আগের পর্ব পড়তে: [১]
ডাকের সাজ খড়ের বাড়ি
কিছুদিনের মধ্যে লোকটি মারা গেল
ভীষণ গর্জনে সেই মহাসর্প বহির্গত হল
লোকটির আত্মা আর তার হিংস্রতা নিয়ে
এক মুখরোচক বিষ তৈরি হল দাঁতে
– প্রশান্ত মল্ল
মধ্য নব্বইতে আমাদের পাড়ায় বাসা করে এলেন, ধরা যাক নাম তাঁর দ্রোণাচার্য। ছাত্র পড়াতেন, তাই আমরা তাঁকে দ্রোণ স্যার বলে ডাকতাম। দ্রোণ স্যার নাকি খুব মেধাবী ছিলেন, স্ট্যান্ডও করেছিলেন বোর্ডের পরীক্ষায়, তারপর নকশাল হয়ে যান। দশবছর জেল খেটে ফিরে আসার পর শরীরে মনে বিপর্যস্ত অবস্থায় বিয়ে করেন, পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, সংগতে ছিল টুকটাক চাকরি– কখনও এই পাবলিকেশনে, কখনও বা অন্য কোথাও, আবার কখনও শুধুই টিউশন। স্ত্রী গান শেখাতেন। দুই-কামরার বাসায় অভাব ছিল, ছিল অবসাদ, ফ্রাস্ট্রেশন, তিক্ততা। তবু সেসব কাটিয়ে আমাদের আধা-সাক্ষর নিম্নমধ্যবিত্ত অঞ্চলে দ্রোণ স্যারের যে পরিচিতিটুকু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, প্রাক্তন নকশাল ও ভাল ছাত্র ইত্যাদি বাদ দিলে, তা হল, দ্রোণ স্যার লেখেন। কিন্তু এ গল্প দ্রোণাচার্যের নয়।
নয়, কারণ তিনি গৌণ, শ্রান্ত কাকের ভূমিকা পালন করেছিলেন মাত্র, যে উড়তে উড়তে ঠোঁট থেকে খড়কুটো ঝরিয়ে ফিচিক হেসে আবার মিলিয়ে যায় শূন্যে, আর সে ঝরা পাতা আমরা মুঠোভরে তুলে অবাক বিস্ময়ে দেখি তার বুকে লেখা নাম ‘আনৃণ্য’ অথবা ‘প্রমা’ কী ‘ধ্রুবপদ’। সত্যি, দেশ আনন্দবাজার আজকালের বাইরেও তাহলে লেখালেখি করে মানুষ? আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত যাপনে চিন্তার ভদ্রবিত্ততার যেটুকু আকাঙ্ক্ষা, তা রবিবাসরীয়র পাতায় গল্প পড়ে, বড়জোর বাড়িতে দেশ বা নবকল্লোল রেখে ফুরিয়ে যেত। তার বাইরেও একটা বিশাল পৃথিবী– কী যেন বলে, লিটল ম্যাগাজিন, কিন্তু লিটল কেন? আকারে ছোট হয়তো। না না, কয়েকটা তো বেশ মোটা আর ভারী দেখতাম, তা হলে এমন অদ্ভুত নাম?
আমরা ফ্যালফেলিয়ে দেখতাম, দ্রোণ স্যারের বাড়িময় অবহেলায় ছড়ানো ছেটানো অজস্র পত্রিকা, কোনওটার স্পাইন গোলাপের ডাঁটির মত সরু ও পলকা, বুনো হাতির কোমর আবার পাশেই। আমরা বাড়ি ফিরে যখন বলতাম, ‘দ্রোণ স্যারের বাড়িতে অনেক লিটল ম্যাগাজিন’ তখন বাবারা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করত ‘সে কেমন? তোদের স্কুলের ওই পুঁচকে খাতাগুলোর মতো?’ কেউ কেউ অবশ্য গম্ভীর হয়ে মতামত জানাত, ‘ওসব পড়তে হবে না এখন। এই দ্রোণ স্যার রাজ্যের হাবিজাবি জিনিস দিয়ে ছেলেপুলের মাথা খায়। নকশালদের দোষ, যাবে কোথায়!’ আমাদের বাবারাও তথৈবচ ছিলেন, কেউ বন্ধ কারখানার শ্রমিক, কেরানি, কেউ দোকানদার, বড়বাজারের সাপ্লায়ার হয়তো। এই জীবনে লিটল ম্যাগের রহস্যগেহ বোধের অতীত, সন্দেহ করতে হয় তাকে। তবু দ্রোণস্যার পাঠ দিয়েছিলেন, আমাদের মতো মাটিকাদার সন্তানদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন দুটো জিনিস। এক, বিদেশি সাহিত্য– তাঁর হাত ধরে টলস্টয়, উইলিয়াম গোল্ডিং, মিখায়েল শলোখভেরা পাখা মেলে উড়ত ঝিমধরা লোকালয়ে, আর দুই, লেখালেখির প্রথম পাঠ। আমাদের সেই বয়েসেই দেখিয়েছিলেন, সহজ ভাষা লেখার ভিত্তিপ্রস্তর না-ও হতে পারে।

দ্রোণাচার্য কবিতা লিখতেন, কখনও উপন্যাস। দুটো কবিতার বই বেরিয়েছিল, উপন্যাস একটা। তাঁর লেখা আমাদের কঠিন লাগত, কারণ আমরা তখনও বাণিজ্যিক পত্রিকার নিগড় থেকে বেরইনি, স্বাভাবিকভাবেই। এত কঠিন শব্দ, বাক্যের কী প্যাঁচালো বিন্যাস, এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই টুপ করে এক দুপুরবেলা দ্রোণ স্যার খড়কুটো ফেললেন, কমলকুমার মজুমদার। তিনি কে? স্যারের কাছ থেকে বই নিয়ে একটা লেখা পড়তে গিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া, ধুস এসব গল্প নাকি! তখন আমরা ক্লাস নাইন। কিন্তু স্যার বললেন, ‘ভাষাকে জোর করে সহজ করানো, এ এক চাল, বুঝলে? নব্বই দশকে এ চাল আর থাকার কথা নয়, অনেকদিন হল।’ ভাষা নাকি হিংস্র পশুর মতো, আক্রমণাত্মক, দাঁতের গোড়ায় রক্ত লেগে তার, আর গমক হবে গম্ভীর বাঘ। কেউ একজন ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, ‘স্যার আপনার লেখা শুকতারাতে মিলবে?’ দ্রোণ স্যার হেসেছিলেন। বোঝেননি, আমাদের জীবনে এমন কেউ, যে লেখে, যাকে হাতে লেখা দেওয়াল ম্যাগাজিনের বাইরেও ছাপার অক্ষরে দেখা যায়, সে প্রায় দানিকেনের দেবতা। তার প্রতিটা শব্দ অগ্নিবর্ণ শরনিক্ষেপ, হাতের কলম তার, আমাদের বিস্ময় জাগায়। স্যার কি তাহলে সুনীল গাঙ্গুলীদের চেনেন? কাকাবাবুর মতো তাঁরও কি আছে গোপন এক চরিত্র? স্যার উত্তর দেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘খবরের কাগজ বেশি পোড়ো না, যদি লিখতে চাও। ওই ভাষা, সরল, কোনও রহস্য নেই, হাত পা বেঁধে দেবে। নাও, এই বইটার নাম জাগরী। পড়তে পারো।’ অতি অবশ্যই সে বইও পড়া হয়নি। লোকটা তারকাটা, ভুলভাল বকে।
পাগল নয়তো কী ! আমরা কোনওদিন মান্য কাগজগুলিতে তাঁর নাম দেখলাম না, বদলে প্রত্যক্ষ করলাম দ্রোণাচার্যের অসহায় ক্রোধ। নিজের মনে বিড়বিড় করতেন, ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে, সে-ই ভাষাকে বাঁচায়।’ কিন্তু বাঁচাবে কে? ধীরে ধীরে লিটল ম্যাগগুলোতেও তাঁর লেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। লিখতেন না অনেকদিন, তারপর আবার, অনিয়মিত। লিখে পাঠাতেন না, ফেলে রাখতেন, সন্তানের মাথার চুলে ঘ্রাণ নিয়ে যে আশ্লেষ নেয় অন্ধ পিতা, সে অনুকারে হাত বোলাতেন খাতাগুলোর গায়ে, মাঝে মাঝে খুলে পড়তেন আবার। আর দিনে দিনে সরে যাচ্ছিলেন আরও অন্ধকারে, এককোণায়। চাকরি ছিল না, টিউশন অনিয়মিত, খবরের কাগজগুলো তাঁকে না চিনলেও যে ছোট পত্রিকাগুলোতে টুকটাক লেখাপত্র বার করত, যাদের দেখিয়ে গর্বোজ্জ্বল মুখে কখনও বা বলেছেন, ‘আজ এটা এল, আমার একটা কবিতা আছে’, ক্রমে তাদের কেউ মরে গেল, কেউ বিগ হাউস হয়ে যাবার অনিবার্যতায় মুখ ঘুরিয়ে নিল, আর কারওর সঙ্গে ঝগড়া করে ছেড়ে চলে এনেন তিনি, যেগুলো সবসময়ে আমাদের ইতিহাসে ঘটে এসেছে। মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠতেন, ‘আমার উপন্যাসটার মতো লেখা বাংলায় এই মুহূর্তে আসেনি, এ আমি তোমাকে হলফ করে বলছি। আমি না, অন্যেরা বলেছে অনেকে।’ আমরা না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। দ্রোণ স্যার বিড়বিড় করতে করতে ঘুরতেন রাস্তায়, নিজের মনে গুম থাকতেন, বাড়ি গেলে দেখতাম স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের ওপর আধশোয়া হয়ে ঘুমোচ্ছেন। খুব ঘুমোতেন, ডিপ্রেশন কী না বুঝিনি। পাড়ার মানুষ বলত, ‘জেলে থাকার সময়ে রুণু গুহনিয়োগী তো কম অত্যাচার চালায়নি ! মাথাটা তখন থেকেই গেছে।’

হ্যাঁ, দ্রোণ স্যারের পুলিশ প্রশাসন বামফ্রন্ট সরকারের ওপর রাগ ছিল দারুণ, গল্পও করেছেন রুণু কীভাবে একটার পর একটা ঘুসি মেরে তাঁর নার্ভ ড্যামেজ করেছিল। এমনকী এটাও ভাবতেন যে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের জন্য বামফ্রন্ট সমান দায়ী, কিন্তু তাঁর হতাশার কারণ সেটা ছিল না। আজ বুঝি, তিনি না লিখতে পেরে অস্থির হয়ে উঠতেন। আরও দুর্বহ, লেখা ছাপাতে না পারা। আগেকার বন্ধুদের সঙ্গে মনোমালিন্য, বিচ্ছেদ, পরিচিত লিটল ম্যাগগুলোর ঝরে যাওয়া, নিজের লেখার প্রেমে পড়ে যাওয়াও হয়তো, এই সমস্ত কিছু তাঁকে প্রান্তবাসী করে দিচ্ছিল আস্তে আস্তে। উপন্যাসটা প্রত্যাশামতোই বিক্রি হয়নি বেশি, পাবলিকেশন উঠে যায়। শেষদিকে জ্যোতিষচর্চা শুরু করেছিলেন। তখনকার দু’ একটা লেখা পড়তে গিয়ে দেখেছি, ভাষা চরম জটিল, প্রায় অগম্য। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ‘অবস্কিওর’ হবার এই সাধনা নিরাবেগ ছিল না, এমনকী ব্যতিক্রমও নয়। যিনি সারাজীবন ঋত্বিক ঘটককে আদর্শ জ্ঞান করেছেন, নিমগ্ন থেকেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সুষমায় এবং এস্টাবলিশমেন্টকে লাথানোর দুর্নিবার অক্ষম বাসনায় জেনে এসেছেন যে ভাষাপ্রকল্প আসলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট, তাঁর ক্ষেত্রে, বা তাঁদের, এটাই কনভেনশন।
আমাদের বাবারাও তথৈবচ ছিলেন, কেউ বন্ধ কারখানার শ্রমিক, কেরানি, কেউ দোকানদার, বড়বাজারের সাপ্লায়ার হয়তো। এই জীবনে লিটল ম্যাগের রহস্যগেহ বোধের অতীত, সন্দেহ করতে হয় তাকে। তবু দ্রোণস্যার পাঠ দিয়েছিলেন, আমাদের মতো মাটিকাদার সন্তানদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন দুটো জিনিস। এক, বিদেশি সাহিত্য– তাঁর হাত ধরে টলস্টয়, উইলিয়াম গোল্ডিং, মিখায়েল শলোখভেরা পাখা মেলে উড়ত ঝিমধরা লোকালয়ে, আর দুই, লেখালেখির প্রথম পাঠ। আমাদের সেই বয়েসেই দেখিয়েছিলেন, সহজ ভাষা লেখার ভিত্তিপ্রস্তর না-ও হতে পারে।
এরকম হয়ে এসেছে বহুদিন ধরে, একসময়ে লেখা থামিয়ে দেওয়াটাও। আর তাঁদের এই জার্নিটা দেখিয়ে দেয়, আমাদের অসফল লেখালেখির হাওয়ায় আশ্চর্য পুঁথির পাতা ওড়ে না, শেষ অভিলাষ মারণআঘাত হলেও মোক্ষম মুহূর্তে আমরা খুঁজতে গিয়ে দেখি কোষাগার রিক্ত, এমনকী আমাদের পাঠপ্রতিজ্ঞার ছায়াতমসায় ব্যক্তিগত সিংহাসনগুলিতে বসতেও অস্বীকার করেন নিজস্ব ঈশ্বরের দল, তাঁরা ততদিনে তিক্ততায় নিজেদের ডিজ়ওন করতে শুরু করেছেন। তবু এগুলোই শেষ নয়, এবং এটাও দ্রোণাচার্যের গল্প ছিল না। এর পরেও গল্প থাকে, শ্রান্ত কাক স্মিত হেসে উড়ে গেলে অকৃতকার্যতার ভুর্জপত্র তার ঠোঁট থেকে পেড়ে ফেলি পরবর্তী বোকাবালকের দল। সেখানে কাঁপা হাতে নাম লিখে ফেলি, দ্রোণাচার্য–ঘোষ বোস সাঁতরা যেটাই হোক না কেন, এবং অর্গলবদ্ধ রাখি, আততায়ীর প্রতিজ্ঞার মত। এটাও কনভেনশন, এরকমই হয়।
দ্রোণ স্যার বহুদিন এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর জায়গায় ভাড়া এসেছিল একটা বিহারী পরিবার। ফেলে যাওয়া ছেঁড়া কাগজপত্র ঝেঁটিয়ে সাফ করার সময়ে আমার নাম লেখা একটা খাতা পায় তারা, হোমটাস্ক ছিল হয়ত। আমাদের বাড়ি -চিনত, খবর দেয়। এসে দেখি, শূন্য ঘর, একচিলতে বাগানে ধুলো উড়ছে আর চৈত্রের হা হা বাতাস। একটা গুবরে পোকা নিজের মনে মেঝের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছিল, মনে হল ঘুমোবে। অনেক খবরের কাগজ, যেগুলো মলাট হিসেবে ব্যাবহার হত, তাদের গায়ে পেনে নাম লেখা–বালজাক, গর্কি ভল্যুম ৫, পুরী সিরিজ। বাড়ির দুটো বাচ্চা ফাঁকা পেনের খাপ দিয়ে বাগানের মাটি খুঁড়ছিল। একটা কাগজ ফরফরিয়ে উড়ে যেতে আতিপাতি চোখ চালালাম–ছিন্ন বুড়ো আঙুলেরা নিজেদের অভিজ্ঞান কোথাও ফেলে যায়নি।
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৩ আগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pragjyotishcollege
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।