পরশুদিনের ঘটনা। তিতিরের মনটা খারাপ ছিল। এমনিতেই গত এক বছর ধরে করোনার জন্য স্কুল বন্ধ। বাড়িতেই অনলাইন ক্লাস, তার উপর কথায় কথায় বাবার দাবড়ানো। জিওমেট্রিতে সবে রম্বাস অর্থাৎ অসমকোণ সমবাহু চতুর্ভুজ ক্ষেত্রটা একটু বুঝতে দেরি হয়েছে, অমনই, বাবার হুঙ্কার— মাথায় খালি গোবর ভরা আছে! যা, তোর দ্বারা অংক হবে না।

তাই সব ছেড়ে সে বাগানে চলে এসেছিল। ‘তিতিরের ঠাম্মি বলে— ‘মন কেমন করলে বাগানে চলে যাবে। সেখানে যত সবুজ দেখবে, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাবে, তত দেখবে মন আবার ভালো হয়ে যাচ্ছে’। বাগানে গিয়েই লোকটাকে প্রথম দেখতে পায়। লোকটা একটা নোংরা গাঢ় নীল রঙের জোব্বা মতন কী একটা পরে ছিল। একটা চোখ বন্ধ মতন— সম্ভবত এক চোখে অন্ধ। মুখ মাস্কে ঢাকা থাকলেও দাড়ি আছে বোঝা যাচ্ছিল। চুলও অবিন্যস্ত। মনে হল হাতে ছোট একটা কুঠার মতন কী একটা ছিল। লুকিয়ে পেয়ারা পাড়ছিল বোধহয়। অমনি তিতির চেঁচিয়ে উঠেছে— কে, কে ওখানে?

— ‘কে, তিতির নাকি?’ লোকটা জিজ্ঞেস করল।
— কে আপনি? আমাকে চেনেন?
— চিনি বইকি। এ পাড়ার সব বাচ্চাদের আমি চিনি।
— আপনাকে আগে তো কখনও দেখিনি। কী নাম আপনার? ওখানে কী করছিলেন? তিতির অকপট।
— সে তুমি আমাকে চিনবে না। আমার নাম দীনহরি। পয়সাকড়ি আমার বিশেষ নেই, তাই লোকে আমাকে মজা করে ‘হরি ও দীন’ বলে ডাকে। তুমি আমাকে হরি দাদু বলে ডাকতে পারো।

হরি দাদু? তিতির মনে মনে ভাবল কী সব পুরনো আমলের নাম রে বাবা!

‘হরি পুরনো আমলের নাম হবে কেন?’ লোকটা যেন তিতিরের মনের কথা জেনে যায়। ‘তুমি হ্যারির কথা বইতে পড়েছ না! বিলেতে হ্যারি, এখানে হরি। আমিও কিন্তু ম্যাজিক জানি। জাদু দেখিয়েই আমি পেট চালাই।’— লোকটা চোখ পাকিয়ে বলল। সম্ভবত হাসলও, মাস্কের জন্য ঠিক ঠাহর করতে পারল না তিতির।

Kuhoki story banner 1

হ্যারি আর হরি এক হল? তিতিরের আশ্চর্য লাগে। —আর কোন হ্যারির কথা বলছেন? পর্টার?
— সেও হতে পারে, তবে আমার পছন্দ হুডিনি। হ্যারি হুডিনি, মস্ত ম্যাজিসিয়ান। ওটা আমার নামের সঙ্গেও বেশ মিলে যায়, তাই না! হ্যারি হুডিনি আর হরি ও দীন, বুঝতে পারলে? লোকটা অনর্গল বলতে থাকে –হুডিনিও ম্যাজিশিয়ান, আমিও তাই। এই যেমন এখন আমি ম্যাজিক করে তোমার মনের খবর জেনে নিলাম। তোমার তো মন খারাপ, তাই না?

এ আর এমন কী! তিতির মনে মনে ভাবল। নিশ্চয়ই বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছে বাবার বকুনি। উফ্‌, বাবাও না! অত জোরে বকার কী আছে? পাড়াশুদ্ধ সবাই জেনে যায়…

— ‘উহুঁ, আমি কিন্তু কিছুই শুনতে পাইনি।’ লোকটা আবার যেন তিতিরের মনের কথা জেনে ফেলে। —আমি শুধু তোমার মাইন্ড-রিডিং করছিলাম।
— তুমি আর কী কী ম্যাজিক জানো? তিতির কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে।
— এই তো, দেখো, ম্যাজিক করে কেমন এক নিমেষে তোমার বন্ধু হয়ে গেলাম। ‘আপনি’র থেকে ‘তুমি’টাই অনেক আন্তরিক, তাই না?

তিতির জিভ কাটে। খেয়াল করেনি। হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমি বলে ফেলেছে। সে যাক্‌গে। সে অপ্রতিভ থেকে বলে— ঐ রকম না, আসল ম্যাজিক… যেমন হাত সাফাই কিছু জানো?

এবার হরি তার জোব্বা থেকে কয়েকটা তাস বার করে। তারপর তাসগুলোকে উলটো করে দু হাতে মেলে ধরে যাতে বোঝা না যায় কোনটা কী তাস। তারপর বলে— যেকোনও একটা তাস বেছে নাও।  আমাকে দেখিয়ো না।

তিতির তাই করে।

— এবার আমি না দেখে বলে দেব, তুমি কোন তাস বেছেছো।

লোকটার কোঁচকানো চোখ দেখে তিতিরের মনে হয়, সে নিশ্চয়ই মাস্কের আড়ালে হাসছে। তার পরেই অপেক্ষা না করে বলে— তুমি নিশ্চয়ই রুইতনের বাদশা বেছেছো?
—  দাঁড়াও, দাঁড়াও… তিতির থামিয়ে দেয়। ঐসব রুইতন না কি বললে, ঐ সব আমি বুঝি না। ইংরাজিতে বল। যেমন ডায়মন্ড, স্পেড, ক্লাবস্‌, হার্ট…

এবার লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে। —তা বললে তো চলবে না। এর পেছনে যে অনেক গল্প আছে। রুইতন কথাটা আসলে এসেছে Ruiten অথবা রম্বাস থেকে।
—  আবার রম্বাস! তিতির বিরক্ত। সবে বাবার আর অংকের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে পালিয়ে এসেছি।
—  ‘আরে দিদিভাই, এটা কিন্তু ভীষণ ইন্টারেস্টিং গল্প।’ হরিবাবু নাছোড়বান্দা —’অঙ্কের ভেতরেও গল্প লুকিয়ে আছে। শোনো তাহলে… এই শব্দগুলো আসলে ওলন্দাজি, অর্থাৎ ডাচ। যখন ওলন্দাজরা এই বাংলার চুঁচুড়া, চন্দননগর ইত্যাদি জায়গায় উপনিবেশ করেছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভাষার আদানপ্রদান হয়। রুইতন এসেছে Ruiten অথবা রম্বাস থেকে। দেখ দেখ, ভালো করে শেপটা দেখ। ঠিক ডায়মন্ডের মতন। রম্বাস আর কোনওদিন ভুলবে না। ঠিক এইভাবে বাংলায় বাকি তাসের নামগুলো হল— ইস্কাপন, যা এসেছে Schoppen থেকে, যার অর্থ কোপানো বা এক্ষেত্রে কোদাল। তারপর হরতন, যা এসেছে Harten থেকে, মানে তোমার চেনা হার্ট ইত্যাদি ইত্যাদি… কথা বলতে বলতে একটা ভাঙা কঞ্চি দিয়ে বাগানের মাটিতে ইংরাজিতে বানান করে Ruiten, Harten ইত্যাদি লিখতে থাকে। আবার শেপগুলোও এঁকে দেখায় বোঝার সুবিধের জন্য।

— বাহ্‌ দারুণ তো! বাবা না একদম পড়াতে পারে না! তুমি কী সুন্দর গল্প করে বোঝালে। এবার রম্বাসের কথা হলেই এই তাসের গল্প মনে পড়বে।

Kuhoki story banner 2

তিতিরের হরিদাদুকে বেশ ভালো লাগে।

— তা, বেশ। এবার বল, আমি ঠিক বললাম কি না? তোমার হাতে এখন রুইতনের বাদশা বা কিং অফ্‌ ডায়মন্ড্‌স আছে… কী তাই তো?
— ওমা, তাই তো! তিতির বেশ অবাক হয়ে যায়। তার বেশ মজা লাগে। তার মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে শুরু করেছে। লোকটা একটু থেমে বলে— এতে কিন্তু বিশেষ বাহাদুরি নেই। 

এবার হরি তার হাতের বাকি সব তাসগুলোকে সোজা করে মেলে ধরে। তিতির দেখে সব তাসগুলোই রুইতনের বাদশা। অর্থাৎ যে কোনও তাস বাছলেই, উত্তরটা একই থাকবে। অস্ফুটে তিতিরের অভিব্যক্তি বেরিয়ে আসে— ওহ্‌ এই ব্যাপার!

— না হে দিদিভাই, ব্যাপারটা কিন্তু অতটাও তুচ্ছ করার বিষয় নয়। ভালো করে তাসগুলো দেখ তো! কিছু বিচিত্র দেখতে পারছ?

তিতির উল্টোপাল্টে দেখল— কই না তো!
— তাহলে তুমি তাস নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করোনি।
— হ্যাঁ, বাবা বলে ‘তাস, দাবা, পাশা/ তিন সর্বনাশা’।
— কিন্তু তার মধ্যেই যে কত জ্ঞান লুকিয়ে আছে। শুধু স্কুলের বই পড়লে তো তা জানা হবে না দিদিভাই। শোনো তাহলে। তুমি যদি যেকোনও সাধারণ তাসের প্যাকেট দেখ, তাহলে দেখবে যে রুইতনের বাদশা, বা তোমার কিং অফ্‌ ডায়মন্ডস্‌ দুটো কারণে আলাদা। এক- এই তাসে একটা কুঠার আঁকা আছে। আর বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী কারণ, এটাই একমাত্র বাদশা যে একদিকে ফিরে আছে। অর্থাৎ তার মাত্র একটাই চোখ দেখা যাচ্ছে। বাকি সব রাজা বাদশার দুটো চোখই দেখা যাচ্ছে। এর পেছনেও একটা গল্প আছে কিন্তু।
— কী গল্প?
— বলছি… বলছি… তুমি তো সুপারহিরো মুভি খুব ভালবাসো, তাই না? তা ‘থর’কে তুমি নিশ্চয়ই চেনো!
— হ্যাঁ, হ্যাঁ… তিতিরের মুখটা আলোকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু বাবা ওইসব সিনেমা দেখা পছন্দ করে না। বলে, যত সব আজগুবি।
— তাই বুঝি! আমার গল্পটা কিন্তু থরকে নিয়ে নয়। বরং তার বাবা ওডিনকে নিয়ে, যে অ্যাসগ্রাড বলে সেই কাল্পনিক রাজ্যের রাজা ছিল। সেই রাজা ওডিন ম্যাজিক শেখার জন্য এবং সৃষ্টিসংক্রান্ত সব গূঢ় জ্ঞানলাভের জন্য নিজের একটা চোখ বলিদান করেছিল। রুইতনের বাদশা সেই রাজা ওডিনের রূপ। তাই তার একটা চোখই মাত্র দেখা যায়। অন্য চোখটা তো তার কানা, এই অনেকটা ঠিক আমার মতন। আমি ‘ও-দীন’ আর রাজা ওডিন। হাঃ হাঃ হাঃ… লোকটা এবার সশব্দে হেসে ওঠে । 

আরিব্বাস্‌! তিতির বেশ উত্তেজিত। তারপর একটু খুঁটিয়ে দেখে বলল— কিন্তু হরি দাদু, এখানে সব বাদশারই তো দুটো চোখই দেখা যাচ্ছে!
— ব্রিলিয়ান্ট। তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।

তিতির বেশ খুশি হয়। বাবা শুধু শুধুই বলে তার মাথায় নাকি গোবর ভরা আছে। 

এদিকে হরিদাদু বলে চলেন— আমি বলেছি যেকোনও সাধারণ তাসের প্যাকেট দেখলে তুমি দেখবে রুইতনের বাদশার একটা চোখ। কিন্তু এটা তো সাধারণ প্যাকেট নয়। এগুলো ম্যাজিক কার্ড। তাই এখানে দুটো করেই চোখ আছে। আর সেগুলো হল জ্ঞানচক্ষু। এবার মন দিয়ে শোনো। এই এক একটা তাসের দিকে চেয়ে তোমাকে একটা মন্ত্র বলতে হবে। তারপরে একমনে প্রার্থনা করলে তোমার যে সব পড়ার সাবজেক্ট বা চ্যাপ্টার কঠিন লাগে, বা পারো না, সেগুলো দেখবে একেবারে জলবৎ তরলং হয়ে গেছে।

— সত্যি! তিতিরের যেন বিশ্বাসই হতে চায় না।
— সত্যি। কিন্তু একটা ব্যাপার। এই প্যাকেটে মাত্র তেরোটা তাস আছে। তাই তোমার তেরোটা মাত্র চ্যাপ্টারের জন্য এই জাদু কাজ করবে। আর একটা শর্ত। যেই এক একটা তাসের কাজ শেষ হয়ে যাবে, অমনি সেটাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এর অন্যথা হলে কিন্তু তোমার সব প্রাপ্ত জ্ঞান আবার হারিয়ে যাবে।
— না, না, আমি সব শর্ত মানব। তুমি আমাকে মন্ত্রটা শিখিয়ে দাও প্লিজ… তিতিরের উচ্ছাস আর ধরে না।
— বেশ। শোনো তবে। তাসের দিকে চেয়ে তোমাকে বলতে হবে, “ওডিনের বরে খুলে গেল জ্ঞানের গুপ্ত দরজা/ শক্ত কঠিন বিষয় হল জলের মতন সোজা”
…ব্যাস্‌ তাহলেই ম্যাজিক শুরু।
— ওয়াও! তিতিরের বাঁধ ভাঙা বিস্ময়।

হরিদাদু যেই তাসগুলো তিতিরকে দিয়েছে, অমনি পেছন থেকে বাবার আওয়াজ এল, —কী রে! যেই আমি ফোনটা নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, অমনি কেটে পড়েছিস! তোর যে কী হবে! এখুনি আয় বলছি। 

তিতির কোনওরকমে পকেটে তাসগুলো ঢুকিয়ে ঘরের দিকে ফিরে সাড়া দিল— এই তো, এখুনি আসছি, বাবা…

তারপর ঘুরে হরিদাদুকে টা টা বলতে যাবে আর দেখে সে আর নেই। অদ্ভুতভাবে যেন হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেছে। যাঃ বাবা, কোথায় গেল! না, কোথাও তো নেই! তিতির কি দিনে স্বপ্ন দেখছিল না কি! নাঃ নিজেকে চিমটি কেটে বেজায় লাগল, ‘উঃ’ বলে কঁকিয়ে উঠল। তারপর চোখে পড়ল হাতে তখনও ধরা সেই ম্যাজিক তাস। দুরু দুরু বক্ষে তিতির একটা তাস নিয়ে সেই মন্ত্র উচ্চারণ করল আর মনে মনে প্রার্থনা করল যেন জিওমেট্রির চ্যাপ্টারের সব অংকগুলোই তার হয়ে যায়।

ঘরে ঢুকতেই বাবা বলল— আজ যতক্ষণ না তোর রম্বাস হচ্ছে ততক্ষণ তোর সব গল্পের অমনিবাস বন্ধ। তিতিরের ওই একটাই শখ। সে খুব গল্পের বই পড়তে ভালবাসে। আর পড়ার সিলেবাসের চক্করে প্রত্যেকবার বাবা ওই অমনিবাসকেই টার্গেট করে। এবার কিন্তু তিতির একটুও না ঘাবড়ে বলল, ‘শুধু রম্বাস কেন, রেক্ট্যাঙ্গল, রাইট ট্রায়ঙ্গল এমনকি থ্রি ডাইমেনশনাল রাইট প্রিজ্‌ম, রম্বিক ডোডেকাহেড্রন, রম্বিক ইকোসাহেড্রন— যা ইচ্ছে জিজ্ঞেস কর, সব রেডি। 

তিতির নিজেই চমকে গেল, এটা কী বেরোল তার মুখ দিয়ে? এসব কী, সে কী করে বলবে? বাবাও শুনে প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল। তার পরেই সামলে নিয়ে বলল— ওরে অলম্বুস, বোস এখানে, আপাতত আগে রম্বাসটা রপ্ত কর, নইলে আজ তোর একদিন কি আমার…

Kuhoki story banner 3

শুরু হল পরীক্ষা। অদ্ভুতভাবে, বাবা যাই জিজ্ঞেস করে, তিতিরের হাজির-জবাব বেরোয় মুখ থেকে। শেষে রম্বাসের প্রপার্টি জিজ্ঞেস করায়, তিতির শুধু তার ক্লাসের উপযুক্ত আটখানা প্রপার্টি ছাড়াও যখন কার্টেসিয়েন ইকুয়েশন লিখে স্পেশাল সুপার এলিপ্সের সঙ্গে মিল দেখিয়ে দিল, তখন বাবা জোর বিষম খেল আর জল, জল বলে চেঁচিয়ে উঠল। জল খাওয়ার পর ফল অবশ্য খুব একটা আলাদা হল না। তিতিরের কান ধরে হাল্কা ঝাঁকিয়ে বাবা বলল— ডেঁপোমি হচ্ছে! আর পাকামো না করে, নিজের পড়ায় মন দে। —বলে বাবা উঠে গেল।

তিতির কিন্তু বিশেষ মজা পেল। একইসাথে ভীষণ আশ্চর্যও হল। এ তো দারুণ ব্যাপার। এবার কে আটকায় তাকে! কিন্তু তখনই মনে পড়ল তার কাছে মাত্র তেরোটা তাস। তার মধ্যে একটা শেষ হয়ে গেল। উফ্‌ বড্ড কম দিয়ে ফেলেছে হরিদাদু! অন্তত এমনি তাসের প্যাকেটে যেমন বাহান্নটা তাস থাকে, তেমন দিলে তিতিরের এই স্টুডেন্ট লাইফটা কেটে যেত। তাছাড়া আরও কত কী শেখার আছে। বিল্টু দাদা কী সুন্দর ব্যাডমিন্টন খেলে, সবাই তাকে কত প্রশংসা করে। কিন্তু তিতির সেরকম পারে না। একটা তাস দিয়ে সেটা শিখে নিত। তারপর ইদানীং ভারতনাট্যমটা করতে গিয়েও খালি ভুল হয়ে যাচ্ছে আর বাবা প্রত্যেকবার খোঁচা দিচ্ছে— ও কিছু না, আমাদের উঠোনটা একটু ব্যাঁকা আছে। নেহাত মা রাগারাগি না করলে, বাবা হয়ত আরও কত কী বলত! মা’ই তাকে বাঁচায় সব সময়। তিতির এবার দেখিয়ে দেবে সবাইকে। কিন্তু সবার আগে একটা তাস পুড়িয়ে ফেলতে হবে, ঠিক যেমন হরিদাদু বলেছিল। 

সেই পরশু থেকে আজ অবধি তিতির এরকম আরও অনেক ভেল্কি দেখিয়েছে। ঠাম্মিকে দাবাতে শুধু হারিয়েছে তাই নয়, যে ঠাম্মি তাকে দাবা শিখিয়েছে, তাকেই নতুন করে বুঝিয়েছে সিসিলিয়ান ডিফেন্স কাকে বলে, ক্যাটালন ওপেনিং… ইত্যাদি আরও কত কিছু। সিলেবাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইয়া বড় ‘নদী’ কবিতাটার একটা ছোট অংশ ছিল। কিন্তু তিতির পুরো কবিতাটাই একবার পড়ে মুখস্ত করে ফেলেছে। অংক তো একেবারে জলভাত হয়ে গেছে, কথায় কথায় বাঁদরকে তৈলাক্ত বাঁশে নামাচ্ছে, ওঠাচ্ছে। এমনকি নিজেই অংক বানিয়ে বিল্টু দাদাকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। মাকে নতুন একটা রেসিপি বাতলে দিয়ে তাক্‌ লাগিয়ে দিয়েছে। মা এই নতুন রান্নাটা তার অফিসের গেট টুগেদারে নিয়ে যাবে স্থির করেছে। সব মিলিয়ে দারুণ কাটছিল। সমস্যা একটাই। এই উত্তেজনায়, চমক দেখানোর খেলায়, তিতিরের দশটা তাস শেষ হয়ে গেছে। বেঁচে আছে মাত্র আর তিনটে। এদিকে সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তাতে ইতিহাস আর বাংলাটা কিছুতেই আয়ত্তে আসছে না। ইতিহাসে তিতিরের চিরকাল হাঁসফাঁস অবস্থা আর বাংলা রচনাটাও ঠিক জমে না তার। তারপর তার গত দু-দিনের অভূতপূর্ব প্রতিভার বিচ্ছুরণে বাবা অবাক হয়ে তাকে পাড়ার বাগ্মিতা প্রতিযোগিতা বা এলোকিউশন কনটেস্টে নাম লিখিয়ে দিয়েছে। এই প্রথম বাবা তার প্রতি এতটা আস্থা দেখিয়েছে। সে কিছুতেই বাবাকে মাথা নোয়াতে দেবে না। তাছাড়া তো আরও কত কী করার ছিল! নাঃ তেরোটা বড্ড কম। মনটা তাই আবার ভালো নেই সকাল থেকে। কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছে না কী কী কাজে বাকি তিনটে তাস লাগাবে। 

এরপর কেটে গেল আরও দু-সপ্তাহ। অবশেষে যা হওয়ার ছিল তাই হল। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মানসিকতাতে যা হয়— সেই ধারণা ভিত্তি করে তিতির পরীক্ষাকেই প্রাধান্য দিল। দুটো তাস সেখানে লাগল। পরীক্ষা ভালোই হল। পরে অবশ্য মনে হয়েছিল এই তাসের সুবিধে না নিলেও সে পারত। ইতিহাসের পেপারটা সোজাই ছিল। আর বাংলায় রচনা এসেছিল— ‘একটা অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা’। তিতির হরি দাদুর কথাটাই লিখেছিল। লিখে খুব স্যাটিসফায়েড হয়েছিল। 

পরীক্ষার পর এবার শেষ তাসটা ব্যবহার করার সময় এসেছিল। সে চিরকাল মুখচোরা, কখনও এরকম বাগ্মিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কিন্তু এবার ম্যাজিক তাসের জন্য সে অনেক আত্মবিশ্বাসী। মনটা একটু খারাপ ছিল যে ম্যাজিক শেষ হয়ে যাবে এরপর। আবার সে সেই সাধারণ মেয়ে হয়ে যাবে। তিন সপ্তাহের জন্য যে ‘অসাধারণ’ তকমাটা সে পেয়েছিল, সেটা সে খুব এঞ্জয় করছিল। কী আর করা যাবে! জীবন তো আর ম্যাজিক নয়।

কিন্তু মুশকিলটা বাধল প্রতিযোগিতার দিনের সকালবেলায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও শেষ তাসটা সে খুঁজে পেল না । নিশ্চয়ই বিল্টুদা’র কীর্তি । কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করছে না। এদিকে তিতির কেঁদেকেটে একসা। ওটা ছাড়া ও যে পারবেই না। কী করে বোঝাবে সে! কে বিশ্বাস করবে ওকে? এদিকে সময় হয়ে যাচ্ছে। বাবা তাড়া দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তিতির মা’র কাছে গিয়ে সবটা বলল। —জানি মা, কেউ বিশ্বাস করবে না, তাই আমি কাউকে বলতে পারছি না, কিন্তু তুমি প্লিজ বিশ্বাস কর। আমি এক বর্ণও মিথ্যা বলছি না, এই বলে সে হরিদাদুর সব ইতিবৃত্ত বলল। আর এও বলল যে ওই তুরুপের তাস না পাওয়া গেলে তার ঐ প্রতিযোগিতায় গিয়ে কোনও লাভ নেই। সে কিছুই বলতে পারবে না। 

মা তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু সব বৃথা। ওদিকে আর দেরি করাও যায় না। শেষে মা কীরকম তাস সব পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নিয়ে বলল— ঠিক আছে তুমি যাও। যা পারো তাই বল। যদি সফল হতে না পারো কোনও অসুবিধে নেই। আমি বাবাকে সামলে নেব। কিন্তু না গেলে অযথা সমস্যা বাড়বে। আর এর মধ্যে আমি সারা বাড়ি ভালো করে খুঁজে দেখছি। যদি পেয়ে যাই তাহলে আমি সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি তোমার কাছে। অগত্যা নিমরাজি হয়ে যেতেই হল তিতিরকে। জানে কপালে আজ চরম দুর্ভোগ আছে। কী আর করা যাবে! এক দিন না একদিন এটা হওয়ারই ছিল। 

নেহাত করোনা নিয়মাবলী মেনে লোক কম হয়েছে। তিতির জানে আজ সে কী ভয়ানক নাস্তানাবুদ হতে চলেছে। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, ভীষন কনফিডেন্ট দেখাচ্ছে। এই প্রথম তার বাবাকে তার প্রতি এতটা আস্থা দেখাতে দেখছে সে। আর আজকেই কী না…

তিতিরের কান্না পাচ্ছিল। বাগ্মিতা প্রতিযোগিতার টপিক শুনে তো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। এ তো কিছুই বলতে পারবে না সে। প্রায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেলবে এমন সময় দেখে মা দৌড়তে দৌড়তে আসছে। দূর থেকে তার দিকে হাতটা তুলে দেখাল। হাতে সেই তুরুপের তাস— রুইতনের বাদশা বা কিং অফ্‌ ডায়মন্ডস্‌…

আঃ! তিতির হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচল। মা ঠিক খুঁজে পেয়েছে। ওদিকে মাইকে তার নাম এনাউন্স হয়ে গেছে। সে চোখ বন্ধ করে আওড়ালো—

“ওডিনের বরে খুলে গেল জ্ঞানের গুপ্ত দরজা
শক্ত কঠিন বিষয় হল জলের মতন সোজা”

তারপর মনে মনে প্রার্থনা করল বাগ্মিতা প্রতিযোগিতার টপিকটা নিয়ে। তারপর শুরু করল তার বক্তৃতা। আর যথারীতি দারুণ বলল। হাততালিতে হল ফেটে পড়ল। টপিকটা প্রথমে কঠিন লাগলেও পরে তিতিরের মনে হল— বিষয়টা তার জানার মধ্যেই পড়ে। শুধু শুধু সে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু রুইতনের বাদশা থাকলে এমনিতেই সব সোজা। 

বাবার আনন্দটা দেখার মতন। নিজের মেয়েকে নিয়ে এতটা গর্ব করতে তিতির আগে কখনও দেখেনি। তার নিজেরই কেমন লজ্জা করল। এসে মাকেও জড়িয়ে ধরল সে। —কোথায় পেলে তাসটা? কই, দাও দেখি, আমাকে ওটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

ওমা, যেই তাসটা হাতে নিয়েছে তিতির, অমনি চমকে উঠেছে। এ কী! এটা তো সেই তাস নয়। এটা তো একটা সাধারণ তাসের রুইতনের বাদশা। এর তো একটাই চোখ দেখা যাচ্ছে। এ তো ম্যাজিক তাস নয়…

মা তখন তিতিরকে জড়িয়ে বলল— কী করব! সারা বাড়ি খুঁজে কোথাও পেলাম না তোর ম্যাজিক তাস। তখন এমনি একটা সাধারণ তাস থেকে রুইতনের বাদশাটা এনে তোকে দূর থেকে দেখালাম। আমি জানি তো আমার তিতির সোনা এমনিতেই পারবে। তুইও দূর থেকে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলি না। কিন্তু সাহসটা পেয়ে গেলি। আর অমনি কী সুন্দর বললি, দেখ্‌!

তিতিরের চোখে জল। আনন্দাশ্রু। সে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরল। জীবনে এরকম হাজার হাজার ম্যাজিক প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে। এটা সেই রকম এক ম্যাজিক মুহূর্ত।

অলংকরণ: শুভ্রনীল ঘোষ

Kuhoki alias Souvik Maiti

‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এ নামেই প্রকাশিত হয়েছে “একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প" বইটি, যা পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছে। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *