কলকাতা শহরের ইঁট, কাঠ, কংক্রিট আর অ্যাসফল্টের জঙ্গলে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তবু, ছোটবেলাতেই আমাদের গ্রোভ লেনের ছোট্ট দোতলায়, অল্প জায়গায় নানারকম টবে চড়কের মেলা থেকে কেনা দোপাটি, অপরাজিতা, গাঁদার চারা লাগাতাম। তবে অধিকাংশেরই বড় হওয়ার আগেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হত। মায়ের কথা শুনে গাছের টবে হেলথ টনিক ঢেলে দিতাম– মানুষের জন্য যা ভাল, গাছের জন্যও তা হবে না কেন? অবশ্যই সেই যুক্তি কাজে লাগেনি। আমরা তিন ভাই-বোন যখন বেশ ছোট, তখন থেকেই প্রতি বছর মা আমাদের নিয়ে পুজোর ছুটির মাসটা কাটাতে যেতেন ঝাড়গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দুরে শালবনি বলে এক গ্রামে। একটা ছোট্ট বাংলোয় আমরা কাটাতাম প্রকৃতির মাঝখানে। সেখানে না ছিল বিদ্যুৎ, না জলের কল, না আধুনিক বাথরুম। সেখানে আকাশছোঁয়া শাল, পিয়াল, মহুল গাছের জঙ্গলের মধ্যে, নানা জীবজন্তুর সান্নিধ্যে দিন কাটাতাম স্থানীয় সাঁওতাল, লোধা আদিবাসীদের মতো। ছোটবেলার এই অভিজ্ঞতা আমার অল্পবয়সী মনে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। তাই অজান্তেই আমার মনের মধ্যে গাছপালার প্রতি জন্মেছিল একটা গভীর ভালোবাসা।
আমার ছেলেবেলার সেই সব মানসিকতা, সেই সব রোমাঞ্চ আমি ছাত্র হয়ে পড়তে এসে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম সাত সমুদ্র, তেরো নদী পেরিয়ে অ্যামেরিকায়। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। এ দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছি পুরোপুরিভাবে। বস্টন শহর থেকে প্রায় মাইল পঁচিশ দূরে ও হেনরি, ডেভিড থোরো নামক বিখ্যাত দার্শনিক ও চিন্তাবিদের স্মৃতিবিজড়িত ‘ওয়ালডেন পন্ড’-এর কাছাকাছি আমাদের এই ‘ওয়েল্যান্ড’ নামের বাসস্থান। চারদিকে ‘কনজারভেশন ল্যান্ড’-এর ঘন জঙ্গল, যেখানে কোনওরকম বাড়িঘর করা চলবে না। আর পাশেই স্যাডবেরি নদী। এখানে চারপাশেই গরু, ঘোড়া আর ভেড়ার মস্ত-মস্ত খামার। এইসব জায়গার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমার ছোটবেলার ঝাড়গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়।

যাইহোক, আমাদের ওয়েল্যান্ডের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের প্রথামতো পেলাম একটা বেশ বড়সড় ঘাসভর্তি সবুজ লন, কিছু বুশ বা ঝোপঝাড়, আর কয়েকটা বিশাল উঁচু, অনেক পুরনো পাইন গাছ। এ দেশের ল্যান্ডস্কেপিংয়ে ঘাসভর্তি সবুজ লন সিংহভাগ নিয়ে থাকে, কিন্তু আমার মনে সেই ছোটবেলার গাছ আর ফুল করার ইচ্ছে ছেড়ে যায়নি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, যে ছোটবেলা থেকেই আমার ছবি আঁকা, বিশেষ করে জলরংয়ে ছবি আঁকায় খুব উৎসাহ। তাই আমাদের জমিটা আমার চোখে পরিবর্তিত হয়ে গেল একটা মস্ত, ফাঁকা ক্যানভাসের মতো, তাতে ইচ্ছেমত ছবি আঁকো, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রং দাও। আমরা মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে ও অন্যান্য বিশেষ বিশেষ দিনে ছোট-ছোট গাছ (প্ল্যান্ট) ও বড় গাছের চারা কিনতে আরম্ভ করলাম, আর শুরু করলাম তাদের এদিক-ওদিক মাটিতে লাগাতে, নিজের ইচ্ছেমতো, কোন গাছের কী প্রয়োজন, তা একেবারে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে।

