“বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ নেহাৎ ছিলেন বােকা,
না হলে কেউ শখ করে হয় বাংলা বইয়ের পােকা?”
— অপূর্ব দত্ত
গত সপ্তাহে ফতুয়ার বুকপকেটে বিশ্বকবি ও বীরসিংহের বীর সন্তানের ছবি নিয়ে ঝরা পলাশে পা ফেলে হেঁটে ফেললাম কয়েক মাইল। ঢাকার রাজপথ থেকে চট্টগ্রামের অলিগলি — মাতৃভাষাকে সঙ্গী করে দীর্ঘ পথ চষে ফেলার পরও হৃদয় জুড়ে প্রাপ্তি কেবল একরাশ শূন্যতা। ভাষাদিবসের মাসে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলনের পীঠস্থানেই আমার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা মেটাতে মুখ থুবড়ে পড়ল “মোদের গর্ব, মোদের আশা”। “আ মরি বাংলা ভাষা” এখন কার্যত ব্রাত্য বাংলা ভাষার রাজধানী শহরের জনমানসে। তাই তো সে ভাষার ভরসায় সামান্য আলুভাজার সন্ধানে বেরিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি যে সকল বাঙালিবাবুদের দোকানে, তারাই প্রাণ পট্যাটো ক্র্যাকার’ শোনামাত্রই হাসিমুখে এগিয়ে দিয়েছে রঙিন, মুচমুচে সবুজ প্যাকেট। ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘরেই যদি আমার মাতৃভাষার অবস্থা এরকম সঙ্গীন হয়, তাহলে বিশ্ব মানচিত্রে তার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা বাতুলতাই বটে। আসলে দুই বাংলায় ছড়িয়ে থাকা অজস্র বাঙালিকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগেই যুক্তির পরাকাষ্ঠায় প্রকট হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার নির্মম সীমাবদ্ধতা। প্রযুক্তির এক্সলেরেটরে ভর করে গোটা বিশ্ব এখন একটা গ্রাম। আর এই গ্লোবাল ভিলেজে ব্যবসার ভাষা ইংরেজি, বাণিজ্যের ভাষা ইংরেজি। কাঁটাতারের বেড়াজাল মুছে অধুনা সৃষ্ট এই নতুন গ্রামে ডারউইনের বিবর্তনবাদ মেনে টিকে থাকার যুদ্ধে আবেগ অপেক্ষা অধিক শাণিত অস্ত্র হিসেবে উঠে এসেছে বাস্তববাদ আর বাস্তববাদের ভাষা হিসেবে বাংলা নিজেকে উন্নীত করতে পারেনি আজও। তাই তো গ্লোবালাইজড ভিলেজের শিল্পপতি থেকে শুরু করে পাড়ার মুদি দোকানদার — সবার তুরুপের তাস ‘প্রাণ পটেটো ক্র্যাকার’ কিংবা ‘প্রাণ লিচি ড্রিংকস’। আলুভাজা নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় কোথায় বিশ্বায়িত বাঙালির! হলদিরামের রংবাহারি কৌটোতে বাঙালির রসগোল্লা আজকাল বিক্রি হয় ‘রসগুল্লা’ নামে। মাল্টিপ্লেক্সের অন্ধকারে আমরা ভুট্টার খই নয়, পপকর্ন খাই। বিশ্বায়নের দুনিয়ায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে যে…

সুইডেনের নোবেল নিয়ে বাঙালির বড্ড অহংকার! একশো দশ বছর পেরিয়ে আসার পরও তৃপ্তির চোয়া ঢেঁকুরের ঝাঁজ কমেনি এতটুকু। যদিও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদাসীনতার ঘূর্ণিপাকে নিজেকে নিমজ্জিত রাখা আত্মতুষ্টির মগডালে বিচরণকারী এই জাতি অহরহ ভুলে যায় রামায়ণ কিংবা মহাভারতের কথা। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য প্রসবকারী সংস্কৃত ভাষাকে আজ অবলুপ্ত বলা চলে নির্দ্বিধায়। ১৫০ কোটি অধিবাসী সম্বলিত যে ভারত এক সময়ের শ্রেষ্ঠ ভাষাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কুণ্ঠাহীনভাবে, বাংলা ভাষার অবলুপ্তিকালেও যে তারা হাস্যমুখে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে নির্লিপ্ত থাকবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। ফলস্বরূপ, দেবনাগরী হরফের হাত ধরে নিজের অন্তিম যাত্রায় সামিল হওয়া বাংলা ভাষার জন্য স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ইংরেজি ভাষায় হ্যারি পটার লিখে কয়েক মিলিয়ন উপার্জনকারী জে কে রাউলিংয়ের পাশে বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর উক্তি — ” দুমুঠো ভাত ডালের ব্যবস্থা না করে কেউ যেন বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে না আসে…” বিচ্ছিরি রকমের আর্থিক অসমৃদ্ধির পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার অভাব। ভাগ্যিস, “মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ” স্লোগান তুলে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের কাজে কবিগুরু রণে ভঙ্গ দেননি। নাহলে, “Song offerings”-এর হাত ধরে নোবেলপ্রাপ্তির আফিম নিয়ে নেশা করার সৌভাগ্যটুকু বাঙালির অধরাই থেকে যেত।
আরও পড়ুন: বাংলা ভাষা এবং ভাষা প্রযুক্তি
সত্যজিতের অস্কার নিয়ে আত্মতৃপ্তির ফানুস ওড়ানো বাঙালির সিনেমা আজ টিকে আছে শিবরাত্রির সলতে হয়ে। বাঙালি “দিলখুশ”কে টপ করে গিলে ফেলে হিন্দিভাষী “পাঠান”। পশ্চিমবঙ্গের মাল্টিপ্লেক্সে পাশাপাশি থিয়েটারে দর্শকশূন্য বাংলা ছবির পাশে পাঠানের পরপর হাউজফুল বোর্ড! ” রাবণ”,” কিশমিশ”কে ” বাপি বাড়ি যা ” করে বাংলার বুকে বক্সঅফিস দাপিয়ে বেড়ায় “আর আর আর” থেকে “বাহুবলী”। কম্প্রোমাইজপ্রেমী বাঙালির সংস্কৃতিতে থাবা বসাতে শুরু করে দক্ষিণী আগ্রাসন। দুয়েকটা ” প্রজাপতি ” মাঝেসাঝে রঙিন ডালা মেললেও বাংলা ছবির বক্সঅফিস থেকে ইতিমধ্যেই লক্ষ্মীর অন্তর্ধান ঘটেছে কাবেরীর মতো করেই। সৌজন্যে, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বাংলার নির্লজ্জ,অসহায় আত্মসমর্পন। যেখানে পেশার সাথেসাথে নেশার নিয়ন্ত্রণও চলে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠের রুচির হাতে। দিনশেষে পড়ে থাকে জন্মদিনে সত্যজিৎ রায়ের মূর্তির গলায় ঝোলানো বাসি রজনীগন্ধ্যার মালা আর ধুঁকতে থাকা বাংলা সিনেমার পাশে তামিল কিংবা হিন্দি ছবির ঢাউস হাউজফুল বোর্ড। বাংলাবিমুখ বাঙালি দর্শকের ভিড়ে মাতৃভাষায় ছবি বানিয়ে কে-ই বা দেউলিয়া হতে চায়!

নিট কিংবা সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্ট তো বটেই,এমনকি বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক স্তরের সর্বোচ্চ পরীক্ষা ডব্লুবিসিএসের মেইনসের প্রশ্নপত্রের ভাষাও কিন্তু আর বাংলা নয়। সেখানেও কাজের ভাষা ইংরেজির রাজত্ব। ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে বইগুলি বাংলা ভাষায় উপলব্ধ, তা পড়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নিছক দিবাস্বপ্নই বটে। বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর স্তরের বিজ্ঞানশাখার প্রশ্নের ভাষাও যেখানে ইংরেজি, সেখানে শিশুকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পাঠানো বিলাসিতা বই আর কিছুই নয়। মঞ্চে উঠে গলা কাঁপিয়ে বাংলা ভাষার আবেগে গলে চোখে নোনাজল এলেও মাতৃভাষার সাথে প্রথম পরিচয় করানো নিজের জন্মদাত্রী মাকে দুধে, ভাতে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন অর্থের। আর এই বিশ্বে অর্থের ভাষা ইংরেজি, কাজের ভাষা ইংরেজি। উদাত্ত কণ্ঠে মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সাথে তুলনা করলেই তো আর মায়ের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া যায় না। তার জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থানের আর গ্লোবাল ভিলেজে কর্মসংস্থানের ভাষা কিন্তু ইংরেজি। কলসেন্টারের একটা স্বল্প সাম্মানিকের চাকরির জন্যও বহুক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় যে ভাষা — তার ওপর বুক ঠুকে বাজি ধরা দায়। বরং কথার মাঝে একটু হিন্দি কিংবা ইংরেজি মিশিয়ে টান দিতে পারলে হয়তো স্মার্টনেসের পারদ চড়ে অনেকটাই। তাই তো হাসতে হাসতে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে ” কিউ কি ” কিংবা “মাতলব”-এর মতো শব্দবন্ধ। ইংরেজির পাশাপাশি কর্পোরেট দুনিয়ার নতুন ভাষা এখন “বাংরেজি”। শুধু বাংলায় আজকাল আর পকেট ভরে না যে…বাংলার তারকা ক্রিকেটার কিংবা অভিনেতার মুখ দেখিয়ে বাঙালি শিল্পপতির কোম্পানির প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনের ভাষাও তাই এখন হিন্দি কিংবা ইংরেজি কারণ, বাণিজ্যে শুষ্ক আবেগের ঠাঁই আদতে নির্বুদ্ধিতার নামান্তর….

বাংলা ভাষা এখন অনেকটা ওই পরকীয়ার মত। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে উষ্ণ চুমুর ক্ষণিকের কৃত্রিম সুখানুভূতিতেই তার সীমাবদ্ধতা।রোজনামচার উত্থানপতনের সঙ্গী হয়ে সুখ-দুঃখের চাকা ঘোরানোর সাধ থাকলেও সাধ্য তার নেই। তাই তো সদ্যসমাপ্ত বইমেলায় কয়েক কোটি ব্যবসার গল্পে উদ্বাহু হয়ে নৃত্যরত বাঙালির একটা বড়ো অংশের কাছেই আজও অচেনা প্রুফরিডারের চশমার মোটা কাঁচের নিচে জমে থাকা অশ্রুমিশ্রিত অন্ধকার। বাঁধাইশিল্পীর ঘরের ছাদ চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের খবর রাখে না কেউ। প্রচ্ছদশিল্পীর মায়ের ওষুধের টাকা ফুরিয়ে যায় তুলি কেনার অছিলায়। বঙ্গদেশে বইশিল্পের সাথে জড়িত মানুষগুলোর আর্থিক হাল সোমালিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা আমলাশোলের দুর্ভিক্ষপীড়িতদেরও হার মানায় অবলীলায়। বইবিক্রির খতিয়ান নয় অঙ্কের ঘরে পৌঁছলেও বাংলা ভাষার দক্ষ প্রুফরিডারদের কপালে বরাদ্দ যে নামমাত্র সম্মাননা, তাতে জল ফুটানোর খরচ জোগাড় হলেও চা পাতা জোটে না নিয়মিত। ওই টাকা পকেটে নিয়ে — ” যায় যদি যাক প্রাণ, বাংলা ভাষা ভগবান ” বলা বোধ হয় পেটে বাংলা না পড়লে সম্ভব নয় কিছুতেই। আসলে,যে রাজ্যে সবথেকে সস্তার মদের নাম বাংলা; সেখানে বাংলা ভাষার এ হেন করুণ হাল একরকম অবশ্যম্ভাবীই ছিল। বাংলার চলচ্চিত্র জগতের বর্তমানের দুই মেগাস্টারের শৈশবের ভাষাও কিন্তু বাংলা নয়; যথাক্রমে সিন্ধ্রি এবং হিন্দি, বাংলাটা ওনাদের বেশ ভুলে ভরা। বাঙালিয়ানার উদযাপনে বাঙালির অনীহার এর থেকে বড়ো নিদর্শন বোধ হয় গোটা রাজ্যে বিরল।
ধোপদুরস্ত মোটা পাড়ের সাদা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি চোখের জন্য বেশ আরামদায়ক হলেও স্বচ্ছন্দ চলাফেরার পথে তা পাহাড়প্রমাণ অন্তরায়। কর্মজীবনের সাফল্যের দৌড়ে পোশাকজনিত প্রতিবন্ধকতা বাঙালি চায় না বলেই আজ ধুতি-পাঞ্জাবির স্থলাভিষিক্ত প্যান্ট-শার্ট। ঠিক এভাবেই কান ও জিভের মিষ্টতাকে হার মানিয়ে যখন বড়ো হয়ে ওঠে পেটের তাগিদ, আশ্বাসের হাতটা কাঁধে রাখতে ব্যর্থ হয় আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। খুঁজতে হয় নতুন আশ্রয়।তাই তো অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী দুই বাঙালির গবেষণার ত্রিসীমায় ঠাঁই মেলে না মাতৃভাষার। বাঙালি ফুটবলারদেরও আজ অত্যাধুনিক বিদেশি কোচিং পদ্ধতির সাথে খাপ খাওয়াতে পেশাদারি ভঙ্গিমায় কথ্য ইংরেজির কোর্স করানো হয় নিয়মিতভাবে। দিনের শেষে বাংলা ভাষার শুকনো ভাতে লবণ জোটানোর সামর্থ্য নেই যে…

তবুও বৈশাখের পঁচিশ, ফেব্রুয়ারির একুশ আর বিজয়া দশমীর রোমান্টিসিজমের দুনিয়া জুড়ে সদর্পে রাজ করে দৃপ্ত স্লোগানের ভাষা, উল্লাসের ভাষা — বাংলা। অন্য কোনো ভাষা সেখানে বড্ড বেমানান। কিন্তু ভাষাদিবসের ঠিক পরদিন সকালে, বাইশে ফেব্রুয়ারির কর্পোরেট সেক্টর, নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, নিউজরুমের বিবিসি কিংবা পিটিআইয়ের সূত্র, ডব্লুবিসিএসের মেইন্সের পেপার থেকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রিন্সিপাল — সবার কাছেই আবারও ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে দাঁড়ায় আমাদের আবেগের মাতৃভাষা। জীবনের ইঁদুরদৌড়ে টিকে থাকতে বাংলা ছেড়ে তাই রপ্ত করতেই হবে প্রয়োজনীয়তা তথা বিশ্বায়নের ভাষাকে। পেটে ভাত না থাকলে ভাষার মত অবলুপ্ত হতে বসবে জাতিও। ফেব্রুয়ারির একুশে পাঞ্জাবি পরে ” আমি বাংলায় গান গাই”-কে অমরভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে দৈনন্দিন পেশাগত দুনিয়ায় বাংলাকে অবহেলা করা ছাড়া উপায় কি আর…
ছবি সৌজন্য: Pexels, Wikimedia Commons, Flickr
লেখক চিরঞ্জিৎ সাহা বয়সে তরুণ। উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ ও প্রশাসনিক চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিরত। উনিশ কুড়ি লাভ-স্ট্রাক ২০১৯ বিজেতা। প্রথম প্রকাশিতব্য বই 'X = প্রেম'