সুইমিং গগলস পড়া চোখ দিয়ে সামনেই দেখতে পাচ্ছি সি টার্টল আস্তে আস্তে সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসছে। আমি প্রায় স্থির, হাতে ক্যামেরা, নজর টার্টল-এর দিকে। টার্টল নাকি হঠাৎ করে রেগে গেলে রক্ষে নেই! এদিকে, সে ধীরে সুস্থে আমার পাশ দিয়ে ঘুরে জলের ওপরে শ্বাস নিয়ে, আমার সামনাসামনি চলে আসছে। খানিক ঘাবড়ে যাচ্ছি সবে, তখনই দেখি অতল সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসছে উজ্জ্বল গোলাপি কিছু একটা। প্লাস্টিক? এই গভীর সমুদ্রেও? এসব ভাবতে যাব, সে সময় দেখি টার্টল মহাশয় আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সোজ্জা গোলাপি বস্তুটির দিকে ধেয়ে, নীচে নেমে, দু হাতে সজোরে তাকে জড়িয়ে ধরে, টেনট্যাকলসগুলো কচমচ করে তারিয়ে তারিয়ে খেতে শুরু করলেন! ওমা! গোলাপি বস্তুটি আর কিছু নয়… ক্রাউনড জেলি ফিশ! কয়েক সেকেন্ড দম বন্ধ করে নীচে ডুবে একটু কাছ থেকে দেখেই উঠে এলাম। মহাসাগরের বুকে তখন একদম অনন্তের মাঝে স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্স চলছে…
ঝাঁক ঝাঁক মাছের মধ্যে দিয়ে সমুদ্রের অজানা রঙিন জগতে সাঁতার কাটতে কাটতে এসব দেখতে যাওয়া, এই জন্যেই তো মলডিভস… নাহ, মালদ্বীপ বলছি না, ওদের মতো করে মলডিভস, বা রিপাবলিক অফ মলডিভস রইল!https://banglalive.today/wp-content/uploads/2023/01/WhatsApp-Video-2023-01-17-at-15.50.04.mp4প্রায় ১২০০র ওপর আইল্যান্ড ও আরও কিছু স্যান্ড ব্যাঙ্ক দিয়ে তৈরি মলডিভস। বহু বহু বছর আগে অগ্নুৎপাত থেকে এর জন্ম-প্রক্রিয়া শুরু, তারপর আগ্নেয়গিরি থেমে গেলে তৈরি হয় প্রবালদ্বীপ… কোরালের জনসংখ্যা ক্রমে বাড়তে বাড়তে তৈরি হয় ‘রিফ’, সেই রিফ ধরে গড়ে ওঠে ছোট ছোট দ্বীপ, আর এক সাথে অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে ‘অ্যাটল’। ক্রমে ক্রমে, অনেক ‘অ্যাটল’ মিলে গড়ে ওঠা মলডিভস হয়ে ওঠে মাছ এবং লাখ লাখ সামুদ্রিক প্রাণের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র— কোনও দ্বীপে মানুষ থাকে, কোনও কোনওটি একদম মানবশূন্য! বহু বছর আগে, আন্দামান গিয়ে সমুদ্রের নীচের জগতের প্রেমে পড়ি… প্রবল ইচ্ছে জন্মায় সমুদ্রের নীচের জগৎটা আরও কাছ থেকে দেখার। এর মাঝে জীবনে অনেক কিছু ঘটে, তারপর আবার যখন সমুদ্রের নীচে যাবার কথা ওঠে, তখন সাত-সতেরো খুঁজে দেখে ঠিক করি যাব ‘মলডিভস’-এই। যেখানে থাকব, তার চারপাশে কোরাল, ইচ্ছে করলেই জলে ডুব দেওয়া, মাছ আর কোরালের মধ্যে সময় কাটানো… রাতে শোবার সময় কানে সমুদ্রের আওয়াজ, সকালে ঘুম ভাঙবে জলের মাঝে বাড়িটাতে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে…পাশ দিয়ে তখন বেবি শার্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর দুপুর রোদ্দুরে আরাম চেয়ারে বসে নিশ্চিন্তে সমুদ্র দেখা— ফিরোজাতে, নীলেতে, সবুজেতে মিলেমিশে তখন একাকার…

যাওয়ার জায়গা ঠিক হতেই কীভাবে যাব আর কোথায় থাকব এসব ভাবনা শুরু। যাওয়ার তো একটাই উপায়, প্লেনে চড়ে সমুদ্দুরের ওপর দিয়ে হুশশ করে উড়ে গিয়ে রাজধানী ‘মালে’-র ভেলানা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। কিন্তু সমস্যা হল, অতগুলো দ্বীপ থেকে বেছে ঠিক করা কোথায় থাকব! যাওয়ার টিকিট কেটে ফেলতে পারলে মলডিভস মোটামুটি নানারকম বাজেটে ঘোরা যায়। প্রথমত, পাবলিক আইল্যান্ডে থেকে, লোকাল নৌকো করে অন্য আইল্যান্ড ঘোরা এবং স্নরকেলিং, স্কুবা বা অন্যান্য ওয়াটার স্পোর্টসের স্বাদ নেওয়া। পাবলিক আইল্যান্ডের মধ্যে মাফুশি আর ফিহালোহি আইল্যান্ড খুব জনপ্রিয় আর বেশ সুন্দর। প্লেন তো নামে হুলহুলে আইল্যান্ডে, আর একটা সুন্দর ব্রিজ দিয়ে হুলহুলে থেকে মালে… সেখান থেকে সরকারি বা প্রাইভেট বোট নিয়ে যায় মাফুশিতে। এই সব পাবলিক আইল্যান্ডে ওয়াটার স্পোর্টস এবং অন্যান্য অ্যাকটিভিটি কিছুটা সস্তা।

কিন্তু মলডিভস বলতেই যে ফিরোজা রঙের জল, শুয়ে পড়া নারকেল গাছ, সাদা বালি, সমুদ্রের ওপর বাড়ি এসব নিয়ে পিকচার পোস্টকার্ড ছবি দেখি, সেসব উপভোগ করতে গেলে দ্বিতীয় অপশন, প্রাইভেট আইল্যান্ডে থাকা। এখানে প্রাইভেট আইল্যান্ড এর অপশন অজস্র। তাই আমাদের প্রয়োজন এবং পকেটের রেস্ত অনুযায়ী ভাবতে বসলাম। প্রথমত এবং প্রধানত যাচ্ছি, খুব ভালো হাউস রিফে সাঁতার কাটব বলে। মানে, এমন একটি দ্বীপ আর রিসোর্ট যেখানে পা ফেললেই কোরাল আর মাছ ঘুরছে… তার মানে, ওই দ্বীপের নিজস্ব কোরাল রিফ, সেখানে যত ইচ্ছে যখন ইচ্ছে ডুব দাও আর স্নরকেল কর— কেউ বাধা দেবার নেই, পুরো স্বাধীনতা!দ্বিতীয়ত, অবশ্যই বছরভর কাজ করে, কয়েকদিন একটু আরাম করতে…আর তৃতীয়ত, ছবি তুলে স্মৃতির পাতায় জমা করতে, জলের নীচের, ওপরেরও… প্রথমে কোন অ্যাটল-এর রিসোর্ট খুঁজব, সেসব ভাবা, তাতেও প্রাধান্য ওই যেখানে কোরাল আর সি লাইফ ভালো দেখতে পাব সেখানে… তো, আরি অ্যাটল বাছা হল,তারপর রিসোর্ট… বাজেট আর চাহিদা মিলিয়ে বাছা হল ভিলামেনঢু রিসোর্ট, কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের পছন্দের দিনে ফাঁকা পাওয়া গেল না! অক্টোবর শেষ থেকে শুরু হয়ে যায় টুরিস্ট আসার সিজন… অতএব রাসঢু অ্যাটল-এর অন্য একটি আইল্যান্ড ‘কুরামাঠি’… প্রায় দু কিলোমিটার লম্বা একটি দ্বীপ, পছন্দ হল বিশেষ করে কোরাল রিফের জন্যে, আর তার সঙ্গে সুন্দর ছবির মত বিচ আর স্যান্ড ব্যাংক। ওখান থেকে মায়া ঠিলাও যাবার ইচ্ছে রইল। মায়া ঠিলা, নাসিমো ঠিলা, কান্ডিমা ঠিলা, বানানা রিফ এগুলোকে মলডিভস-এর বেস্ট ডাইভিং সাইট বলা হয়, যেখানে চোখধাঁধানো রঙিন জীবন্ত কোরাল আর নানান প্রাণীর সমাহার…

যাইহোক, রিসোর্টের সঙ্গে কথা বলে, করা হল বুকিং। ঠিক যাওয়ার বাইশ দিন আগে হল পেমেন্ট! ব্যাস! প্রতিবার বেড়ানোর বুকিং হয়ে গেলেই যাবার আগে যা যা হয়! —সাবধানে গাড়ি চালাই বাবা… একটুও কোথাও যেন ধাক্কা না লাগে!—নাহ হাবিজাবি খাব না, কোনওমতেই শরীর খারাপ করা যাবে না!—অ্যাই, ঠান্ডা জল খাবি না! জ্বর টর এলে পুরো বারোটা বাজবে!এই অতি সাবধানতা আর চাপা উত্তেজনা নিয়ে দিন গুনতে গুনতে যাত্রা শুরু! মলডিভসে ভিসা অন অ্যারাইভাল, যাওয়ার দুদিন আগে সরকারি সাইটে ইমুগা ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। সব দরকারি কাগজ, পাসপোর্ট রেডি করে এইবার টুক করে আগে থেকে ঠিক করা প্লেনের জানলার ধারের সিটটায় বসে পড়া… জানলার ধার আজও প্রিয় বড্ড! নির্দিষ্ট সময়ে যথারীতি জানলায় আটকে থাকা চোখ দেখতে পেল, গাঢ় নীল রঙের জলের মধ্যে ফিরোজা আসমানি আর সবুজের খেলা… গভীর জলের মধ্যে ভেসে থাকা গোল গোল প্রবাল দ্বীপ! এসে গেছি তাহলে! *** দুই ডানায় ভর দিয়ে, দুপাশে ছোট ছোট প্রবাল দ্বীপ রেখে প্লেন নামল ভেলানা এয়ারপোর্টে। বাইরেই রিসোর্ট থেকে অপেক্ষা করছিলেন একজন, পথ দেখিয়ে বাসে করে নিয়ে গেলেন ‘ট্রান্স মলডিভিয়ান এয়ারলাইন’-এর নুভিলু সি প্লেন টার্মিনালে। ঝকঝকে সুন্দর লাউঞ্জে বসে কিছুক্ষণ সি প্লেন ওঠানামা দেখতে দেখতে আমাদের ডাক এল। আমাদের আইল্যান্ড প্লেন এবং বোট দুভাবেই যাওয়া যায়.. তবে সি প্লেন-এর অভিজ্ঞতা কে আর মিস করতে চায়! ‘লাইসেন্স টু কিল’-এ জেমস বন্ডের সি প্লেন মনে পড়ে? গভীর সমুদ্র থেকে উঠে এসে কীভাবে চাপল? আমাদের অবশ্য যথারীতি লাইন দিয়ে সুষ্ঠভাবে চাপতে হল, পনেরো জন লোকের মধ্যে চটপট আগে উঠে জানলার ধারও পাওয়া গেল… হুঁ হুঁ বাবা, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চাপার এফিসিয়েন্সিটা যাবে কোথায়!

তারপর, ভারত মহাসাগরের নীল জলের ওপর দিয়ে হালকা মেঘেদের সঙ্গী করে, নীচে খুব ছোট ও মাঝারি, নানান আকারের দ্বীপের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে মিনিট কুড়ির মধ্যে প্লেন নামল কুরামাঠির লেগুন-এর দিকে ফিরোজা রঙের জলের মধ্যে! রোদ ঝলমলে চারপাশ যেন তুলি দিয়ে আঁকা ছবি! সেখান থেকে নৌকো করে জেটি এবং রিসেপশন। আদর যত্নের অঙ্গ হিসেবেই পুরো আইল্যান্ডের ম্যাপ চলে এল সামনে! ছোট হলেও, আইল্যান্ডের প্রতি কোনায় মন মুগ্ধ করা সৌন্দর্য্য— কোথাও ম্যানগ্রোভ, কোথাও স্ক্রু পাইন বা সি লেটুস বা আয়রন উড এর ফাঁক দিয়ে ফিরোজা রঙের হাতছানি… কোথাও মধ্য দিনের প্রবল সূর্যকে আড়াল করতে তিন শতাব্দী প্রাচীন বট কিংবা ব্রেড ফ্রুট গাছ। আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা নানান ফুলের সম্ভার আর পাখির ডাক… আইল্যান্ডের ম্যাপে চোখ বুলিয়ে নিয়ে চললাম আমাদের সেদিনের ঠিকানাতে। পৌঁছে দেবার জন্যে আমাদের অটো বা টোটোর মত ছোট ওদের ইকো ফ্রেন্ডলি ‘বাগি’। উঠে নিজেরা গল্প করতে করতে এগোচ্ছিলাম। যেতে যেতে এক জায়গায় থেমে গেল বাগি, চালক বলে উঠলেন, “এই যে আপনাদের ভিলা!”বাংলা? আশ্চর্য হয়ে তাকাতেই বলে উঠলেন, “বহু বছর আগে কাজের তাগিদে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছি, আপাতত এটাই আমার ঠিকানা…” তারপর, হাসি ও ভালোবাসা বিনিময়… বাড়ির সামনেই একটা নুয়ে পড়া নারকেল গাছ আর সি লেটুসের ফাঁক দিয়ে সমুদ্র। হালকা ঢেউয়ের আওয়াজ আর ঝলমলে রোদ্দুর… অতএব, আর কেউ অপেক্ষা করে? পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে স্নরকেল গিয়ার নিয়ে সোজা জলে…

ও হ্যাঁ, মলডিভস-এর প্রাইভেট রিসোর্টগুলোতে তিন রকমের প্ল্যান চলে— হাফ বোর্ড, যাতে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ অথবা ডিনার, ফুল বোর্ড, যাতে তিনটেই থাকবে আর অল ইনক্লুসিভ, যাতে এর সাথে সিলেক্টেড কিছু পানীয় এবং স্নরকেল কিট ইত্যাদি ওরাই দেবে, এবং আরও কিছু সুবিধেও…আমাদের ফুল বোর্ড, তাই স্নরকেল কিট নিয়ে গেছিলাম। সাঁতার কাটা মুখ্য উদ্দেশ্য হলে ওই কিট, জলে হাঁটার জন্যে অ্যাকোয়া শু, সুইম স্যুট বা র্যাশ ভেস্ট এবং ফিনস নিয়ে যাওয়া সব চেয়ে ভালো। সমুদ্রে সাঁতার কাটতে সব চেয়ে বেশি লাগে পায়ের কেরামতি, আর তার জন্যে ফিন্স খুব দরকারী। চারপাশে কেউ নেই, সামনে শুধু নীল সমুদ্র… পুলে সাঁতার কাটা অভ্যেস, সমুদ্রে এভাবে সাঁতার কাটার আগে ভিতরে যেমন চরম উত্তেজনা তেমনই একটু ভয়। যদিও রিসেপশনে ঢুকতেই বুঝিয়ে দিয়েছিল, কতটা যাওয়া নিরাপদ, আর কোরালে পা না দিয়ে কীভাবে স্নরকেল করতে হবে। সাহস নিয়ে সবাই মিলে নেমে পড়লাম জলে… প্রথমে আলাপ হল রাগী মুখের ট্রিগার ফিশ-এর সঙ্গে, একটা ফুলকপি কোরালের সাথে সে লুকোচুরি খেলছিল। তারপর, একে একে ড্যামসেল ফিশ, ওরিয়েন্টাল সুইটলিপ, ব্লু স্ন্যাপার— এদের সঙ্গে দেখা। যাওয়ার আগে অবশ্য ছবিতে এদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল স্রেফ, সামনে থেকে দেখতে পেয়ে বেজায় খুশি! সারাদিন জলে কাটিয়ে সূর্য যখন ফেরার তোড়জোড় করছে, আমরা বালি পথ ধরে হাঁটা দিলাম স্যান্ড ব্যাংকের দিকে, যেখানে দু দিক থেকে সমুদ্র মিশে গেছে বালির বুকে আর সূর্য তাদের সঙ্গতে মেতেছে রঙের খেলায়…

সেদিন সন্ধে থেকে বৃষ্টি শুরু হল! মলডিভসে সাউথ ওয়েস্টার্ন মনসুন থাকে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। অক্টোবরের শুরুতে কখনও পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি হয়, তবে সাধারণত ওখানে যখন তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে রোদ্দুরও উঠে যায়। সেসব ভাবতে ভাবতেই ইয়াত্ত বড় ছাতা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে রাতের খাবার খেয়ে ঠিক করলাম পরদিন আবহাওয়া ভালো থাকলে স্কুবা যাব। মলডিভসে সাঁতার না জেনে গেলে অনেক কিছু মিস হয়ে যায় জানতামই, তবে সেদিন জানলাম স্কুবার প্রফেশনাল ট্রেনিং না থাকায় ওই মায়া ঠিলা মিস করব… পরদিন ঝকঝকে আকাশ, বলা ছিল ঠিক সকাল ন’টায় স্কুবাতে বেরোবো। ওরাও সময় নিয়ে পাক্কা, আমরাও… একটা ছোট্ট ট্রেনিং নিয়ে ঝাঁপ দিলাম গভীরে। তিন বার বয়েন্সি অ্যাডজাস্ট করে নেমে গেলাম বেশ খানিক গভীরে। সৌভাগ্য যে, নানান কোরালের মাঝে দেখা দিলেন ট্রামপেট ফিশ, মান্টা রে, রিফ শার্ক, আরও ঝাঁক ঝাঁক মাছ। ঘণ্টাখানেক যে কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি। সমুদ্র থেকে উঠেও ঘোর কাটে না। যাই হোক, চনমনে খিদে নিয়ে বসা গেল শান্ত নীল আর ফিরোজা জল দেখতে দেখতে খাবার থালা নিয়ে। ছোট দ্বীপ, যেখানেই বসবে পাশে সমুদ্র নিয়েই, রেস্তোরাঁতেও। প্রতিদিন এও এক উৎসাহের কাজ ছিল, সমুদ্র দেখতে দেখতে নানা দেশের অসাধারণ সব নতুন খাবার খাওয়া, সঙ্গে মলডিভিয়ান মাসরশি, মাসহুনি, মলডিভিয়ান লাইভ লবস্টার— এই সব…

দুপুরটা কেটে গেল নারকেল গাছে বাঁধা দোলনাটায়… শুধু সমুদ্র দেখতে দেখতে, নারকেল গাছের ওপারে কখনও মৌসুমী মেঘের শ্যামা রূপ, কখনও রোদ ঝলমলে খুশি। নারকেল মলডিভস-এর জাতীয় গাছ— সারা আইল্যান্ড জুড়ে তার প্রাধান্য, সব কটেজের ছাদে নারকেল পাতার ছাউনি, নারকেলের ফ্রেশ গন্ধ সমেত বডি লোশন, শ্যাম্পু, রুম ফ্রেশনার, মায় খাবার লিস্টেও কিছু না কিছু নারকেল দিয়ে।সন্ধেটা কাটল সমুদ্রের প্রাণী নিয়ে মেরিন বায়োলজিস্ট-এর মনোগ্রাহী উপস্থাপন শুনে…তারপর অপেক্ষা পরদিন সকালের, পরের দুদিন কাটবে সমুদ্রের বাড়িতে… *** স্প্যানিশ মস, বাগানবিলাস ঘেরা আধো রোদ আধো ছায়ার রাস্তা দিয়ে এগিয়ে একটা কাঠের ব্রিজ, ব্রিজের ওপারে গিয়ে সামনেই আমাদের ঘর… পরপর এক সারি ঘরের মধ্যে একটা। দরজা খুলতেই হালকা বাজনা, আর একটু এগিয়ে ঘরের পর্দাটা তুলতেই যেন একটা বড় স্ক্রিন জুড়ে সমুদ্র! কাচের ওপারে রোদ ঝলমলে বারান্দা, বারান্দায় পা ঝোলালেই নীচে নীল সমুদ্র, মাছ আর কোরালের টুকরো। চারদিক নিস্তব্ধ, কেউ কোথাও নেই, শুধু সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার আওয়াজ… দুদিন আর কোত্থাও যাব না, কোনও অভিযান নয়, স্রেফ বারান্দা থেকে সমুদ্রে আর সমুদ্র থেকে বারান্দায়। আর চলবে নিমো আর ডোরিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা…

রাতে বারান্দার ওপরে তখন তারার চাঁদোয়া, নীচে কালো অন্ধকার সমুদ্র। ভাগ্য ভালো থাকলে মলডিভস-এর বিচেও নেমে আসে তারার আলো, দেখা যায় বায়োলুমিনিসেন্স! মলডিভস-এ ভোর হয় ওই ছ’টার কাছাকাছি, ইকোয়েটরের কাছে তো… যথারীতি পাঁচটায় ঘুম ভাঙতেই সমুদ্র-বারান্দায় বসে পড়েছি, আকাশে হালকা আলোর আভা আর অসীম নিস্তব্ধতার মাঝে ঢেউয়ের আওয়াজ যেন প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া মার্কনি ইউনিয়ন-এর ‘ওয়েটলেস’… বছরভরের সমস্ত ক্লান্তি উধাও। পাক্কা ছ’টা বাজতে সাতে অসীম সমুদ্রের মাঝখান থেকে আকাশে আর জলে আলোর খেলা দেখিয়ে সুয্যি উঁকি দিলেন… আমরা তখন সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির কাছে নতশির! ঠিক তখনই মাথার ওপর শিশিরের মত ঝরে পড়ল খুব হালকা বৃষ্টির জল, একদিকে সূর্য আর অন্যদিকে সাতরঙা রামধনু… এইভাবে দুদিন কেটে গেল সমুদ্রবাড়িতে… বারান্দায় পা ঝুলিয়ে আর নিমো আর ডোরির পিছনে ছুটতে ছুটতে… কখনও পাশ দিয়ে অনায়াসে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিফ শার্ক, কখনও বা স্টিংরে কখনও নাম-না-জানা মাছগুলো। অকারণ হিংসে, দ্বেষ আর দূষণ থেকে কদিন বহু যোজন দূর…

পুরো আইল্যান্ডটাকে উপভোগ করার জন্যে শেষ দিন আমাদের অন্য একটি দিকে থাকার কথা। লেগুন সাইড। দ্বীপের এক দিকে কোরাল আর অন্যদিকে নীল জলের লেগুন… সৌন্দর্য্য দেখা ছাড়াও আইল্যান্ডে নানানরকম এক্সকারশন আর ওয়াটার স্পোর্টস হয়, উইন্ড সার্ফিং, কায়াকিং, বানানা বোট, সানসেট ক্রুজ, সেমি সাবমেরিন, আর স্নরকেল ট্রিপ..আগের সন্ধেয় ঠিক করা ছিল পরের দিন আমরা টার্টল রিফ স্নরকেল করতে যাব। আঠারো জনকে নিয়ে যাবে দুজন গাইড। যাওয়ার আগে বেশ ভয়-টয় দেখিয়ে দিল গাইড ভাই, “দেখো, ভালো সাঁতার আর নিজে স্নরকেল পারো তো? নাহলে কিন্তু বোটে বসে থাকতে হবে, পুরো পেমেন্ট করেও! ঘণ্টাখানেক সাঁতার- কখনও স্রোতের সঙ্গে, কখনও বিপরীতে। ভেবে বোলো..” ভেবে বললাম, যাবই! নতুন ভিলাতে শিফট করেই বেরিয়ে পড়লাম টার্টল দেখতে, ঝকঝকে সাদা নৌকোয়। সঙ্গে নানা দেশ থেকে আসা হাসিমুখের সঙ্গীরা… প্রায় আধঘণ্টা যাবার পর মাঝ-সমুদ্রে হঠাৎ নৌকোর ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ হল। গাইডের নির্দেশ, স্নরকেল কিট আর ফিন্স পড়ে ডাইভ দিন! পুলে সাঁতার কাটা মানুষ, খানিক ভয় নিয়েই দিলাম ঝাঁপ… গগলসটা ঠিক করে নীচে তাকাতেই সব ভয় শেষ… সমুদ্রের সেই আশ্চর্য রঙিন জগৎ! এরপর এক ঘণ্টা আর ফিরে তাকানো নেই- স্রোতের সঙ্গে, বিপরীতে, খানিকক্ষণ বৃষ্টির মাঝে টানা সাঁতার… একটা, দুটো, আর তিনটে টার্টলের সাথে। ওই তৃতীয় জনের সঙ্গেই তো প্রথমে আলাপ করালাম! ব্যাস! এমনি করেই চলে এল ফিরে যাওয়ার দিন। ফিরতে হবে দ্বীপ ছেড়ে, সমুদ্র ছেড়ে, সমুদ্র বাড়ি, সাদা বালি, রঙিন মাছ আর কোরাল ছেড়ে… যথাসময়ে সি প্লেনে উঠলাম, জানলা দিয়ে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে মিলিয়ে গেল আমাদের কদিনের ঠিকানাটা।ফেরার পথে আমাদের সঙ্গে উঠলেন ওই দ্বীপের এক কর্মী। কথায় কথায় জানা গেল, উনি কাজে রিজাইন করে ফিরছেন। মিলিয়ে যাওয়া দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “একদিন দুদিন, এক মাস, দেড় মাস ভালো লাগে… তারপর বাড়ি ফিরতে মন চায়। বাড়িতে একটু ছুটি কাটিয়ে, আবার অন্য কোথাও ফিরব কাজে, অন্য কোনও দ্বীপে…” “ভাকিভেলানি মলডিভস…”
ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।