বাংলাদেশে তৃতীয়বারের জন্য পা রাখলাম। ইমিগ্রেশনের জরুরি কাজকর্ম সেরে সকাল দশটায় এসে দাঁড়ালাম যশোরে। প্রায় আড়াই বছর পর এ দেশে পৌঁছে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছি। ভোর চারটের সময় দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। প্রায় ছ’ঘণ্টা পর সীমান্ত পার করা গিয়েছে। ক্লান্তিতে হোক বা আনন্দের আতিশয্যে, থমকে রইলাম কিছুক্ষণ। হবে নাই বা কেন? এ দেশ বড় প্রিয় যে। এ দেশের আনাচে কানাচে আমার পরিবারের জন্ম জন্মান্তরের কাহিনি লেখা আছে। অবচেতনে তাকেই বোধহয় খুঁজতে থাকি।

কলকাতায় আমাদের তিন পুরুষের বাস। কিন্তু আত্মপরিচয়ের জন্য সেটুকুই যথেষ্ট নয়। বংশলতিকার ক’জন পূর্বজদের নাম আমার জানা আছে? বড়জোর চোদ্দো পুরুষ। কিন্তু দেশভাগের আগে পদ্মানদীর জলে পুষ্ট বাইঘ্যা গ্রাম অথবা তারও আগে অন্য কোনও জনপদে তাঁরা বাস করতেন। আমার ‘দ্যাশের বাড়ি’ ফরিদপুরকে প্রথম দেখি ২০১৮ সালে। ২৮ দিন সাইকেলে চেপে ভারতের ২৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেছিলাম। হিলি সীমান্ত ছুঁয়ে দিনাজপুর, নওগাঁও, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্ঠিয়া জেলা অতিক্রম করে ফরিদপুরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ফরিদপুর পৌঁছনোমাত্রই কিছু ছায়া শরীর যেন আমার নাম ধরে ডাকে। তাদের অস্পষ্ট অবয়ব যেন দেখতে পাই। হ্যালুসিনেশন? হতে পারে। ভিটের টান বড় মন উথালপাথাল করা হয়।

Padma River
পদ্মার বুকে…

সাতচল্লিশের পর এলো একাত্তর। বাঙালি ভিটে ছেড়ে শরণার্থী হয়েছে বহুবার। আর সেই রাতে আমি শরণ নিয়েছিলাম সেই ভিটে হারানো প্রাক্তন হয়ে যাওয়া আমার দেশের বুকে। আমার বংশের ঐতিহাসিক ও ভূতপূর্ব পূর্বজদের কাছে। আজ সকালে যশোরে পৌঁছে বাংলাদেশ দেখার প্রথম দিকের দিনগুলো না চাইলেও মনে পড়ে। আচ্ছন্ন ভাব কাটল অপরিচিত গলার স্বরে।
– ভাইয়া, শ্যামলী পরিবহণ?
– হ্যাঁ।
– চইলা আসেন ভাই। সামনেই কাউন্টার।

পরিবহণ কোম্পানির লোকজন জামাই আদর করে বাসের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। বাস দেখে মুগ্ধ আমি শ্যামলী পরিবহনের বাংলাদেশী বাসে উঠে পড়লাম। কলকাতা থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত যে বাসে এসেছি তার তুলনায় বাংলাদেশের বাস রাজকীয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুন্ডাই কোম্পানির বাসের ইঞ্জিন সূক্ষ্মতম আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলল ঢাকার উদ্দেশ্যে। এখন সব দায়িত্ব ড্রাইভার সাহেব আর সুপারভাইজারের। হাতে আমার অনেক সময়। অতএব সেই সুযোগে এইবারের বাংলাদেশে আসবার মূল কারণটুকু সংক্ষেপে বলে ফেলি। এইবার চলেছি কোনও নদীর খোঁজে নয়। তবে জলসম্পৃক্ত সফর তো অবশ্যই। বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের হাওর জীবনের খোঁজখবর নিয়ে বই লিখব বলে। হাওর অঞ্চল নিয়ে দুই বাংলায় বই লেখা হয়েছে খুবই কম। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হাওর সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল নন। অথচ প্রকৃতির খেয়ালিপনায় এই অঞ্চল একেবারেই অনন্য, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বিধৌত সমগ্র ভারতীয় ভূমিভাগের থেকে।

Surma River
সুনামগঞ্জ হোটেলের ব্যালকনি থেকে সুরমা নদী।

হাওর সম্পর্কে জানতে হলে প্রথম প্রশ্নই হল ‘হাওর’ শব্দের অর্থ কি। এই বিশালাকার জলাভূমির নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর উত্তর। সংস্কৃত ‘সাগর’ শব্দ চলিত উচ্চারণে হয়ে ওঠে সায়র। সিলেট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার রীতি অনুযায়ী কালক্রমে সায়র হয়ে ওঠে হাওর। হাওর শব্দটিই এখন সর্বজনবিদিত। ‘ভাটি বাংলার’ এই নিম্নভূমিতে রয়েছে মোট ৪২৩টি হাওর। এর মধ্যে হাকালুকি হাওর বৃহত্তম ও টাঙ্গুয়ার হাওর দ্বিতীয় রামসার সাইট। বাংলাদেশের ভূমিভাগের দশ ভাগের এক ভাগ নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত যা মোট সাতটি জেলা ও পঞ্চাশটি উপজেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। ১৪,৫৩৬ বর্গ কিলোমিটারের এই অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব লোকসংস্কৃতি ও জীবন ধারার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। তবে বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীবিকার জন্য অতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে সমগ্র হাওর অঞ্চল আজ ধ্বংসের মুখে। সবটুকু হারিয়ে যাওয়ার আগেই বাঙালিকে ঘুম ভেঙে শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজে নেমে পড়তে হবে। এক অসম লড়াইকে দিতে হবে সার্থক রূপ। আমি ব্যক্তিগতভাবে দায় অনুভব করি। অতএব দেশের সীমানা ভুলে গিয়ে চলেছি হাওরের বুকে। ওর সুখ-দুঃখের, বঞ্চনার দলিল লিখে রাখা বড় প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মের কাছে তথ্যের অভাব যেন না হয়।

এই অঞ্চল যে সারা বছর জলে ডুবে থাকে এমনটি আদৌ নয়। বছরের সাত মাস থৈথৈ জল আর পাঁচমাস জল সরে গিয়ে অধিকাংশ শুকনো জমির দেখা পাওয়া যায়। ওখানকার সাধারণ মানুষের ভাষায় ‘বর্ষায় নাও-শুকনায় পাও’। ভরা বর্ষায় রয়েছে অগুন্তি মাছের প্রজাতি আর ‘শুকনার’ সময়ে বোরো ধান। পাঁচটি মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে এরা ধানের গোলায় সারা বছরের গ্রাসাচ্ছদনের ভাতটুকু নিশ্চিত করে। উদ্বৃত্ত চাল বিক্রি করে স্থানীয় বাজারে। অবশ্য আজকাল ধান ছাড়াও কিছু পরিমানে সব্জির চাষ হচ্ছে। জলের সময় সাতমাস এদের কোনও কাজ থাকে না। তখন হাওরের মাছ এদের একমাত্র ভরসা। মাছে ভাতে বাঙালির প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায়।

Tanguar Haor
সন্ধের মোহিনী মায়ায় টাঙ্গুয়ার হাওর

দ্বিতীয় প্রশ্ন আপনাদের মনে আসতেই পারে, যে হাওরের জলের উৎস কি? আর এখানেই ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত ভুলে গিয়ে দুই দেশ একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের উত্তরপুবের এই জেলাগুলোর সীমানা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেঘালয় ও ত্রিপুরার পর্বতশ্রেণি। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অফুরন্ত বৃষ্টিপাত ঘটে এই সকল পাহাড়ি অঞ্চলে। কত ঝোরা, ঝর্ণা, নদী পাহাড়ের উঁচু থেকে হলহলিয়ে নেমে আসে এই নিম্নভূমিতে। সেই ‘ঢলের পানিতে’ চাপা পড়ে যায় অসংখ্য বিল ও বেশ কয়েকটি নদী। যেমন ধরুন যাদুকাটা ও বালু নদী। ভরা বর্ষায় ওপর থেকে পার্থক্য করবার জো নেই। যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত হয় শুধু জল আর জল। এরই মধ্যে কিছু কিছু উঁচু জমিতে মানুষ ঘর বানায়। ঘরের সামনে বাঁধা থাকে নৌকা। মুদিখানা থেকে শুরু করে ইস্কুল যাওয়া, থানা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন অফিস (পঞ্চায়েত) যাতায়াতের সবটুকুই নৌকার ওপর নির্ভরশীল। তবে কিশোরগঞ্জের নিকলির হাওরের কথা যদি বলি, তাহলে সেখানে রয়েছে চওড়া রাস্তা, যা কিনা হাওরের বুক চিরে আকাশে গিয়ে মিলিয়েছে। বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে কোনওক্রমে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট জমি বা ‘কান্দা’ দেখলে এ অঞ্চলের দুর্গমতা টের পাওয়া যায়। তবে দুর্গমতা সত্ত্বেও একটি সাফল্যের কথা না বলে পারছি না।

সংস্কৃত ‘সাগর’ শব্দ চলিত উচ্চারণে হয়ে ওঠে সায়র। সিলেট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার রীতি অনুযায়ী কালক্রমে সায়র হয়ে ওঠে হাওর। হাওর শব্দটিই এখন সর্বজনবিদিত। ‘ভাটি বাংলার’ এই নিম্নভূমিতে রয়েছে মোট ৪২৩টি হাওর। এর মধ্যে হাকালুকি হাওর বৃহত্তম ও টাঙ্গুয়ার হাওর দ্বিতীয় রামসার সাইট।

বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ছিল দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। আজ তারা সফল। তাই একশো শতাংশ সফলতার অংশ হিসাবে হাওরের সেই দ্বীপসদৃশ গ্রামগুলিতে বিদ্যুৎ ঠিক পৌঁছে গিয়েছে। তবে বিদ্যুৎ, স্কুলকলেজ, ইন্টারনেট সংযোগ, হাসপাতাল তৈরি হলেও হাওরবাসীদের মুখে যে চওড়া হাসি বছরভর দেখতে পাওয়া যায় এমনটি বলা যাবে না। প্রতিদিনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বিরামহীন সংঘর্ষ আজও তারা করে চলেছে। নাগরিকজন পার্থিব বিলাসের আকাঙ্ক্ষী হয়ে রাতে নিশ্চিন্ত ঘুম দেয়। আর হাওরের জেলে অথবা ভাগচাষীর দল আগামীর আশঙ্কায় ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা ক’জন এই পার্থক্যের গভীর অর্থ বুঝতে পেরেছি? বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল ধারার সঙ্গে এঁরা কখনোই মিশে যেতে পারেননি। বলা ভালো আমরা তথাকথিত বাঙালি সুশীল সমাজ এঁদের আপন করে নিইনি।

আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পৌঁছে গিয়েছি দৌলতদিয়া ঘাট। সামনেই উন্মুক্ত পদ্মা। ওপারে দেখা যায় শিবালয় ঘাট। খানিক পরে বাস উঠে পড়ল ফেরিতে। আমিও মখমলি গদি ছেড়ে নেমে এলাম ফেরির ডেকে। তিনতলার ডেক থেকে পাখির চোখে পদ্মাকে দেখি। ওপারের গঙ্গা এপারে নাম বদলে হয়েছে পদ্মা। ১৯৪৭ সালে আমার পূর্বপুরুষ দেশ বদল করেছিল। অতএব গঙ্গা ও পদ্মা দুই নদীই আমার। একান্ত আমার। আজকের পারাপারের সঙ্গে সেদিনের পারাপারে কত তফাৎ। আমি অন্তরাত্মা সঁপে দিয়ে প্রতিবার সেই সব হারানোর ক্ষণটুকু অনুভব করবার চেষ্টা করি। মিনিট চল্লিশেক পর নদী পার করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকার পথ ধরি। ঠিক রাত সাড়ে আটটায় (বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী) পৌঁছলাম কলাবাগান। আমার প্রিয়তম বন্ধু জিয়ান জিয়া হাজির হল মিনিট পনেরোর মধ্যে। ষোলো কোটি বাঙালির এই দেশে জিয়ানের ঘর আমার একমাত্র নিশ্চিন্ত আশ্রয়। ঘর তো শুধু চার দেওয়াল নয়। নিরাপদে স্বপ্ন দেখার আশ্বাস। হাওর যাত্রা শুরু করবার আগে দিন চারেকের জন্য একটু থিতু হওয়া। পরিকল্পনাকে গুছিয়ে নেওয়ার শেষ সুযোগ এই বাসাতেই আমি পাব।

Dhaka University
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামপাস।

রাতের ঢাকা বরাবর আমাকে টানে। শহরের ক্লান্তি ঢেকে দেয় যাবতীয় রঙিন আলো। আমারও পথের ক্লান্তি জুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল দোতলা লাল সবুজ বাস, ট্রাফিক পুলিশের হাতে ধরা সবুজ লেসার টর্চ। খুব বেশি বদলে যায়নি এই শহর। একমাত্র ঢাকা মেট্রো রেলের উঁচু উঁচু থামগুলো ব্যতিক্রম। রিকশাওয়ালা নিখুঁত কায়দায় জ্যাম কাটিয়ে নিয়ে চলে চলেছে পশ্চিম তেজতুরি বাজারের দিকে। ইচ্ছে হল আজ রাতেই কাওরান বাজার যাব। দোস্তকে সে কথা বলতেই মৃদু ধমক খেলাম। ফরমান এলো আজ শুধুই বিশ্রাম। আগামীকাল থেকে আমার সব হুজ্জুতির বাড়বাড়ন্ত দেখলেও কেউ আমায় বাধা দেবে না। জিয়ান মহারাজের শাসন মেনে নিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লাম। গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অফিসের বহুতলের ফাঁকে দেখলাম আধা চাঁদ উঠেছে। মনে হল এই শহরে আজকের শুরু আর আগামীতে নিরাপদে ফিরে আসবার জিম্মা নিয়েছে প্রকৃতি স্বয়ং। এভাবেই আমার ইচ্ছের ভরণপোষণ কোরও তুমি। আমাকে নির্বিঘ্নে লিখতে দিও হাওরের দীর্ঘশ্বাসের জীবন্ত দলিল।  (চলবে)

ছবি সৌজন্য: লেখক, Roar Media

Samrat Moulik

সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘুরে দেখছেন ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীব্যবস্থা, জানছেন ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া- পাঁচটি দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার একা ভ্রমণ করেছেন দু চাকায় সওয়ার হয়ে। এছাড়াও প্রায় দু দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম,অজানা পাহাড় ও জঙ্গল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের স্নাতক সম্রাটের শখ প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের ছবি তোলা। প্রথম প্রকাশিত বই 'দাগ'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *