আগের পর্ব পড়তে: [১]
ঢাকা থেকে প্রথমে কোন জেলায় যাব, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না। মূলতঃ দুটি কারণে। একটি কারণ, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ আর দ্বিতীয়টি হল চূড়ান্ত বৃষ্টিপাত। প্রথম কারণটি অপ্রত্যাশিত হলেও দ্বিতীয়টি খুব স্বাভাবিক। এদেশে আসার আগেই অসম বিধ্বস্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর বন্যায়। সঙ্গে সিলেটও। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় হাওর অঞ্চলে অকাল বর্ষা নতুন কিছু নয়। রেইনওয়্যার নিয়ে এসেছি। সঙ্গের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বেশিরভাগই জল নিরোধক। এবারের এপ্রিল অথবা মে মাসে সিলেট ডিভিশনের বন্যা তাই আমাকে অবাক করেনি। কিন্তু বৃষ্টিবলয় রিমঝিম যে গোটা জুন মাস জুড়ে আমার সঙ্গে ফেউয়ের মতো লেপ্টে থাকবে, সেটা আশঙ্কা করিনি। তবে মাটি আঁকড়ে কাজ করবার বাসনা পূরণে বৃষ্টিধারা কখনওই অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে না। দেবী দুর্গার মাতৃসুলভ কমনীয় রূপের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধং দেহি রূপ দেখে আমরা আজন্ম অভ্যস্ত। হাওরের ভয়াল প্রকৃতির মাঝে নরম সৌন্দর্য খুঁজে পাব, সেই আশাতেই আমার মনের ভিতর জমতে থাকা ভয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঝোলা প্রস্তুত করে তরতাজা আবেগ নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম ঢাকাকে বিদায় জানিয়ে।

আমার হাওর যাত্রার প্রবেশপথ হল সুনামগঞ্জ। ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুরা ইতিমধ্যে অনেক সাহায্য করেছেন সফর পরিকল্পনায়। ওঁদের আশ্বাস আর প্রকৃতির কৃপাপ্রার্থনা করে সৈয়দাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চেপে পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ। এগারো ঘণ্টার সফরে অতিক্রম করেছি ২৭০ কিলোমিটার। গন্তব্যে পৌঁছনোর খানিক আগেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল কিন্তু রাত ন’টায় যখন সুনামগঞ্জ বাজারে পৌঁছলাম, তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। আমার প্রথম কাজ হল এক কাপ লিকার চা খেতে খেতে উল্লাসভাইকে ফোন করা। উল্লাসকে পেয়েছি গাজীপুরের কাজি শরিফের মাধ্যমে। কাজির বন্দোবস্ত সবসময় পোক্ত হয়। তার প্রমাণ পেলাম ফোনের ওপারে উল্লাসের উল্লসিত গলার স্বরে।
– সম্রাটদা হোটেল আয়ান বাবায় চইলা আসেন। রুমের কথা বইলা রাকসি।
গুগল ম্যাপ অনুযায়ী হোটেল মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে। হেলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম। ছ’তলায় ঘর পেলাম নামমাত্র মূল্যে। পরিছন্ন ও সাধারণ সুবিধাযুক্ত। মিনিট দশেকের মধ্যে উল্লাস চলে এল রিসেপশনে আর সেখান থেকে আমরা সোজা খাবার হোটেলে। খেতে খেতে আগামীকালের পরিকল্পনা শুনে বুঝলাম, ও কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে। এখন শুধু বন্যা আর বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখা ছাড়া আমার আর কোনও ভাবনা নেই। রাতের খাবার শেষ করে পৌঁছনোর চেষ্টা করলাম লঞ্চঘাটে। চেষ্টা করলাম বলেছি কারণ শেষাবধি বোট পর্যন্ত পৌঁছনো গেল না। নদীর জল বাজারের রাস্তার কাছাকাছি উঠে এসেছে। রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে দেখে উল্লাসকে বললাম হোটেলে ফিরে যাব। স্নান শেষ করে ঘুমিয়ে পড়া একান্ত দরকার। জানি না আগামী ক’দিন কী পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াব। শুভরাত্রি বলে চলে এলাম হোটেলে। সুনামগঞ্জ তখন প্রায় শুনশান। বাজারের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে টের পেলাম নতুন করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সঙ্গে বাজ পড়বার আওয়াজ কানে এলো। আমার এই হোটেলের উল্টোদিকেই সুরমা নদী বয়ে চলেছে। নদীর বুকে তখন অন্ধকার ঘন হয়ে জমে রয়েছে। প্রকৃতির আশীর্বাদ ব্যাতিরেকে হাওরের বুকে ভেসে পড়া অসম্ভব। অজান্তেই হাত জোড় হয়ে আসে। মনে মনে বলি ‘গঙ্গা মাইয়া কি জয়’। মা গঙ্গার বরপুত্র আমরা। আমাদের কাছে পৃথিবীর সমস্ত নদীই গঙ্গা। মা গঙ্গার অভয় পেলে সাত সাগর তেরো নদী আরামসে পাড়ি দিতে পারি। সময়ের ওপর ভরসা রেখে ঘরের আলো বন্ধ করলাম। চরাচর জুড়ে শুধু প্রবল আঁধার।
ঘুম ভাঙল কাকভোরে। অতি হালকা আলোয় ঘরের ভিতরের কিয়দংশ আলোকিত। কাচের জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই চোখে পড়ল সুরমা নদী ও তার প্রবল জলস্রোত। তখনও অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রমাদ গুনলাম। ছ’তলার ব্যালকনি থেকে চারদিকের যা হাল দেখলাম তাতে উৎসাহ স্তিমিত হওয়ার কথা। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। জীবনে বহু পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে যখন মনে হয়েছে পিছিয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ঠিক তখনই খুলে গিয়েছে সাফল্যের গুপ্ত পথ। সুরমা, যাদুকাটা, হাওরের দলের ওপর আমার বিশ্বাস অটুট। ওঁরা ঠিক আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন ওঁদের হৃদপিণ্ডের অলিন্দের অলিগলিতে।

বেলা তখন পৌনে বারোটা। দুপুর হতে আর একটু বাকি। হোটেলের সামনে একহাঁটু জল। সুরমা হাঁটু ছাড়িয়ে কখন বুক পর্যন্ত উঠে আসবে জানি না। হোটেলে আটকে পড়বার আগেই তড়িঘড়ি করে রিকশা নিয়ে ছুটলাম সাহেবঘাটে। বোট যে কোনও মুহূর্তে ছেড়ে যেতে পারে। দীপ বণিকের দেওয়া মাঝি আলম সাহেবকে ঘাটে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম। আমার উল্টোদিকের একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হবে কিন্তু ক’দিনের না কমানো হাল্কা কাঁচাপাকা দাড়িতে ওনাকে মুমূর্ষু লাগছে। তাহিরপুর হয়ে যাব কিনা জানতে চাইলাম। এর উত্তরে ওঁর দুশ্চিন্তার কারণটা জানতে পারলাম। সুরমা ধরে তাহিরপুর হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর পৌঁছনোর যে প্রচলিত রুট, সেটা ধরে বোট যেতে পারবে না। বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় আলম নিজেও জানেন না কীভাবে টেকেরঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বুঝতে পারলাম খুব সঙ্গীন মুহূর্ত। তবু এগিয়ে যেতে হবে। আলম সাহেবের অভিজ্ঞতা আর আল্লার রহমত, এই দুইয়ের জোরে বোট যখন ঘাট ছাড়ল, ঘড়িতে বাজে ঠিক সোয়া বারোটা।
অস্বীকার করব না আমি খুবই আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ভয় যেহেতু গুনিতক হারে বাড়তে থাকে, তাই পিঠের ব্যাগ থেকে তিনধরনের ক্যামেরা বের করে সেট করতে বসে গেলাম। বোটের ডেক বেশ প্রশস্ত। মন ব্যস্ত রাখতে হবে অন্য কোনও কাজে। আলম সাহেব সিগ্রেট ধরিয়েছেন। কড়া তামাকের গন্ধ নদীর প্রবল বাতাসও নিমেষে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। কালো আর ধূসর রঙের আকাশ মনে করিয়ে দিচ্ছে আবহাওয়া অনুকূল নয়। তবু ক্যামেরা সেট করে যখন টান হয়ে দাঁড়ালাম, সুরমাকে আর ভয় পেলাম না। হতে পারে এমন বর্ষাঘন দিনে সুরমা নিজেকে আর হাওরের দলকে দেখাবে বলে আমায় টেনে এনেছে। এই প্রেক্ষাপট প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়েছে। ভয় পেয়ে এই অনিশ্চয়তার মজা উপভোগ না করবার বোকামি আমি করব না। বরং হাওরের জীবনে ঢলের পানির ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখবার, তাকে বুঝে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। তাকে কাজে লাগানো উচিত। ভাবামাত্র মন খুশি হয়ে গেল। গলা ছেড়ে হাঁক মারলাম,
– মিজান ভাই, এক কাপ রং চা হয়ে যাক, চিনি ছাড়া।

আলম হাসলেন। অভিজ্ঞ মাঝি বুঝে নিয়েছেন আমি আশঙ্কা কাটিয়ে এখন বেদম স্ফূর্তিতে গা ভাসাব।
– বসেন। এই ন্যান সিগ্রেট। টান মারেন।
– শুক্রিয়া। এখন আর চলে না।
– ভালো। আমি ছাড়তে পারি না। চেষ্টাও করি নাই অবশ্য।
আলম সামনের দিকে চোখ রেখে কথাগুলো বলে। আমি বলি,
– আলম ভাই, সুরমা আর কতদূর চলবে?
– এহুনি শ্যাষ হইব।
– ওহ!! তারপর হাওর শুরু?
– হ। আইজকে সময় লাগব। ধরেন ছয় ঘণ্টা। পুরা পথই হাওর দিয়া যাইমু।

চমৎকার। শাপে বর হল। তাহিরপুর থেকে বোটে উঠলে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরকে পেতাম। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়াতে সুনামগঞ্জের বিখ্যাত হাওরগুলি দেখা হয়ে যাবে। আকাশের দিকে মুখ তুলে প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানালাম। ভরা বর্ষার মেঘের দৌলতেই তো এমন সুযোগ এল। প্রকৃতি কখনও বিমুখ হন না। আমরা নিজেদের স্বার্থের কারণে বুঝতে ভুল করি।
– ভাই, এই ন্যান আপনার রং চা আর বিস্কুট। প্যাকেটটা থোন আপনার কাছে।
চোখ নামিয়ে দেখি সামনে এক সদ্য যুবক দাঁড়িয়ে। আরও বেশ কিছুদিন দাড়িগোঁফ কামালে পূর্ণ যুবক হয়ে উঠবে।
– আমি তো বিস্কুট খাই না। ডাক্তারের বারণ।
বিস্কুট খাওয়াতে ডাক্তার নিষেধ করতে পারে ওর হয়তো কল্পনার বাইরে ছিল। মুখ দেখে মনে হল একেই হয়তো বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ওর ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটাবার জন্য একটি বিস্কুট তুলে নিলাম। ছেলের এবার হাসি ফোটে।
– ভাইয়া, শুনসি আপনি ইন্ডিয়ান।
– হ্যাঁ। ঠিক শুনেছ।
– আমার কইলকাতায় যাওনের খুউব ইচ্ছা। আপনার বাসা কইলকাতায়?
– হ্যাঁ, কলকাতায়।
কথোপকথন এগনোর আগেই আলম ভাইয়ের হুঁশিয়ারি কানে আসে।
– বইসা পড়েন।
বোট খুব দুলছে। একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বসে পড়লাম সাইডের টানা লোহার বেঞ্চে। ছেলেটি আপনমনে কথা বলে চলেছে। আমি মাথা নাড়িয়ে অথবা সম্মতিসূচক শব্দে ওকে সামলাচ্ছি। চোখ চলে যাচ্ছে যেখানে হাওর মিশেছে আকাশের গায়ে। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আবিষ্ট হয়ে পড়ছি। ভাগ্যিস ছোট জার্নি লম্বা হয়েছে। অপ্রত্যাশিত লাভে প্রকৃতিকে ফের ধন্যবাদ দিই। হাতঘড়ি দেখি। ঘাট ছেড়ে এসেছি সবে মাত্র আধঘণ্টা হয়েছে। এর মানে সাড়ে পাঁচঘণ্টা কমসে কম লাগবে টেকেরঘাট পৌঁছতে। এই সুযোগে আপনাদের টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে বিশদে জানিয়ে রাখি। নীরস তথ্য বিরক্তি তৈরি করলেও তথ্য ছাড়া এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তবে এই পর্বে নয়। পরের পর্বে। (চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘুরে দেখছেন ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীব্যবস্থা, জানছেন ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া- পাঁচটি দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার একা ভ্রমণ করেছেন দু চাকায় সওয়ার হয়ে। এছাড়াও প্রায় দু দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম,অজানা পাহাড় ও জঙ্গল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের স্নাতক সম্রাটের শখ প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের ছবি তোলা। প্রথম প্রকাশিত বই 'দাগ'।