আগের পর্ব পড়তে: [] []

১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকেলে একটা স্যুটকেস আর খানকতক ডিগ্রি নিয়ে সিডনির কিংসফোর্ড স্মিথ বিমানবন্দরে নেমেছিলাম জীবনের এই পর্যায়ে এসে ভাবতেই ভয় করে কোন সাহসে সেই ঝুঁকি নিয়েছিলাম! শুধু আমি নয়, সেই সময়ে অনেক ভাগ্যন্বেষীই একইভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে এসে পড়েছিলেন তখন ইন্টারনেট ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের কাছে একদমই অপরিচিত ছিলসুতরাং দেশটার সম্বন্ধে প্রাথমিক তথ্যও ছিল না শুধু জানতাম দেশটায় অনেক ক্যাঙ্গারু আছে, আর ভালই ক্রিকেট খেলেতারপর কী হল সে কাহিনি শোনাবার বিস্তর অবকাশ পাব এই ধারাবাহিক কলামে এই পর্বে কিছু তথ্য দেব সেটা হয়তো কিছু পাঠকের জানাআবার সময় বা আগ্রহের অভাবে অনেকেই হয়তো জানেন না যখন প্রথমবার দেশটায় পা রেখেছিলাম আমারও অনেককিছুই অজানা ছিল শখের ইতিহাসবিদ হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস (মানে বিগত আড়াইশো বছরের) নিয়ে কিছু বলব 

সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতেওপুরনো পৃথিবী মানুষের কাছে আমাদের গ্রহের এই বিশাল স্থলভাগটির অস্তিত্ব প্রায় অজানাই ছিল (পুরনো পৃথিবীর অন্তর্গত ছিল বর্তমানের ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা) কমবেশি দুই লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার পূর্ব দিকে বর্তমানের ইথিওপিয়া অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল আধুনিক  মানুষের, মানে হোমো সেপিয়েন্সদের। (Homo মানে man. Sapiens মানে wise – বাংলায় বললে প্রাজ্ঞ মানুষ) সেই ঢেউ পৃথিবীর নানা স্থানে গিয়ে পৌঁছলেও দক্ষিণ গোলার্ধে দূরতিক্রম্য সাগর পেরিয়ে বর্তমান অস্ট্রেলিয়া কার্যত অজানাই রয়ে গিয়েছিল ভাবলে অবাক লাগে ১৭৭০ সালে, যখন পলাশির যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশদের ভারত লুণ্ঠন শুরু হয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলআবিষ্কারকরেন জনমানবহীন এক স্থলভাগের বিষয়ে নানা মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে ইংলন্ডে ফিরে যান সেই তথ্যের ভিত্তিতেই আধুনিক অস্ট্রেলিয়াতে বসতি স্থাপনের বিষয়ে তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবিদের চিন্তাভাবনার সূত্রপাত 

বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটা সত্যি যে আজ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার (ঠিকই পড়েছেন, ৬০ হাজার) বছর আগে মানুষ উত্তরদিক দিয়ে দেশটায় এসে পৌঁছেছিল পরবর্তীকালে বিশাল দেশটার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ৬০ সহস্রাব্দ ধরে বাস করেছে সুতরাং এই আদি বাসিন্দারাই অস্ট্রেলিয়াআবিষ্কারকরেছিলেন, কুক সাহেব নয়পাশাপাশি এক বিস্ময়কর তথা করুণ কাহিনি সে পরে একদিন হবে 

australia
আজকের অস্ট্রেলিয়া পাখির চোখে…

মাঝে মাঝেই মাঝরাতে, বা তারও পরে ফোনটা বেজে ওঠে বছর দশেক আগে আরো বেশি আঁতকে উঠতামআজকাল দেশে থাকা নিকটতম প্রিয়জন প্রায় সবাই চলে যাওয়ার ফলে আর অতটা ভয় হয় না, তবে অবশ্যই চমকে উঠি, বিশেষ করে যদি ঘুমিয়ে পড়ে থাকিপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে সামাজিক মাধ্যমের বৃত্তে থাকলে যে কেউই ফোন করতে পারে() স্ক্রিনে নামটা দেখতে পাই লাইনটা কেটে মেসেজ করে জানিয়ে দিই এখন অনেক রাত, জরুরি কিছু থাকলে মেসেজ করে জানাতে অধিকাংশ ফোনই আসে দেশ থেকে খোশগল্প করার অভিপ্রায় নিয়েআসলে অনেকেরই খেয়াল থাকে না যে পৃথিবীটা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় নিজের অক্ষে একবার পাক মারে, যে কারণে ভারতের বেশ খানিকটা পুবদিকে অবস্থানের দরুন দেশের সন্ধ্যা সাতটা মানে আমাদের রাত সাড়ে বারোটা 

ইংল্যান্ড বা আমেরিকাতে অনেকেরই আত্মীয়স্বজন থাকায় মনে হয় ওই দেশগুলোর ক্ষেত্রে এতটা ভুল হয় না অস্ট্রেলিয়া তুলনামূলকভাবে একটা অপরিচিত দেশএখনও দেশের মানুষের পরিচিত হতে কিছুটা সময় লাগবে এই পর্বে দেশটার বিষয়ে কিছু টুকিটাকি  তথ্য দেব অস্ট্রেলিয়া মহাদেশগুলি মধ্যে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু আয়তনের নিরিখে দেশ হিসেবে ছ’ নম্বরে দেশটির আয়তন ৭৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার, যা ভারতের প্রায় আড়াইগুণ এত বড় দেশটার জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি, যেখানে কেবল কলকাতারই দেড় কোটি কলকাতার আয়তন ২০৬ বর্গ কিলোমিটার, অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার ৪০,০০০ ভাগের একভাগ! তাই প্রায় জনশূন্য ক্যানবেরা থেকে যখন দমদমে নামি, ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ লাগে! ছ’টি রাজ্য এবং দুটি টেরিটরি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া আমার গত তিরিশ বছরের বাস রাজধানী ক্যানবেরাতে, যেটি Australian Capital Territory- অন্তর্গত 

australia-map
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান প্রধান প্রদেশগুলি

রাজ্যগুলির রাজধানী এবং জনসংখ্যা (৩১শে ডিসেম্বর ২০২১, লক্ষে)-সহ অস্ট্রেলিয়ার একটি মানচিত্র দিলাম দেশটার পুব থেকে পশ্চিম ৩২০০ কিমি, উত্তর থেকে দক্ষিণ ৪০০০ কিমি উপকূলরেখার দৈর্ঘ ৩৪,০০০ কিমি এতবড় দেশের রুক্ষ ভিতরের অংশটি কিন্তু প্রায় জনশূন্য ৯০ শতাংশ মানুষ বাস করে উপকূলবর্তী নগরগুলিতে, তার মধ্যে দুটি বৃহত্তম শহর সিডনি এবং মেলবোর্নে দেশের অর্ধেক মানুষের বাস তাসমানিয়া রাজ্যটি মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার আয়তন ২৬.৪৬ বর্গ কিমি, ভারতের ৩২.৮৭ ভারতের আয়তনের উল্লেখ করলাম একটা তুলনামূলক চিত্র দিতে পূর্ব উপকূলের সিডনি থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থ (Perth) পাঁচ ঘণ্টার উড়ান সময়ের পার্থক্য তিনঘণ্টা তার মানে সিডনি থেকে সন্ধ্যা সাতটায় উড়লে পার্থে রাত নটায় পৌঁছনো যায় বার তিনেক অফিসের কাজে পার্থে গেছিযাত্রার ধকলটা প্রায় বিদেশ যাওয়ার মতো, ইমিগ্রেশন কাস্টমসের ঝক্কিটুকু বাদে দেশে যখন আসি, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপকূল ছাড়ালেই মনে হয় দেশের কাছাকাছি এসে পড়েছি!

এই পর্ব শেষ করব অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের বিষয়ে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক  পরিসংখ্যান দিয়ে ১৯৯০ সালে যখন আসি, সারা অস্ট্রেলিয়াতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ ছিলেন ৫০ হাজারের কাছাকাছি ২০২১ সালের সেনসাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে লক্ষ ৮৪ হাজারেমানে ৩০ বছরে ষোলোগুণ বৃদ্ধি! মোট জনসংখ্যার . শতাংশপ্রতি ৩২ জন অস্ট্রেলীয় মানুষের মধ্যে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শুরুর দিকে রাস্তাঘাটে ভারতীয় চেহারার কাউকে দেখলে গায়ে পড়ে আলাপ করতাম বাঙালি হলে তো কথাই নেই! বলাই বাহুল্য, এখন আর তার প্রয়োজন পড়ে না সাড়ে চার লক্ষ মানুষের ক্যানবেরাতে ভারতীয় বাঙালির সংখ্যা আড়াইশো জমজমাট সামাজিক জীবন আমাদের 

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: State.gov, Vectorstock
Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *