রঙিন কাগজ-মোড়া মুখে তুমি আজ খুব ব্যস্ত হয়ে আছ। হতে পারে আজ হয়তো তোমার কোনও দুর্লভ আনন্দের দিন। তোমার সঘন পায়ের চাপে, মুক্তোর মতো ঘামে, হাসির দ্যুতিতে বার বার কেঁপে উঠছে এই শূন্যে তৈরি ঘর। জানালায় দাঁড়ালে দেখা যায় নীচে কত লোক-লৌকিকতার আঁকাবাঁকা রেখা। মরচে-ধরে যাওয়া পথঘাট, কোথাও কোনও একটা ব্যর্থ কালভার্ট। আমি জানি না আজ তোমার ঠিক কোন আনন্দের দিনটি। অভ্যাসমতো কবর সরিয়ে উঠে দেখলাম বাইরের সময়াতীত রোদ। অলীক বুলবুলির মতো সে একটি অলীক খেতে নেমেছে। কেন যে আমার মাথার চুল প্রতিদিন রুষ্ট হয়ে কপালে আটকে থাকে! দু’হাতে ওদের আমি সরিয়ে দিলাম। একদলা হাওয়া নিজের পাঁজরে জঠরে টেনে নিতে নিতে বুঝলাম, আজ আমার সব শব্দ অপ্রয়োজনীয়। আজ আমি ঘরেরই কোথাও কোনও কোণে কাঠের সাঁওতাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। হয়তো একটা শিকারের মতো ভঙ্গিতে। আমি তোমাকে এরই মধ্যে দেখেছি মুহূর্তকয়েক। তখনই দেখেছি রঙিন কাগজের ফাঁক চুইয়ে ঘামই হয়তো গড়িয়ে পড়ছে তোমার। স্তনের গোঙানি শুনে মনে হল তাদের শেকড় ছিঁড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে। শাড়ি মনে হল অভিসন্ধি করছে এক লহমায় খসে পড়ার জন্য। আমি জানি এভাবে বেশ প্রতিশোধ নেওয়া যায়

কাঠের মূর্তিতে তো আমাকে যেতেই হবে। হাতে জলখাবারটুকু খাওয়ার জন্য যেটুকু সময়। এই শূন্যে তৈরি ঘর মুহূর্মুহূ দুলছে। কখনও তোমার পায়ের শব্দকে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড কোনও পাথরের চাঙড় ভেঙে পড়ার আওয়াজের মতো। রক্ত-মাংসের মানুষেরই তো কৌতুহল থাকে। আমারও তাই কৌতুহল হচ্ছে জানতে, আজ তোমার কোন দুর্লভ আনন্দের দিনটি। অবশ্য আমি মুখের রেখা অচঞ্চল রেখেছি। রুষ্ট চুলগুলো কোনওদিনই কিছুই বোঝেনি, তারা এখন পশ্চিমে সরীসৃপ হয়ে আছে। ঘরে যে বাড়তি উত্তাপ, তাতে মনে হল আজ লোকজনেরা আমন্ত্রিত হয়ে আসবে। সবারই মুখ রঙিন কাগজে-মোড়া, হাতে হয়তো অলীক শূল! সে-সময় নীচের যে আঁকাবাঁকা লোক-লৌকিকতার জগত, সেখান থেকে তাকালে দেখা যাবে শূন্যের এই ঘর কী এক ভয়-ধরানো আগুনে জ্বলছে। সেই আগুনের কুণ্ড থেকে পোড়া বাক্স, চেয়ার, জামাকাপড় খসে খসে পড়ছে। পোড়া নারকোল মালইয়ের মতো কোন্ সব মানুষের মাথা, হাত-পায়ের টুকরোও পড়ছে। নীচের লোক-লৌকিকতায় যেসব মানুষ তারা হয়তো জটলায় দাঁড়িয়ে এইসব দেখবে। তারপর ঘরে ফিরে আয়োজন করবে এক সরল ঘুমের। ঠিক তখন এই ঘরের কোনও এক কোণায় আমি কাঠের সাঁওতাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শরীরে চকচকে ত্বক, তাতে এক শিকারের ভঙ্গি। সবাই মুগ্ধ হয়ে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে আর তোমাকে ঈর্ষান্বিত গলায় খয়েরি চুলের আড়াল থেকে বলছে ‘কী সুন্দর, আহা, কী সুন্দর!’

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest

জন্ম কোচবিহার জেলায়৷ বড় হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে৷ কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং লেখার হাতেখড়ি৷ স্থানীয় ছোট পত্রপত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ৷ এরপর লেখায় দীর্ঘ সময়ের ছেদ পড়ে৷ আবার গত তিনবছর ধরে লেখায় ফেরা৷ কাব্যগ্রন্থ 'কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল' ২০২০ কলকাতা বইমেলায় 'শুধু বিঘে দুই' থেকে প্রকাশিত৷ মূলত কবিতা লিখতে পছন্দ করেন৷ একটু আধটু গদ্যচর্চাও হয়৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *