ফিফা-র তালিকায় ১৩৬টা দেশের মধ্যে ভারতের মেয়েরা ৬১ নম্বরে, শুধু এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ১১ নম্বরে। পুরুষদের ফুটবল টিম ১৬৫ দেশের তালিকায় ১০৬ নম্বরে, এশিয়ার তালিকায় ১৯ নম্বরে। এখনকার মতো পুরুষদের দিকে না হয় না-ই দেখলাম, মেয়েদের হালও কি যথেষ্ট খারাপ নয়? সে কথাটা ভাবতে ভাবতে একবার নজর রাখা যাক আমাদের দেশের মেয়েদের বিয়ের গড় বয়সের দিকে। এখনও ২০-র নীচে। আর এটাই হয়ত মেয়েদের ফুটবলের উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বীরভূমের ব্রজসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল টিম জেলা, রাজ্য, এমনকি আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতা থেকেও বিস্তর পুরস্কার এনে চলেছে। স্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক এবং টিমের কোচ মলয় সেন বলছিলেন, যদি ধরে রাখতে পারতাম, এরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত। সামনে প্রশস্ত ফুটবল মাঠে ব্রজসুন্দরী হাই স্কুলের ছাত্রীরা তখন নিজেদের মধ্যে হলুদ আর সবুজ জার্সির দুটো টিম বানিয়ে মহাস্ফূর্তিতে খেলছে প্র্যাকটিস ম্যাচ। বল নিয়ে আগুয়ান ফরোয়ার্ডকে বিপক্ষের ডিফেন্স ধরে ফেলার উপক্রম করতেই এক পার্শ্ববর্তিনী চিৎকার করে সাবধান করে দিচ্ছে – ‘পেছনে ম্যান, পেছনে ম্যান’। শীতের বিকেলের নরম আলোয় তৈরি হচ্ছে ম্যাজিক রিয়্যালিটি। কিন্তু সে সব কথা যথা সময়ে।
মেয়েদের ফুটবল নিয়ে কথা হবে আর সুশীল ভট্টাচার্যের নাম উঠবে না, সে হয় না। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ তিনি যখন ইস্টবেঙ্গলে রাইট ইন বা লেফট ইন খেলেছেন, তাঁর পাশে তখন আপ্পারাও, ভেঙ্কাটেশ, ধনরাজ, সোমানা, আমেদ খানরা। খেলেছেন ভারতের হয়েও। খেলোয়াড় জীবন শেষ করেই শুরু করেছিলেন কোচিং, বাঘা সোমের সহকারী হয়ে ইস্টার্ন রেলে। কয়েক বছর পর তিনি ইস্টবেঙ্গলের প্রথম পেশাদার কোচ। তাঁর কৃতি শিষ্য-তালিকা পিকে, বলরাম থেকে সুভাষ ভৌমিক, কৃশানু দে ছাপিয়ে বেশ লম্বা। ১৯৭৫ সালে যখন উইমেন্স ফুটবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া তৈরি করে মেয়েদের ফুটবলের প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হল, তখন সুশীল ভট্টাচার্যকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রথমে বাংলা, তারপর ইন্ডিয়ার জন্যে টিম বেছে নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার। এইভাবেই শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার, মিনতি রায়, শুক্লা দত্ত, জুডি ডিসিলভাদের খুঁজে পেয়েছিলেন সুশীলবাবু। ১৯৯১ পর্যন্ত মহিলা ফুটবল টিমের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি, আর তাঁর ছাত্রীরাও তাঁকে নিরাশ করেননি। ১৯৮০ সালে কালিকটে যে প্রথম এ এফ সি উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছিল, তাতে রানার্স আপ হয়েছিল সুশীল ভট্টাচার্যের মেয়েরা, পরের বছর তৃতীয়, ১৯৮৩ সালে আবার রানার্স আপ। পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন শান্তি মল্লিক। সুশীল ভট্টাচার্যকে অবশ্য আমরা দিব্যি ভুলে গিয়েছি।

মেয়েদের ফুটবলের সাফল্য আর সম্ভাবনা বিচার করে নব্বই দশকের গোড়াতে উইমেন্স ফুটবল ফেডারেশনকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এ আই এফ এফ)-এর সঙ্গে। কারণ, ফুটবলে তখন টাকাপয়সা ঢুকতে শুরু করেছে, স্পনসর আসছে, ফেডারেশন কাপে খেলা সব ক্লাব লক্ষ লক্ষ টাকার চুক্তি করছে খেলোয়াড়দের সঙ্গে। সুশীল ভট্টাচার্য ততদিনে অবসর নিয়েছেন। মেয়েদের ফুটবল অভিভাবকহীন। আশা করা হয়েছিল, এ আই এফ এফ-এর আওতায় এলে কিছু সুযোগ-সুবিধের মুখ দেখবে মেয়ে ফুটবলাররা।
হা হতোস্মি, হল ঠিক তার উল্টোটা! তখনকার কর্তারা মেয়েদের ফুটবল ব্যাপারটাকেই ভুলে থাকতে চাইলেন। ১৯৮৮ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একটানা এ আই এফ এফ-এর সভাপতির গদিতে বসেছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। মেয়েদের ফুটবল তখন তলানিতে পৌঁছেছিল। ১৯৯৮-এর এশিয়ান গেমসে চিনের কাছে ১৬ গোল খেয়েছিল ভারত, একটিও গোল না দিয়ে। তাতেও কারও কোনও হেলদোল নেই। ২০০৩ সালে শেষবার এশিয়ান গেমসে খেলেছিল ভারতের মেয়েরা, সেবারও চিনের সঙ্গে খেলার ফল ১২-০। মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবল বা অলিম্পিক ফুটবলের মূল পর্বে খেলা এখনও অধরা স্বপ্ন। হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে ২০২২ সালে মেয়েদের আন্ডার সেভেন্টিন বিশ্বকাপ হিসেবে আনার দরকার নেই।

ভারতে মেয়েদের ফুটবলের হাল দেখে ২০০৯ সালে ফিফা তাদের ক্রমতালিকা থেকে ভারতকে ছেঁটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভাগ্যিস নেয়, কারণ মেয়েদের ফুটবলে এই ধাক্কাটা ভারতের খুব দরকার ছিল। তারপর সাফ গেমসে মেয়েদের ফুটবল অন্তর্ভুক্ত হয়, ভারত সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং আস্ত একটা বছর পর ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল আবার ফিফা-স্বীকৃত তালিকায় ফেরে। শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দলই নয়, ভারতের সিনিয়র মেয়েদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হল এ বছর আম্মানে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে জর্ডানকে ১-০ হারানো, মিশরকে ১-০ হারানো। এ আই এফ এফ এখন চারটি স্তরে মেয়েদের ফুটবল আয়োজন করছে– সিনিয়র টিম, আন্ডার ১৯, আন্ডার ১৭, আন্ডার ১৫ এবং আন্ডার ১৫। সিনিয়র মেয়েদের ফুটবলে এখন আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতা হচ্ছে, হিরো মোটরসের মতো স্পনসর পেয়েছে জাতীয় পর্যায়ের ক্লাব প্রতিযোগিতা ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য খেলো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি গেমস হচ্ছে, স্কুলের মেয়েরা খেলছে সুব্রত কাপ।
তাতে বাংলার জায়গা কোথায়? দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হবে। সিনিয়র ভারতীয় দলে বাংলার কেউ নেই। থাকার কথাও নয় বোধহয়। মেয়েদের ফুটবলে আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতা যখন শুরু হয়েছিল, সেই ১৯৯১ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলা, রানার্স আপ মণিপুর। পরের বছর বাংলা রানার্স আপ, মণিপুর চ্যাম্পিয়ন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মণিপুরের দাপট অব্যাহত। প্রতিযোগিতা হয়েছে এ পর্যন্ত মোট ২৬ বার, তার মধ্যে মণিপুর জিতেছে ২১ বার। বাংলা মোটে ২ বার। তবে ১৩ বার ফাইনালে উঠে হেরেছে বাংলা, শেষ বার যদিও ২০১০ সালে! পরের ১২ বছর ধরে বাংলা খোঁড়াচ্ছে। এই বছরের ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগ জিতেছে গোকুলম কেরালা এফ চি। লিগের ১৫টি দলের মধ্যে বাংলার টিম একটাই– দার্জিলিঙের সীমা সুরক্ষা বল, সংক্ষেপে এস এস বি। কন্যাশ্রী কাপ চ্যাম্পিয়ন দলটি এবারের লিগ তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে। তবে এ বছর খেলো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলার মেদিনীপুর বিশ্ববিদ্যালয়। মুগলি হেমব্রম, সিংগো মুরমু, নিকি ওঁরাও, মুগলি সোরেনরা এখন ওয়রল্ড ইউনিভার্সিটি গেমসে খেলতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।

ফেরা যাক বাহিরির ব্রজসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। মেয়েদের বেশ কিছুক্ষণ বল নিয়ে নানারকম কসরত শিখিয়ে প্র্যাকটিস ম্যাচ চালু করে একটা চেয়ারে এসে বসলেন মলয় সেন। বয়স ৫৫, যেটা নিজের মুখে না বললে আন্দাজ করা অসম্ভব। অল্প বয়সে নানারকম খেলায় মেতেছেন, কিন্তু ফুটবল আগাগোড়াই তাঁর প্যাশন। স্বপ্ন ছিল কলকাতার ক্লাবে লিগ খেলা, কিন্তু পড়া আর চাকরির ফাঁদে পড়ে সেই লক্ষে বিশেষ এগোতে পারেননি। বলছিলেন, “নিজে যেটা পারিনি, সেটাই এই সুরঞ্জনা লোহার, পূজা থান্দার, খুশি লোহার, খুশি মাঝি, বৃষ্টি থান্দার, পুজা দাস, পৌলমী থান্দারদের দিয়ে পূরণ করতে চাই। কলকাতায় ক্লাব লিগ খেলবে, রাজ্যের হয়ে, দেশের হয়ে খেলবে। সে ইচ্ছে খানিকটা সফল হয়েছে। বাহিরি ব্রজসুন্দরীর মেয়েরা বেশ কয়েকবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, বোলপুর আথলেটিক্স অ্যান্ড কালচারাল ক্লাবের হয়ে তারা কন্যাশ্রী কাপেও খেলে এসেছে। কলকাতার লিগে সুরুচি সঙ্ঘে খেলছে আমাদের তিনটি মেয়ে। জেলায় বসে এর বেশি কিছু এখনও করে উঠতে পারিনি। পারব কী করে? উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু পরিবার মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেয় না। আমাদের ৩০টি মেয়ের মধ্যে একা রুমা চক্রবর্তী উচ্চবর্ণের হিন্দু। বাকি সবাই এসসি, এসটি, ওবিসি। দৌড়ঝাঁপের খেলা ফুটবল খেলতে হলে যতটা খাবার, যত প্রোটিন, যত নিউট্রিশন দরকার, তা জোগাবার সাধ্য আছে এদের মা-বাবার? আমরাও বিশেষ কিছু পারি না। বুট, জার্সি, শিনগার্ড আর বল জোগাতেই আমাদের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবসর নেওয়ার সময় কিছু দিয়ে যান। জেলা শহরের খেলার সরঞ্জামের দোকানে হাত পেতে জার্সি আর বুট জোগাড় হয়। কলকাতায় টুর্নামেন্ট খেললে মেয়েদের দু-পাঁচ হাজার টাকা দেয়। জানি না এই করে কদিন চলবে! তবু মেয়েরা ফুটবল খেলছে। হাতে নগদ টাকা আসবে বলে প্র্যাকটিসে না-এসে মাঠে ধান কাটতে যাচ্ছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে, বারবার ফোন করে আবার ধরে আনছি। কিন্তু আমিই বা আর কদ্দিন? পাঁচ বছর পরে তো রিটায়ার করব। তারপর?” গলা বুজে আসে জীবন্ত খিদ্দা মলয় সেনের। “অথচ”, গলা ঝেড়ে যোগ করেন তিনি, “যদি ধরে রাখতে পারতাম, অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত এই মেয়েগুলো। কিন্তু তার উপায় কী? যেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল, অমনি বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুর হয়ে গেল। খেলাটা সবে আয়ত্তে এসেছে, পায়ের সঙ্গে মাথাও কাজ করছে, চলে গেল খেলা ছেড়ে সংসার করতে। যে কটা পড়ে রইল, তারাও কলেজ শেষ করল কী করল না, একই অবস্থা। এদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নাই। জেলায় জেলায় মেয়ে ফুটবলারদের স্বপ্ন মাসে সাড়ে বারো হাজার টাকার মাইনের সিভিক পুলিস হওয়া। সেই দিকে তাকিয়ে কয়েক বছর খেলে, চাকরি জোটে না, খেলা ছেড়ে দেয়।”

কয়েক দিন পরেই বোলপুর শ্রীনন্দা গার্লস স্কুলের সামনে পাওয়া গেল ক্লাস নাইনের মঞ্জু ধীবরকে। তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে আগেই। সকালে ফুটবল প্র্যাকটিস করতে এসেছিল, এবার বাড়ি ফিরবে।
— মঞ্জু, তোমার বাবা কী করেন?
— মাছ বিক্রি করে।
— কোথায়? কোন বাজারে?
— বাজারে না, সাইকেলে মাছ নিয়ে ঘুরে।
— আর মা?
— দু-বাড়িতে রান্না করে। দু-বেলাই।
— এখান থেকে তোমার বাড়ি কত দূর?
— অনেক দূর, সে-ই খাসপাড়া।
— স্কুল না থাকলেও অত দূর থেকে তুমি রোজ প্র্যাকটিসে আসো?
— রোজ না, যেদিন ডাকে। ডাকলেই আসি। সাইকেল আছে তো। খেলা থাকলেও আসি। পরীক্ষার জন্যে একটা খেলা মিস করতে হল।
— অন্য দিন বুঝি পাড়ায় প্র্যাকটিস কর?
— না, করি না। বল নাই যে। ওখানে আমরা তিন জন মেয়ে ফুটবল খেলি। কারু বল নাই। আমার মা বলেছে বল কিনে দিবে। দিবে, কিন্তু দেরি হচ্ছে। বল পেলে আমার ছোট ভাইটাকেও নিয়ে খেলব।
— বল নেই যখন, তখন ফুটবল কেন? অন্য খেলাও তো খেলতে পারো। ধরো, কবাডি?
— সে কোথায় খেলা হয়? আমি জানি না। আমি ফুটবল খেলব। স্যার বলেছে, তুই ভালো খেলিস, খেলে যা। আমি যখন অন্য টিমের ম্যানকে কাটিয়ে বেরিয়ে যাই, গোল করি, সবাই হাততালি দেয়, স্যারও দেয়। খুব মজা লাগে। আমি ফুটবলই খেলব।
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।