আগের পর্ব পড়তে: [] []

শতবর্ষে পা দিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ। বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাঁর লেখায় কোনওদিনই কোনও গ্ল্যামারের ঝলকানি বা রাজনৈতিক উস্কানিমূলক মন্তব্য থাকত না। থাকত এক শান্ত সৌন্দর্য, ধৈর্যবান পর্যবেক্ষণ আর ভারসাম্যময় বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দী ব্যাপী কর্মজীবন নিয়ে তিনি যেন সাংবাদিকতার এক খোলা পাঠ্যপুস্তক। তাঁকে বাংলা সাংবাদিকতার শিক্ষক বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। ১৯৪৫ সালে তাঁর সাংবাদিকতায় যোগদান। তারপর নানাভাবে তা প্রবাহিত থেকেছে গত শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যন্ত। সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদপত্রে। নতুন পথ দেখিয়েছেন ‘ওভারল্যান্ড’ সম্পাদনা করতে এসে। স্পষ্ট, অকম্পিত বাচন বরাবর তাঁর পছন্দ। নিজের কলমেও এর প্রকাশ অবিচল থেকেছে। এর জন্য বহু উঁচু পদ ও নানা সুযোগসুবিধা হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু বদলাননি শংকর ঘোষ। তাঁর বিপুল রচনারাজি পড়লে আজ তাঁকে এক একক ‘ক্রুসেডার’ মনে হয়। যেন সময়-পথের একলা অভিযাত্রী। এক নির্ভীক মেধাবী বাঙালি, এক সত্যদ্রষ্টা বিশ্বজনীন ভারতীয়ের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
যে নিবন্ধ বাংলালাইভ পুনঃপ্রকাশ করতে চলেছে, তার প্রথম প্রকাশকাল ছিল ডিসেম্বর ১৯৬০। তখন ভারতে নেহরু শাসনের স্বর্ণযুগ। আর শংকর ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি। নেহরু পাকিস্তান গিয়েছিলেন সে বছর। সেই সময়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে অন্যতম বাধা ছিল সিন্ধুনদের জলবণ্টন। আয়ুব খান তখন পাকিস্তানের সামরিক প্রধানমন্ত্রী। সিন্ধুর জল-বিরোধ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করতে নেহরুর পাকিস্তান যাত্রা। সবার আশা ছিল সিন্ধুর জল সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা হলে অন্য দুটি বিরোধ, কাশ্মীর এবং পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করাও সহজ হবে। দু’দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষই চেয়েছিলেন ভারত-পাকিস্তান মৈত্রী।
দেশের সব কটি বড় কাগজ থেকে নেহরুর সঙ্গে পাকিস্তানে সাংবাদিক পাঠানো হয়েছিল। নেহরুর জন্য পাকিস্তানে যে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হয়েছিল তা দেখে ভারতীয় সংবাদিকরা প্রায় সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা লিখলেন, পাকিস্তানের আমজনতা নেহরুকে দেখে উদ্বেলিত, তাঁরা নেহরুকে একবার চোখের দেখবার জন্য কড়া রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। গলদঘর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন কিন্তু এতটুকু ধৈর্য হারাননি। শংকর ঘোষের কিন্তু তা মনে হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল, রাস্তার দু’পাশে যেমন বেশকিছু জায়গায় লোক জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, তেমনি অনেক জায়গায় রাস্তার দুপাশ খালি ছিল, নেহরুকে দেখার জন্য ভিড় ছিল না কোনও দর্শনার্থীর। পাকিস্তান সরকারের অভ্যর্থনায় কোনও আন্তরিকতা ছিল না, ছিল না কোনও উষ্ণতার প্রকাশ। শংকর ঘোষ লিখলেন, সরকারি অনুশাসন মেনে একজন বিদেশি প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনার জন্য যেটুকু করা প্রয়োজন, পাকিস্তান সরকার ঠিক সেটুকুই করেছে, তার বেশি কিছু করেনি। প্রশাসনিক সব ব্যাপারে সামরিক শাসনের সুস্পষ্ট ছাপ। নেহরুর আপ্যায়নে কোথাও সাধারণ মানুষের অন্তরের যোগ নেই।
পাকিস্তানে ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেল থেকেই টেলিগ্রাফ মারফত ভারতে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই খবর দেশের কাগজে বেরনোর আগেই একজন সরকারী কর্মী শংকর ঘোষকে জানালেন যে নেহরুর সঙ্গে যেসব ভারতীয় সাংবাদিক এসেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সকলেই নেহরুর প্রতি পাকিস্তানের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়েছেন, তাঁদের রিপোর্টেও সে কথা তাঁরা লিখেছেন, কেবল একজন ছাড়া। তিনি লিখেছেন, শুধু প্রোটোকল মেনে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে, তার বেশি কিছু হয়নি। শংকরের বুঝতে বাকি থাকল না যে ব্যতিক্রমী সাংবাদিকটি যে তিনি, সেকথা বুঝতে ওঁদের বাকি নেই। এই রিপোর্টি যে সংশ্লিষ্ট দফতরের চোখ এড়িয়ে যায়নি, সেটাও জানিয়ে গেলেন। নেহরু সফরের পরবর্তী ধাপে শংকর ঘোষকে অন্য সাংবাদিকদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হল। ওঁর স্থান হল হোটেলের আউটহাউসে।
পাকিস্তানে যা দেখেছিলেন, দেশে ফেরার পরে শংকর তাঁর তৎকালীন কর্মস্থল আনন্দবাজার পত্রিকায় সে বিষয়ে লিখেছিলেন। ওঁর ধারণা হয়েছিল, ওদেশের সর্বত্র একটি নির্মাণকার্য চলেছে, জেনারেল আয়ুবের ভাবমূর্তি নির্মাণ। পাকিস্তান সরকার তাতে আরও চটেছিল এবং পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে যে সব সরকারি খবর ও বিজ্ঞপ্তি তিনি নিয়মিত পেতেন, তা আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শংকর নিজের মতামত থেকে একচুল সরেননি। চিরদিন নিজের কাছে যা সত্য বলে মনে হয়েছে, তাই রিপোর্ট করেছেন। তার জন্য কাগজের মালিক বা কোনও সরকারের বিরাগভাজন হলেও তার পরোয়া করেননি। পাকিস্তানের ওপরে লেখা তাঁর এই নিবন্ধমালা প্রমাণ করে সাংবাদিক হিসাবে শংকর ঘোষ কতখানি নির্ভীক ও নিরপেক্ষ ছিলেন।

তাঁর স্ত্রী ও সুলেখক শ্রীমতী আলপনা ঘোষের বদান্যতা ও প্রশ্রয়ে এই দুষ্প্রাপ্য লেখাদুটি পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। উপরের ভূমিকাটিও তাঁরই লেখা। শ্রীমতী ঘোষকে বাংলালাইভের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। 

কাশ্মীর সমস্যা পাক-ভারত সম্পর্কের প্রধান নিয়ামক

 

নেহরুজীর পাকিস্তান সফরের খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সরকারি-বেসরকারি দুই মহলই ধরে নিয়েছিলেন, নেহরু-আয়ূব আলোচনা শুধু কাশ্মীর সমস্যাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাঁদের মতে, আলোচনার সাফল্য যাচাইয়ের কষ্টিপাথর কাশ্মীর সমস্যার সমাধান। বস্তুত নেহরুজীর সফর উপলক্ষে পাকিস্তানে সপ্তাহব্যাপী যে জল্পনা হয়েছে, তা কেবল কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে, যেন কাশ্মীর ছাড়া দুই দেশের মধ্যে আলোচনা করার মতো অন্য সমস্যা নেই। পাকিস্তান সরকারও চেয়েছিলেন শুধু কাশ্মীর সম্বন্ধে আলোচনা করতে। নেহরুজীর তাতে আপত্তি ছিল। তিনি যে করাচী যাত্রার আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, আয়ূব খানের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের সকল সমস্যারই আলোচনা করবেন, তা এক ধরনের অগ্রিম নোটিশ। এই দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য স্থির হল, আলোচনার কোনও নির্দিষ্ট বিষয়সূচী থাকবে না, অর্থাৎ ইচ্ছামত যে কোন বিষয়ের অবতারণা চলবে। অবশ্য তাতে মূল বিরোধের কোনও মীমাংসা হল না— কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি হবে না অথবা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি না হলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান অসম্ভব, তা অমীমাংসিতই থেকে গেল। 

পাঁচদিনের আলোচনার পরও এ-প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয়নিআলোচনায় যে কাশ্মীর ছাড়া অন্য সমস্যাও উত্থাপিত হয়েছিল, পাকিস্তানের অনেকেই তা ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁদের ধারণা, এতে পাকিস্তানের হার হয়েছে; একজন তো মন্তব্য করলেন এ ‘সারেনডার’ ছাড়া আর কিছু নয়। নেহরুজীর প্লেন লাহোরের মাটি ছাড়া সঙ্গে সঙ্গেই আয়ূব খান স্বয়ং বললেন, আলোচনার শুরু ভালই হয়েছে, তবে যতদিন কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হচ্ছে, ততদিন অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে অবস্থার যে-উন্নতিই হোক না কেন, সব যে কোনও মুহূর্তে পণ্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। লাহোরে নেহরুজীর সাংবাদিক সম্মেলনে এক পাকিস্তানী সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তিনি কি স্বীকার করেন না যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব নয়। সাংবাদিক ভদ্রলোক সারা পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই প্রশ্নটি করেছিলেন; পাকিস্তানে সকলেরই ধারণা কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের আগে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতির কথা বলা ঘোড়ার সামনে গাড়ি জোতার সামিল।

নেহরুজী অবশ্য সে-কথা মানেন না, মানলে তিনি পাকিস্তানে যেতেন কি না সন্দেহ। কাশ্মীর সমস্যার কোনও সমাধানই যে এই আলোচনায় বা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যদি আয়ূব খান এদেশে আসেন, তাহলে সে-আলোচনাতেও সম্ভব নয়, সে বিষয় নেহরুজী এবং ভারত সরকার নিঃসংশয়। বস্তুত সে-কথা নেহরুজী একরকম ঘোষণাই করেছেন। লাহোরের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি যে বলেন, ১৯৬২ সালে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে কাশ্মীরেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার নানা সম্ভাব্য তাৎপর্যের মধ্যে একটি সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই— আগামী দেড় বৎসরের মধ্যে তিনি কাশ্মীর সম্পর্কে এমন কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বা আলোচনা চালাতে চান না, যাতে কাশ্মীরের বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়। নেহরুজীর উক্তি কাশ্মীর আলোচনার উপর ‘মরাটরিয়্যাম’ জারি ছাড়া আর কিছু নয়; তার অর্থ আপাতত কাশ্মীর আলোচনা মুলতবী থাকবে। 

বলা বাহুল্য, কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে যে নেহরুজী বা ভারত সরকারের অনিচ্ছা তা নয়। তাঁদের অসুবিধা আয়ূব খান যে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর ভিত্তিতে সমাধানের কথা বলেছেন, তাতে সম্মত হতে। আয়ূবী অভিধান হিসাবে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পারস্পরিক দেওয়া নেওয়া নয়, একতরফা দেওয়া ও একতরফা নেওয়া। আয়ূবী ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর মানে ভারত দেবে, পাকিস্তান নেবে। যা সোজা ভাষায় না বলে আয়ূব খান ঘুরিয়ে বলেছেন তা হল, কাশ্মীর ভাগ করা হোক। অবশ্য সে-ভাগ বর্তমান ‘সীজ-ফায়ার লাইন’-এর ভিত্তিতেই হবে, অথবা জ্ম্মু ও কাশ্মীরের পনেরো আনাই পাকিস্তানকে দিতে হবে, তা তিনি স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি। হয়ত তিনি মনে করেছিলেন সেইটেই হবে নেহরুজীর সঙ্গে তাঁর আলোচনার প্রধান বিষয়।

Nehru and Ayub Khan
নেহরুর সফর উপলক্ষে পাকিস্তানে সপ্তাহব্যাপী জল্পনা চলেছিল

আয়ূব খানের এবং পাকিস্তান সরকারের এইখানেই ভুল হয়েছিল। নেহরুজী আগে একবার যুদ্ধবিরতি রেখার ভিত্তিতে কাশ্মীর বিভাগের প্রস্তাব করেছিলেন বটে, কিন্তু তারপর অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আজ ভারতভূমি শুধু পাকিস্তানের নয়, চীনেরও জবরদখলে। পাকিস্তান সম্পর্কে কোনও নীতি গ্রহণের সময় ভারত সরকারকে আজ চীনের কথাও বিবেচনা করতে হবে। কাগজে বেরিয়েছে যে, নেহরু-আয়ূব আলোচনার ফলাফল জানবার জন্য করাচিতে চীনা কূটনীতিকরা অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে পড়েছিলেন। এই ব্যগ্রতা নিশ্চয়ই নেহরুজী যুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সম্মত হলেন কি না, তা জানবার জন্য নয়। চীনা সরকার বেশ জানেন নেহরুজী তাতে রাজি হবেন না, হলেও তাতে চীনা সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ ঘটবে, তা মনে হয় না। তাঁরা জানতে চাইছিলেন, যুদ্ধবিরতি রেখার ভিত্তিতে কাশ্মীর বিভাগের কোনও প্রস্তাব নেহরু-আয়ূব আলোচনায় উত্থাপিত হয়েছে কিনা এবং সে সম্পর্কে নেহরুজীর মত কী। 

কোনও সন্দেহ নেই, আলোচনায় যদি কাশ্মীর বিভাগের প্রশ্ন উঠত এবং নেহরুজী যুদ্ধবিরতি রেখাকে কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তানের স্থায়ী সীমানা বলে মেনে নিতেন, কাশ্মীরে পাকিস্তানি জবরদখলকে আইনসিদ্ধ করতে উদ্যত হতেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পিকিং থেকে রব উঠত, লাদাকে চীনা জবরদখলও ভারত সরকার মেনে নিন। চীনা প্রধানমন্ত্রী ভারতে এসে সেই প্রস্তাবই করেছিলেন। বলেছিলেন, লাদাকের চীনা অধিকৃত এলাকায় চীনের স্বত্ব ভারত সরকার যদি স্বীকার করেন, তাহলে ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণে যেসব এলাকা চীনা সরকার দাবি করেছেন সে-দাবি তাঁরা তুলে নেবেন, ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ তাঁরা মিটিয়ে ফেলবেন। নেহরু-আয়ূব আলোচনায় চীনের আগ্রহের অন্য কোনও কারণ নেই।

Nehru signing Sindh Water Treaty
সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি সই করছেন নেহরু।

নেহরুজী যে আপাতত কাশ্মীর বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা স্থগিত রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, তার কারণ ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে কাশ্মীর বিভাগের প্রশ্ন বিবেচনা করা সম্ভব নয়। অন্য কোনও ভিত্তিতে যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে, তা চিন্তা করাও অযৌক্তিক। পাকিস্তানের ধারণা, আয়ূব খান যে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর প্রস্তাব করেছেন, তাই চরম উদারতার পরিচায়ক। এই প্রস্তাবেই পাকিস্তানের জনসাধারণকে সম্মত করাতে নাকি সেখানকার জঙ্গি সরকারকে বিশেষ বেগ পেতে হবে। একথাও শোনা গেছে যে, জঙ্গি সরকার হলেও জনসাধারণের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার ক্ষমতা তাঁদের নেই, জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা মনে রেখেই তাঁদের সরকারি নীতি নির্ধারণ করতে হয়। এ অবস্থায় নেহরু-আয়ূব আলোচনা শুধু কাশ্মীর সমস্যায় সীমাবদ্ধ রাখলে আলোচনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হত। পাঁচদিন ধরে আলোচনার মতো বিষয়ও তাঁদের থাকত না।

নেহরু-আয়ূব বৈঠকের ফলে ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কিত আরও আলোচনার যে পথ উন্মুক্ত হয়েছে, তাও সম্ভব হত না। কাজেই বর্তমান অবস্থায় যতটুকু সম্ভব, আলোচনাকে ততটুকু সফল করার জন্যই নেহরুজী কাশ্মীর ছাড়া অন্য বিষয়ও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি আলোচনার সাফল্য চেয়েছিলেন বলেই তাঁর এই পাল্টা প্রস্তাব। প্রকারান্তরে নেহরুজীর প্রস্তাব মেনে নিলেও অন্যান্য বিষয়ের আলোচনায় পাকিস্তান সরকার বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। স্থাবর উদ্বাস্তু সম্পত্তি সমস্যার সঙ্গে দুই দেশের কয়েক কোটি লোকের স্বার্থ জড়িত। নেহরুজী স্বয়ং এই বিষয়টির উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। লক্ষ্য করবার বিষয় যে, যদিও সমস্যাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— নেহরুজী একবার এটিকে কাশ্মীর ও খালের জল সমস্যার সমগোত্র আখ্যা দিয়েছিলেন— নেহরুজী-আয়ূব আলোচনা সম্পর্কিত যুক্ত ইস্তাহারে এর কোনও উল্লেখ নেই। অর্থাৎ প্রসঙ্গের অবতারণাই হয়েছিল, আলোচনা বা কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। অবশ্য এই সমস্যাটি সম্পর্কে আলোচনায় পাকিস্তানের আপত্তির একটি বড় কারণ আছে। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে পাকিস্তানের ভারতকে একটি মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। ভারতীয় হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ তিনশ কোটি টাকা। পাকিস্তানের এই টাকা দেওয়ার ইচ্ছা নেই বলেই সমস্যাটির আলোচনায় তাঁদের এত অনাগ্রহ। 

Nehru and Khan
পাকিস্তান সরকার মুখে যাই বলুন না কেন, আলোচনার সময় তাঁরা ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর কথা মনে রাখেননি

অথচ ভারতকে সুই গ্যাস বিক্রয়ের প্রস্তাব পাকিস্তান সরকার সাগ্রহে আলোচনা করেছিলেন। এই গ্যাস কাজে লাগানোর মতো যথেষ্ট শিল্প পাকিস্তানে নেই, ক্রেতারও অভাব। তাই ভারতকে এই গ্যাস সরবরাহ করায় তাঁদের এত উৎসাহ। অবশ্য শেষ পর্যন্ত যে প্রস্তাব হয়েছে, তাতে তাঁদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। ভারত সরকার বলেছেন, এর পরিবর্তে পাকিস্তানকে ভারতীয় শিল্পজাত দ্রব্য কিনতে হবে। এই সম্পর্কে আরও একটি ভাববার বিষয় এই যে, এই গ্যাস ক্রয় করার অর্থ, ভারতের কিছু শিল্পকে সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তান-নির্ভর করা। এটি সুবিবেচনার কাজ হবে কিনা সন্দেহ; তাছাড়া ভারতে সম্প্রতি যে নূতন কয়লাখনি আবিষ্কার হয়েছে, তারপর এরকম ব্যবস্থার বিশেষ প্রয়োজনও নেই। 

পাকিস্তান সরকার মুখে যাই বলুন না কেন, আলোচনার সময় তাঁরা ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর কথা মনে রাখেননি। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর অজুহাতে নেহরুজীকে কাশ্মীর বিভাগে রাজি করানো। মনে রাখতে হবে যে, কাশ্মীর বিভাগে এককালে নেহরুজী সম্মত থাকলেও নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর সম্পর্কে শেষ বিতর্কে ভারত সরকারের মুখপাত্র হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ মেনন ঘোষণা করেছিলেন যে, ভারত সরকার এ পর্যন্ত যা কিছু আপস প্রস্তাব করেছেন সবই বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং নূতন করে নেহরুজীকে এই প্রস্তাবে সম্মত করানোর প্রয়োজন ছিল। সে উদ্দেশ্য যখন সফল হল না, তখন পাকিস্তান সরকার কেবল তাঁদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের অনুকূল বিষয়গুলির আলোচনাতেই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ফলে পাঁচদিনের আলোচনায় কোন সমস্যারই সমাধান হয়নি। যুক্ত ইস্তাহারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে যেসব আলোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সাফল্যও পাকিস্তানের মনোভাবের উপর নির্ভর করবে। যতদিন পাকিস্তান সরকার কাজে প্রমাণ না দিচ্ছেন যে তাঁরা দুই দেশের মৈত্রী চান, ততদিন সর্বস্তরের আলোচনাই ব্যর্থ হবে। পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বক্তৃতায় নেহরুজী যে বারবার— ‘খোলা মন’ এবং ‘হৃদয় পরিবর্তনের’ প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন, তা নিতান্তই তাৎপর্যহীন শব্দবিন্যাস নয়। ভারত-পাকিস্তান মৈত্রী তিনি চান বলেই পাকিস্তানের প্রতি তাঁর এই অনুরোধ ও সতর্কবাণী।

 

*মূল বানান অপরিবর্তিত
*ছবি সৌজন্য: Frontline, Flickr

banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *