আমি এক ফেরিওয়ালা ভাই/ স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াই।
আমার স্বপ্ন কিনতে হলে আস্ত পাগল হওয়া চাই…
নচিকেতার এই গানখানার জন্মের অনেক অনেক আগে এমন একজন মানুষ সত্যিই ছিলেন বাংলার সাহিত্যজগতে, যিনি আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্ন দেখাতেন কচিকাঁচাদের। নিজের একখানা জবরদস্ত ছদ্মনামও দিয়েছিলেন তিনি এ কথা মাথায় রেখেই। স্বপনবুড়ো। এ নামটা আজকের পোকেমন-অ্যাভেঞ্জার্স-পটার দুনিয়ায় অভ্যস্ত শিশু-কিশোরদের কাছে আর পরিচিত নয়। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন ছোটদের জন্য বাংলায় লেখার কথা উঠলে স্বপনবুড়োর নামটা অবিসম্বাদীভাবেই উঠে আসত। তিনিই তৈরি করেছিলেন ছোটদের রঙিন দুনিয়া ‘সব পেয়েছির আসর’। কে ছিলেন এই স্বপনবুড়ো?
তাঁর আসল নাম ছিল অখিলবন্ধু নিয়োগী। আজকের বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলের সাঁকরাইল গ্রামে তাঁর জন্ম, ১৯০২ সালের ২৫ অক্টোবর। অর্থাৎ এ বছর তাঁর জন্মের একশো কুড়ি বছর পূর্ণ হল। তাঁর বাবার নাম গোবিন্দচন্দ্র নিয়োগী, মা ভবতারিণী দেবী। স্থানীয় বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন বাবা। অখিলবন্ধু বড় হয়েছিলেন তাঁর মামা যদুনাথ সেনগুপ্তের কাছে। গ্রামের পাঠশালায় গুরুমশাই তীর্থবাসী পণ্ডিতের কাছে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানেই করেছিলেন। তারপর অবশ্য কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু গ্রামীণ জীবন বাসা করেছিল তাঁর অস্থিমজ্জায়। পাঠশালার পোড়োদের সঙ্গে মিলে দলবেঁধে মাঠেঘাটে হুটোপুটি করে খেলা, নৌকো করে খালবিল পেরিয়ে ঘুরতে যাওয়া, চড়ুইভাতি, গাছে চড়া, রাত জেগে যাত্রাপালা শোনা— এসবই গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল শিশু অখিলের মনে। তাই পরবর্তীকালে ছোটদের জন্য লেখার সময়েও তিনি এমনই এক আদর্শ পরিবেশ রচনা করতে চাইতেন।
কলকাতায় এসে স্কটিশচার্ট কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন কিশোর অখিল। তারপর সিটি কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা পাশ করে আর্ট কলেজে (তখন যার নাম গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল) ভর্তি হন। কারণ ছবি আঁকার শখটা তাঁর ছোট থেকেই প্রবল। তাই বিজ্ঞান বেশিদিন ভালো লাগল না। সরাসরি গিয়ে পড়লেন শিল্পকলার অঙ্গনে। সেখানে গুরু হিসেবে পেলেন কাকে? দেশীয় শিল্পকলার মহাগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তাঁর কাছে চলল ছবি আঁকার পাঠ। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে অখিল তৈরি করলেন ‘আর্টিস্ট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’। আর সেই সোসাইটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত হল একটি হাতে লেখা পত্রিকা— চিত্রা। সেখানে নিয়মিত ছবি আঁকতেন অবনীন্দ্রনাথ স্বয়ং। পরে ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন আঁকাতেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন অখিলবাবু। ‘কলকাতা কথকতা’ সংস্থার অন্যতম কর্ণধার, বিশিষ্ট অভিনেতা ও সংগ্রাহক বিমল চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অখিলবাবুর বিশেষ স্নেহধন্য। প্রায়ই যেতেন তাঁর মানিকতলার বাড়িতে। তিনি জানালেন, নিজের সম্পাদিত ‘খেয়া’ পত্রিকায় নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন অখিলবাবু। এমনকী সজনীকান্ত দাশ ও আশাপূর্ণা দেবীর বহু গল্পের সঙ্গেও অখিলবাবুর আঁকা ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়েছে। এই আর্টিস্ট হবার সুবাদেই তাঁর যোগাযোগ হয় বাংলা চলচ্চিত্রের জগতের সঙ্গে। ক্রমে সেখানেও নিজের আলাদা জায়গা তৈরি করে নেন অখিলবাবু। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটি বহু বাংলা ছবির গান রচনা করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। ‘মুক্তির বন্ধনে’ নামে একটি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। তবে এই জগতে তাঁর সবথেকে বড় কৃতিত্ব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে শ্রীনিকেতনের কর্মকাণ্ডের উপর তথ্যচিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা। বহু ছবিতে শিল্প নির্দেশনা ও প্রচার পরিকল্পনার কাজ সফলভাবে করে গিয়েছিলেন এই মানুষটি, যা পরের প্রজন্মের বাঙালির কাছে অজানাই থেকে গিয়েছে।

তবে তুলির পাশাপাশি এই আর্ট কলেজে থাকালীনই কলমও ধরেন নিয়োগীমশাই। ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় পরপর প্রকাশিত হয় তাঁর তিনটি গল্প– ‘বাঘমামা’, ‘পরীর দৃষ্টি’ ও ‘স্বপ্নপুরী’। সালটা ১৯২৭। এর পরের বছরই অখিলবন্ধু স্থির করলেন, উপন্যাস লিখবেন। ১৯২৮ সালে ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল তাঁর লেখা উপন্যাস ‘বেপরোয়া’। এই উপন্যাসের বলেই পাঠকমহলে সসম্মানে জায়গা করে নেন অখিলবন্ধু নিয়োগী তথা ‘স্বপনবুড়ো’। শিশু কিশোরদের মনের ভয় কাটিয়ে সাহস করে লড়ে যাবার প্রেরণা জুগিয়েছিল এই উপন্যাস। সেই শুরু। তারপরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি লেখককে। একের পর এক জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস-নাটিকা লিখে গিয়েছেন তিনি। ‘বাবুইবাসা বোর্ডিং’, ‘বনপলাশীর ক্ষুদে ডাকাত’, ‘শশী শ্যামলের সাঁকো’, ‘পঙ্ক থেকে পদ্ম জাগে’-র মতো কালজয়ী লেখা লিখেছেন তিনি। স্বপনবুড়ো নাম অবশ্য নেন অনেকটা পরে, লেখার সূত্রে নয়, নাটিকার সূত্রে। চল্লিশের দশকে রেকর্ডে ‘স্বপনবুড়ো’ নামে একটি নাটিকা প্রকাশ করেন তিনি। তাতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অখিলবাবু স্বয়ং। একেবারে কপিবুক গল্পদাদুর চরিত্র। সাদা দাড়িগোঁফ, নাকের ওপর গোল গোল চশমা, ঢোলা জোব্বা পরনে সেই বৃদ্ধ ছোটদের স্বপ্ন দেখতে শেখাতেন। এই চরিত্রে অভিনয়ের পরেই ‘স্বপনবুড়ো’-কে নিজের ছদ্মনাম হিসেবে গ্রহণ করেন অখিলবন্ধু নিয়োগী। ১৯৪২ সালে যুগান্তর সংবাদপত্রে ছোটদের বিভাগ খোলা হয়। নাম ছিল, ‘ছোটদের পাততাড়ি’। ১৯৪৫ সাল থেকে স্বপনবুড়োই এই বিভাগটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। দারুণ জনপ্রিয় হয় সেই বিভাগটি।
তাঁর আসল নাম ছিল অখিলবন্ধু নিয়োগী। আজকের বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলের সাঁকরাইল গ্রামে তাঁর জন্ম, ১৯০২ সালের ২৫ অক্টোবর। অর্থাৎ এ বছর তাঁর জন্মের একশো কুড়ি বছর পূর্ণ হল। তাঁর বাবার নাম গোবিন্দচন্দ্র নিয়োগী, মা ভবতারিণী দেবী। স্থানীয় বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন বাবা। অখিলবন্ধু বড় হয়েছিলেন তাঁর মামা যদুনাথ সেনগুপ্তের কাছে। গ্রামের পাঠশালায় গুরুমশাই তীর্থবাসী পণ্ডিতের কাছে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানেই করেছিলেন।
শিশুদের জন্য ব্রতচারীর আদলে শিক্ষামূলক এবং কল্যাণমূলক একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন অখিলবাবু। নাম দিয়েছিলেন ‘সব পেয়েছির আসর’। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকী পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও বিভিন্ন জেলার ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি এই সংগঠনের শাখা তৈরি করেছিলেন। অবশ্য এই সাংগঠনিক কাজে দক্ষতা তাঁর মজ্জাগত। কৈশোরে সহপাঠী বন্ধুদের সহযোগিতায় গ্রামে পাঠাগার তৈরি করেছিলেন, আর্ট স্কুলে থাকাকালীন ‘আর্টিস্ট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ‘সব পেয়েছির আসর’ও যে অচিরেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? পঞ্চাশের দশকে, লেখার পাশাপাশি সাংগঠনিক ও সম্পাদনার কাজও সমানতালে করে গিয়েছেন। ১৯৫২ সালে কটকে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’। সেখানে শিশু সাহিত্য শাখার সভাপতির পদে ছিলেন স্বপনবুড়ো। এরপর আরও দু’বার নাগপুর ও হায়দ্রাবাদে এই একই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সে বছরই (১৯৫২) আন্তর্জাতিক শিশুরক্ষা সমিতির আমন্ত্রণে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে ভিয়েনায় যান। আর সেই সুযোগে সাক্ষাৎ করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে। ফিরে এসেই নিজের এই বর্ণিল ইউরোপ ভ্রমণকাহিনি লিপিবদ্ধ করলেন ‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে’ বইটিতে । এই বই থেকেই প্রথম বাংলার ভারতের আপামর জনতা জানতে পারে নেতাজির পরিবারের কথা।
প্রায় নব্বই বছরের দীর্ঘ জীবনে কখনও শিল্পসাহিত্যচর্চায় ছেদ পড়তে দেননি এই স্বপ্নের ফিরিওলা। একশোরও বেশি নাটক, ভ্রমণকাহিনি, জীবনী, গল্প, উপন্যাস রচনা করে গিয়েছেন স্বপনবুড়ো। ১৯৫৬ সালে শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক হিসেবে ‘ফটিক-স্মৃতি পদক’ লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সে বছরই তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ দিয়ে সম্মানিত করেন। বিখ্যাত অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনি এবং বিশিষ্ট নাট্যকার-পরিচালক সুভাষ বসুর কন্যা শ্রীমতী টুম্পা রায় শোনাচ্ছিলেন স্বপনবুড়োকে ঘিরে তাঁর শৈশবস্মৃতি। সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। গড়পার রোডে থাকতেন সত্যবাবুরা। আর মানিকতলায় থাকতেন অখিলবাবু। টুম্পাদির কথায়,
‘আমাদের পাড়াতেই ছিল সত্যজিৎ রায়ের আদি বাড়ি, যেখানে ওঁদের বিখ্যাত ছাপাখানা ছিল। তার উল্টোদিকের বাড়িতে থাকতেন এক অধ্যাপক যাঁকে সারা পাড়া ডাকত ঝান্টুদা নামে। আমাদের থেকে বয়সে অনেক বড় হলেও আমরাও ওঁকে দাদা বলতাম। সেই ঝান্টুদার অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন স্বপনবুড়ো। প্রায় রোজ আসতেন সেখানে। আর ছোটদের সঙ্গে ছিল ওর ভারী ভাব। এমনকী আমরা একদম খুদের দলও ওঁর স্নেহ পেয়েছি দেদার। কাঁধে ঝোলা নিয়ে আসতেন। সেই ঝোলায় থাকত কাগজ, কলম, পেনসিল, গল্পের বই, টফি, মানে ছোটদের ভোলাবার যাবতীয় জিনিস। পরে জেনেছি উনি অসাধারণ ছবি আঁকতেন। তখন তো এসব বুঝতাম না, উনি কে! ওঁকে স্বপনবুড়ো বলেই ডাকতাম আর গল্প শুনতাম। একটু বড়দের উনি নিজের লেখা বই উপহার দিতেন, আর ছোটদের গল্প শোনাতেন সারাক্ষণ। রাজা, রানি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, হিরের চাকা, মুক্তোর রথ এসবের গল্প বলে বলে কল্পনার জগতে নিয়ে যেতেন আমাদের। তারপর এসবের ছবি আঁকতে বলতেন। নিজেহাতে শুধরেও দিতেন কাঁচা হাতের আঁকা। সুকিয়া স্ট্রিটে আমাদের একটা রেলিংঘেরা পার্ক ছিল। প্রায় রোজই বিকেলে সেখানে এসে বসতেন স্বপনবুড়ো আর ঝান্টুদা। আমরা খেলতাম, আর ওঁরা গল্প করতেন। আমাদেরও গল্প শোনাতেন। রোজ ওই আড্ডার টানেই ছুটে যেতাম পার্কে। আমাদের কারও কারও জন্মদিন হলে উনি নিজের হাতে কিছু এঁকে ‘শুভ জন্মদিন’ লিখে উপহার দিতেন। টফি বিলোতেন। সে এক আশ্চর্য স্নেহচ্ছায়াময় অভিভাবকত্ব। এখন ভাবলে মনে হয় কতখানি সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
তবে পরবর্তীকালের শিশু সাহিত্য নিয়ে তাঁর মনে একরকম অভিমানও ছিল। অসিতাভ দাশের লেখায় পাওয়া যায় সেই অভিমানের ছোঁয়া। অখিলবাবুর মনে হয়েছিল ‘কল্লোল’ যুগে বড়দের সাহিত্যের যতখানি অগ্রগতি দেখা গিয়েছিল, শিশুসাহিত্য নিয়ে সেভাবে কাজই হয়নি। তাঁর কাছ থেকে হয়তো আরও কিছু পাওয়ার ছিল বাঙালির। কোনওদিন তথাকথিত শহুরে ‘এলিটিজ়ম’-এর জোয়ারে গা ভাসাননি এই মাটির মানুষটি। রামধনু, শিশুসাথী, মৌচাক, মাস পয়লা-র মতো আদ্যন্ত ছোটদের পত্রিকায় একান্তে নিভৃতে জায়গা করে নিয়েছিলেন এই মানুষটি, ছোটদের জন্য ভাবনা, কল্পনা আর গল্পের পসরা সাজিয়ে।
তথ্যঋণ: কলকাতা কথকতা, স্বপনবুড়ো রচনাবলি, সববাংলায়
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।