শিগগিরই জানতে পারলাম যে কোনও গাছই আলো ছাড়া বাঁচতে পারে না। তবে কিছু গাছ এমন আছে যারা অল্প আলোয় বাঁচতে পারে, আবার কারও কারও অল্প আলোয় পঞ্চত্ব পেতে দেরি হয় না। জল ছাড়া গাছ বাঁচে না, কিন্তু অধিকাংশ গাছই বেশি জলে মরে যায়। আবার কোনও গাছ জলে ডুবিয়ে রাখলেও কিছু হয় না। মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে সুন্দরবনের দিকে বেড়াতে গিয়ে মাতলা নদীর ধারে-ধারে সুন্দরী গাছ দেখে অবাক হয়েছিলাম। সারি সারি গাছগুলো যেন হাঁটতে হাঁটতে জলে এসে নেমে সূর্যপ্রণাম করছে। তাদের কাণ্ডের বেশ অনেকটা জলে ডোবানো। কোনও গাছ ভীষণ আগ্রাসী, দ্রুত বেড়ে ও ছড়িয়ে গিয়ে অন্য সব গাছ মেরে ফেলে। আবার কিছু গাছের বেড়ে ওঠায় ভীষণ অনীহা। তবে অধিকাংশ গাছের চারপাশে ভিড় করে অন্য গাছ লাগালে তাতে ফুল ভালো হয় না। সবই একেবারে মানুষের স্বভাবের প্রতিফলন। সেটাই তো স্বাভাবিক, তারাও তো জীবন্ত। এটাও জানলাম যে অনেক গাছ এখানের দীর্ঘ ও ভয়াবহ ঠান্ডা, তুষার ইত্যাদির পরও ফিরে আসে বছরের পর বছর। এই চিরস্থায়ী গাছগুলি বছরের পর বছর ফুল ফুটিয়ে আনন্দ দেয়। আবার কিছু কিছু গাছ প্রতি বছর পুঁততে হয়। তরিতরকারির গাছেরা এই বার্ষিক রোপণ পর্যায়ভুক্ত।

এ তো গেল ছোট গাছ বা প্ল্যান্টদের কথা। বড় গাছের চারাও লাগিয়েছিলাম বেশ কিছু। ক্রমশঃ শিখলাম যে তারা বড় হয়ে মানুষের মতোই অনেক জায়গা নেয়। তাই বেশি বড় হওয়ার আগে আমাকেই তাদের তুলে নিয়ে যথেষ্ট জায়গা নিয়ে দূরে দূরে লাগাতে হয়েছে, যার ফলে তারা বেড়ে গিয়ে পরিণতবয়স্ক বড় বড় গাছে রূপান্তরিত হয়েছে, আর বছর বছর ফুল ফুটিয়ে আমাদের আনন্দ দিয়ে চলেছে। কয়েক বছরের মধ্যেই আমি বাগান করার নানা গোপন তথ্য জেনে নেওয়ার ফলে আমার সেই কাল্পনিক ফাঁকা ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করে দিলাম নিজের মনের খুশিমতো। এখানে একটা নানা রঙের টিউলিপের বেড, ওখানে একটা পাখিদের স্নান করার ওয়াটার বাথ, তার পাশ দিয়ে একটা ছোট পায়ে-চলা রাস্তা চলে গেছে, তার একপাশে টিউলিপ, ডেইসি, লিলি আর ড্যাফোডিলের সার, অন্য পাশে মাথা উঁচু করা আইরিসের ঝাড়।

রাস্তার শেষে একটা উঁচু আরবর (লতানে গাছ বেয়ে ওঠার সিঁড়ি), তার একদিকে কনকর্ড গ্রেপ আর অন্যদিকে উইস্টারিয়া– দুটো লতানে গাছ দুদিক দিয়ে এসে মাথার ওপরে সরু চাঁদোয়ার মত ক্যানোপি তৈরি করবে। রাস্তার অন্যদিক মিশেছে বাড়ি ঢোকার প্রধান পথ। তার দু-ধারে লম্বাটে ফ্লাওয়ার বেড- সেখানে নানা রকম গোলাপ, আর পিয়োনির ঘন সবুজ পাতাওলা গাছ।
এ ছাড়া আছে নানা বুশ বা ঝোপ। সামনের রাস্তার বর্ডারে ফরসিথিয়া ঝোপের সারি, বাড়ির সামনের দুপাশে নানা রংয়ের রডোডেনড্রন আর আজেলিয়ার ঝোপ। বসন্তে তারা ফুলে ফুলে ভরে যাবে। তাছাড়া আছে বড় গাছ। বাড়ির এক ধারে ম্যাগনোলিয়া আর দু’রকম চেরি গাছ। অন্যধারে একটা মস্ত ডগউড গাছ, আর তার থেকে একটু দুরে একটা জাপানি মেপল। এছাড়াও বাড়ির ডানদিকে আছে অনেক তরিতরকারি গাছ। তাদের প্রতিবছর পুঁততে হয়, কখনও বীজ থেকে, আর কখনও চারা থেকে। তারা টাটকা ফসল ফলিয়ে আমাদের আনন্দ দেয়।

এত বছরের খোঁড়াখুঁড়ি, গাছ লাগানো, আগাছা-জন্মানো বন্ধ করার জন্য মালচ বা কাঠের গুঁড়ো দেওয়া, সার দেওয়া, আগাছা তোলা, জল দেওয়ার পর আমার বাগানের ক্যানভাস ফুল আর রঙে ভরে উঠছে প্রতি বছর– কোনও বিরাম না দিয়ে। আমাদের এ অঞ্চলে ঠান্ডার প্রকোপ খুবই বেশি। নভেম্বর থেকে এপ্রিলের ছ’টা মাস প্রায়ই তুষারপাত হয়। তাপমাত্রা প্রায়ই শূন্য ডিগ্রির অনেক তলায় থাকে। সুতরাং বছরের প্রায় অর্ধেক সময় চারপাশ সাদা হয়ে থাকে পুরু তুষার আর বরফে, আর ‘ওল্ড ম্যান উইন্টার’-এর হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া পাতাহীন গাছের ডালে ডালে কাঁপন ধরায়। মনে হয় প্রকৃতি যেন একবারে নিষ্প্রাণ।

কিন্তু এপ্রিল মাস হলেই বৃষ্টি শুরু হয়। কথায় বলে ‘এপ্রিল শাওয়ার্স ব্রিং মে-ফ্লাওয়ার্স’। আর বরফ গলে ঘাস দেখতে পাওয়ার আগেই নানা রঙের ছোট ছোট ক্রোকাস ফুল মাথা উঁচু করে জানান দেয়, আর দেরি নেই, শীত শেষ হয়ে এল বলে। ইতিমধ্যে মে মাস এসে গেছে। এখানে কোনও কোনও গাছে পাতা আসার আগে ফুল এসে যায়। তাই সামনের সার দেওয়া ফরসিথিয়া ঝোপে হলুদ ফুলের আগুন লেগে গেছে। তার মধ্যেই ম্যাগনোলিয়া গাছ বড় বড় সাদা ফুলে ভর্তি, আর তার ঠিক পাশেই শুরু হয়েছে বিখ্যাত চেরি ব্লসম। সাদা-গোলাপি ছোট ছোট ফুলে গাছ উপচে পড়ছে। আর একদিকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকেই মাটিতে শুরু হয়েছে রঙের খেলা। ঘাসের রং একেবারে পান্নাসবুজ।

যেন এই রং দেখেই জীবনানন্দ দাস লিখেছেন –
কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস— তেমনি সুঘ্রাণ—
হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!
আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে-গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি— চোখে চোখ ঘষি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।
মে মাসের গোড়ায় একদিকে যেমন ম্যাগনোলিয়া, চেরি গাছে রঙের ধূম, অন্যদিকে মাটিতে রং লাগিয়েছে নানা রঙের টিউলিপ, ড্যাফোডিল আর হায়াসিন্থ। মাথা তুলে হাতছানি দিচ্ছে। আমাদের বাড়ির ড্রাইভওয়ের পাশ দিয়ে একটা পায়েচলা পথ গিয়ে বাড়ির সামনে মিশেছে। সেই ‘টিউলিপ পাথ’-এর একদিকে নানা রঙের ও প্রকারের টিউলিপ আর ড্যাফোডিল, আর অন্যদিকে নানা রঙের আইরিস ও একটা বার্ড-বাথ। আইরিস সম্বন্ধে একটু বলা দরকার। তারা সাধারণত ঘন নীল বা খয়েরি, হাল্কা হলুদ, গোলাপি, সাদা-হলুদ-নীল রঙের ছিট্ ছিট্ দেওয়া হয়। লম্বা ডাঁটির গায়ে মাথা তুলে থাকে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মনে পড়ে যায় ভিনসেন্ট ভ্যান গখের ছবির কথা। আইরিস ছিল তাঁর অতি প্রিয় বিষয়। অন্যদিকে লাল, সাদা, ম্যাজেন্টা অ্যাজেলিয়া ঝোপ গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে সেজে রয়েছে আর ‘উদ্ধত শাখা’-র শিখরে ফুটেছে হালকা গোলাপি আর লাল রঙের ‘রডোডেনড্রন-গুচ্ছ’।

আর একটা অসাধারণ দৃশ্যের কথা না বললে আমার এ লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আমাদের ড্রাইভওয়ে থেকে ‘টিউলিপ পাথ’-এ ঢোকার মুখে একদিকে একটা ‘ট্রেলিস’-এর গায়ে রয়েছে একটা উইস্টারিয়া ঝোপ, আর অন্যদিকে কনকর্ড গ্রেপ বা আঙুরের লতা। জুন মাসের গোড়ায় সেই ঝোপ হাস্নাহানার তীব্র গন্ধওলা ফুলের ভারে নুয়ে যায়। আর তার ঠিক তলায় আছে ‘ব্লিডিং হার্ট’-এর সম্ভার। এই ফুল দেখতে একেবারে যেন হৃদয় থেকে রক্ত ঝরছে। তবে এ রক্তের রং সাদা। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।

এদিকে জুন মাস আসতেই ডগউড গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। ঝাঁকে-ঝাঁকে ফুটে থাকা ডগউড ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। এই দেখেই বোধহয় অষ্টাদশ শতাব্দীর জাপানি নিসর্গ-শিল্পী কাৎসিসুকা হোকুসাই ডগউডের প্রেমে পড়েছিলেন। তার ঠিক পিছনেই আছে একটা জাপানিজ মেপল। তার ফুলের শোভা নেই, কিন্তু আছে লালচে-বাদামি রঙের পাতার সৌন্দর্য। তাকে সামনে রেখে ঝাঁকে-ঝাঁকে সাদা ডগউড ফুল যেন তরুণীর লাস্য নিয়ে ফুটে ওঠে।

জুনের শুরু হতে হতেই আবার অন্যদিকে লাল-সাদা-গোলাপি রঙের পিয়নি ফুল ফুটতে শুরু করেছে। পিয়নির ফুল বড়-বড়, পদ্মফুলের মতো, আর তাদের বাহারই বা কী! তার সঙ্গে বাড়ির সামনের পায়ে চলা পথের ধারে আছে স্যালমন রঙের পপির শোভা।

জুনের মাঝামাঝি হলেই, আর একটু গরম পড়তে শুরু করতেই শুরু হয়ে যায় গোলাপ আর লিলির রঙের হোলিখেলা। আমাদের বাগানে বেশ কয়েকটা সাদা, গোলাপি আর লাল রঙের গোলাপের ঝোপ আছে, আর তারা একেবারে রঙে-রঙে বাড়াবাড়ি রকমের ভেঙে পড়ে, আর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব একেবারে আলো করে থাকে নানা রঙের লিলি। এই সময়টা আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা একেবারে রঙে-রঙে রাঙিয়ে থাকে।

অগস্টের আরও গরমের মুখে ফোটে বড় পাতাওলা গাছে পেরেনিয়াল হিবিস্কাস বা জবা। মস্ত-মস্ত সাদা ফুল, আর মধ্যিখানে লালের ছোপ। আর অন্যদিকে বিশাল লম্বা লম্বা সোজা হয়ে ওঠা কান্ডের ওপরে মস্ত হলুদ পাপড়ি আর বাদামি মধ্যিখান নিয়ে সূর্যমুখী, সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেমন এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গখ। এই গাছগুলোর সামনে দাঁড়ালে নিজেকেই বামন বলে মনে হয়। বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, সেই উইস্টারিয়া ঝোপের উল্টোদিকে কনকর্ড গ্রেপ-এর ভাইন কিন্তু এতক্ষণে একেবারে আঙুরে-আঙুরে ভর্তি। জুলাই মানেই আবার আরও কতরকমের ফুল ঝাঁকেঝাঁকে ফোটে। ডেইজি, ব্ল্যাক-আইড সুসান, কোন ফ্লাওয়ার, আর ফোটে মাথায় ঝুঁটিওলা অ্যাসটিলবে।

এদিকে জুন-জুলাই আসা মানেই আর এক ধরনের গাছ করার ধুম পড়ে যায়। তা হল তরিতরকারি বা ভেজিটেবল গার্ডেনিং। এখানে আলু-পেঁয়াজ থেকে সব তরিতরকারি অপর্যাপ্ত হয়– এখানকার আবহাওয়া আর মাটির গুণে। আমাদেরও একটা মস্ত ভেজিটেবল গার্ডেন আছে। তবে তার কথা ও ছবি পরের জন্য রেখে দিলাম। আমাদের বাগানে এপ্রিলের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত এইরকম নানা রঙের খেলা চলে। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই বইতে শুরু করে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। তাপমাত্রাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আর গাছগুলোও কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে– তারা যেন খবর পায় এবার চলে যাওয়ার পালা। অক্টোবরের প্রথম থেকেই সব বড় গাছের পাতার রং পাল্টাতে শুরু করে– সবুজ থেকে লাল-কমলা-বাদামি হতে হতে তারা ঝরে পড়তে শুরু করে। শুরু হয় ‘ফল’।

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি একদিন আবহাওয়ার খবরে জানা যায় যে সে রাতে ফ্রস্ট পড়বে। কোনও কোনও গাছে তখনও ফুল লেগে রয়েছে, তরিতরকারি গাছে কিছু কিছু ফসল তখনও ঝুলে রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি নির্মম। পরেরদিন উঠে দেখব সব গাছের পাতা একেবারে কালো হয়ে গেছে। চোখে জল এসে যায়– মনে মনে বলি, যেতে নাহি দিব। কিন্তু যেতে তো দিতেই হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হবে তুষারপাত। গাছগুলোর কালো কালো মৃতদেহ সাদা তুষারে ঢেকে যাবে। সেই এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত গাছগুলো এইভাবে কয়েক ফুট বরফ আর তুষারের তলায় ঘুমিয়ে থাকবে। আমরাও অপেক্ষায় থাকব, কবে তারা আবার প্রকৃতিদেবীর জাদুকাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠবে নতুন করে।
*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা, তাঁর নিজের বাগানের।
রাহুল রায় পেশায় ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, গবেষক। অসংখ্য গবেষণাপত্রে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি একজন চিত্রশিল্পী, বেহালাবাদক, গায়ক ও লেখক। কলকাতা এবং নিউ জার্সির একাধিক বাংলা পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন।