শুধু এ দেশের নামকরা রাজনীতিবিদ নন, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ, দূরদর্শী। নামকরা ব্যারিস্টার বাবার সন্তান। পণ্ডিত রাশভারী এই মানুষটাই আবার শিশু হয়ে যেতেন কচিকাঁচাদের সঙ্গ পেলে। শিশুদের কাছে তাঁর একটাই পরিচয়- ‘চাচা নেহেরু’… হ্যাঁ, কথা হচ্ছে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে নিয়ে, যাঁর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর তারিখটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে শিশুদিবস হিসাবে, এ দেশের শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রসংঘের তরফে এক ঘোষণায় ২০ নভেম্বর তারিখটিকে ‘শিশু দিবস’ হিসাবে পালন করার কথা বলা হয়। এর পিছনে কারণ হিসাবে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভৎস ও বেদনাদায়ক স্মৃতি। মহাযুদ্ধের দগদগে ঘা তখনও শুকোয়নি। এশিয়া, আফ্রিকা সহ গোটা বিশ্বে এই যুদ্ধের বলি হয়েছিল লক্ষাধিক নিষ্পাপ শিশু। অসুস্থ, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যাও ছিল কয়েক হাজার। সেই অসহায় বিপর্যস্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ কল্যাণ তহবিল (UNICEF)।

নভেম্বর মাসের ২০ তারিখটি বিশ্বব্যাপী ‘শিশুদিবস’ হিসাবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকে ভারতেও ওই বিশেষ দিনটিকেই শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হত। স্বাধীনতার পরেও সেই নিয়মই চালু ছিল। ১৯৬৪ সালের মে মাসে মৃত্যু হয় স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর। বাচ্চাদের সঙ্গ বরাবরই ভালোবাসতেন নেহেরু। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘একটি শিশুই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তারাই দেশের আলো, তারাই একদিন আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে’। তাই তাঁর মৃত্যুর পর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে উপযুক্ত সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে একটি বিল পাস করা হয়। তাতে বলা হয়, ১৪ নভেম্বর নেহেরুর জন্মবার্ষিকী এবং শিশু দিবস দেশে একই সঙ্গে পালন করা হবে। 

nehru with children
বাচ্চাদের সঙ্গ বরাবরই ভালোবাসতেন নেহেরু

মূলত শিশুদের পড়াশোনা ও সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই পালন করা হয় শিশু দিবস। শিশুরা যাতে নিশ্চিন্তে, নিরাপদে তাদের পূর্ণ শৈশব উপভোগ করতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়েই এই উদযাপন। কিন্তু যাদের নিয়ে এত কথা এই ২০২২ এ দাঁড়িয়ে তাদের অবস্থান ঠিক কেমন এ দেশে? এই প্রশ্নের উত্তরে অপেক্ষা করে আছে এক তিক্ত সত্যি। আজও আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকে এদেশের হাজার হাজার শিশু। অসুখ আর অপুষ্টির বলি হয়। বলি হয় আশ্রয়হীনতারও। মাথার নীচে ছাদের অভাবে বস্তি বা দোকানের ছাউনির নীচে, রেলস্টেশনের ধুলোয় নষ্ট হয় হাজার হাজার শৈশব। শিক্ষার অধিকার তো দূর, দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে করতেই মুছে যায় শৈশবের দিন। আজও প্রতিদিন শিশুশ্রম, শিশুপাচার ও শোষণের শিকার হয় পথশিশুরা। নানান নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে শৈশব থেকেই। যৌন হেনস্থার শিকার হয়। শিশুশ্রমের সমস্যা দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই ছিল, আছে। কিন্তু কোভিড পরবর্তী বিশ্বে তা যেন আরও মারাত্মক চেহারা নিয়েছে। একটি পরিসংখ্যান মতে, কোভিড ১৯ এর পরে এশিয়া মহাদেশের প্রায় ৮০ কোটি শিশুর শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে, যার একটা বড় অংশই ভারতীয়। এই স্কুলছুটের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই ফুলেফেঁপে উঠবে শিশুশ্রম কেনাবেচার বাজার।

street children
স্কুলছুটের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই ফুলেফেঁপে উঠবে শিশুশ্রম কেনাবেচার বাজার

এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে ‘শিশুদিবস’ শব্দটির প্রাসঙ্গিকতা অনেকটাই বদলে গেছে, বলাই বাহুল্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর শিশু অধিকারের ক্ষেত্রগুলোতে আজও পিছিয়ে আমাদের দেশের শিশুরা। ইউনিসেফ ইন্ডিয়া রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে, অতিমারি চলাকালীন স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে স্কুলছুটের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি ২৮ কোটি ৬০ লক্ষ শিশুর শিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ‘শিশুদিবস’ নিছক উদযাপনের দিন নয় আর, এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে এক নতুন শপথ নেওয়ার দিন। এ বিশ্বকে শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার পিছনে তার অভিভাবকের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি মানুষের সদিচ্ছা দরকার। 

* ছবি: Flickr, Needpix.com

banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *