– বাচ্চাটার আঠারো ঘন্টার বেশি জ্বর হয়ে গেল। আপনি অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছেন? বেশ ঝাঁঝের সাথেই কথাটা বললেন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক।

এসব চিৎকার-চেঁচামেচি, বিরক্তি প্রকাশ কিংবা গালাগালি বেশ গা সওয়া হয়ে গেছে ডাক্তারবাবুর। বয়স বাড়ছে। এখন আর কথায় কথায় রাগ হয় না। মুচকি হাসিটা মাস্কের তলায় ঢেকে গেল কিন্তু উত্তরের মধ্যে বিদ্রূপের আভাস বেশ স্পষ্ট

– আঠারো ঘন্টা জ্বর পেরিয়ে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়, এমন লেখা কোনও বইতে পড়েছি বলে মনে করতে পারছি না। তাছাড়া আমি যেটুকু জানি, জ্বর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবজনিত লক্ষণ নয়।

– জ্বর কমছে না আর আপনি মস্করা করছেন?

– দেখি, জ্বরের চার্ট বানিয়েছেন?

– জ্বরের চার্ট? সে আবার কী?

– জ্বর মেপেছিলেন?

– অত মাপি-টাপি নি। হাত দিয়েই দিব্যি গরম মনে হচ্ছে।

– আপনার মনে হওয়াটাই সব নয়। থার্মোমিটারে জ্বর মাপতে হবে। জ্বর মেপে দরকার মতো বারবার জ্বরের ওষুধ খাওয়াতে হবে।

– গায়ে কেমন গরম দেখুন… আর আপনি বলছেন জ্বর নেই?

– নেই বলিনি তো… জ্বর আছে কিনা সেটা মাপতে বলেছি।

থার্মোমিটার এনে জ্বর মাপতে দেখা গেল সেটা একশোর থেকে বেশ খানিকটা নীচে। প্রেসক্রিপশন প্যাড থেকে চোখ তুলে ভদ্রলোকের দিকে সোজাসুজি তাকালেন ডাক্তার।

– নিজের হাতের ওপর এতখানি বিশ্বাস না রাখলেই পারতেন। তাছাড়া জ্বর এলেই লাফিয়ে উঠে সেটা কমিয়ে ফেলতে হবে এরকম মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। জ্বর কোনও রোগ নয়। জ্বর হ’লে বোঝা যায়, শরীরে কোথাও একটা যুদ্ধ বেঁধেছে। এটুকুই। শুধু জ্বর কমানো মানে রোগ সারানো নয়। প্রেসক্রিপশনে যা যা লেখা আছে সেগুলো মেনে চলুন। এই মুহূর্তে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার দরকার নেই। কাল আবার দেখিয়ে যাবেন।

কী ভাবছেন? সম্পূর্ণ কাল্পনিক কথোপকথন? নাঃ! রীতিমতো রোজনামচা কথাবার্তা। আজকাল অবশ্য প্রতি মুহূর্তে খাঁড়ার ভয়ে ডাক্তারকে অনেক সময়ই ফরমায়েশি চিকিৎসা করতে হয়। একবার শিশু-চিকিৎসার জগতে দিকপাল একজন চিকিৎসক এবং আমাদের মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “তুইও জানিস, আমিও জানি এক্ষুনি অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই কিন্তু এরপর যদি বাড়ি গিয়ে বাচ্চার মাথায় তাল পড়ে তাহলেও বাড়ির লোক এসে ঝামেলা করবে- ডাক্তারের গাফিলতির জন্যই মাথায় তাল পড়েছে!” পরিস্থিতি সত্যিই ঘোরালো। স্বাভাবিকভাবেই, ডাক্তারের নিজস্ব বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বাড়ির লোককে খুশি করে নিজের পিঠ বাঁচানোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে কার লাভ হচ্ছে কে জানে…

যাক সে সব কথা। লেখা শুরুর আগে খানিক ধরতাই না হ’লে জমে না। ডাক্তারিতে যেসব যন্ত্রপাতি প্রতিনিয়ত ব্যবহার হয় থার্মোমিটার তাদের মধ্যে অন্যতম। আজকের লেখায় থার্মোমিটার ব্যবহারের ইতিহাস জেনে নেব।

থার্মোমিটারের আধুনিক রূপ হালের কথা কিন্তু থার্মোমিটার ব্যবহারের মূলনীতি বহুদিন ধরেই প্রচলিত। হেরন বা হিরো অফ আলেক্সান্দ্রিয়া (১০-৭০ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রিসের বিখ্যাত গণিতবিদ ও স্থপতি ছিলেন। তাপের পরিবর্তনে বাতাসের সংকোচন-প্রসারণের ঘটনা তিনি লিপিবদ্ধ করেন। তাপে বাতাস প্রসারিত হ’লে নলের মধ্যে বাতাস ও জলের সংযোগস্থল সরে যায়। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই যাবতীয় থার্মোমিটার তৈরি হয়েছে। পরবর্তী ধাপে ইতালীয় চিকিৎসক সান্তোরিও সান্তোরিও এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির নাম আসে। তাঁরা দুজনেই কাছাকাছি সময়ে আলাদাভাবে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র তৈরি করেন। তরল হিসেবে জলের বদলে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়। তারপর সতেরো ও আঠারো শতক জুড়ে বিভিন্নভাবে এই যন্ত্রের মানোন্নয়ন করা হয়। তখন এর নাম ছিল থার্মোস্কোপ। ১৬২৪ সালে ‘থার্মোমিটার’ নাম দিলেন ফ্রান্সের জে. লুরেশোঁ। গ্রিক শব্দ ‘থার্মোস’ মানে ‘গরম’, ‘মেট্রন’ মানে ‘পরিমাপ’।

THERMOMETER
১৬২৪ সালে ‘থার্মোমিটার’ নাম দিলেন ফ্রান্সের জে. লুরেশোঁ।

ক্রমোন্নতির সরণীতে পরবর্তী নাম ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট। ‘ফারেনহাইট’ নামটি ছোটবেলা থেকেই সবার চেনা। ১৭০৯ সালে ভদ্রলোক দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। কাঁচের নলে পারদ ব্যবহার করে তাপমাত্রা নির্নয়ের পদ্ধতির প্রচলন করলেন। সেইসাথে প্রথম তাপমাত্রা মাপার স্কেল তৈরি করলেন। জলের বরফ হওয়ার তাপমাত্রাকে ৩২ এবং ফুটে বাষ্প হওয়ার তাপমাত্রাকে ২১২ হিসেবে ধরা হ’ল। মাঝে ১৮০ ঘরের ব্যবধান। ১৮০ ঘরে ভাগ করে গাণিতিক হিসেব বেশ অসুবিধেজনক। বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস ০ থেকে ১০০ ঘরে ভাগ করা তাপমাত্রা মাপার স্কেল তৈরি করলেন। তাঁদের নামেই বহুল প্রচলিত ফারেনহাইট এবং সেলসিয়াস স্কেল। পরে পরম শূন্যকে (-২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নিম্নাঙ্ক ধরে কেলভিন স্কেল তৈরি করা হয়। এসব যন্ত্র দিয়ে তখন মূলত পরিবেশের তাপমাত্রা পরিমাপ করা হ’ত।

থার্মোমিটারের আধুনিক রূপ হালের কথা কিন্তু থার্মোমিটার ব্যবহারের মূলনীতি বহুদিন ধরেই প্রচলিত। হেরন বা হিরো অফ আলেক্সান্দ্রিয়া (১০-৭০ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রিসের বিখ্যাত গণিতবিদ ও স্থপতি ছিলেন। তাপের পরিবর্তনে বাতাসের সংকোচন-প্রসারণের ঘটনা তিনি লিপিবদ্ধ করেন। তাপে বাতাস প্রসারিত হ’লে নলের মধ্যে বাতাস ও জলের সংযোগস্থল সরে যায়। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই যাবতীয় থার্মোমিটার তৈরি হয়েছে। 

বিজ্ঞানের যে কোনও আবিষ্কার পরীক্ষাগার থেকে মানুষের প্রয়োজনে আসতে অনেকটা সময় লেগে যায়। চিকিৎসকরা বুঝতে পারলেন এই যন্ত্র দিয়ে মানুষের দেহের তাপমাত্রাও নির্নয় করা যাবে। জ্বর হ’লে বা শরীর অত্যন্ত ঠান্ডা হয়ে গেলে থার্মোমিটারের সাহায্যে নিখুঁতভাবে সেটা মাপা যাবে। নইলে এতদিন শুধুই আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছিল। তাতে ভুলও হচ্ছিল স্বাভাবিকভাবেই। ১৮৪৮ সালে ডা. হারম্যান বোরহেভ প্রথমবার চিকিৎসার দুনিয়ায় থার্মোমিটারের প্রচলন করেন। ১৮৬৭ সালে স্যার থমাস অ্যালবার্ট ছ’ইঞ্চি লম্বা বিশেষ ধরনের থার্মোমিটারের প্রচলন করেন। আগে তাপমাত্রা পরিমাপ করতে অন্তত মিনিট কুড়ি সময় লাগত। এখন সেটা পাঁচ মিনিটেই মাপা গেল। ডা. ফ্রান্সিসকো পম্পেই কপালের পাশের দিকে টেম্পোরাল ধমনীর তাপমাত্রা পরিমাপ শুরু করেন। তারপর মূল কাঠামো এক রেখে অনেকবার অল্পবিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। পারদ ব্যবহারে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে ডিজিটাল থার্মোমিটার তৈরি হ’ল। তাপমাত্রা বাড়লে বৈদ্যুতিক রোধ কমে যায়, তাপমাত্রা কমলে রোধ বাড়ে। এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ডিজিটাল থার্মোমিটারের সেন্সর তাপমাত্রা নির্ণয় করে। করোনাকালে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এতে সরাসরি শরীরের সংযোগ প্রয়োজন হয় না। দূর থেকে তাপমাত্রার বিকিরণ পরিমাপ করা হয়। এভাবেই তাপমাত্রা পরিমাপ ক্রমশ সহজ হয়েছে। যদিও বরাবরেই মতোই এ আবিষ্কারের পেছনেও আছে একটা দীর্ঘ ইতিহাস। মেধা, অনুসন্ধিৎসা আর সময়ের নিরন্তর বোঝাপড়া।

The Doctor’s Dialogue ওয়েব পত্রিকা থেকে পুনর্মূদ্রিত। 

ছবি সৌজন্য: Pixabay ও গুগল।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *