আগের পর্ব পড়তে: [] [] []

প্রায় এক ঘণ্টার যন্ত্রণাভোগের পর গাড়িটা রাস্তার ধারে রাখলাম মানসিক, শারীরিকভাবে ক্লান্ত মুখের ভেতরটা ব্লটিং পেপারের মতো শুকনো, জিভটা তেতো বাঁ দিকে বসা গম্ভীর মুখ দাড়িওলা ভদ্রলোক মিনিটখানেক একটা ফর্মে যা লেখার লিখে কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
হিয়ার ইউ গো, মাইট!
(যাঁরা অস্ট্রেলীয় উচ্চারণের সঙ্গে পরিচিত নন, ‘মাইটকথাটার ইংরিজি অর্থমেট’ (Mate), বাংলায়বন্ধুবাদোস্ত’)কাগজটার শেষ লাইনে বড় বড় করে লেখা ‘FAILED’ ভাবলাম, with friends like this who needs enemies? এমন বন্ধু থাকতে শত্রুর দরকার কি একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা ইস্কুলে একবার ভূগোলে গোল লাইন থেকে পতন রক্ষা করেছিলাম, কলেজে কঠিনভাইব্রেশনবিষয়টি ভালোরকম কাঁপিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সরাসরি ফেল করার দুর্ভাগ্য আগে কখনও হয়নি

দেশে কিন্তু আমার গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছিল এক সদাশয় চেহারার নাদুশনুদুশ ভদ্রলোক সল্টলেক এলাকায় ফাঁকা রাস্তায় মিনিট পনেরো ঘুরিয়ে প্রাথমিক দক্ষতা আছে কিনা দেখে নিয়ে পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াতে যাবার পর নিজের গড়িমসির জন্যই সেই লাইসেন্সের বৈধতা শেষ হয়ে গিয়েছিল ক্যানবেরা মোটামুটি নিঝুমপুরী অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য শহরের তুলনায় দিনের ব্যস্ততম সময়েও রাস্তায় যানবাহন অনেক কম তার মধ্যেও পরীক্ষক সাহেব খুঁজে খুঁজে কঠিনতম জায়গায়, পরিস্থিতিতে আমার দক্ষতা পরখ করলেন ভুল অনেকগুলিই করেছিলাম, যার মধ্যে অমার্জনীয় ছিল তিন চার সেকেন্ড একটা দু’লেনের রাস্তার মাঝামাঝি দিয়ে চালানো মনে রাখার মতো একঘণ্টাকখনও শেন ওয়ার্ন, কখনো গ্লেন ম্যাকগ্রার মোকাবিলা করছি পরীক্ষক সিলি মিডঅনে ওঁত পেতে আছেন ভুলভ্রান্তির সন্ধানে

Canberra
ক্যানবেরা এক নিঝুমপুরী

রামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুবই সীমিততবে একটা গল্প শুনেছিলাম কোনও এক ভক্ত তাঁর নানা দুর্দশা নিয়ে ঠাকুরের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছিলেন ঠাকুর হাত তুলে আশ্বাস দিয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে মানে সয়ে যাবেমাসখানেক বাদে দ্বিতীয়বার ফেল করার (এবারে কারণ ছিল অতি সাবধানী হয়ে অন্যান্য যানবাহনের গতি শ্লথ করে দেওয়া) পরে আমার কেন জানি না, অতটা খারাপ লাগছিল নাব্যর্থতার সঙ্গে একটা মানসিক সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে কর্মস্থল, বাজারহাট হাঁটা পথে হলেও ক্যানবেরার মতো শহরে গাড়ি না চালাতে জানা একটা বড় রকমের সমস্যা, বিশেষ করে ছোট বাচ্চা থাকলে আমার কন্যার বয়স তখন পাঁচ ভরা শীতের মধ্যে বাসস্ট্যান্ডে বেচারিকে নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে কান্না পেয়ে যেত ভেবেছিলাম হাল ছেড়েই দেব কিন্তু ছাত্রজীবনে খড়্গপুরে এক অধ্যাপকের হাত দেখা স্ত্রীয়ের কথা ফলে গেলভদ্রমহিলা বলেছিলেন আমার জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতি বন্ধুবান্ধব সামলে দেবে ভবিষ্যদ্বাণী ক্ষেত্রে একদম নির্ভুল প্রমাণিত হল। বিভিন্ন উৎস থেকে অযাচিত সাহায্য পেয়ে গেলাম

Driving Form
গাড়ি চালানোর পরীক্ষা উতরাতে আমিও পিটারের দ্বারস্থ হলাম

আমার বারংবার বাহনচালনায় ব্যর্থতার খবর বন্ধুমহলকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে সেই সময়ে এক সান্ধ্য নিমন্ত্রণে একজন জানালেন, তাঁর স্ত্রীও বার তিনেক ফেল করেছিলেনশেষে পিটার নামে এক ট্রেনার তাঁকে ঠিকঠাক তালিম দিয়ে উতরে দেনদিনকয়েক বাদে আরও একজন ফেলুড়ে (কথাটা বুদ্ধদেব গুহরখেলা যখনউপন্যাসটি থেকে চুরি করাআমার প্রয়াত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দাদার প্রিয় উপন্যাস ছিল সেটি) ভদ্রলোক পিটারকে দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন অতঃপর আমিও পিটারের দ্বারস্থ হলাম অস্ট্রেলিয়ানদের তুলনায় রীতিমতো ছোটখাটো চেহারা, মাথাজোড়া টাক, মৃদুভাষী ধুতি চাদর পরিয়ে দিলে সংস্কৃত পন্ডিত বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায় প্রায় সাতাশ বছর বাদে স্বীকার করতেই হবে, ভদ্রলোক প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়া আমাকে পরম ধৈর্যের সঙ্গে নানা ভুলত্রুটি শুধরে দিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটাই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আশির দশকে আনন্দবাজারে প্রায়ইসত্যদা’ নামে এক ভদ্রলোকের ছবিসহ বিজ্ঞাপন থাকতওঁর কোচিংয়ে নাকি অব্যর্থ সাফল্য আমি আর জীবনসঙ্গিনী চন্দনা পিটারের নাম দিয়েছিলাম সত্যদা 

আমার দুর্দশার কথা আমার সহকর্মীরাও জেনে গেছেন ততদিনে আমারই সমবয়সী এক মহিলা প্রস্তাব দিলেন, কাজে যাতায়াতের পথে উনি আমায় তালিম দিতে পারেন ছুটির দিনে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবও যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন প্রায় মাসখানেক নিয়মিত অনুশীলনের ফলে তৃতীয়বারে পাশ করে গেলামঅনেকের কাছে (উদাহরণ আমার দাদা) গাড়ি চালানো প্রায় হাঁটার মতোই সহজআমার সেই সহজাত দক্ষতা ছিল না তাই এইপাশটির তাৎপর্য বেশ অন্যরকম আমার কাছেপশ্চিমী দেশগুলোতে যেসব ক্ষেত্রে মানুষের জীবনের ঝুঁকি ও  নিরাপত্তা জড়িত, সেসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনও মায়াদয়া নেই ফাঁকি দিয়ে বা উৎকোচ প্রদান করে পার পাওয়া যায় না সেই জন্য গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র মানুষের কাছে পাসপোর্টের মতোই মূল্যবান ওয়ালেটে রাখা প্লাস্টিকের কার্ডটির গুরুত্ব সম্বন্ধে আমিও তাই প্রতিমুহুর্তে সচেতনদু’বার ফেল করার দীর্ঘশ্বাস কি সহজে ভোলা যায়?

আজকাল সেই দিনগুলির কথা ভাবলে হাসি পায় সেই লাইসেন্স পাওয়ার পর তিন চার লক্ষ মাইল গাড়ি চালিয়েছি একসময়ে লেপটে থাকা সন্তানরা বড় হয়ে গিয়ে নিজেদের জীবন কাটাচ্ছ পশ্চিমী দুনিয়ায় যৌবনের রাজত্ব বুড়োবুড়ি শূন্য বাসায় দিন কাটাচ্ছি ক্যানবেরার রাস্তাঘাট সুন্দরজ্যামজট নেই পরিচিত রাস্তা দিয়ে আনমনে কথা সে কথা ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌঁছে যাই ভাবনাগুলো উজান বেয়ে মধুর অতীতে ঘোরাফেরা করে

সাধে কি বলে, স্মৃতি সততই সুখের

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *