ছেলেটা কালোকোলো বেঁটেখাটো। ওর বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় মাথায় বেশ নিচু। ওর মা সন্ধ্যার মতে ছেলে বারো বছরে পড়েছে। লোকজন বলে, বড় হলে মারাদোনার হাইটেরই হবে। তার বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না।

সে যাই হোক, রায়পাড়ার মাঠের চারিধারে দাঁড়িয়ে যারা ম্যাচটা দেখছিল তারা ওর ড্রিবলিং দেখে থ হয়ে গেল। তপন দত্তের ষাট বছর বয়েস হল। সারাজীবন মাঠে ময়দানে ঘুরে ঘুরে জীবন কাটল বা বলা যায় হেলায় নষ্ট হল। কত খেলা দেখেছে এবং কত খেলোয়াড়ের খেলা দেখেছে আজ পর্যন্ত, তা গুণে শেষ করা যাবে না। কিশোর বয়সে দেখা চুনি গোস্বামীর ড্রিবলিং এখনও মনে গেঁথে আছে। তাও চুনির তখন পড়ন্ত বেলা। তা ওই তপন দত্ত বলল,
– আরে এ তো চুনির মতো কাটাচ্ছে। সেই একইরকম ইনসাইডে টোকা মেরে এক ঝটকায় আউটসাইড ডজে বল বের করে নিচ্ছে। পায়ে আঠার মতো বল লেগে। দারুণ… দারুণ…. ।
পাশে দাঁড়ানো বছর ত্রিশের কে একজন বলল,
– হ্যাঁ হ্যাঁ… মারাদোনার মতো… পা থেকে বলই বেরোচ্ছে না। পায়ে চুম্বক লাগানো নাকি!… বাঃ বাঃ।
আর একজন মতামত দিল—
– তেমন তেমন লোকের হাতে পড়লে অনেক দূর যাবে এটা… ওরে বাপরে ড্রিবলিং দেখ! ফ্যানটাস্টিক! চেহারাটাও খানিকটা মারাদোনা টাইপের!
– হ্যাঁ রোগা মারাদোনা বলা যায়… নামটা কি ওর?
স্বরূপ ভটচাজ এ পাড়ার পুরনো বাসিন্দা। তিনি বললেন,
– ওর নাম বিচকে। ছোটখাটো চেহারা বলে সবাই ওকে বিচকে বলে ডাকে। ভাল নাম অমিত না কী যেন…। ওর মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। ওই সুভাষ কলোনির বস্তিতে থাকে। বাবাটা একেবারে অকম্মার ঢেঁকি। ওর ওপরে একটা ভাই আছে। সে একেবারে ফুলবাবু। এই বয়সেই নানা বদগুণ রপ্ত করে ফেলেছে। কী আর বলব…

সন্ধ্যামণির কদিন ধরেই ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছিল। আজ সকাল থেকে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হল। মুখুজ্জেদের বাড়ি থেকে একটা থোক টাকা পায়। বলতে গেলে ও টাকাতেই সংসার চলে। কদিন কামাই হলে ওরা যদি অন্য লোক ঢুকিয়ে নেয়, সর্বনাশ হয়ে যাবে। অবশ্য ও বাড়ির বৌদি এমনি লোক ভাল। শরীরে দয়ামায়া আছে। কিন্তু ওদের তো কাজের লোক ছাড়া একদিনও চলে না। সন্ধ্যামণি না গেলে যে মেয়েটা রান্না করে তাকে দিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নেয়। কিন্তু সেও খুব হিসেবী মেয়ে। এমনি করবে না। ‘এক্সট্রা’ টাকা নেবে। সুতরাং বিচকের মায়ের বদলি লোক তো তারা খুঁজবেই। কিন্তু আজকে শরীর যেন একেবারে চলছে না। হাত পা ছেড়ে যাচ্ছে। মাথায় যেন দশমণি ভার। সন্ধ্যা শুয়ে পড়ল বিছানায়। বিচকের বাবা ‘কী হল? কী হল আবার?’ বলে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তার দ্বারা কোনও কাজ হবার নয়। সন্ধ্যামণি চোখ বুজে অবশ হয়ে পড়ে আছে। সেদিকে চেয়ে কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধেশ্বর মাঝি ছুটে বেরিয়ে গেল রায়পাড়ার মাঠের দিকে। ছোট ছেলেটাকে ডেকে আনার জন্য।

সিদ্ধেশ্বর যখন মাঠের ধারে গিয়ে পৌঁছল বিচকে তখন বল পায়ে ছ’ গজের পেনাল্টি বক্সের ডানদিকের মাথায়। তিনটে ডিফেন্ডার তাকে ঘিরে ধরেছে। পায়ের তলা দিয়ে পেছন দিকে বল টেনে নিয়ে একবার ইনসাইড আর একবার আউটসাইড টোকায় দুটো ডিফেন্ডারকে বডি ফেইন্টে দুদিকে দুলিয়ে বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো দুজনের মাঝখান দিয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে গেল বল একদম পায়ে আটকে রেখে। তারপর চেটো দিয়ে ওই চলন্ত গতিতেই তৃতীয় ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে বল তুলে দিয়ে তাকে তিনটে স্টেপে পেরিয়ে ওদিকে গিয়ে বলটাকে ডান পায়ে নিল। গোলকিপার জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে কোণটা ছোট করে। বলের ওপর ঝাঁপাতে চলেছে। বিচকে এক মুহূর্ত নষ্ট করল না। বলটা বাঁ পায়ে নিল। তারপর চাঁটা মারল বলের তলায়। গোলকিপার বডি থ্রো করেছে। বল তার শরীর এড়িয়ে গোলপোস্টের বাঁ দিকের কোণ দিয়ে ঢুকে গেল। মাঠের ধারে লোকজন চিৎকার করে উঠল। হাততালিতে কান পাতা দায়। স্বরূপ ভটচাজ বললেন,
– ওঃ… চিন্তা করা যায় না! 

আরও পড়ুন: অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প: সাঁতার

সারাজীবন ধরে ফুটবল মাঠে মাঠে ঘুরে মরা এক ব্যর্থ, না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে বেঁচে থাকা বিস্মৃত মাঠের মানুষ তপনজ্যোতি দত্ত কোনও সমুদ্রের ধার বা পাহাড়ের ওপর থেকে নবকিরণে উদ্ভাসিত একটা সূর্যোদয় দেখতে লাগলেন বিচকের দিকে সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। এই সোল্লাস হর্ষ এবং করতালি ধ্বনির মধ্যে তিনি রুদ্ধবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল, জীবন থেকে এখনও বোধহয় কিছু পাওয়া যেতে পারে। সেন্টারে আবার বল বসানো হচ্ছে, সেই সময় বিচকের বাবা সিদ্ধেশ্বর সাইডলাইন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল। 
– এই বিচকে, বিচকে… শিগগির আয়। তোর মায়ের খুব শরীর খারাপ।
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলে প্লেয়ার বদল করিয়ে বিচকে ছুটতে ছুটতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাত্রেই সন্ধ্যামণিকে কোনওরকমে মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে গেল বিচকে আর তার বাবা। ওখানে রাত্রেও ওপিডি চালু থাকে। চিকিৎসা যা হবার ওখান থেকেই হবে। সন্ধ্যামণিদের হাসপাতালের বাইরে ডাক্তার দেখাবার ক্ষমতা নেই। মরণ-বাঁচন যা হবে ওই হাসপাতালের চিকিৎসায়, হাসপাতাল থেকে দেওয়া ওষুধে। ঘণ্টা দুই লাগল অবশ্য। সন্ধ্যার তখন বেহুঁশ অবস্থা। শুয়ে রইল একটা বেঞ্চে। সিদ্ধেশ্বর সেই একইভাবে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল। বিচকে উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে লাগল। কিন্তু ডাক্তারবাবুই বা কী করবেন। এই রাতের বেলাতেও রুগির চাপ প্রচুর। তাঁকে হিমসিম খেলে চলবে না আবেগতাড়িত হবার তো জায়গাই নেই। ঠান্ডা মাথায় চাপ সামলাতে হচ্ছে। 

Dribble
বিচকে তখন বল পায়ে ছ’ গজের পেনাল্টি বক্সের ডানদিকের মাথায়

হাসপাতাল থেকে ওষুধপত্তর নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজল। ওখানে একটা ইঞ্জেকশান দেবার পরে সন্ধ্যার বেহুঁশ ভাবটা খানিকটা কেটেছিল। যাই হোক, বিচকে আর সিদ্ধেশ্বর কোনওমতে বাড়িতে এনে ফেলল সন্ধ্যাকে। মাথা যন্ত্রণাটা কমলেও ঘুসঘুসে জ্বর এবং অবশ ভাব একেবারেই যায়নি। বিছানা থেকে এখনও উঠতে পারছে না সন্ধ্যা। বিচকে মাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওষুধ খাওয়াতে লাগল। বড় ছেলে রোহিত, সে সংসারের সাতে পাঁচে নেই। কে মরল কে বাঁচল তার কিছু যায় আসে না। সে থাকে নারকেলডাঙায় কাকার বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই সেখানে আছে। সিদ্ধেশ্বর রাত জাগতে পারে না। বিচকে প্রায় সারারাত জেগে থেকে মায়ের সেবা করতে লাগল।

এইভাবে দু’দিন কাটল। মুখুজ্জেবৌদির ফোন আসতে লাগল বারবার। বিচকে জানাল মায়ের ভীষণ শরীরখারাপ। তবু একই প্রশ্ন আসতে লাগল কবে নাগাদ আসতে পারবে। ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারছে না সন্ধ্যামণি, জানাল বিচকে। পরের দিন সকালেই আবার ফোন। কেউ ফোন ধরল না। কারণ বিচকে ঘরে নেই। সিদ্ধেশ্বর বাবুদের বাড়ির ফোন ধরে না। সন্ধ্যামণি অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তার ফোনে কথা বলার ক্ষমতাই নেই। মুখুজ্জে ম্যাডাম স্বগতোক্তি করলেন
— পাজির পা ঝাড়া। বেইমান…
ঘরে যে কটা টাকা ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাই দিয়ে বাজার থেকে চারটে মুসাম্বি কিনে এনেছে বিচকে। ডাক্তার ফল খেতে বলেছে। ভিটামিনের নাকি খুব অভাব আছে শরীরে। সন্ধ্যামণির ঘুম ভেঙেছে। বিচকে মুসাম্বি কেটে নিয়ে এল মায়ের কাছে। বসল এসে পাশে। সন্ধ্যামণির চোখের কোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল ছেলের মুখের দিকে। বিচকের মনে ভীষণ কষ্ট হল। সে বলল,
– মা, কাঁদছ কেন? তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?
সন্ধ্যামণি ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কান্নাভেজা গলায় বলল,
– আমি চলে গেলে তোকে কে দেখবে বাবা… তুই এত ছোট …
চোখের জল অবারিত ধারায় বেরিয়ে আসতে লাগল তার গাল বেয়ে। বিচকে মায়ের শরীরের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– না মা তোমাকে আমি কিছুতেই যেতে দেব না। কিছুতেই যেতে দেব না। তোমার কিচ্ছু হবে না মা। ওষুধগুলো খেলেই তুমি ভাল হয়ে যাবে দেখো।
বিচকে তার মাকে জড়িয়ে ধরে রইল নিবিড় মমতায়। মুখুজ্জে ম্যাডামের ফোন এল আবার। টালির ছাদের ভাঙাচোরা ঘরে ফোন বাজতে লাগল। ফোন ধরার পরিস্থিতি তখন সে ঘরে নেই। ফোন বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে অবসর নিল। মুখুজ্জে ম্যাডাম রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন।

এদিকে সন্ধে হতে না হতে খবর ছড়িয়ে গেল সারা দুনিয়ায়— মারাদোনা প্রয়াত হয়েছেন। দিকে দিগন্তে কয়েক কোটি লোকের চোখ অকারণে ছলছল করে উঠল। চোখের সামনে আচমকা দুলতে লাগল চৌত্রিশ বছর পিছনের বিদ্যুৎগতির বুলডোজার শিল্প। ইংল্যান্ডের একের পর এক ডিফেন্ডার এক অনন্য সম্মোহনে ছিটকে যাচ্ছে এদিকে ওদিকে। নিরুপায় গোলকিপার একটা শেষ চেষ্টা দিল। কয়েক ফুট এগিয়ে এল অ্যাঙ্গেল ছোট করবার আশায়। কাজে দিল না। সম্মোহনে কাবু হয়ে গেল। মারাদোনার ডান পা থেকে পলকে বাঁ পায়ে গেল বল। বাঁ পায়ের আউট স্টেপের টোকা। অসহায় গোলকিপার পিছন ফিরে দেখল তার ডানদিকের পোস্ট ঘেঁসে বল যাচ্ছে জালের দিকে। দুলতে লাগল ছবি। আরও অনেক অনেক ছবি। টেনে জড়িয়ে মেরে ধরে আটকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। বিদ্যুতের গতিতে মাঠময় ছবি আঁকছে এক প্রাণবন্ত বাঁ পা। সবাই মিলে মহা হয়রান হচ্ছে ওঁকে বাগে আনবার জন্য। কয়েক কোটি মানুষের বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করতে লাগল। কিছুক্ষনের জন্য ঘরদোর শূন্য লাগতে লাগল।

সারাজীবন ধরে ফুটবলের মাঠে মাঠে পাক খাওয়া ব্যর্থ খেলোয়াড়, ব্যর্থ কোচ, ব্যর্থ সংসারী তপন দত্ত রাত প্রায় আটটার সময় গুম মেরে বসেছিলেন। তাঁর অর্ধাঙ্গিনী কণিকা এসে বললেন,
– আরে তুমি যে কে কোথায় মারা গেছে তার শোকেতাপে একেবারে গড়াগড়ি খাচ্ছ। নিজের সংসারের দিকে একটু চোখ ফেরাও। তার যে কী মড়ার হাল কোনও খবর রাখ!
তপনজ্যোতি কোনও উত্তর দিলেন না। চুপ করেই বসে রইলেন। ওই একই প্রশ্নোত্তরমালার বস্তাপচা পুনরাবৃত্তির সম্মুখীন হওয়ার প্রবৃত্তি হল না এই মুহুর্তে। বত্রিশ বছর কেটে গেল এইভাবে। তিমির আর ঘুচল না কখনও। তপন দত্ত যে শুধু মারাদোনার শোকে বিহ্বল হয়ে বসেছিলেন তা আসলে নয়। একটা সুখস্বপ্নের আলোকরেখা নিবিড় গোপনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল তার মনের কোণে। তিনি হঠাৎ উঠে পড়ে গায়ে জামাটা গলাতে গলাতে বললেন,
– আমি একটু আসছি…
– বেশি রাত কোরও না কিন্তু। তোমার জন্য জেগে বসে থাকতে পারব না বলে দিলাম….
– না না আর দেরি হবে না। যা করবার তাড়াতাড়িই করব।
কণিকা ঠিক বুঝতে পারল না।

মুখুজ্জেদের বাড়ি থেকে একটা থোক টাকা পায়। বলতে গেলে ও টাকাতেই সংসার চলে। কদিন কামাই হলে ওরা যদি অন্য লোক ঢুকিয়ে নেয়, সর্বনাশ হয়ে যাবে। অবশ্য ও বাড়ির বৌদি এমনি লোক ভাল। শরীরে দয়ামায়া আছে। কিন্তু ওদের তো কাজের লোক ছাড়া একদিনও চলে না। সন্ধ্যামণি না গেলে যে মেয়েটা রান্না করে তাকে দিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নেয়। কিন্তু সেও খুব হিসেবী মেয়ে। এমনি করবে না। ‘এক্সট্রা’ টাকা নেবে। সুতরাং বিচকের মায়ের বদলি লোক তো তারা খুঁজবেই।

রাস্তায় সিদ্ধার্থ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হল। সিদ্ধার্থ অনেক পরের প্রজন্মের হলেও আগেকার যুগের ক্রীড়াজগতের সব খবরাখবর রাখে। পেশায় সে একটা নামী কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। কিন্তু খেলাধুলো ভীষণ ভালোবাসে। বিশেষ করে ফুটবল। তপনজ্যোতির ফুটবল জীবন ও তার ব্যর্থতা সম্বন্ধে সিদ্ধার্থ ওয়াকিবহাল। এ ব্যাপারে তপন দত্তর ওপর তার একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত সমবেদনা আছে। সে এখনও মনেপ্রাণে কোচ হিসেবে তপনের একটা ‘ব্রেক’ কামনা করে।
— আরে… তপনদা হন্তদন্ত চললেন কোথায়?
তারপর নেহাতই পরিহাসছলে বলল,
– কোনও জিনিয়াস টিনিয়াসের সন্ধান পেয়েছেন নাকি?
কথাটা ওই পরিস্থিতিতে এত খাপ খেয়ে গেল যে তপনজ্যোতি চমকে গেলেন। বললেন,
– হ্যাঁ… ওই… বলতে পারো… অনেকটা সেইরকমই।
সিদ্ধার্থ অবাক, খুশি এবং কৌতূহলী তিনটেই একসঙ্গে হল। তবে কৌতূহল প্রকাশ করল না। বলল,
– বাঃ দারুণ দারুণ… দেখিয়ে দিন তো দাদা… আমরা চাই আপনি কী সেটা সবাই জানুক। দেখিয়ে দিন ওস্তাদের খেল।
তপনজ্যোতি দত্তর বুকের ভেতর গুরগুর করে উঠল এক তীব্র রোমাঞ্চে। রাত সাড়ে আটটার সময়ে সুভাষ কলোনিতে ঢুকে তপনবাবু একটা পান সিগারেটের দোকানে জিজ্ঞাসা করলেন,
– আচ্ছা, এখানে অমিত মাঝি মানে বিচকের বাড়িটা কোথায়? ওই ফুটবল খেলে… কালো মতো…
দোকানদার মাথা নেড়ে দাঁত বের করে হেসে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি… সামনে এগিয়ে যান। ওই বাঁ দিকের কোণের বাড়িটা… কোনও ম্যাচ ট্যাচ আছে নাকি?
— হ্যাঁ… ও..ই একটা… ঠিক আছে, ধন্যবাদ।
তপনবাবু এগিয়ে যান। টালির চালের থ্যাবড়া মতো ঘেয়ো ঘরটার সামনে গিয়ে তপন দত্ত দুবার
‘অমিত… অমিত’ বলে ডাকলেন। বিচকে বেরিয়ে এল।
— খোকা তুমি আমাকে চিনবে না। আমার নাম তপনজ্যোতি দত্ত। একসময়ে বেঙ্গলের আনডার সিক্সটিন টিমের কোচিং করিয়েছি। বিএনআর, এরিয়ান, খিদিরপুর টিমে খেলেছি একসময়ে। এসব তোমাদের জানার কথা নয়। সে যাই হোক, তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল… 
বিচকে নির্বিকারভাবে বলল,
– কবে ম্যাচ? কত দেবেন? 

Football
অমিত মাঝি মানে বিচকের বাড়িটা কোথায়? ওই ফুটবল খেলে… কালো মতো…

তপনজ্যোতি ফুটবলের খেপ সংষ্কৃতির সঙ্গে আবাল্য অভ্যস্ত। তিনি জানেন বহু কিশোরের অভাবের সংসার চলে এই খেপ খেলা রোজগারের টাকায়। এই কিশোরদের বেশিরভাগেরই লেখাপড়ার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। লাগাতার খেপ খেলে খেলে শরীরটা হয়ে যায় চোট আঘাতের বাসা। প্রায় কারোরই তেমন চিকিৎসা হয় না এবং চোট পুষতে পুষতে অধিকাংশ প্রতিশ্রুতিবান খেলোয়াড় অকালে ঝরে যায়। তপনবাবু একটু হেসে বিচকের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
– না না, কোনও ম্যাচ নেই। আমি ম্যাচ খেলাতে আসিনি।
– তবে? আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ খারাপ। তিনদিন ধরে শুয়ে আছে। যা বলবার একটু তাড়াতাড়ি বললে ভাল হয়।
– তাই নাকি! মায়ের শরীরখারাপ? ডাক্তার দেখেছে? আমি কি ডাক্তারকে খবর দেব?
– হ্যাঁ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। মা বলছে আর বাঁচবে না।
– না না সে কখনও হয় না। আজ রাতটা ওয়েট কর। কাল সকালেই আমি সব ব্যবস্থা করব। কিচ্ছু চিন্তা কোরও না। যাই হোক, আমি কাল সকালে আসব। ডাক্তার নিয়ে আসব। যেটা বলতে এসেছিলাম, সেটা তখনই বলব। 

তপন দত্তর মূল বক্তব্য হল, তিনি আনডার ফিফটিন এজ গ্রুপের একটা ক্লাব টিম করতে চান। হল্যান্ডের আমস্টারডামে ওই এজ গ্রুপের একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আছে। প্রায় সব দেশ থেকে ক্লাব টিম আসছে। চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ-এর জন্য পুরস্কার মূল্য প্রচুর। তাছাড়া বিজয়ী দলের কোচের জন্য বড়সড় মূল্যের পুরষ্কার আছে। বিচকেকে কেন্দ্র করে একটা দল খাড়া করতে চান। তপনজ্যোতি তার দলের নামও ঠিক করে ফেলেছেন— ইয়োলো ডায়মন্ড। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে আনমনে ভাবতে ভাবতে স্বপ্নের জগতে চলে গেলেন তপন। তিনি নিজেকে ছিয়াশির আর্জেন্টিনার কোচ বিলার্ডো ভাবতে লাগলেন এবং বিচকে তাঁর স্বপ্নে মারাদোনা হয়ে মাঠ দাপিয়ে ড্রিবলিং-এর যাদুতে বিপক্ষকে তছনছ করতে লাগল। এই রকম স্বপ্নের ঘোরে সারারাত কাটল। মাঝে মাঝেই তাঁর ঘুম ছুটে যেতে লাগল এবং ঘুমের ঘোরে নানারকম কথা বকবক করতে লাগলেন। সহধর্মিনী কণিকাদেবীর এই উৎপাতে বারবার ঘুমের ব্যাঘাত হতে লাগল। তিনি তীব্র অসন্তোষ এবং বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
– উঃ সারাদিন ধরে খেটে মরার পর রাত্রে যে একটু ঘুমোব সে উপায়ও নেই। ছেলেমানুষের মতো কাণ্ড। একটু পাশ ফিরে শোও… পাশ ফিরে শোও। দয়া করে একটু ঘুমোতে দাও। 

চোখের সামনে আচমকা দুলতে লাগল চৌত্রিশ বছর পিছনের বিদ্যুৎগতির বুলডোজার শিল্প। ইংল্যান্ডের একের পর এক ডিফেন্ডার এক অনন্য সম্মোহনে ছিটকে যাচ্ছে এদিকে ওদিকে। নিরুপায় গোলকিপার একটা শেষ চেষ্টা দিল। কয়েক ফুট এগিয়ে এল অ্যাঙ্গেল ছোট করবার আশায়। কাজে দিল না। সম্মোহনে কাবু হয়ে গেল। মারাদোনার ডান পা থেকে পলকে বাঁ পায়ে গেল বল। বাঁ পায়ের আউট স্টেপের টোকা। অসহায় গোলকিপার পিছন ফিরে দেখল তার ডানদিকের পোস্ট ঘেঁসে বল যাচ্ছে জালের দিকে। দুলতে লাগল ছবি।

কিন্তু হল্যান্ডের ওই টুর্নামেন্টে সুযোগ পেতে গেলে একটা ট্রায়াল টুর্নামেন্ট খেলতে হবে। সেখানে কোয়ালিফাই করতে পারলে তবেই ওখানে যাওয়ার ছাড়পত্র মিলবে।পূর্ব ভারত থেকে দুটো টিম যেতে পারবে— চ্যাম্পিয়ন আর রানার্স। টুর্নামেন্টটা হবে ময়দানে মহমেডান স্পোর্টিং মাঠে। পরেরদিন সকালে ডাক্তার সুব্রত ঘোষকে নিয়ে এলেন তপন দত্ত। ডাক্তার দেখলেন, প্রেসক্রিপশান লিখলেন এবং কিছু রুটিন ব্লাড এবং ইউরিন টেস্ট করতে দিলেন। এও বললেন,
– রেস্টের দরকার। নতুন ওষুধ কিছু দিলাম না। আগেরগুলোই চলুক। এক সপ্তা পরে কেমন আছে জানাবেন।
ডাক্তারবাবু বলে গেলেন রেস্টের দরকার। কিন্তু রেস্টটা হবে কী করে? সন্ধ্যামণি কাজে না বেরোলে ঘরের তিনটে লোকের খাওয়া জুটবে কি করে? বিচকে তাই এককথায় রাজি হল তপনজ্যোতির প্রস্তাবে। আরও দুদিন পরের কথা। সন্ধ্যামণি এখন উঠে বসতে পারছে। ওষুধটা ধরেছে মনে হয়। একটু চলাফেরা করার অবস্থায় না আসতে পারলে রক্ত, প্রস্রাব কিছুই পরীক্ষা করা যাবে না। কারণ ওগুলো করতে গেলেও তো সেই বিনা পয়সার হাসপাতালই ভরসা। থাক ওসব এখন।

এদিকে মহমেডান মাঠে ট্রায়াল ম্যাচ। বেলা সাড়ে চারটে বাজে। সন্ধ্যামণি আবার শুয়ে পড়ল। মাথাটা বড় ভারী লাগছে। বিচকে খেলতে গেছে তপনজ্যোতিবাবুর সঙ্গে কোথায় একটা জায়গায়… ওই ধর্মতলার দিকে। সন্ধ্যামণি কোনওদিন ধর্মতলা বা গড়ের মাঠ দেখেনি। মুখুজ্জে বৌদির কত অসুবিধে হচ্ছে সে কথা তার মাথায় ঘুরছে এই অবশ মস্তিষ্কেও। সিদ্ধেশ্বর মনের চাপ কাটানোর জন্য ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে লাগল। মারাদোনা না কে একটা মারা গেছে। রাস্তার ধারে ওই ক্লাবঘরে নীল সাদা জামা পরা, বিচকের মতো বেঁটে, ঝাঁকড়াচুলো একটা প্লেয়ারের বড় বড় ছবি সাঁটাচ্ছে কেলাবের ছেলেরা। ইয়োলো ডায়মন্ড জিততে পারলে রেজিস্ট্রেশান পাবে। এ তো সবে টুর্নামেন্টের ফার্স্ট রাউন্ড। কিন্তু প্রথমেই ‘টাফ টিম’ পড়েছে। মালেশিয়ার টিম।

তপনজ্যোতি মাঠের ধারে ডাগ আউটে বসে আবার স্বপ্নের জালে জড়িয়ে গেলেন। উঠে গিয়ে বিলার্ডোর স্টাইলে শশব্যস্ত হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন। মাঠের ভেতর বিচকে ছুটছে মারাদোনা হয়ে। খেলা শেষ হতে আর নব্বই সেকেন্ড বাকি। বিচকে বল ধরল বিপক্ষের লেফট হাফ লাইনের কাছে নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে। অবিকল ছিয়াশির মারাদোনার মতো পায়ের তলা দিয়ে বল টেনে রোল করে ঘুরে গেল। একজন… দুজন… তিনজন ছিটকে গেল ডান পায়ের ইনসাইড আউটসাইড ডজে। বাঁদিক দিয়ে সমান্তরালভাবে চড়চড় করে উঠে আসছে সেন্ট্রাল মিডিও। বিচকে পেনাল্টি বক্সের বাঁদিকে পৌঁছে ছুটন্ত অবস্থায় একটা ওয়াল খেলল মিডিওর সঙ্গে। ছ’ গজের পেনাল্টি বক্সের মাথায় বল পায়ে পৌঁছে সামনে পেল শেষ ডিফেন্ডারকে। চলন্ত অবস্থাতেই ডানপায়ে ক্ষিপ্র আউটসাইড ডজ মারল। বেশ খানিকটা সূক্ষ্মকোণে চলে গেছে বিচকে। সময় নষ্ট করল না। গোলকিপারকে ভাববার সময় দিল না। ডান পা থেকে বুলেট ছুটে গেল পোস্ট আর বারের ডান কোণ দিয়ে। খেলা শেষ হতে আর পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড বাকি।

তপনজ্যোতি সাইডলাইনের ধারে দাঁড়িয়ে চোখ বুজিয়ে একনাগাড়ে দুই মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকিয়ে যেতে লাগলেন। যদিও এটা কিছুই না। সবে প্রথম রাউন্ডের বেড়া টপকাল। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে। কিন্তু তপনজ্যোতি ভাবলেন তাঁর জীবনে একটা আইডেন্টিটি দরকার ছিল, বিচকে তাঁকে সেটা সংগ্রহ করে দিল। সারাজীবন ধরে অনটনে কাটানো, মাঠে মাঠে ঘুরে জীবন ক্ষইয়ে ফেলা তপনজ্যোতি দত্তের মনে একটা আলোক উদ্ভাসিত দিগন্তরেখা জেগে উঠল। মাঠের মধ্যে তখন বিচকেকে নিয়ে উৎফুল্ল নাচানাচি চলছে। 

Football 2
আপনার নতুন আবিষ্কার তো ক্যান্টার করে দিয়েছে খবর পেলাম।

বিচকেকে নিয়ে তপন দত্ত সুভাষ কলোনিতে পৌঁছলেন রাত নটা নাগাদ। দেখা গেল বিচকের মা বিছানা থেকে উঠে স্টোভ ধরাচ্ছে। বিচকে ছুটে ঘরে ঢুকে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– মা… বলেছিলাম না তোমাকে মরতে দেব না! জানো, খুব বড় মাঠে খেললাম আজকে। গড়ের মাঠে। কী সুন্দর! চারদিক ঘেরা। আমি একটা গোল করেছি। সবাই বলল, আমি নাকি মারাদোনার মতো খেলি।
প্রায়শই ভ্যাবলা মেরে যাওয়া সিদ্ধেশ্বর মাঝির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল অনাবিল হাসিতে। তপনজ্যোতি দত্ত পরের রাউন্ডের ছক কষতে লাগলেন মনে মনে নিজেকে কার্লোস বিলার্ডো ভেবে।

***

পরদিন সকালে বাজারে বেছে বেছে চারাপোনা গামলায় তুলছিলেন তপনজ্যোতি দত্ত। একশো ষাট টাকা কেজি। এর কম দামে খাওয়ার যোগ্য মাছ বাজারে পাওয়া গেল না। বাড়িতে তিনটে লোক। তপন-কণিকা দম্পতি ছাড়া তপনবাবুর এক ভাগ্নে তাঁদের সঙ্গেই থাকে। হাসনাবাদের ওদিকে বাড়ি। কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইংরিজিতে অনার্স পড়ে। মামার খুব ভক্ত এবং মামির খুব প্রিয়পাত্র। কণিকার মতে ‘খুব করিতকর্মা ছেলে। মামার মতো লগবগে নয়।’ তাঁরা নিজেরা নিঃসন্তান। তা নিয়ে তেমন ক্ষোভ বা অসন্তোষ কিছু অবশ্য নেই ওঁদের দুজনের মনে।
– দাদা, কালকের খবর পেয়েছি। আপনার নতুন আবিষ্কার তো ক্যান্টার করে দিয়েছে খবর পেলাম। রিয়েলি চাইল্ড প্রডিজি।
তপনবাবু চারাপোনা থেকে মুখ তুলে দেখলেন সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে। সিদ্ধার্থ বিশ্বাস, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। তপনবাবু গামলাটা মাছওয়ালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
– আরে তুমি জানলে কী করে? পেপারে তো বেরয়নি।
– আরে দাদা… খবর কি আর চাপা থাকে! পেপারে এক কোণে খুব ছোট করে বেরিয়েছে। ভাল, খুব ভাল… আপনার দিন আসছে।
– আরে না না, মগডালে তুলো না এখনই। স্পনসর না পেলে এগোতেই পারব না। এতগুলো ছেলের খরচ… খাওয়া দাওয়া, কনভেয়্যান্স এইসব তো আছেই। তাছাড়া ইমারজেন্সি মেডিক্যাল এক্সপেন্সের ব্যাপার আছে। অনেক ছেলের জন্য নতুন বুট কেনার দরকার এক্ষুণি। সব মিলিয়ে ভালো খরচার ধাক্কা। টুর্নামেন্ট না জিতলে তো কোনও ফিনান্সিয়াল বেনিফিট পাব না। খুব টেনশানে আছি। জানি না স্পনসর না পেলে শেষ পর্যন্ত টানতে পারব কিনা।
সিদ্ধার্থ অতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া দিল—
– না না সে সেটা হতে দেওয়া যাবে না। ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।
সিদ্ধার্থর সহযোগিতাপ্রবণ অনুভূতিশীলতা দেখে তপনজ্যোতি গভীরভাবে আপ্লুত হলেন। বললেন,
– সে তো বুঝলাম। কিন্তু ব্যবস্থাটা কী? আমি তো তেমন কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছি না। এসব সামলে সেকেন্ড রাউন্ডের ওপর কনসেনট্রেট করতে হচ্ছে। সামনের শনিবার ম্যাচ। কী হবে জানি না। আমি ওই অমিত মাঝি মানে, বিচকের ওপর ভীষণভাবে ওপর ভরসা করে আছি।
– আপনি ম্যাচের ওপর কনসেনট্রেট করুন তপনদা। আমাদের কোম্পানি ইন্ডিয়ান ফুটবল ডেভেলপমেন্টের ওপর একটা প্রোজেক্ট আন্ডারটেক করেছে। আমি আপনাকে থিয়েটার রোডের অফিসে আপনাকে নিয়ে যাব। ওখানে পিআরও-র সঙ্গে আপনাকে মিট করিয়ে দেব। আমি যতটা পারি বলে রাখব। মনে হয় প্রবলেম হবে না।
তপনবাবু বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন সিদ্ধার্থর মুখের দিকে। কিছু হোক না হোক ছেলেটা তাঁর কথা গুরুত্ব দিয়ে তো ভাবছে। তাঁর উপকার করতে চাইছে। সেটাই বা কম কী? দুনিয়ায় কে আর কার কথা ভাবে। 

তপন দত্তর মূল বক্তব্য হল, তিনি আনডার ফিফটিন এজ গ্রুপের একটা ক্লাব টিম করতে চান। হল্যান্ডের আমস্টারডামে ওই এজ গ্রুপের একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আছে। প্রায় সব দেশ থেকে ক্লাব টিম আসছে। চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ-এর জন্য পুরস্কার মূল্য প্রচুর। তাছাড়া বিজয়ী দলের কোচের জন্য বড়সড় মূল্যের পুরষ্কার আছে। বিচকেকে কেন্দ্র করে একটা দল খাড়া করতে চান। তপনজ্যোতি তার দলের নামও ঠিক করে ফেলেছেন— ইয়োলো ডায়মন্ড। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে আনমনে ভাবতে ভাবতে স্বপ্নের জগতে চলে গেলেন তপন। 

বেলা আড়াইটে নাগাদ থিয়েটার রোডে পনেরোতলা বিল্ডিংয়ের আটতলায় তপন দত্তকে নিয়ে সাইনার্জি ফার্মাসিউটিক্যালসের পিআরও-র চেম্বারে ঢুকল সিদ্ধার্থ। পিআরও-র স্থূলকায় চর্বিবহুল চেহারা। কোমরের বেল্ট উপচে পেট বেরিয়ে আসতে চাইছে গায়ের শার্ট ফুঁড়ে। বেশ ভালোমানুষ ধরনের গোলগাল চোখমুখ। ধুরন্ধর টাইপের নয়।
— আসুন আসুন… সিদ্ধার্থর মুখে আপনার কথা এত শুনেছি কী বলব… আপনার সবকিছু আমার মুখস্থ হয়ে গেছে মশায়। আমি নিজেও একজন ডাইহার্ড ফুটবল ক্রেজি।
– না না আমি অতটা কিছু নই। সিদ্ধার্থ আমাকে ভালোবাসে বলে…
– না না সে কখনও হয় না। শুধু ভালোবাসা থেকে বললে সে বলত , লোকটা খুব ভালো… এর বেশি কিছু নয়। যাক সে কথা, আমি হানড্রেড পারসেন্ট চেষ্টা করব আপনার টিম যাতে সাইনার্জির স্পনসরশিপ পায়। অন্তত আমার দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না। কিন্তু একটা ছোট ক্রাইটেরিয়া আছে। সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচটা জিততে হবে। ওটা জিতলে আমি আশা করি ফুল স্পনসরশিপ বার করে আনতে পারব। আমি এম ডি-কে একটা হিন্ট দিয়ে রেখেছি।
তপন দত্ত আশা নিরাশার দোলা মেশানো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদুস্বরে বললেন,
– হ্যাঁ… তা তো বটেই… সেকেন্ড রাউন্ডটা তো জিততেই হবে। নইলে আর কী করে হবে…
– নিশ্চয়ই জিতবেন… নিশ্চয়ই জিতবেন। শুনলাম আপনি একটা মারাদোনা পেয়ে গেছেন… লাকি এনাফ…
– হ্যাঁ ছেলেটার কোয়ালিটি আছে। কিন্তু প্রপার গ্রুমিং দরকার। জানি না ওর ভবিষ্যৎ কী। খুব গরীব ওরা।
– লেটস বি অপটিমিস্টিক। দেখা যাক কী দাঁড়ায়। ওক্কে, সিদ্ধার্থ, গিভ মি আ কল আফটার দা ম্যাচ।    (চলবে…)

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৯ জুন বুধবার
*ছবি সৌজন্য: Artmajeur, Pixels

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণায় জন্ম ১৯৫৩ সালে। কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। প্রথাগত পড়াশোনা থেকে চিরকালই পলাতক। লেখালেখির সঙ্গে জড়িত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। ফিলহাল ডিজিটাল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মনোনিবিষ্ট। চাকরি ঘুরে ফিরে বিভিন্ন জায়গায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *