-ভাই, আমাকে এই কটা ওষুধ একটু এনে দিবি রে?
-জি, দাদি…
এক তলার জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকা আর ওষুধের ফর্দটা সুমিতা ইস্ত্রিওয়ালার ছেলেটাকে দিয়ে দিল। ছেলেটার নাম বাবুয়া। বয়স দশ বছর। বাড়ি বিহারের পূর্ণিয়া জেলায়। তার বাবার এই হাউসিং কমপ্লেক্সে একটা অস্থায়ী ইস্ত্রির দোকান আছে। ঠিক করোনার শুরুর আগে, বাবা দেশের বাড়ি গেছিল। ট্রেন, বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর ফিরে আসতে পারেনি। বাবুয়া তাই এখন একাই থাকে। ছোট্ট ইস্ত্রির চৌকিটার উপর শোয়। ভারী লোহার ইস্ত্রিটা দিয়ে ভালো করে ইস্ত্রি করতে পারেনা। তারপর উনুন জ্বালানোর সমস্যাও আছে। এমনিতেও করোনার জন্য লোকেরা বাইরে বিশেষ ইস্ত্রি করতে দিচ্ছেও না। অতএব সে সব পাট চুকেছে। বাবুয়া এখন কমপ্লেক্সের বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাড়ির ধাউড়ে। সবার ফাই-ফরমাস খাটে। এর টুকটাক বাজার করে দিচ্ছে, ওর জল তুলে দিচ্ছে, কারুর ওষুধ এনে দিচ্ছে। পরিবর্তে কমপ্লেক্সের কেউ না কেউ ওকে দু’বেলা খেতে দেয়। তবে বাবুয়ার সঙ্গে সুমিতার একটু বিশেষ কাছের সম্পর্ক। সুমিতাও একা মানুষ। আজ একুশ বছর হল স্বামী গত হয়েছেন। একমাত্র ছেলে থাকে বম্বেতে। এই করোনা কালে, সুমিতাও তাই বাবুয়ার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া তার আর্থারাইটিসের ব্যথাটাও খুব বেড়েছে। গাঁটে গাঁটে ব্যথা। বাবুয়া মাঝে মাঝে গা, হাত-পা টিপে দেয়। সুমিতার বাইরের সব কাজই এখন মোটামুটি বাবুয়াই করে। সুমিতাও খুব স্নেহ করে এই দশ বছরের ছেলেটাকে। যেন সে তার লোকাল গার্জেন। সকালবেলা দু’জনে মিলে বসে একসঙ্গে চা খায়। সুমিতা খাটে বসে আর বাবুয়া মেঝেতে উবু হয়ে। সুমিতা চায়ের কাপে চুমুক দেয়। বাবুয়া গ্লাসে ফুঁ দিয়ে তারপর এক চুমুক দেয়। হিন্দি ভাষাটা ঠিক বোঝেনা সুমিতা। বাবুয়া বাংলা বুঝলেও, বলতে পারেনা। তবু তাদের মধ্যে কথা হয়।
– তোদের গ্রামে থাকাকালীন চা খেতিস না? – সুমিতা গল্পের অবতারনা করে।
-গাঁও মে তো হামলোগ দুধ পিতে থে। হামারা গাঁওমে, বহত্ সারি ভ্যাঁস হ্যায়। সুভা সুভা হাম সারে বাচ্চে লোগ সাত্তু খাতে থে আউর দুধ পিতে থে।
বাবুয়ার কথা সব না বুঝলেও, ওর হাত নেড়ে, অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলাটা বেশ উপভোগ করে সুমিতা। বাবুয়াকে একটা কাপড়ের করা মাস্ক তৈরি করে দিয়েছে সুমিতা। ঘরে মাস্ক না পরলেও, বাইরে যেন সর্বদা বাবুয়া মাস্ক পরে সেটা সুমিতা খুব জোর করে।
– বাইরের লোকেদের থেকে দুরত্ব বজায় রাখবি বুঝেছিস? আর মাস্কটা নাকের নীচে পরে লাভ কি? তোল, তোল, নাকের উপর তোল।
সুমিতার কড়া শাসনে বাবুয়া শুনতে বাধ্য হয়। সে সুমিতা কে দাদি বলে ডাকে। সুমিতা তাকে কখনও বাবুয়া, কখনও ভাই বলে ডাকে।
দুপুরে অধিকাংশ দিন বাবুয়া সুমিতার কাছেই খায়। যেদিন কমপ্লেক্সের অন্য কারুর বাড়িতে খেলো তো ঠিক আছে, না হলে তার বাঁধা আছে দাদির বাড়িতে আসা। সপ্তাহে একবার করে সুমিতার ফোনে বাবুয়ার খবর নিতে ফোন করে তার বাবা। সে ভালো বাংলা বলতে পারে। ফোনে জানায় যে সে গ্রামে আটকে পড়েছে। বাস চললেই চলে আসবে। সুমিতা আশ্বাস দেয় বাবুয়া ভালো আছে।
দুপুরবেলাটা বাবুয়া ইস্ত্রির চৌকিটার উপর শুয়ে কাটায়। হাউসিং কমপ্লেক্সটা বাইপাসের ধারে। কখনও কখনও হেঁটে গিয়ে সে বাইপাসের ধারে ফুটপাথে উবু হয়ে বসে থাকে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল দেখে। করোনার জন্য রাস্তায় মানুষ বা গাড়ির ভিড় কম। সিগন্যালে লাল ট্র্যাফিক লাইট জ্বললেই, রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে ওঠে। বাবুয়া গুনগুন করে তাল দেয় সে গানের সঙ্গে।
সন্ধেবেলা আবার সুমিতার একতলার বাড়িতে আসে। সুমিতা খাটের উপর বসে, টিভিতে একের পর এক বাংলা সিরিয়াল দেখে। বাবুয়াও মেঝেতে উবু হয়ে বসে তাই দেখে। ভাষা বিভ্রাটে খুব একটা বোঝার অসুবিধে হচ্ছে বলে মনে হয় না। একদিন হঠাৎ সুমিতা বলল,
– হাম তো হিন্দি মে আখবার পাড় সকতে হ্যা…
– শুধু হিন্দি নয়…ইংরাজিও শিখতে হবে। আর কলকাতায় আছিস, বাংলা অক্ষরমালাটা অন্তত শিখে রাখ। দোকান, বাজার করতে সুবিধে হবে। আর অঙ্কটা কেমন তোর?
-জি?
‘অঙ্ক’ শব্দটার সঙ্গে ঠিক পরিচিত নয় বাবুয়া।
– আরে বাবা, – যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ…অঙ্ক,…অঙ্ক জানিস না?
– ও…গণিত…ওহ ভি তো হাম জানত হ্যায়…নহি তো দুকান ক্যায়সে করতা হুঁ…
কিন্তু সুমিতা নাছোড়বান্দা। রীতিমত খাতা কিনিয়ে শুরু হয় সামান্য পড়াশুনো।
রোজ রাতে সুমিতার জন্য কমপ্লেক্সের গেট থেকে রুটি কিনে আনে বাবুয়া। সুমিতা দুটো রুটি বেশি আনতে বলে। সেটা বাবুয়ার জন্য ধরা থাকে। খাওয়ার পর সুমিতার মশারিটা টাঙাতে সাহায্য করে বাবুয়া। ইদানিং রাত্রে বাবুয়া ওই ঘরেই, মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে শুয়ে পড়ছে। সুমিতাই বলেছে। রাতে বাথরুমে যেতে সাহায্য করে বাবুয়া। অমাবস্যা, পূর্ণিমাতে পায়ের ব্যথাটা বাড়লে, বাবুয়াকে বলে একটু পা-টা টিপে দিতে। এইভাবেই চলতে থাকে।
আরও পড়ুন: মারি ক্যুরি এক অদম্য জেদের নাম
এর কিছুদিন পর করোনার বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হওয়াতে সুমিতার ছেলে, বউমা ও নাতি বম্বে থেকে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সুমিতার নাতির বয়সও দশ বছর। সুমিতা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বড় সংসার নিয়ে। বাবুয়া কিছুটা ব্রাত্য হয়ে পড়ে। এখন সে অধিকাংশ সময়টাই বাইপাসের ধারে ফুটপাতে কাটায়। বাস চলাচল সামান্য শুরু হলেও বাবুয়ার বাবা এখনও ফেরেনি। এদিকে বর্ষা নেমেছে। ইস্ত্রির ছোট চৌকিটায় বসে বাবুয়া এক দৃষ্টিতে বৃষ্টি পড়া দেখে। অঢেল সময় তার। উপরে কেবিল টিভির লাইনের কয়েকটা তার একটু ঢালু হয়ে থাকায়, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো একদিক থেকে অন্যদিকে কিরকম সার বেঁধে নেমে আসে, তা দেখতে ওর খুব মজা লাগে। তারপর যেই দু-তিনটে বিন্দু একত্রিত হয়ে ভারী হয়ে পড়ে, অমনি টপ্ করে মাটিতে পড়ে যায়। বাবুয়া সুমিতার কাছে শেখা বাংলায় গুনতে থাকে কটা বিন্দু একসঙ্গে হওয়ার পরে তা পড়ে যাচ্ছে। কখনওই চারের পরে আর গুনতে হয়না। হঠাৎ সে সম্বিত ফিরে পায় সুমিতার একতলার ঘরের হই-হট্টগোলে।
-দাদুভাই, ওরকম করেনা বাবা, মা বকবে খুব…জ্বর এসে যাবে বাবা…চলে এসো, চলে এসো বলছি…
বাবুয়া দেখে সুমিতার নাতি বারান্দার গেট খুলে বৃষ্টির জলে নেমে খুব লাফাচ্ছে আর মজা করছে। বোধহয় তার মা, বাবা কাজে বেরিয়েছে। ঠাম্মি আর দুরন্ত নাতিকে সামলাতে পারছে না। বাবুয়াও পাশে গিয়ে মুচকি হেসে দাঁড়ায়। সুমিতার নাতি জমা জলের উপর লাফিয়ে জল ছেটায় চারিদিকে আর মহানন্দে হেসে ওঠে। দেখাদেখি বাবুয়াও তাই করে।
-একা হনুমানে রক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব দোসর। তুই আবার এসে জুটেছিস বাবুয়া। ওরে দুটোরই যে জ্বর আসবে রে। এসো দাদুভাই ঘরে এসো বাবা। যা, বাবুয়া, যা তোর দোকানে ঢোক রে…
সুমিতা ব্যাপারটা আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে।
অবশেষে নাতিকে ঘরে ঢোকাতে পারে সুমিতা। পরম মমতায় চুল, মাথা মুছিয়ে দেয়। বাবুয়াও ফিরে যায় তার দোকানে। ভেজা জামাটা খুলে হাত দিয়েই চুল ঝেড়ে মাথা শুকোবার চেষ্টা করে। এক দৃষ্টিতে নাতিকে দেখে সুমিতা। ভালো লাগে তার দেখতে।
রোজ রাতে সুমিতার জন্য কমপ্লেক্সের গেট থেকে রুটি কিনে আনে বাবুয়া। সুমিতা দুটো রুটি বেশি আনতে বলে। সেটা বাবুয়ার জন্য ধরা থাকে। খাওয়ার পর সুমিতার মশারিটা টাঙাতে সাহায্য করে বাবুয়া। ইদানিং রাতে বাবুয়া ওই ঘরেই, মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে শুয়ে পড়ছে। সুমিতাই বলেছে।
আজকাল সুমিতার ঘরটা সারাক্ষণ গমগম করে। হাসি, ঠাট্টা, গানে যেন ভরে আছে। বাবুয়া দূর থেকে দেখে। তার বেশ ভালো লাগে। সবকিছুর বাইরে থেকেও যেন সে তার ভাগ পেয়ে যায়। দুপুরের খাওয়াটা অবশ্য এখনও সুমিতা ওর জন্য পাঠিয়ে দেয়। আজকাল অনেক পদের রান্না হয় বাড়িতে। টুকটাক করে সবই চেখে দেখার সুযোগ পায় বাবুয়া। দাদির ছেলে, বউমাও খুব ভালো। ওকে প্রায়ই এটা সেটা জিনিস দেয়। কিন্তু বাবুয়ার আর ওই বাড়িতে থাকা হয়না। পড়াশুনোও চুকে গেছে। টিভিও আর দেখা হয়না। আবার তার স্থায়ী ঠিকানা ইস্ত্রি ঘরের চৌকিটা।
কিছুদিন পরে সুমিতার ছেলে বউমা নাতি বম্বে ফিরে যায়। ওদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়ে। আবার বিধিনিষেধ জারি হয়। সুমিতা আবার কেমন যেন অসহায় বোধ করে। বাবুয়া আবার ফিরে আসে সুমিতার ঘরে। সুমিতা বুঝতে পারে সে বাবুয়ার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। পুরনো জায়গার ফিরে এসে বাবুয়ারও বেশ ভালোই লাগে। এই অসম বয়েসের সাহচর্য্য ক্রমশ অভ্যাসে পরিণত হয়। পাড়ায় সুমিতার নতুন পরিচয় হয় বাবুয়ার দাদি হিসেবে। মন্দ লাগে না তার। বেশ মজাই লাগে।
ভ্যাকসিন নেবার পর সুমিতার ধুম জ্বর আসে। বাবুয়া নাওয়া খাওয়া ভুলে দাদির সেবা করে। এই সময় সুমিতা একটু খিটখিটেও হয়ে গেছিল। তাতে অবশ্য বাবুয়া কিছু মনে করেনি। জল তুলে আনা, খাবার কিনে আনা, ওষুধ আনা সব সে করে। দাদির কাছে শিখে নিয়ে চা-ও বানিয়ে দেয় সে।
ধীরে ধীরে শহর স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে। বাস এমনকি কিছু ট্রেন চলাচল ও শুরু হয়। একদিন বাবুয়া বাজার করতে গেছে, এমন সময় সুমিতার কাছে বাবুয়ার বাবার ফোন আসে। এই অতিমারিতে তার দেশের বাড়িতে অনেক আত্মীয়-পরিজন মারা গেছে। সে আর কলকাতায় ফিরতে চায় না। দেশেই খেতি-বাড়ি করবে। ওদের গ্রামের একটি ছেলে ট্রাক চালায়। সে পরশুদিন কলকাতায় আসবে। তাকে ঠিকানা দেওয়া আছে হাউসিং কমপ্লেক্সের। সে গেলে বাবুয়া যেন নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে তার সঙ্গে ট্রাকে করে চলে আসে।
সুমিতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বাবুয়া চলে যাবে! চিরকালের মতন! তা কী করে হবে। না, না – তা হয় না। চটজলদি কিছু ভেবে না পেয়ে শুধু বলে,
– বাবুয়া তো এখন যেতে পারবে না।
– কেন? পারবে না কেন? কোথায় সে…ভালো আছে তো?
– আরে, বাবুয়া একদম ঠিক আছে। কিন্তু সে পড়াশুনো শুরু করেছে। আপাতত আমার কাছে পড়ছে। খুব শিগগির আমি ওকে কর্পোরেশনের স্কুলে ভরতি করে দেব। তখন অনলাইনে ক্লাসও শুরু হবে। আমার মোবাইল ব্যবহার করে ও ক্লাস করবে। পূর্ণিয়া গিয়ে ও কী করবে। ও এখন এখানেই থাক।
– আরে না, না, ওকে আর পড়তে হবে না ভাবিজি। বাবুয়ার মা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে, ছেলে অতদূরে একা আছে বলে। ওকে চলে আসতে বলুন।
– কী আশ্চর্য!
বিরক্ত হয়ে জোরে বলে ওঠে সুমিতা।নিজের গলাই কেমন কর্কশ শোনায় যেন। তবু নিজেকে থামাতে পারে না সুমিতা।
– মা অবুঝ হয়ে কাঁদছে বলেই ওকে চলে যেতে হবে! ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না? তোমরা কি চাও ও এরকম অনপড়-গাঁওয়ার হয়েই থাকবে চিরকাল। না, ও এখন যেতে পারবে না।
ফোন কেটে দেয় সুমিতা। কিন্তু শান্তি পায়না। ভীষণ অস্থির লাগছে। দিশেহারা লাগছে। কান্না পাচ্ছে। সে কি এত স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। নিজের সুবিধের জন্য সে একটা দশ বছরের ছেলেকে তার মা’র থেকে আলাদা করে রাখছে! নিজের উপর ঘেন্না হয় সুমিতার। ওদিকে বাবুয়া বাজার করে ঘেমে নেয়ে ফিরেছে।
– অভি আপকা কপড়া ধো দেতে হ্যায় দাদি।
বাথরুমে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে বাবুয়া। এক ধমক দেয় সুমিতা।
– না, তোকে কিচ্ছু করতে হবে না । তুই কি ভাবিস, তোকে ছাড়া আমার চলবে না। আমি আজ একুশ বছর একা আছি। আজও পারব।
বাবুয়া কিছু বুঝতে পারে না। চুপচাপ থাকে।
– দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ দেখছিস কি…বেরিয়ে যা…আমাকে একটু একা থাকতে দে।
বাবুয়া আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে হাঁটতে বাইপাসের ধারে গিয়ে বসে। হঠাৎ তার মা’র কথা খুব মনে হয়।
সন্ধ্যেবেলা সে আবার বাড়ি ফিরে আসে। দেখে দাদি চুপচাপ বসে আছে। ঘরে ঢুকতেই সুমিতা তাকে বলে,
-বাবুয়া, তোর বাবা ফোন করেছিল। তোর পূর্ণিয়া ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
সুমিতা সবকিছু বলে বাবুয়াকে। শুধু সে যে ফিরে যেতে বাধা দিয়েছে তা আর বলে না। বাবুয়ার মধ্যে বিরাট কিছু একটা ভাবান্তর দেখা যায় না। সে শুধু ঘাড় নাড়ে। কত অনায়াসে যেন অদৃষ্টের লিখন মেনে নিতে পারে এই শিশু বয়স। সুমিতাও ফোন করে বাবুয়ার বাবাকে জানায় যে সে ফিরে যাবে। মাফ চেয়ে নেয় সকালের রূঢ় ব্যবহারের জন্য। শুধু একটাই অনুরোধ। বাবুয়া কে যেন তারা কাছেপিঠে কোনও স্কুলে ভরতি করে দেয়। যদি কিছু টাকা লাগে, তাহলে সুমিতা দেবে।
– আরে কী যে বলেন, ভাবিজি। আপনার এহসান আমরা জিন্দেগিতে ভুলব না। এতদিন আপনি আমার বাবুয়া কে দেখলেন।
ফোন রেখে দেয় সুমিতা।
এবার অনেকটা হালকা লাগছে সুমিতার। বাবুয়াকে আদর করে ডেকে বলে,
– কাল সকালে আমি আমাদের জন্য একটু পোলাও রান্না করব। একটু বাসমতী চাল এনে দিস তো।
ফিরে যাওয়ার আগে সে বাবুয়াকে একটা ফোনও কিনে দেয়।
– এটা কিন্তু তোকে খেলা বা ভিডিও দেখার জন্য দিচ্ছি না। তোকে শিখিয়ে দেব কী ভাবে এর সাহায্য পড়াশুনো করতে হয়। নিয়মিত পড়াশুনো করবি। আর…আর…চাইলে,… কখনও আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলে আমাকে একটা মিস্ড কল দিস্। আমি তোকে ফোন করব।
হঠাৎ কী ভেবে দৌড়ে এসে দাদিকে জড়িয়ে ধরে বাবুয়া। সুমিতাও এই ছোট্ট হাতদুটো আঁকড়ে ধড়ে। দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে নেমে আসে জলের ধারা।।
ছবি সৌজন্য: Pxhere
‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এ নামেই প্রকাশিত হয়েছে “একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প" বইটি, যা পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছে। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।