্ম এই কাজে আগ্রহী নয়। নুন তৈরির কাজে সব চেয়ে বড় সমস্যা জ্বালানির। প্রচুর জ্বালানি দরকার হয় নোনা জলকে ঘন করতে। পাহাড়-জঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য। আর বর্ষাকালে খুবই দুরূহ। গ্যাস দুর্লভ ও দুর্মূল্য। একমাত্র উন্নত মানের কোনও প্রযুক্তির যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাচীন এই উৎপাদন প্রক্রিয়া আবার উজ্জীবিত হতে পারে।

 

 

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশ পাবে ২৯ মার্চ

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Flickr

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *