আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮]
চুনী গোস্বামী
এক সাক্ষাৎকারে ইংরেজ অভিনেতা রিচার্ড অ্যাটেবরোর কাছে এক সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় যখন তাঁকে ‘শতরঞ্জ কি খিলারী’ ছবিতে জেনারেল উটরামের ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন তখন তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল! অ্যাটেনবরোর সংক্ষিপ্ত উত্তর “when Ray offers you a role in his film, you don’t think about it over a cup of tea- you just say ‘yes’!”
একইরকম প্রতিক্রিয়া আমার হয়েছিল ১৯৯২ সালের শুরুর দিকের এক শনিবারের সকালে অগ্রজ বন্ধু সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের টেলিফোন পেয়ে। সেসময় সিডনির বাঙালিদের সামাজিক জীবন রীতিমত জমজমাট। কাউকে নিমন্ত্রণ করলে নিদেনপক্ষে সপ্তাহখানেক আগে থেকে বলে রাখাই রীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। সঞ্জয়ের বাড়ির জমায়েতটা কিন্তু সেদিনই সন্ধ্যায়। তবে যেই প্রধান অতিথির নাম শুনলাম, অ্যাটেবরো সাহেবের মতো বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বিনা দ্বিরুক্তিতে রাজি হয়ে গেলাম।
আর ভনিতা না করে বলেই দিই। সেই অতিথি ছিলেন আমার অনেক স্বপ্নের নায়ক কিংবদন্তি ফুটবলার চুনী গোস্বামী। সঞ্জয়ের খেলাধূলায় বিন্দুমাত্র উৎসাহ আছে বলে জানতাম না— তাই ওর বাড়িতে চুনীবাবুর পদার্পণ একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। আসলে সে বছর অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলছিল, চুনীবাবু এসেছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে কোনও এক সংবাদপত্রের তরফে। ওঁর এক সঙ্গী মিত্রার (সঞ্জয়ের স্ত্রী) পারিবারিক বন্ধু, সেই সূত্রেই যোগাযোগ।
সেদিন চন্দনা বেশ অসুস্থ ছিল। যাওয়ার অবস্থায় ছিল না। আমিও একটু দ্বিধার মধ্যে ছিলাম ওকে একা রেখে যেতে। কিন্তু মোহনবাগান-অন্তপ্রাণ জীবনসঙ্গীর এমন একটা দুর্দান্ত সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে রাজি ছিল না ও। আমাকে প্রায় জোর করেই পাঠাল। কুণ্ঠিত চিত্তে ‘পতির পুণ্যে সতীর পূণ্য’ অজুহাতে একাই গেলাম ।

ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে। প্রথম দর্শনে মধ্য-পঞ্চাশের চুনীবাবুকে দেখে বেশ নিরাশই হয়েছিলাম।খেলোয়াড় জীবনের সিনেমা নায়কোচিত চেহারাতে প্রকৃতির নিয়মে কিছুটা মালিন্য এসে গেছে ততদিনে। একটু আড়ষ্টই ছিলাম শুরুতে। কিন্তু অন্য দুই ভদ্রলোক (মোহনবাগানের তৎকালীন কর্মকর্তা) আলোচনা পরিচিত এলাকায় নিয়ে এলেন। আমিও সুযোগ পেয়ে মোহনবাগান তথা ওঁর নিজস্ব ক্রীড়াজীবন বিষয়ে আমার বিশ্বকোষ-সম জ্ঞান মহানন্দে উজাড় করে দিলাম। সিডনির মতো জায়গায় এমন ঢিল ছোঁড়া সমর্থক পেয়ে বেশ আশ্চর্যই হলেন সবাই। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক স্মৃতির উজান বেয়ে শোনালেন কিছু অজানা গল্প।
সঙ্গীদের কাছে শুনলাম, উনি নাকি প্রতিদিন কাকভোরে উঠে সিডনির রাস্তায় ঘণ্টাখানেক দৌড়ে আসেন। এই প্রসঙ্গে ওঁর একটা কথা আজও কানে বাজে— “I don’t believe I have earned my breakfast until I complete my morning exercise.” আমার বাবা বলতেন— “একটা মানুষ এমনি এমনি বড় হয় না!” একজন সফল মানুষের আড়ালে অনেক পরিশ্রম, প্রচুর ত্যাগ থাকে। আমাকে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন, কিছু উপদেশও দিয়েছিলেন। যদি শুনতাম, আজ হয়তো শরীরটা আরেকটু সুস্থ থাকত।
মনে হয় আমাকে পছন্দই করেছিলেন। ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন কলকাতায় গেলে দেখা করতে। তখনও আমরা এদেশে নতুন, তাই ১৯৯৫-এর আগে দেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আমার সেলেব্রিটিদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করায় বেশ অস্বস্তি আছে দুটি কারণে। প্রথমত, প্রচুর মানুষ তাঁদের অযথা বিরক্ত করেন, আমি আর সেই সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাই না। আর একটি কারণ হল আমার দেখা কিছু নামকরা মানুষের অসীম দম্ভ এবং অভদ্র ব্যবহার। কিন্তু সেদিনের সেই দুঘণ্টার আলাপে চুনীবাবুকে একটু অন্যরকম লেগেছিল। তাই উনি দেশে ফিরে যাওয়ার পরপরই ওঁকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। বেশ তাড়াতাড়িই উত্তর পেয়েছিলাম— দায়সাড়া নয়, বেশ আন্তরিক টাইপ করা চিঠি, ইংরিজিতে। চিঠিটাকে অতি যত্নে রেখেছিলাম। কিন্তু বহুদিন সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সম্প্রতি হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে একটা বাক্সে খুঁজে পেলাম সেই চিঠি। দুর্ভাগ্যবশত সেই বাক্সের চিঠিগুলির অধিকাংশেরই প্রেরকেরা আজ আর নেই। চুনীদা চলে গেলেন ২০২০তে।

তারপর অবশ্য আর যোগাযোগ ছিল না। ১৯৯৫ সালে দেশে গিয়ে মূলত চন্দনার উৎসাহেই ফোন করেছিলাম। একটু কষ্ট করে হলেও চিনতে পেরে দেখা করতে বলেছিলেন। সাউথ ক্লাব ও ক্যালকাটা ক্লাব মিলিয়ে একটা সুন্দর শীতের দুপুর কাটিয়েছিলাম। সস্ত্রীক বাড়িতে নিমন্ত্রণও করেছিলেন। কিন্তু সময়াভাবে এবং অন্যান্য কারণে আর তা সম্ভব হয়নি। এর পর অবশ্য আর কখনও দেখা বা কথা হয়নি বিখ্যাত মানুষটির সঙ্গে।
***
চুনী গোস্বামীর প্রয়াণের পর শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখতে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম দু-তিন পাতায় সীমাবদ্ধ রাখব লেখাটি। কিন্তু শুরু করে আর সহজে থামতে পারিনি— নেই নেই করে ১৫টি পর্বে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলাম মহানায়কের বর্ণময় জীবনের নানা কথা।
চুনী গোস্বামী এক বিরল প্রতিভা। জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক। সত্তরের দশকে বাংলার ক্রিকেট অধিনায়ক রূপে সেই সময়ের অপরাজেয় বোম্বাই দলকে ঘরের মাঠে প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন। রীতিমতো ভালো টেনিস খেলতেন। প্রখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় জয়দীপ মুখার্জির মতে টেনিসে মনোযোগ দিলে অনায়াসে ডেভিস কাপে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে পারতেন। শুনেছি মোহনবাগানের হয়ে একবার হকিও খেলেছিলেন। এছাড়া দুর্দান্ত ক্যারমও খেলতেন।
***
পঞ্চাশের কম যাঁদের বয়স তাঁদের উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনের বিশেষ কোনও স্মৃতি মনে হয় নেই। আমার বয়স তখন পঁচিশ। কলকাতাতেই চাকরি করি ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টসে।
সাদা কালো টেলিভিশনে শেষ যাত্রা দেখানো হচ্ছিল। সেই সময়ের সমস্ত শিল্পীই ছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের একটা কথা মনে আছে:“ওরকম স্টার আর হবে না!” অভিনেতা অনেক এল গেল— মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও উত্তম স্বমহিমায় বিরাজ করছেন আজও।
চুনী গোস্বামী এক বিরল প্রতিভা। জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক। সত্তরের দশকে বাংলার ক্রিকেট অধিনায়ক রূপে সেই সময়ের অপরাজেয় বোম্বাই দলকে ঘরের মাঠে প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন। রীতিমতো ভালো টেনিস খেলতেন।
চুনী গোস্বামীর ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। অমন গ্ল্যামারাস ক্রীড়াবিদ পশ্চিমবঙ্গে আর কেউ ছিলেন বলে আমার জানা নেই (কিছুটা টক্কর দিতে পারেন হয়তো সৌরভ গাঙ্গুলি)। রূপ, গুণ, বুদ্ধিমত্তা সব কিছুই প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছিল মানুষটাকে, (নাস্তিক বলে ভগবানের জায়গায় ‘প্রকৃতি’ শব্দটা ব্যবহার করলাম। সেই চালু কথাটাও বলতে পারতাম ‘ভগবান জিসকো দেতা হ্যায় ছপ্পড় ফোরকে দেতা হ্যায়’)।
কোন এক সিনেমা পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে এক মহিলা জানিয়েছিলেন: “পুরুষ মানুষদের গোঁফ না থাকলে কেমন হনুমানের মতো দেখতে লাগে!” উত্তর ছিল: “উত্তমকুমার বা চুনী গোস্বামীকে কি হনুমানের মত দেখতে?”
মনে হয় অভিনয় জগতে প্রবেশ করলেও সফল হতেন উনি। ‘প্রথম প্রেম’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেওছিলেন। সহ-অভিনেতা ছিলেন বিশ্বজিৎ এবং সন্ধ্যা রায়। ছবিটা নাকি বাণিজ্যিক সাফল্যও পেয়েছিল। শ্যামবাজার পাড়ায় থেকে ছবিটা কেন দেখিনি মাথায় আসছে না।
শুনলাম বিশ্বজিত নাকি ওঁর ভাল বন্ধুও ছিলেন।
বিশ্বজিতের কথায়: “ভারতীয় ফুটবলে প্রথম সুপারস্টারের নাম চুনী গোস্বামী। ওকে ঘিরে উৎসাহ উন্মাদনা ছিল দেখার মতো। এরকম গ্ল্যামারের আলোতে কাউকে থাকতে দেখিনি সেই সময়। ফুটবলার হিসেবে স্টারডম শুধু ওই পেয়েছিল। সেই সময় সব নতুন ফুটবলাররা চুনী গোস্বামী হতে চাইত। ওঁর মতো খেলতে চাইত।”

উপরোক্ত ‘প্রথম প্রেম’ ছবিতে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কের চরিত্রেই দেখা গিয়েছিল চুনী গোস্বামীকে। ছবিটি রিলিজের পর একটি অনুষ্ঠানে চুনীর মহিলা ফ্যান ফলোয়িং-এর আঁচ পেয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। তাঁর ভাষায়, “প্রথম প্রেম রিলিজের পর আমরা দুজনে একসঙ্গে এক জায়গায় গিয়েছি। যেভাবে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য আর হাত মেলানোর জন্য মহিলারা ঘিরে ধরেছিল ওকে, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সামলানো যাচ্ছিল না কোনওভাবেই।”
কাকতালীয়ভাবে চুনী গোস্বামীর প্রয়াণের কয়েকদিন আগেই বলিউডের দুই মহাতারকা ঋষি কাপুর এবং ইরফান খানের মৃত্যু হয়। বিনোদন জগতের পত্রিকা হলেও ‘আনন্দলোক’-এর প্রতিবেদনে এই দুই চিত্রতারকার পাশাপাশিই স্থান পেয়েছেন চুনী। সিনেমা ও ক্রীড়াজগত মিলেমিশে একাকার।
সম্পাদকীয়র কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:
“চুনী গোস্বামীও তো জীবন শেষে রেখে গেলেন বিপুল নস্ট্যালজিয়া। কোনও ক্লাসিকের শেষের মুগ্ধতা ছড়ালেন… তৈরি করলেন নানা কৌতূহল। স্মৃতিচারণে, গল্পে, ছবিতে যেন রক্তমাংসে প্রাণ পেলেন। আর বোঝালেন লার্জার দ্যান লাইফ শব্দটার মানে।”
***
অনেক কথা লিখে ফেললাম। লিখতে লিখতে নেট থেকে, পাঠকদের মন্তব্য থেকে অনেক কিছু জানতেও পারলাম। ওঁর পারিবারিক ইতিহাস, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল। সেরকম তথ্য পেলাম না। ভালোই হয়েছে। মনে হয় ব্যক্তিগত জীবনটাকে public domain-এর বাইরেই রাখতে চেয়েছিলেন এই charismatic তারকাটি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। নেই উত্তমকুমারও। কিন্তু মাঝে মাঝে খেয়াল থাকে না যে ওঁরা আর নেই। বাঙালির হৃদয় জুড়ে ওঁরা আছেন, থাকবেন। সবার কথা জানি না, তবে আমার মতো ভক্তদের হৃদয় জুড়ে চিরকাল থাকবেন চুনী গোস্বামী নামে সেই গ্ল্যামারাস সুপারস্টারটি, যিনি এক বছর দশেকের বালককে একদিন অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় মাথায় আলতো করে হাত ছুঁইয়ে ধন্য করেছিলেন।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।