বইয়ের নাম: মানভূম জার্নাল
লেখক: পৌষালী চক্রবর্তী
প্রকাশক: ধানসিড়ি
বিনিময়: ১২০ টাকা (হার্ড কভার)
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৬৪
প্রকাশকাল: ২০২১
প্রচ্ছদশিল্পী: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাপ্তিস্থান: ধানসিড়ি বইঘর, ধ্যানবিন্দু, দেজ
অনলাইন কিনতে: ধানসিড়ি, ফ্লিপকার্ট, বইঘর ডট ইন

ধানসিড়ি প্রকাশনীর ‘মানভূম জার্নাল’ পৌষালী চক্রবর্তীর লেখা এক অন্য আঙ্গিকের কাব্যগ্রন্থ। মানভূম এই বইয়ের প্রাণকেন্দ্র। ঘাটবেড়া পাহাড়, বেরসার বন, আম্রুহাঁসা নদীকে আলিঙ্গন করে ৫৭টি কবিতার সমাহার রয়েছে মানভূম জার্নালে। 

‘আহ্নিক গতি ছন্দে ডেকে ওঠে তুৎ পাখি
অনাবিল মানবের ভূমে নত এই সহজ সভ্যতা’।

শালবৃক্ষের কথা শুনতে কান পাতলাম এরপর। বরং দেখে ফেললাম, ‘আকাশে আকাশে ক্ষমা/ তবু কী সুতীব্র ফাঁস!/ নিরন্ন উপবাসে দোলে/ ‘উমত শবর’-এর লাশ’।

মানুষের জন্ম হয়, দেবতারও। ‘বুড়হা-বুড়ির পাহাড়। লল্লাট ধান্যবনে কোল পাতা ছল।/ সরু দাগ শিরিঙ্গি নদীর। মুখ ঢেকে শুয়ে আছে পুরা প্রত্নস্থল’। আর তারপরেই আবার লেখা হয়— ‘কে ছিল এখানে কবে? যেন এক মৃতের নগর… ছায়া গৃহকোণ ছিল; মায়ামৃদু বধূ না কি বিনত শ্রাবক?’

কেউ যেন আমার কানে কানে বলে যায়, ‘লক্ষ্যভ্রষ্ট তির কুড়াও/ তূণীর ভরে তোলো তুমি, মেয়ে…’ জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়ে সম্বিত ফিরল বুঝি আমার। তূণীর ভরে তোলা হল না তো! আর কি সম্ভব? জিজ্ঞাসাই বুঝি অনন্ত এখন। মন শান্ত হয়ে এলে দেখি, ‘শীতল মাটির ঘর, চোখপুরা কাজ/ নকশী আঙিনা জুড়ে ফসলের আঁচ’। কিন্তু সত্যিই কি দেখি ঐ দৃশ্য? আজকের শহুরে জীবনের হারিয়ে যাওয়া কল্পনার মতো তুৎ পাখি উড়া দিয়েছে কখন! টুসুর বিলাপ ওঠে সেখানে। ধামসা ভাসান বাজায় না কেউ। করম রাত্রি জুড়ে মাদলে মাতন ওঠে দ্রিমি দ্রিমি… 

Manbhum journal

মানভূম জার্নালের কবিতাগুলি পড়তে পড়তে আস্ত এক আদিবাসী গাঁও চোখের সামনে এসে পড়ে। শাল, মহুয়ার গন্ধ আর ধামসা, মাদলের সুরে আচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া পাঠকের কোনও উপায় নেই। বাতাসে বসন্তের গন্ধ লেগে আছে এখানে। শীত যাই যাই করছে, সে বোধহয় বুঝে উঠতে পারছে না, বসন্তকে এবার জায়গা করে দিতে হবে। এই আবহে বসন্ত যাপন কবিতার কথা উল্লেখ করতেই হয় বিশেষ করে। 

‘আজকাল পলাশ ফোটার শব্দে/ খুব ভয় করে।/ মনে হয় প্রপাতের নীচে গিয়ে মুখ লুকাই’।

বসন্ত আসার শব্দে ভয় করার কারণ কী? কবি বসন্তকে ভয় করেছেন, এমন কথা শুনেছি কি আমরা এর আগে? এই বসন্ত-যাপন প্রকৃতপক্ষে কবিতার থেকে বেরিয়ে আসা এক বাস্তব চিত্র। ভয়ের কারণও তাই। 

‘ভীষণ ভয়ের জল না পাওয়ার কাল/ আসার কথা বলাবলি হচ্ছে’।  

চরম এক ধাক্কায় পাঠককে শুধু না, মধুমাসকেও কবি খাদান প্রান্ত থেকে উঠে আসতে দেখেন। ‘ছাইরং জমি তার বহুনন্দিত পঞ্ছী শাড়ি/ কল্কা ওঠা নকশি পলাশ, ফ্যাকাশে সবুজ ডুরে’। এরপর আবার সেই রুক্ষ বাস্তব—

‘বোরিং গাড়ি ঢোকে/ হাঁ মুখ রক পাইথন এক;/ খরা শুষে নেবে’। আর তারপরেই খনিক বিরতি দিয়ে একটি লাইন—পোস্তবাটার মতো গাঢ় মেঘ করে উপদ্রুত অঞ্চলে’। আমি নিশ্চিত পোস্তবাটার মতো গাঢ় মেঘ, এই উপমা একমাত্র কোনও নারীর পক্ষেই লেখা সম্ভব। কবিতার তিনটি অংশেই ছত্রে ছত্রে বৈপরীত্য ঘন হয়ে আছে। মাদলের মাতন যখন মাথুর অভিলাষ জাগায়, তখনই ‘করুণ বিধবা কেঁপে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ সুরে/ আদিগন্ত বাঁশি। নাচনির হাড়ে গড়া’। 

ছো-নাচ পালায় দুর্গা সিং মুড়াকে দুর্গতিনাশিনী সাজে নেচে যেতে দেখি। এমনই সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় হাড়িরাম কালিন্দী আসেন। তেল হোলদার উপকথা আসে। পড়তে পড়তে মনে হয়, সত্যিই যেন আমি বা আমাদের মতো শহরবাসী এই কবিতাগুলি পড়তে এসেছি ‘ভুল জুতো পায়ে’। আমাদের টায়ার সোলের চপ্পল নেই, ‘আমাদের পদভার কর্কশ ও সোচ্চার’। এই অশ্রুত, অলিপিকথা শোনার জন্য আমাদের কান প্রস্তুত নয়। 

      ‘উড়ন্ত ধুলোর ঝড়ে

   খুঁজে দেখো রামচন্দ্র-শর

    সীতাকুণ্ডে ডুবে গেছে

অশ্রুত অলিপিকথা, 

     মানুষের ঘর’। 

সবশেষে পাঠকের উদ্দেশ্যে আবার পৌষালীর কবিতার লাইন ধরেই বলব, ‘পাথর সরিয়ে দেখো/শোনা যাবে অলিপিকাহন’। মানভূম জার্নাল শিরোনামের কবিতাটিতে দেখি—

‘বৌয়ের মাটিমাখা হাত থেকে একে একে ফুটে উঠছে দেওয়ালি পুতুল’। আলোর সম্ভাবনা রেখে যাচ্ছে কবিতা, আর আলো ফোটার আগে তার প্রস্তুতি—‘কোজাগরি চাঁদের মতো ফুলে উঠবে দুধ ও রুটি’।

পৌষালীর কবিতা অনুভবের পথ আর বাস্তবকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে। চলতে চলতে রুখুসুখু পথের গাঢ় নির্জনতাকে আলিঙ্গন করেছে, মানুষ আর প্রকৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে মানভূম জার্নাল। তীক্ষ্ণ ধী আর অনুভবসম্পন্ন এই কবির আগামী লেখাগুলি আরও শ্রী ও সমৃদ্ধি পাক, এই কামনা রইল।      

 

তুষ্টি হুগলি জেলার শেওড়াফুলির বাসিন্দা এবং বোটানিতে স্নাতক। গদ্য ও কবিতা লেখায় সমান আগ্রহ। প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তিন - ভিজে যাওয়া গাছ, ব্ল্যাক ফরেস্ট ও এরিসেডের আয়না। গদ্যের বইয়ের নাম পদাবলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *