আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] []

এখানে সবুজ সাপ শুয়ে আছে

 

‘কবিতার ফানুস তুমি এই ফোঁপরা ধোঁয়ার শহরে, কুচুটে মফস্সলে, সরল সবুজে
বৃথাই খুঁজো না আর, আলোর উৎস থেকে বহুদূরে নৈশ সড়কে
কবিতার চেরা-জিভ হাওয়ায় রেখেছে তার বিষ-ফণা, হলুদ-ছোবল। বিষ-ফুল
                                                                           হাতে নিয়ে
যে যার তাঁবুর পাশে তার সব প্রেমিকারা রূপহীন, ঘ্রাণহীন ঘুমিয়ে পড়েছে…’

—প্রজিত জানা

বইমেলা আসে। আমরা রোগা কবিলেখকের দল ধুলো মেখে ঘুরে বেড়াই। বড় স্টলে পারতপক্ষে পা দিই না। অন্য কারণ ছাড়াও, ভীষণ ভিড়। আমরা গুপ্তঘাতকের চোখে খুঁজে ফেলি লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল। সেখানে গেলে চেনাজনের আলিঙ্গন মেলে। হয়ত চা। সঙ্গে বড় প্রকাশনের গুষ্টির তুষ্টি নাশ হয়। শাণিত জিভের অসিচালনায় মুহূর্তে নস্যাৎ হয় বেস্টসেলার। আমরা আড়চোখে দেখে নিই বন্ধুর পাতলা দুই ফর্মার বই কত বিক্রি হল। ঈর্ষালতা আমাদের বুকে ছলবলায়— পঞ্চাশ কপি বেরিয়ে গেল, পুশ সেল করল না কি? চেনাজন পুরস্কার পেলে তো কথাই নেই। চা খেতে খেতে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াই আমরা। রসিয়ে বৃত্তান্ত দিই, কোন ক্ষমতাবান সাহিত্যিকের ব্যাগ কতটা ভারী ছিল পুরস্কারপ্রাপ্ত বন্ধুর হাতে। আড্ডায় উপস্থিত হন একদা নির্জনে থাকা গদ্যকার, নিজেকে লিটল ম্যাগাজিনের ধারক বলে পরিচয় দেওয়া কবি। তাঁদের তিরতিরে হাসি আমাদের রসনাগরলে অনুমোদন দেয়। হয়ত তাঁরাও মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন— আমাকে কি দিতে পারত না ওরা? আমাকে কি ভুলেই গেল সকলে? অবসোলেট হই ক্ষতি নেই, কিন্তু ইররেলিভান্ট হয়ে গেলাম? আবার প্রতিষ্ঠানকে ধুইয়ে দেওয়া বন্ধুই আগস্ট মাসের ফেসবুকের পাতায় বিজ্ঞাপন দেন, অমুক বিগ হাউজের শারদ সংখ্যাতে তাঁর লেখা বেরচ্ছে। ইররেভারেন্স আড়ালে মুচকি হাসে। তাতে বেদনাছায়ার প্রলেপ ছিল না।

kolkata book fair
আমরা রোগা কবিলেখকের দল ধুলো মেখে ঘুরে বেড়াই

হ্যাঁ, লিটল ম্যাগাজিন হোক বা তাদের উদযাপন, সৃজনের সঙ্গে ঈর্ষার হরগৌরী মিলন এখানে চিরকালীন। কফি হাউসে বসে বিদ্রোহীর গোপন সংকেত আমরা পড়ে ফেলেছি—আমার চিঠি কি এল সাদা বাড়ি থেকে? আমরা দেখেছি অনুজের প্রতিষ্ঠায় অগ্রজের ঈর্ষার চোরাস্রোত। যে নিয়মে পত্রিকাদের ভেতর অলিখিত পাঁচিল ওঠে, এক পত্রিকার প্রকাশ অনুষ্ঠানে ডাক পান না অন্য পত্রিকার লেখকদল, সে ইশারার ষড়যন্ত্র আজ আমাদের করায়ত্ত। তাই লিখতে এসে কিছুদিনের মধ্যে আমরাও বুঝে যাই, কোন সাহিত্যিকের সামনে কোন পত্রিকার প্রশংসা করা চলে না,  অথবা নানা ভাগে বিভক্ত বইমেলার আড্ডাকে উত্তেজিত দলতন্ত্রে নিষিক্ত করতে গেলে ঠিক কার নিন্দে করা উচিত। এভাবে আমরা শিক্ষিত হই এবং আমাদের ভাণ্ডার ভরে চোরাগোপ্তা আয়ুধে। তার ফলায় বিষের জোগান দিয়ে চলে বিষণ্ণ সব অতিকথা— অমুক লেখক সারাজীবন নিভৃতে থেকে লেখার তপস্যা করে গিয়েছেন। তমুক সম্পাদক পত্রিকা বার করতে গিয়ে নিজের রক্ত বিক্রি করেছিলেন। বাণিজ্যপত্রিকার আহ্বান হেলায় ফিরিয়ে রক্তহিম কবিতাটি কবিতা ক্যাম্পাসে দিয়েছেন তমুক কবি। অতিকথা, প্রবাদ, গল্পগাছা, আড্ডা, কথকতা, কথকতা, কথকতা—আমাদের ঘিরে গড়ে ওঠে এক অলীক গোষ্ঠীর পরিবৃত্ত, যা আমাদের গোপনে রক্তাক্ত করে। সমবেত ঈর্ষা, দলাদলি ও কানাকানি পেরিয়ে আমরা আদতে সেই পরিবৃত্তের মোহে পড়ে যাই, অথবা সে কারণেই হয়ত ভাবি আমরা সকলে, এই পক্ষ ওই পক্ষ সবাই আসলে একটা লড়াইয়ের অংশীদার, অভিপ্রায় আলাদা যদিও। বিগ হাউজের মনোপলির বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই, যাতে আমরা সৎ এবং ওরা ধান্দাবাজ হয়েও নিজেদের মত। আর এভাবেই ক্যাম্পগঠনের দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের অতিকথাকে পল্লবিত করে। নিরীক্ষামূলক সৃষ্টি টিকে থাকে শুধুমাত্র নিখাদ আদর্শ সম্বল করে, এমন অ্যাসাম্পশন খারাপ উপন্যাসের পাতা ছাড়া অন্য কোথাও মিলবে না। বিকল্পকে বাঁচতে গেলেও দরকার হয় জীবনরসদ। গরগরে কেচ্ছা, হিংসে, দলাদলির ঝালতরকারি। বিগ হাউজকে নিন্দে এবং প্রতিষ্ঠানধন্য সাহিত্যিকের শ্রাদ্ধ চেনা ছক। কিন্তু তাদের বাইরেও অন্তঃস্রোত হয়। আন্তর্দলীয় সংগ্রাম ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি বাঁচে না, কথাটা কি ট্রটস্কি বলেছিলেন? লিটল ম্যাগাজিন সে অভিন্নে উজ্জ্বল।

তার মানে কিন্তু এই নয় যে প্রতিজ্ঞা ছিল না। আমরা দেখেছি চোয়ালচাপা লড়াই। হারতে হারতেও শেষবারের মত ঘুরে ইয়াহু বলে চিৎকারের বাসনা। অসামান্য সব লিটল ম্যাগাজিন গত দুই দশক ধরে বেঁচে থেকে ও মরে গিয়ে আমাদের পুষ্ট করেছে। দাহপত্র, অনুবর্তন, মাঝি, তীব্র কুঠার, ছাতিমতলা, জিরাফ, অহিরা, সুন্দরবন সংস্কৃতি-পত্র, লোক, নীললোহিত, মল্লার, পর্বান্তর, উবুদশ, একলব্য, দশমিকের মত কাগজ যে আমাদের ভাষায় বেরিয়েছে, এটুকুই গর্বিত হবার জন্য যথেষ্ট। এদের কেউ সাড়ম্বর, কেউ ক্লান্ত, কেউ বা মৃত। যেরকম হয়ে এসেছে গলিয়াথ-বিরোধী ইতিহাসে। কিন্তু আমরা যা বুঝেও বুঝি না, এগুলোও জীবন, এবং এগুলোই জীবন। সেখানে শুদ্ধতার আশা আর্মচেয়ার তাত্ত্বিক করতে পারেন। কিন্তু রাজনীতির মত এখানেও ফড়ে-দালালদের ছায়াপুঞ্জ আকাশ ঘোলাটে করে, তাদের হাত ধরে স্বপ্নদর্শী কিশোর হাঁটে। তার পকেটভর্তি বোমা নিয়ে। শ্রেণিঘৃণা বদলে যায় ভ্রাতৃঘৃণায়। চোয়ালচাপা সংকল্পের নীচে লুকনো লোভী দীর্ঘশ্বাসের আখ্যান আমরা প্রাণপণে অস্বীকার করেছি।

Little mag pavilion
লিটল ম্যাগাজিন হোক বা তাদের উদযাপন, সৃজনের সঙ্গে ঈর্ষার হরগৌরী মিলন এখানে চিরকালীন

মনে পড়ে শুরুর দিককার একটা ঘটনা। বইমেলার আড্ডায় এক প্রবীণ লেখক জানালেন, আমার একটা গল্প অমুক পত্রিকায় বেরচ্ছে। আমি তাতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, তাই নাকি? আমারও ওখানে একটা বেরবার কথা, ওই সংখ্যাতেই। কথাবার্তা মিটে গেল। কিছুদিন পর সম্পাদকের ফোন— ‘করেছ কী? তুমি নাকি (…)দা-কে বলেছ যে— দেখুন, আপনার গল্পের সাথেই আমার গল্পও যাচ্ছে! (…)দা রেগে ফায়ার, আমাকে বলছেন ওর স্পর্ধা হয় কী করে এমন কথা বলার? ওইটুকু ছেলে, ও কি ভেবেছে আমার সঙ্গে একাসনে বসবে? তুমি এসব কেন বলতে গেছ (…)দা-কে?’

ঘটনা হল, সেই লেখকের সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠা, ত্যাগ, নিরীক্ষামূলক সাহিত্যচর্চার প্রতি কমিটমেন্ট কিন্তু একশো শতাংশ খাঁটি ছিল। বহু কেন, লেখালেখির প্রায় সব ক্ষেত্রেই আপোষহীন ছিলেন তিনি। এবং তার পরেও রথের চাকা মাটিতে গেঁথে গেল তাঁর। এটাও হয়, কারণ জীবন এটাই। কেন এরকম হবে, কেন সবাই মহাকাব্যের চরিত্রদের মত শ্বেতবস্ত্রের অধিকারী হবে না, সে প্রশ্ন করার মানেই হল লিটল ম্যাগাজিনের জগৎকে আপনি বোঝেননি। এগুলো ছাড়া ছোট কাগজ বাঁচবে না। বাঁচবে না কমিটেড লেখকের প্রতিজ্ঞাও।

তাই অবাক হবেন না, যদি দেখেন বইমেলাতে নানা কিসিমের সাহিত্য অনুষ্ঠানের ভিড়ে বাঁকা চোখের ইশারা। যদি দেখেন, প্রত্যেক কবি লেখকই নিজের বইটা হাতে করে এসে নিজের কবিতা বলে বেরিয়ে যাচ্ছেন, দাঁড়াচ্ছেন না অপরের কবিতা বা গল্পটি শুনতে, অথবা ভক্ত কিশোর পেয়ে নিজের বইটি গছিয়ে দিচ্ছেন অনায়াসে, হয়ত বা পারস্পরিক বই বিনিময়ও হচ্ছে, এবং তারপর উদাসমুখে অনুষ্ঠানের মাঝেই কাজের বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সাহিত্যিককে দু মিনিট পরে অন্য কোথাও আড্ডা দিতে দেখলে অবাক হবেন না। না, আমি বড় প্রকাশনা সংস্থার বিগ বাজেট অনুষ্ঠানগুলোর কথা বলছি না, যেগুলো অডিটোরিয়াম ভাড়া করে হয়। আমি বলছি ছোট প্রকাশনাগুলোর কথা, যাদের বেশিরভাগই পত্রিকা করতে করতে প্রকাশনায় রূপান্তরিত হয়েছে নিজেদের ও বন্ধুবান্ধবদের বই বার করবার উদ্দেশ্যে। তারা খোলা মাঠে, নিজেদের টেবিল বা ছোট স্টলের ভেতর, বড়জোর আধ ঘণ্টার জন্য মঞ্চ ভাড়া করে অনুষ্ঠান করে। সেখানে ভিড় জমান কলকাতা ও মফস্সলের সফল অসফল কবি সাহিত্যিকের দল। উদাসমুখে তাঁরা চায়ে চুমুক দেন। নিজেদের ভক্তবৃন্দের ছোট ছোট দল বানিয়ে এদিক ওদিক গল্প করেন। তারপর নিজেদের নাম ঘোষণা হলে স্টেজে গিয়ে পড়ে আসেন নিজের লেখাটি। তারপর? আড়চোখে দেখে নেওয়া বাকি বক্তা কারা এবং ওজনে কত ভারী। তারপর সুযোগ বুঝে বেরিয়ে যাওয়া। এগুলো দেখলে বিস্মিত হবার, ক্রুদ্ধ হবার পরিবর্তে মনে রাখবেন, এক সার্বিক অতিকথার পরিবৃত্তের নগরীর কোল ঘেঁষে বাঁচে ব্যক্তিগত অসাফল্য, নীচতা, ঈর্ষা ও বিষাদের ছায়াময় মফস্সল।

tea stall
উদাসমুখে তাঁরা চায়ে চুমুক দেন

তবু বইমেলা আসে। আমরা রোগা কবিলেখকের দল একা ঘুরি। বড় স্টলগুলোতে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। প্যাভিলিয়নের টেবিল, মাঠ, ফুটপাতের ধারে যেখানে লুকিয়ে চুরিয়ে সিগারেট খাওয়া যায় আর পুলিশ না দেখার ভান করে, মাঝে মাঝে ভাগিয়েও দেয়, সেসব জায়গা ভাল লাগে আমাদের। আমরা আবার লিটল ম্যাগের টেবিলে যাই, খুঁজি ভাল লেখা। ঈর্ষাকাতর হই, ভুলেও যাই তারপরে। কেউ আমাদের চেনে না, যে দুচারজন পাঠক আছেন, তাঁরা জানেন না আমরা কোথায়। আমরাও চিনি না কাউকে। ছোট ছোট ক্লাস্টারে আড্ডা মারতে গিয়ে নামহীন অপরিচয়ের বিষাদ থেকে বেরবার চেষ্টা করি। নিজেকে বোঝাই, এই মুষ্টিমেয় সহচরই আমার জাদুকাঠি, তাঁরা প্রণম্য। আমরা কেউ জিততে আসিনি এখানে। সবুজ চোখের ইঙ্গিতে অভিভূত আমরা, মিথ্যে উচ্চাশার ভানে আত্মকৌতুকী আমাদের অমেধাবী বোকা লেখালেখির দল কখনও একদিন গুদামের ড্যাম্পধরা অন্ধকার মেঝের কারাগার থেকে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর।

এবং আবারও বইমেলা আসে। পাশাপাশি টেবিলে বসে আমরা আড়চোখে দেখে নিই অপরের সম্ভার। বাঁকা হাসি নিজেদের মধ্যে। কানাকানি করি, বিখ্যাত কবির ফ্ল্যাটে গিয়ে কতক্ষণ ধরনা দিয়েছিল ওই সম্পাদক। ওই ছেলেটা ফেসবুকে কবিতা লিখত না? তার বইও বার করেছে এরা? স্ট্যান্ডার্ড আর কিছু রাখবে না দেখছি! আর ওই মধ্যবয়স্ক স্কুলটিচার কবি? ও তো মণীন্দ্র গুপ্তর কোনও গদ্য না পড়েই সেদিনকার আড্ডায় খুব ফটরফটর করছিল। কিন্তু তখনই, কেচ্ছাখামারির মাঝেই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম ওদের টেবিলে এতক্ষণ ডিউটি দেওয়া মেয়েটা উঠে চা খেতে যাবার ফাঁকে হতাশ ক্রেতা এসে ফিরে যাচ্ছেন। তখন দৌড়ে গিয়েছিলাম। স্বতঃপ্রণোদনায় বিক্রি করে দিয়েছিলাম সেই ফেসবুক কবির বইটা। নিজের রশিদে লিখে রেখেছিলাম, ওরা এলে হিসেব তুলে নেবে।

ভ্রাতৃপ্রেম আর ভ্রাতৃদ্রোহ হাত ধরাধরি রাস্তা হাঁটছে।

 

ছবি সৌজন্য: Wikimedia commons, Needpix.com.

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *