এক ৬২ বছরের প্রবীণ এসে বসেছেন বছর ছত্রিশের ‘পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু’র রোগশয্যার পাশে। তিনি অনেক মৃত্যু দেখেছেন, ‘কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো, অল্পকালের আয়ুটিকে নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর কাউকে দেখেননি। মৃত্যুশয্যায় শায়িত যুবক তাঁকে গাইতে অনুরোধ করলেন– ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে,/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’ শুধু একটি গানের অনুরোধেই তাঁর রসতৃষ্ণার নিবৃত্তি ঘটল না। আর একটি গান তিনি প্রবীণকে দু’বার অনুরোধ করে শুনলেন– ‘দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো,গভীর শান্তি এ যে,/আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে উঠল কোথায় বেজে।’

১৩৩০ বঙ্গাব্দের ২৪ ভাদ্র (১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) ‘গানের পালা সাঙ্গ’ করে ৩৬ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই অমৃতলোকের পথযাত্রী হলেন রসস্রষ্টা সুকুমার রায়। তার ঠিক দু’দিনের মাথায় ২৬ ভাদ্র লিখিত সুকুমার রায় স্মরণে প্রদত্ত অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শোনালেন ‘মৃত্যুপথের পথিক’-এর অনুরোধে গাওয়া ‘পূর্ণতার গান, আনন্দের গান’-এর কথা। আসলে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে জেনেছেন-ভেবেছেন ‘পূর্ণতার গান, আনন্দের গান’ রূপেই। মৃত্যুর মধ্যেও খুঁজে পেয়েছেন ‘পরম প্রাণের ব্যঞ্জনা’। তিনি উপলব্ধি করেছেন ‘মহাপ্রাণই হচ্ছে অনির্বাণ সত্য, সেই জন্যেই ক্ষুদ্রপ্রাণ নিবলেও ভাবনা নেই’। চেয়েছেন ‘মৃত্যুর মোহন রাগিণীতেই প্রাণ কেঁদে উঠুক’। বিশ্বাস স্থাপন করেছেন উপনিষদের ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ মন্ত্রে।

অবশ্য তাঁর এই জ্ঞান-বোধ-অনুভব-প্রতীতি প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত। জননী সারদা দেবীর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স তেরো। সেটিই তাঁর জীবনে প্রথম প্রত্যক্ষ মৃত্যু। সকালে উঠে মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনলেও সে কথাটির অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে পারেননি তখন। কিন্তু সেই কৈশোরেই তাঁর উপলব্ধি– ‘সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর।’ কৈশোরের মতো প্রথম যৌবনেও তাঁর জীবনে নেমে এল মৃত্যুর চরম অভিঘাত। কাদম্বরী দেবীর আত্মহননের সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র তেইশ। সেই ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, ‘মৃত্যুর সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়।’ বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা, বিয়োগ-ব্যথায় কাতর কবির স্বীকারোক্তি, ‘আমার পায়ের নীচ থেকে যেন পৃথিবী সরে গেল, আমার আকাশ থেকে আলো নিভে গেল, আমার জগৎ শূন্য হল, আমার জীবনের সাধ চলে গেল।’ এই বিরহযাতনা অসহনীয়। 

কিন্তু তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়েছেন– ‘তবু এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, …যাহাকে ধরিয়াছিলাম তাহাকে ছাড়িতেই হইল, এইটাকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম তেমনি সেই ক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি বোধ করিলাম।’ মৃত্যুর মতো এমন বেদনাবহ বিষয়ে এত কমবয়সে ঔপনিষদ্-ঋষিসুলভ এই বোধ অসাধারণ প্রাজ্ঞতার পরিচায়ক। ২৫ নভেম্বর ১৮৯৪ ইন্দিরা দেবীকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, 

‘…আমাদের চতুর্দিকে একটি নিস্তব্ধ নির্বাক অনন্তকাল দাঁড়িয়ে রয়েছে, …আমি একলা মরি আর লক্ষ প্রাণী বন্যায় ভেসে যাক সেও তার কাছে কিছুই নয়। সূর্য একদিন তার সমস্ত সৌরজগৎ-সুদ্ধ নিবে গিয়ে, বরফে জমে গিয়ে, একেবারে মরে যাবে, সেও তার কাছে কিছুই নয়…’। 

Tagore Sitting
কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢত্ব, বার্ধক্যে তাঁর জীবনে পরপর নেমেছে মৃত্যুর চরম অভিঘাত

মৃত্যু এবং অনন্তের মেলবন্ধন উপলব্ধি করতে না পারলে বোধহয় চেতনার গভীরে এমন আলোড়ন অনুভব করা সম্ভব নয়। জীবনের মাঝখানে মৃত্যু যে বিচ্ছেদ আনে, তাকে ছেদরূপে দেখেননি রবীন্দ্রনাথ। নিজের জীবনের মধ্যে পূর্ণতাকে উপলব্ধি করেছেন। তিনি এ জগৎ সংসারকে সত্য বলে মেনেছেন। তিনি জানেন এ জগতে সকলের চেয়ে পরিচিত মৃত্যু। কিন্তু ‘জগতে মৃত্যুর ক্ষতি একমাত্র আমি-পদার্থের ক্ষতি’। মৃত্যুতে সংসারে কোনও ক্ষতি সাধিত হয় না। সূর্যালোকে কালিমা পড়ে না, আকাশের নীল নির্মলতা মলিন হয় না, অফুরান সংসারের ধারা পূর্ণবেগেই চলে। তবে এই সংসারকে নিজের বলে জানাই অসত্য। কারণ এই সংসারের সূচ্যগ্র বিন্দুকেও কেউ নিজের বলে ধরে রাখতে পারে না। মৃত্যুর ঠেলায় সমস্তই ধুলোয় লুটোপুটি খায়। কিন্তু সংসার ব্যক্তিমানুষের সমস্তই নেয়, একটি কণাও ফেলে দেয় না। 

‘প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু-না-কিছু দান করছে। সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না…কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল, অহংটিকেই তার খাজনা স্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে।’ 

এ যেন সেই ‘সোনার তরী’র কথা– ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই—ছোটো সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’ মৃত্যুকে ভয় পান না এমন মানবপ্রাণ বিরল। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ, ‘ধর্মকে আশ্রয় করিলে মৃত্যুভয় থাকে না।’ এই ধর্ম অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়। ধর্ম বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ‘জগতের প্রাণগত চেতনা’। চেতনা-সঞ্চারক ধর্ম মানুষের মধ্যে সুগভীর অনুভব নিয়ে আসে। 

‘ধর্মকে যতই আশ্রয় করিতে থাকিব, ততই চেতনা লাভ করিতে থাকিব, ততই অনুভব করিতে থাকিব, যে মহা-চৈতন্যে সমস্ত চরাচর অনুপ্রাণিত হইয়াছে, আমার মধ্য দিয়া এবং আমাকে প্লাবিত করিয়া সেই চৈতন্যের স্রোত প্রবাহিত হইতেছে।’

অবসানকে, বিদায়কে, মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ ভক্তির সঙ্গে গভীরভাবে জানার কথা বলেছেন। জ্ঞান বিনে মুক্তি নেই। তিনি বলেছেন, মৃত্যুকে ‘তাঁরই ছায়া বলে জানব,যস্য ছায়ামৃতম্ যস্য মৃত্যুঃ।’ তাঁর বিশ্বাস, ‘মৃত্যু বড়ো সুন্দর, বড়ো মধুর। মৃত্যুই জীবনকে মধুময় করে রেখেছে।’ তাঁর মনে হয়েছে, ‘সংসারের উপর মৃত্যু আছে বলেই আমরা ক্ষমা করতে পারি। নইলে আমাদের মনটা কিছুতে নরম হত না। সব যায়, চলে যায়, আমরাও যাই। এই বিষাদের ছায়ায় সর্বত্র একটি করুণা মাখিয়ে দিয়েছে।’ সম্পূর্ণ করে পেতে গেলে মৃত্যুর ভিতর দিয়েই পেতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এখানে পরিপক্ব ফলের বৃন্তচ্যুত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ দানের উদাহরণ টেনেছেন। মৃত্যুতে সমস্ত জাগতিক বাধা দূর হয়ে যায়, সেখানে থাকে না কোনও সাংসারিক প্রয়োজনের তুচ্ছতা, কোনও লৌকিক ও সাময়িক সম্বন্ধের ক্ষুদ্রতা।  ‘… কেবল একটি মাত্র সম্পূর্ণ যোগ হয়েছে, সে হচ্ছে অমৃতের যোগ। মৃত্যুই এই অমৃতকে প্রকাশ করে।’ মৃত্যু এবং সম্পূর্ণতাকে তিনি এভাবে এক সুতোয় বেঁধেছেন।

rabindranath-tagore-the-world-poet
প্রশান্তচন্দ্র ও রানি মহলানবিশ (কবির বাঁ পাশে) — বাইশে শ্রাবণ এঁরা ছিলেন রবি-সমীপে।

রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘যেখানে আমার প্রেম সেইখানেই আমি নিত্যের স্বাদ পাই, অমৃতের পরিচয় পেয়ে থাকি।’ তিনি অনুভব করেছেন, সেই প্রেমের মধ্যে যাঁকে দেখেন, তাঁকেই তিনি অমৃতের মধ্যে দেখেন। সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করে তাঁর মধ্যে অসীমকে দেখতে পান এবং মৃত্যুতেও সে তাঁর কাছে মরে না। ‘প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে প্রেমের আলোকে আমরা এই অনন্ত অমৃতলোককে আবিষ্কার করে থাকি।’ তাঁর ধারণা, পক্ষান্তরে যাদের সঙ্গে আমাদের প্রেমের সম্পর্ক নেই অথবা জীবনের গভীর যোগ নেই তাদের মৃত্যুতে আমাদের কিছুই আসে যায় না। এইখানেই মৃত্যু হয়ে ওঠে বিনাশ। এইভাবে মানবদরদী প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথ অবিনাশী-অক্ষয়-অজর-অমর প্রেমকে পরম যতনে মৃত্যুর হাত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।

উপনিষদের মৈত্রেয়ীর প্রার্থনা-মন্ত্র ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্’ ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মৈত্রেয়ী যে শরীরের অমরতা চাননি এবং আত্মার নিত্যতা সম্বন্ধেও তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না, এ কথা নিশ্চিত।’ কিন্তু মৈত্রেয়ীর ‘আমি যাতে অমৃতা না হব তা নিয়ে আমি কী করব’ বলার মধ্যে তাঁর যে অমৃতা হওয়ার ইচ্ছা, তা তিনি কীভাবে হতে চেয়েছিলেন? স্বামী যাজ্ঞবল্ক্যর ত্যক্ত সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ঠেলে ফেলে দিয়ে মৈত্রেয়ী চেয়েছিলেন অমৃত। তিনি প্রেমের মধ্যে এই অমৃতের স্পর্শ পেয়েছেন, পেয়েছেন অনন্তের স্বাদ। ‘প্রেমই সীমার মধ্যে অসীমতার ছায়া ফেলে পুরাতনকে নবীন করে রাখে, মৃত্যুকে কিছুতেই স্বীকার করে না।’ সংসারের বিচিত্র বিষয়ের মধ্যে মৃত্যুর অতীত পরম পদার্থের পরিচয় পাই এই প্রেমের আভাসের মধ্যে এবং এই প্রেমকেই ‘পরিপূর্ণরূপে পাবার জন্য আমাদের অন্তরাত্মার সত্য আকাঙ্ক্ষা আবিষ্কার করি’। মৈত্রেয়ীর ‘মৃত্যুহীন মধুর কণ্ঠে’ উচ্চারিত অমৃতের প্রার্থনা ‘মৃত্যোমামৃতংগময়’-তে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছেন ‘নিত্যকাল যে কেমন করে রক্ষা পেতে হবে’, তার দিশা। সেই দিশায় আমাদের মনেও ‘যেন লেশমাত্র সন্দেহ না থাকে’।

 

*ঋণ: রবীন্দ্র রচনাবলি
*ছবি সৌজন্য: Livemint, Idiaspora, Deccan herald

পেশায় শিক্ষক দিলীপকুমার ঘোষের জন্ম হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের দফরপুর গ্রামে। নরসিংহ দত্ত কলেজের স্নাতক, রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। নেশা ক্রিকেট, সিনেমা, ক্যুইজ, রাজনীতি। নিমগ্ন পাঠক, সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত সৈনিক। কয়েকটি ছোটবড় পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে অণুগল্প, ছোটগল্প এবং রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'সুখপাঠ' এবং 'উদ্ভাস' পত্রিকায় রম্যরচনা এবং দ্বিভাষীয় আন্তর্জালিক 'থার্ড লেন'-এ ছোটগল্প প্রকাশ পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *