নীতিশ মুখোপাধ্যায়। নাম বললে অনেকেই হয়তো চিনতে পারবেন না। একটু পুরনো দিনের মানুষ হলে গুলিয়ে ফেলবেন ওই একই নামে পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত অভিনেতার সঙ্গে। কারণ, নীতিশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেই বিরল গোত্রের মানুষ, যিনি বরাবর প্রচারের আলো সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন অন্তরালে থেকে, সৃজন করেছেন নিরলসভাবে, সুনিপুণ দক্ষতায়, মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী। সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা সন্দেশ-এর পাতায় তাঁর অলঙ্করণ নজর কাড়ত অনেকেরই। ইলাস্ট্রেটর হিসেবে বেশ জনপ্রিয়ও ছিলেন। তবে সেটি তাঁর প্রধান পরিচয় নয়। তাঁর যে পরিচয়টি খুব বেশি লোক জানেন না, তা হল তাঁর চলচ্চিত্রভাবনা এবং ফিল্ম তৈরি। পরিচালক হিসেবে তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি (শর্ট ফিল্ম) এবং পূর্ণাঙ্গ ছবি— তিন ঘরানাতেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন নীতিশবাবু। তবে তথ্যচিত্রে তাঁর তুলনা খুব কমই আছে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হয়ে প্রায় শতাধিক তথ্যচিত্রের প্রয়োজনা তিনি করেছিলেন, তাঁর পারিবারিক সংস্থা ‘লুক পাবলিসিটি’-র মাধ্যমে, যার মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তৈরি দুটি ছবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একাধিক ছবি দেশি-বিদেশি পুরস্কারে সম্মানিতও বটে। 

নীতিশবাবুর সহোদর আশিস মুখোপাধ্যায় তথ্যচিত্রের জগতে প্রবাদস্বরূপ। তথ্যচিত্র তৈরির পথিকৃৎও বলা চলে তাঁকে। সম্পর্কে তিনি ছিলেন নীতিশবাবুর বড়দাদা। ফলে তাঁর কাছ থেকেই নীতিশবাবুর ফিল্মের হাতেখড়ি এবং ছবির জগতে পা রাখা। গোড়ার দিকে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন নীতিশবাবু। সেই সূত্রেই সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দু’জনের সঙ্গেই এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হন স্বভাবশিল্পী নীতিশ মুখোপাধ্যায়। আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন। ফলে রংতুলির সঙ্গে গভীর সখ্য তো ছিলই। তার ওপর পেশায় যিনি অলঙ্করণশিল্পী, তাঁর কাছে রংতুলির জগতও ছিল সমান প্রিয়। ফলে ফিল্মের নেগেটিভের ওপর তুলি দিয়ে ছবি এঁকে অভিনব পদ্ধতিতে অ্যানিমেশন তৈরি করেছিলেন তিনি। আজও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর এই অনন্যসাধারণ শিল্পসৃষ্টি বহুল-আলোচিত।

১৯৬৯ সালে ‘আলোর গান’ তথ্যচিত্র দিয়ে প্রথম নজর কাড়েন নীতিশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর তৈরি ‘অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর কথাশিল্প’ শীর্ষক তথ্যচিত্র সমালোচক মহলে উচ্চ প্রশংসিত হয় এবং রাজ্য সরকার তার স্বত্ব কিনে নেয়। ১৯৭৪ সালে নীতিশবাবু তৈরি করেন তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছবি ‘একদিন সূর্য’। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়শ্রী রায় এবং সৌমেন ভট্টাচার্য। একটি ছোট ভূমিকায় বড়দা আশিস মুখোপাধ্যায়কেও নিয়েছিলেন নীতিশবাবু। সুনীল দাশের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি এই ছবি বক্স অফিসে জনপ্রিয় না-হলেও তার চিত্রনাট্য এবং মেকিং-এর অনন্যতায় নজর কেড়েছিল। ‘সেরা পরীক্ষামূলক ছবি’, ‘সেরা চিত্রগ্রহণ’ এবং ‘সেরা চিত্রনাট্য’ বিভাগে বিএফজেএ পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবিটি। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালনাও ছিল নীতিশবাবুর। ভৈরোঁ রাগে ‘মন সুমর তো নিশিদিন তুমহারে নাম’ বলে একটি ভজন গাইয়েছিলেন উস্তাদ আমির খান-কে দিয়ে। এছাড়াও ‘নাই যদি বা এলে তুমি’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি গেয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও গান গেয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী অমল নাগ, যিনি পরবর্তীকালে নীতিশবাবুর অন্য ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ‘একদিন সূর্য’ ছবির জন্য নীতিশবাবু নিজেহাতে ডিজাইন করেছিলেন প্রচারপুস্তিকা, যেখানে ছবির মূল গল্পের সারাংশ লিখেছিলেন এভাবে– 

‘অভির কাছে এই শহর একটা অনন্ত পটভূমির মত। তবু কখনও কখনও তারও স্বরে হতাশার সুর ফুটে ওঠে। কিন্তু সে ক্ষণিকের। তার অনেক ভেতরে একটা আলাদা পৃথিবী তৈরি করার কাজ চলে অনবরত। তার সঙ্গে বাইরের কঠিন আর নির্দয় সময়ের কোনও মিল সে কখনও খুঁজে পায় না। তবু বারে বারেই সেই একই জায়গায় ফিরে আসা। একটি দিনের প্রত্যাশাকে শুধু ভালোবেসে যাওয়া। অভির বাইরের সাফল্য আর ব্যর্থতার কঠিনতম সময়ের মধ্যেও রুপুর একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা, জীবনকে গভীরভাবে ভালোবাসার সাধনায় মগ্ন সেজকাকুর অন্ধ হয়ে যাওয়া, রুপুর বাবার গ্লানিময় অতীত– এই সবকিছুর সঙ্গে সে নিজেকে একাত্ম না করে পারে না। যেহেতু সদরের কঠিন বাস্তব আর তার অন্দরের ভালোবাসা একইসংগে জড়িয়ে আছে।’

আশির দশকে নীতিশ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেন ‘নয়নশ্যামা’ নামে কাহিনিচিত্র, যা সম্ভবত তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি এই ছবির নামপত্রে অ্যানিমেশন ব্যবহার করেছিলেন নীতিশবাবু। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, প্রবীর রায়, সন্তু মুখোপাধ্যায়, স্মিতা সিংহ প্রমুখ। এ ছবিতে প্রথম একটি বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করেন রঞ্জিত মল্লিক, যিনি নীতিশবাবুর পরের ছবির নায়ক। ১৯৮৪-র আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবে ইন্ডিয়ান প্যানোরামায় নির্বাচিত হয়েছিল এই ছবিটি। রাশিয়ার ভারতীয় ফিল্মোৎসবে সেখানকার একাধিক শহরে ছবিটি দেখানো হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে এসে রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে এনএফডিসি-র প্রযোজনায় নীতিশ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেন ‘রবিবার’। এখানেও মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন রঞ্জিত মল্লিক, জয়িতা মুখোপাধ্যায়। ছিলেন আলপনা গোস্বামী, অনুপকুমার, গীতা মুখোপাধ্যায়। প্রতিটি ছবিই সাদাকালো সেলুলয়েডে নির্মিত এবং অ্যানিমেশনের সার্থক ব্যবহারে শিল্পের এক অন্য ধারার উপস্থিতি ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে জহরলাল নেহরুর স্ত্রী কমলা নেহরুকে নিয়ে তৈরি যে তথ্যচিত্রটি (‘কমলা নেহরু’) জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়, তার স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে শিল্প নির্দেশনা, সবই করেছিলেন নীতিশবাবু।

নীতিশবাবুর সহোদর আশিস মুখোপাধ্যায় তথ্যচিত্রের জগতে প্রবাদস্বরূপ। তথ্যচিত্র তৈরির পথিকৃৎও বলা চলে তাঁকে। সম্পর্কে তিনি ছিলেন নীতিশবাবুর বড়দাদা। ফলে তাঁর কাছ থেকেই নীতিশবাবুর ফিল্মের হাতেখড়ি এবং ছবির জগতে পা রাখা। গোড়ার দিকে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন নীতিশবাবু। সেই সূত্রেই সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দু’জনের সঙ্গেই এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হন স্বভাবশিল্পী নীতিশ মুখোপাধ্যায়। 

আসলে নীতিশবাবুর মতো চির সৃজনশীল মানুষেরা কখনও শিল্পের একটিমাত্র মাধ্যমে আবদ্ধ থাকতে পারেন না। সে চেষ্টাও করেন না। নীতিশবাবুও তাই কখনও ফিচার ছবি, কখনও ডকু ছবি আবার কখনও বা টেলিভিশনের জন্য কাজ করেছেন। দূরদর্শনের গোড়ার দিকের বহু সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট, নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন নীতিশবাবু। ‘অন্দরমহল’, ‘হে মহাজীবন’, ‘সুরের সারথি’-র মতো বহু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে কাজ করবার অভিজ্ঞতা ছিল নীতিশবাবুর ঝুলিতে। যে মানুষটিকে ভেতর থেকে শ্রদ্ধা করতেন, সেই সত্যজিৎ রায়ের মতোই বাঙালিয়ানা, রাবীন্দ্রিকতা, চিত্রময়তার পাশাপাশি আধুনিকতার উৎকর্ষ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন নিজের কাজে, ফিল্মে। সত্যজিতের কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বারবার যে ‘ইনার আই’-এর কথা বলেছেন নীতিশবাবু, সেই অন্তর্দৃষ্টি, সেই হার্দিক অনুভবের ছোঁয়া তাঁর নিজের প্রতিটি ছবিতে ধরা পড়েছে। তাঁর কথায়, স্মৃতিচারণায়, তুলির টানে উঠে এসেছে সেই সংবেদনশীল শিল্পীসত্তা। সত্যজিতের যে কথাটি নীতিশবাবুর জীবনে ও মননে আমৃত্যু গাঁথা ছিল, তা হল— আমরা আগে আর্টিস্ট, পরে পরিচালক। নিজস্ব শিল্পবোধ, শিল্পানুরাগ এবং শিল্পচেতনা তাঁর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি কাজে খুব স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে চিরকাল। আকাশ থেকে ঝরে পড়া জীবন-উদ্দীপনা নিজের মধ্যে গ্রহণ করে তাকে শিল্পরসে জারিত করে কখনও ক্যামেরায় আবার কখনও বা রংতুলিতে প্রকাশ করেছেন নীতিশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রয়াণে আরও একটু নিঃস্ব হল বাংলা চলচ্চিত্র এবং শিল্পজগত। 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *